×

মুক্তচিন্তা

বিশ্বব্যাংকের প্রতিবেদন : খেলাপি ঋণ বিনিয়োগে অশনিসংকেত

Icon

অনলাইন ডেস্ক

প্রকাশ: ২৬ মে ২০২৩, ১২:৫৮ এএম

বিশ্বব্যাংকের প্রতিবেদন : খেলাপি ঋণ বিনিয়োগে অশনিসংকেত

বিশ্বজুড়ে অর্থনৈতিক সংকটের প্রভাব ব্যাপকভাবে পড়েছে দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোতে। এই সংকট বাড়ছে ব্যাংক খাতেও। সম্প্রতি প্রকাশিত বিশ্বব্যাংকের আঞ্চলিক প্রতিবেদনে বলা হয়, দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোর মধ্যে খেলাপি ঋণের হারে শীর্ষে রয়েছে শ্রীলঙ্কা, যা মোট ঋণের ১০.৯ শতাংশ। এর পরের অবস্থানে রয়েছে বাংলাদেশ, যার পরিমাণ মোট ঋণের ৯.৪ শতাংশ। প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, উচ্চ আমদানি ব্যয়, নিয়মিত ঋণ পরিশোধ না করা, নিয়ন্ত্রণ সংস্থ’ার দুর্বল ঋণ তদারকি ইত্যাদির কারণে দেশে খেলাপি ঋণ বাড়ছে। বাংলাদেশ ব্যাংকের হিসাব মতে, ২০২২ সালের ডিসেম্বর মাসে ব্যাংক খাতে খেলাপি ঋণ দাঁড়িয়েছে ১ লাখ ২০ হাজার ৬৫৭ কোটি টাকা, যা বিতরণকৃত ঋণের ৮.১৬ শতাংশ। এর ১ বছর আগে একই সময়ে এই হার ছিল ৭.৯৩ শতাংশ খেলাপি ঋণের, সেই হিসাবে ১ বছরে ব্যাংক খাতে খেলাপি ঋণ বেড়েছে ১৭ হাজার ৩৮৩ কোটি টাকা, যা গেল খেলাপি ঋণের হিসাব, তার সঙ্গে যদি পুনঃতফসিল ও পুনর্গঠন করা ঋণ, আদালতের স্থগিতাদেশের কারণে খেলাপি ঋণ দেখানো যাচ্ছে না এমন ঋণ ও বিশেষ নির্দেশিত হিসাবের ঋণকে খেলাপি হিসেবে দেখানোর পক্ষে অস্বাভাবিকভাবে বেড়ে না যায়, সে জন্য গত ডিসেম্বরে কেন্দ্রীয় ব্যাংক নোটিস জারি করে বিশেষ ছাড় দেয়। বিশ্বব্যাংকের প্রতিবেদন অনুযায়ী, ব্যাংক খাতে আমানত ও ঋণ নিয়ে ২০২২ সালের শেষ প্রান্তিকে বেসরকারি খাতে ঋণ প্রবৃদ্ধি আগের প্রান্তিকের মতোই ছিল, তবে এই সময়ের প্রবৃদ্ধি আগের বছরের একই সময়ের ছেয়ে বেশি। সময়ের আবর্তে বাংলাদেশের অর্থমন্ত্রীরা সংসদে ঋণ নিয়ে কথা বললেও বিগত ২০০৯ সালের পর থেকে টানা ১০ বছর বাজেটে খেলাপি ঋণ নিয়ে কেউই কথা বলেননি যদিও বর্তমান অর্থমন্ত্রী ২০১৯ সালে ক্ষমতা গ্রহণের পরপর বলেছিলেন, কাল থেকে কোনো প্রকার খেলাপি ঋণ আর থাকবে না। অথচ বিগত ৯টি বছরে এই খেলাপি ঋণ ২২ হাজার কোটি টাকা থেকে বেড়ে এখন দাঁড়িয়েছে ১ লাখ ২০ হাজার কোটি টাকার