×

সারাদেশ

শেরপুরের গারো পাহাড়ে মানুষ-হাতির দ্বন্দ্ব

Icon

কাগজ প্রতিবেদক

প্রকাশ: ২৫ মে ২০২৩, ০২:৩৮ পিএম

শেরপুরের গারো পাহাড়ে মানুষ-হাতির দ্বন্দ্ব

ছবি: সংগৃহীত

শেরপুরের গারো পাহাড়ে থামছে না মানুষ-হাতি দ্বন্দ্ব। ফলে চরম বিপাকে রয়েছেন পাহাড়ি গ্রামবাসীরা। শেরপুরের সীমান্তবর্তী ৩ টি উপজেলার ৬ ইউনিয়নের পাহাড়ি গ্রামগুলোতে বন্যহাতির তান্ডব চলছেই। গত প্রায় দুই যুগ ধরে উপুর্যপুরি বন্যহাতির তান্ডবে বিপর্যস্ত হয়ে পরেছে পাহাড়ি গ্রামবাসীরা।

বন্যহাতির তান্ডবে বিপর্যস্ত এসব পাহাড়ি গ্রামগুলো হচ্ছে, নালিতাবাড়ি উপজেলার পোঁড়াগাঁও ও নয়াবিল ইউনিয়নের নাকুগাঁও, দাওধারা, কাটাড়ি, ডালুকোনা, খলচান্দা, আন্ধারুপাড়া, বাইগরপাড়া, পানিহাতা, বুরুঙ্গা ও সমশ্চুড়া। ঝিনাইগাতী উপজেলার নলকুড়া ও কাংশা ইউনিয়নের হলদীগ্রাম, গোমড়া, সন্ধ্যাকুড়া, রাংটিয়া, নাওকুঁচি, গান্ধীগাঁও, হালচাটি, গজনী, বাঁকাকুড়া, গুরুচরনদুধনই, জুকাকুড়া, পানবর ও তাওয়াকোচা।

শ্রীবরদী উপজেলার রানিশিমুল ও সিঙ্গাবরুনা ইউনিয়নের হাড়িয়াকোনা, বাবেলাকোনা, চান্দাপাড়া, মেঘদল, চুকচুকি, কর্নঝোড়া, ঝুলগাওঁ বালিজুরি, হাতিবর, মালাকোচা, খ্রিস্টানপাড়া, রাঙ্গাজান, খাড়ামুড়া ও হালুয়াহাটি। এসব পাহাড়ি গ্রামগুলোতে প্রায় প্রতিনিয়তই চলছে বন্যহাতির তান্ডব।

জানা গেছে, পাহাড়ে হাতির খাদ্য ভান্ডার বা অভয়ারণ্য না থাকায় ক্ষুধার্ত বন্যহাতির দল খাদ্যের সন্ধ্যানে নেমে আসছে লোকালয়ে। তান্ডব নিলা চালাচ্ছে ফসলি জমি জনবস্তিতে। সাবাড় করে চলেছে কৃষকদের কষ্টার্জিত, ক্ষেতের ফসল, গোলার ধান,ঘর-বাড়ি, গাছ-পালা ও বিভিন্ন ফসলের। এতে যেন পাল্লা দিয়েই বাড়ছে মানুষ-হাতির দ্বন্দ্ব। বন্য হাতির তান্ডবে পাহাড়ি গ্রামগুলোতে কৃষকদের জানমাল ও ক্ষেতের ফসলের ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি সাধিত হচ্ছে।

জানা গেছে, এসব পাহাড়ি গ্রামগুলোতে গারো-হাজং, কোচ, বানাই, হিন্দু-মুসলমানসহ বিভিন্ন জাতীগোত্রের প্রায় ৫০ হাজার মানুষের বসবাস। গারো পাহাড়ের পাদদেশে ভারতের মেঘালয় রাজ্যের সীমান্ত ঘেঁষে অবস্থিত শেরপুরের সীমান্তবর্তী পাহাড়ি গ্রামগুলোতে ১৯৯৫ সালে বন্যহাতির পদচারণা শুরু হয়। শতাধিক বন্যহাতি কয়েকটি উপদলে বিভক্ত হয়ে সীমান্তের প্রায় ৪০ কিলোমিটার এলাকাজুড়ে গারো পাহাড়ে অবস্থান করে আসছে। এসব পাহাড়ি এলাকাগুলোতে নেই ন্যাচারাল কোন বন।