ওপরে। তারপর ২০১৯-২০২০ অর্থবছরের বাজেট বক্তৃতায় অর্থমন্ত্রী খেলাপি ঋণের প্রসঙ্গটি নিয়ে আসেন এবং ভালো ঋণ সংস্কৃতি গড়ার লক্ষ্যে তাদের জন্য অনেক সুযোগ-সুবিধার কথা বলেছিলেন। অর্থমন্ত্রী ব্যাংকিং কমিশন গঠনের কথাও বলেছিলেন, যার বাস্তবায়ন এখন পর্যন্ত দেখা যায়নি। ক্রমাগত খেলাপি ঋণ বৃদ্ধির কারণে গত মহান জাতীয় সংসদে জনৈক সংসদ সদস্য কর্তৃক প্রশ্ন উত্থাপিত হলে অর্থমন্ত্রী তার উত্তরে বলেছিলেন, ঋণখেলাপি হওয়ার কারণ পাঁচটি। এক. দেশীয় ও আন্তর্জাতিক অঙ্গনে নিয়মবহির্ভূত অনেক কিছু হয়েছে; দুই. ব্যাংক কর্তৃপক্ষ যথাযথভাবে ঋণ গ্রহীতা নির্বাচনে ব্যর্থ হয়েছে; তিন. ঋণের বিপরীতে রাখা পর্যাপ্ত জামানত, একই সম্পদ একাধিক ব্যাংকে জামানত রাখা ও জামানত বাজার মূল্যের ছেয়ে বেশি দেখানো; চার. গ্রাহকের সব দলিল সংগ্রহ ও সঠিক যাচাই না করা; পাঁচ. ঋণ গ্রহীতার তহবিল ঋণ খাতে প্রবাহিত করা, প্রয়োজন ও সামর্থ্যরে বিচার না করে অতিরিক্ত ঋণ প্রদান, সময় সময় ঋণসীমা বাড়ানো, ঋণ তফসিলকরণ ও পুনঃগঠন সুবিধা দেয়া ইত্যাদি। অর্থমন্ত্রী আরো বলেছেন, ঋণখেলাপি হলে আদায় ও বিতরণ ক্ষতিগ্রস্ত হয়, যা সামষ্টিক অর্থনীতির বিবেচনায় জাতীয় আয়ে (জিডিপি) এর নেতিবাচক প্রভাব ফেলে। তবে রাজনৈতিক পৃষ্ঠপোষকতায় ঋণ দেয়ার সংস্কৃতি যে ঋণখেলাপির অন্যতম কারণ, তা মন্ত্রী মহোদয় উল্লেখ করলে তার উল্লেখিত কারণগুলো সম্পূর্ণ হতো। এখন আসা যাক খেলাপি ঋণের সংখ্যাতাত্ত্বি¡ক বিশ্লেষণ নিয়ে যা বিভিন্ন সংস্থার মধ্যে গড়মিল রয়েছে। বিশ্বব্যাংক সম্প্রতি বলেছে, দক্ষিণ এশিয়ায় খেলাপি ঋণের হার সবচেয়ে বেশি, যা বাংলাদেশে (৯.৪ শতাংশ) তাদের প্রকাশিত গেøাবাল ইকোনমিক প্রসপেকস্টাস শীর্ষক প্রতিবেদনে উল্লেখিত হয়েছে। এরপর রয়েছে ভুটান (১০.৯ শতাংশ), আফগানিস্তান (১০.৮ শতাংশ), ভারত (৮.৯ শতাংশ), পাকিস্তান (৮.২ শতাংশ) এবং শ্রীলঙ্কা (১০.৯ শতাংশ)। খেলাপি ঋণ বাড়লে নানা সমস্যা দেখা দেয়। যেমন তারল্য সংকট যা বিনিয়োগকে বাধাগ্রস্ত করে এবং ব্যাংকের মুনাফা কমিয়ে দেয়, যার প্রভাব পড়ে কর্মকর্তাদের আর্থিক সুবিধা প্রদানের ক্ষেত্রে। আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের (আইএমএফ) একটি প্রতিবেদনের বরাত দিয়ে টিআইবি বলছে, ২০১৯ সালের জুন পর্যন্ত খেলাপি ঋণের প্রকৃত পরিমাণ ছিল ২ লাখ ৪০ হাজার ১৬৭ কোটি টাকা; এর সঙ্গে অবলোপনকৃত খেলাপি ঋণ ৫৪ হাজার ৪৬৩ কোটি টাকা যোগ করলে খেলাপি ঋণের পরিমাণ প্রায় ৩ লাখ কোটি টাকা, বর্তমানে সে অঙ্কটা আরো বেশি। বিভিন্ন সময়ে খেলাপি ঋণ হ্রাস এবং ইচ্ছাকৃত ঋণখেলাপিদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণের কথা বলা হলেও তা কার্যকর না করে বারবার ঋণ পুনঃতফসিলীকরণ ও পুনর্গঠন করা হয়েছে। সম্প্রতি টিআইবি পরিচালিত ‘ব্যাংকিং খাত তদারকি ও খেলাপি ঋণ নিয়ন্ত্রণ : বাংলাদেশ ব্যাংকের সুশাসনের চ্যালেঞ্জ ও উত্তরণের উপায়’ শীর্ষক গবেষণা প্রতিবেদন প্রকাশ করা হয়, যাতে গত কয়েক বছরে খেলাপি ঋণের ক্রমবর্ধমান ধারা বিশ্লেষণের পাশাপাশি খেলাপি ঋণ তদারকিতে থাকা বাংলাদেশ ব্যাংকের নীতিকাঠামোর নানা দিক তুলে ধরা হয়। তাদের মতে, খেলাপি ঋণ হ্রাসে যথাযথ পদক্ষেপ না নেয়ায় এবং ইচ্ছাকৃত ঋণখেলাপিদের আইনের আওতায় না আনায় দিন দিন ব্যাংক খাতে খেলাপি ঋণের পরিমাণ বাড়ছে। গত ১০ বছরে ব্যাংকিং খাতে খেলাপি ঋণ বেড়েছে প্রায় ৪১৭ শতাংশ। প্রকৃতপক্ষে এই খেলাপি ঋণের পরিমাণ প্রায় ৩ লাখ কোটি টাকারও বেশি। ব্যাংক খাতে গত বছরের জুন পর্যন্ত ঋণ বিতরণ করা হয়েছে ১১ লাখ ৩৯ হাজার ৭৭৬ কোটি ৯৬ লাখ টাকা। এর মধ্যে খেলাপি হয়েছে ৯৮ হাজার ১৬৪ কোটি ৩১ লাখ টাকা। যা মোট ঋণ বিতরণের ৮.৬১ শতাংশ। গত বছর মার্চে খেলাপি ছিল ৯৫ হাজার ৮৫ কোটি টাকা। সে হিসাবে মাত্র ৩ মাসে খেলাপি ঋণ বেড়েছে ৩ হাজার ৭৯ কোটি টাকা। বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলোর তথ্যের ভিত্তিতে বাংলাদেশ ব্যাংকের তৈরি ‘ঋণ শ্রেণিকরণ ও প্রভিশন’ শীর্ষক প্রতিবেদন থেকে এসব তথ্য পাওয়া গেছে। সর্বশেষ বলা যায়, সরকার যদি সচেষ্ট হয় তবে সামাজিকভাবে এসব খেলাপি ঋণের মোকাবিলা করাও সম্ভব আবার প্রশাসনিকভাবেও সম্ভব। এখন কোনটি ভালো হবে তা কর্তৃপক্ষ ভেবে দেখবে, তবে সমস্যার অবশ্যই শান্তিপূর্ণ সমাধান চাই ব্যাংকিং শিল্পের স্বার্থে। স্থানীয় অর্থনীতিবিদ ও ব্যাংকসংশ্লিষ্ট বিশেষজ্ঞরা অনেক দিন ধরেই ব্যাংকিং সেক্টরে জমে থাকা বিপুল পরিমাণ খেলাপি ঋণ আদায়ের জন্য কার্যকর ও শক্তিশালী ব্যবস্থা গ্রহণের কথা বলে আসছেন। কিন্তু অতীতে সরকার তেমন কোনো কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণ করতে সক্ষম হয়নি। তবে আইএমএফ বাংলাদেশকে ৪৭০ কোটি মার্কিন ডলার ঋণ অনুমোদন করার ক্ষেত্রে আর্থিক খাত সংস্কার, বিশেষ করে খেলাপি ঋণ আদায়ের ওপর জোর দিয়েছে। বাংলাদেশ ব্যাংক আইএমএফের শর্ত পরিপালনের লক্ষ্যে ব্যাংক কোম্পানি আইন সংস্কারের উদ্যোগ নিয়েছে। এর মধ্যে ইচ্ছাকৃত ঋণখেলাপিদের চিহ্নিত করে তাদের কিছু সুযোগ-সুবিধা কার্টেল করার প্রস্তাব করা হয়েছে। তবে ইচ্ছাকৃত ঋণখেলাপিদের পৃথকভাবে চিহ্নিত করা খুব কষ্টসাধ্য ব্যাপার। কারা ইচ্ছাকৃত ঋণখেলাপি আর কারা ইচ্ছাকৃত ঋণখেলাপি নন, তা নির্ধারণের জন্য উপযুক্ত মানদণ্ড থাকতে হবে। যারা প্রতিকূল পরিস্থিতির কারণে ঋণখেলাপি হয়ে থাকেন, তাদের সহায়তা দিয়ে ঋণ পরিশোধে সামর্থ্যবান করে তোলা যেতে পারে। কিন্তু ঋণগ্রহীতাদের মধ্যে একটি শ্রেণি আছে, যারা সামর্থ্য থাকা সত্ত্বেও ইচ্ছা করেই ঋণের কিস্তি আটকে রাখেন, ইচ্ছাকৃত ঋণখেলাপিরা সাধারণভাবে অত্যন্ত ক্ষমতাবান, যারা ইচ্ছাকৃত ঋণখেলাপি তাদের যদি সঠিকভাবে চিহ্নিত করা না যায় এবং তাদের বিরুদ্ধে যদি কঠোর ব্যবস্থা গ্রহণ করা না হয়, তাহলে ব্যাংকিং সেক্টরে খেলাপি ঋণের পরিমাণ কমিয়ে আনা কোনোভাবেই সম্ভব হবে না। ব্যাংকিং সেক্টরে খেলাপি ঋণের মাত্রা বর্তমানে একটা অসহনীয় পর্যায়ে চলে গেছে, ঋণখেলাপিদের কোনো ধরনের বিশেষ সুবিধা দেয়া হলে তা নিয়মিত ঋণের কিস্তি পরিশোধকারীদের খেলাপি হতে উদ্বুদ্ধ করবে। বিশেষ কোনো সুবিধা যদি দিতেই হয়, সেটা দিতে হবে তাদের, যারা ইচ্ছা থাকা সত্ত্বেও বিরূপ পরিস্থিতির কারণে ঋণের কিস্তিÍ পরিশোধ করতে পারছেন না। ইচ্ছাকৃত ঋণখেলাপিদের কারণে ব্যাংকিং সেক্টর একটা দুরবস্থার মধ্যে পতিত হয়েছে। কাজেই তাদের কোনোভাবেই ছাড় দেয়া যাবে না। খেলাপি ঋণের কারণে ব্যাংকিং সেক্টরে নানা সমস্যার সৃষ্টি হচ্ছে, যা কোনোভাবেই চলতে দেয়া যায় না। তাই দেশের কেন্দ্রীয় ব্যাংক, অর্থ মন্ত্রণালয় ও ঋণগ্রহীতাদের একসঙ্গে কাজ করতে হবে, যার জন্য রাজনৈতিক সদিচ্ছার কোনো বিকল্প নেই।

ড. মিহির কুমার রায় : কৃষি অর্থনীতিবিদ ও গবেষক; ডিন, সিটি ইউনিভার্সিটি। [email protected]

সাবস্ক্রাইব ও অনুসরণ করুন

সম্পাদক : শ্যামল দত্ত

প্রকাশক : সাবের হোসেন চৌধুরী

অনুসরণ করুন

BK Family App