একসময় ২০ হাজার একর বনের জমিতে ন্যাচারাল রিজার্ভ ফরেস্ট হিসেবে শাল গজারী বন ছিল। ৯০ দশকের পর থেকে সরকারিভাবে ন্যাচারাল বন পরিস্কার করে গারো পাহাড়ে সৃজন করা হয় সামাজিক বনায়ন। শুধু তাই নয় ১০ বছর দেয়াদের এসব উডলট বাগানগুলো দফায় দফায় পরিস্কারও করা হয়। আবাদ করা হয় সবজিসহ বিভিন্ন ফসলের।

ফলে হাতির খাদ্যজাত কোন গাছপালা গড়ে উঠছে না গারো পাহাড়ে। একারনে চরমভাবে খাদ্য সঙ্কটে পরেছে বন্যহাতি দল । স্থানীয়রা জানায় বন্যহাতির দল দিনের বেলায় গভীর অরণ্যে আশ্রয় নিচ্ছে। আর সন্ধ্যা ঘনিয়ে আসার সাথে সাথে নেমে আসছে লোকালয়ে। তবে ক্ষেতের ধান, গাছের কলা,কাঁঠালসহ বিভিন্ন প্রজাতির ফলমুল পেকে উঠার সাথে সাথে পাহাড়ি গ্রামগুলোতে বন্য হাতির তান্ডব বেড়ে যায় বলে জানান গ্রামবাসীরা। এসময় পাহাড়ি গ্রামবাসীদের দুর্ভোগের সীমা থাকে না।

ঘর-বাড়ী, ক্ষেতের ফসল ও জানমালের ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি সাধিত হয়। জানমাল ও ক্ষেতের ফসল রক্ষার্থে পাহাড়ি গ্রামবাসীরা রাতজেগে পাহাড়া বসায়। ঢাকঢোল ও পটকা ফুটিয়ে,মশাল জ্বালিয়ে হাতি তাড়ানোর চেষ্টা চলে । কিন্ত যতই হাতি তাড়ানোর চেষ্টা চলে ততই বন্যহাতির দল তেড়ে আসছে লোকালয়ে। এসময় ঘর-বাড়ী ছেড়ে অনেকেই চলে আসেন লোকালয়ে। এভাবে গত দুই যুগ ধরে হাতির সাথে যুদ্ধ করে টিকে আছে পাহাড়ি গ্রামবাসীরা। বর্তমানেও বন্যহাতির তান্ডব চলছেই। বন্যহাতির তান্ডবে বিপর্যস্ত হয়ে পরেছে পাহাড়ি গ্রামবাসীরা।

গজনী গ্রামের মনেন্দ্র চন্দ্র কোচ, হালচাটি গ্রামের দিজ্ব্য মোহন কোচ,নাওকুচি গ্রামের ইউপি সদস্য গোলাপ হোসেনসহ গ্রামবাসীরা জানান,বন্যহাতির তান্ডবে পাহাড়ি জমিগুলোতে এখন চাষাবাদ করা সম্ভব হয় না। এখানে নেই কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা। ফলে তারা অতিকষ্টে দিনাতিপাত করে আসছেন। তারা আরো বলেন,পেটে খাবার না থাকলে ও প্রতিরাতেই হাতি তাড়াতে মশালে ব্যবহারের জন্য কমপক্ষে ২ লিটার কেরোসিন তেল ঘরে রাখতে হয়।

অনেকের ক্ষেত্রে তা সম্ভব হয়ে উঠেনা। হাতি তাড়াতে সরকারিভাবে দেয়া হয় না কোন সাহায্য সহযোগিতা। অনুসন্ধানে জানা গেছে, দীর্ঘ প্রায় দুই যুগে হাতির আক্রমণে প্রাণ হারিয়েছেন নারী পুরুষ ও শিশুসহ বিভিন্ন জাতিগোষ্ঠীর অর্ধশতাধিক মানুষ। আহত হয়েছেন কয়েক শত। এছাড়া মানুষের পাতা ফাঁদসহ নানাভাবে ৩৩টি হাতির ও মৃত্যু হয়েছে।

বন্যহাতির তান্ডবে জানমাল ও ক্ষতিগ্রস্ত কৃষকদের ক্ষতিপূরণ ব্যবস্থা চালু রেখেছে সরকার। হাতির পায়ে পৃষ্ট হয়ে কোন মানুষ মারা গেলে দেয়া হয় ওই পরিবারের পুনর্বাসনের জন্য আর্থিক সহায়তা। ফসলের ক্ষতিপুরন ব্যবস্থা চালু রয়েছে। গুরুচরন দুধনই গ্রামের ইউপি সদস্য রহমত আলীসহ গ্রামবাসীরা বলেন পাহাড়ি গ্রামের কৃষকরা বনের জমিতে চাষাবাদ করায় ক্ষতিগ্রস্থ ফসলি জমির মালিকানা বিষয়ে কাগজপত্র দাখিল করতে না পেরে ফসলের ক্ষতিপূরণ পাচ্ছেন না।

কাংশা ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান মোঃ আতাউর রহমান ও নলকুড়া ইউনিয়নের চেয়ারম্যান রুকুনুজ্জামান বলেন হাতির সাথে যুদ্ধ করে টিকে থাকা বিপর্যস্থ পাহাড়ি গ্রামবাসীদের সরকারীভাবে বিনামূল্যে খাদ্যসহায়তা ও হাতি তাড়াতে কেরোসিন তেল বিতরন ও হাতির খাদ্য সংকট দূরীকরণে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা জরুরি বলে দাবি জানিয়েছেন।

নালিতাবাড়ি উপজেলার মধুটিলা রেঞ্জ কর্মকর্তা রফিকুল ইসলাম বলেন, ভারত সীমান্তে কাটা তারের বেড়া নির্মান করায় হাতিরদল ভারতে প্রবেশ করতে পারছে না। কোন কোন সময় নদী - নালা হয়ে ভারতে প্রবেশ করলেও ভারতীয় জনগন তাড়িয়ে দিচ্ছে বাংলাদেশে। ফলে হাতিরদল অবরুদ্ধ হয়ে পরেছে। শ্রীবরদী উপজেলার বালিজুরি ফরেস্ট রেঞ্জ কর্মকর্তা রবিউল ইসলাম বলেন, হাতিকবলিত এলাকায় বসবাস কারিদের পুনর্বাসন করে সরিয়ে নেয়ার পাশাপাশি ওইসব এলাকায় ন্যাচারাল বন সৃজন করে হাতির খাদ্যভান্ডার গড়ে তোলা হলে মানুষ- হাতি দ্বন্দ্ব কমিয়ে আনা যাবে।

ঝিনাইগাতী উপজেলা ট্রাইবাল ওয়েলফেয়ার অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি নবেশ খকশী বলেন ভয়াবহ অবস্থার দীর্ঘদিন পরও হাতি-মানুষের দ্বন্দ্ব নিরসনে গ্রহণ করা হয়নি কার্যকর ও টেকসই কোন উদ্যোগ বা ব্যবস্থা। ১৯৯৫ সাল থেকে ২০২৩ সাল পর্যন্ত শেরপুরের সীমান্তবর্তী পাহাড়ি গ্রামগুলোতে বন্যহাতির আক্রমণে মানুষ মারা গেছেন ৫৯জন। আর মানুষের হাতে ৩২টি হাতির মৃত্যু হয়েছে। তবে ২টি হাতি হত্যার বিষয়ে মামলা দায়ের করা হয়েছে।

এসব হাতির বেশির ভাগই মৃত্যু হয়েছে বৈদ্যুতিক ফাঁদে, গুলিবিদ্ধ হয়ে, নয়তো ধারালো অস্ত্রের আঘাতে। শ্রীবরদী উপজেলা ট্রাইবাল ওয়েলফেয়ার অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি প্রাঞ্জল এম সাংমা বলেন গারো পাহাড়ে অভয়ারণ্য গড়ে তুলে হাতি-মানুষের দ্বন্দ্ব নিরসনে পদক্ষেপ গ্রহণ করে মানুষের জানমাল রক্ষা ও হাতির খাদ্য সংকট দূরীকরণ জরুরি হয়ে পরেছে।

ঝিনাইগাতী উপজেলার রাংটিয়া রেঞ্জ কর্মকর্তা মকরুল ইসলাম আকন্দ বলেন, হাতির তান্ডবে ক্ষতিগ্রস্ত কৃষকদের ক্ষতিপূরণ বাবদ ২০২২এপর্যন্ত ২০ টাকা বিতরন করা হয়েছে । যারা বনের জমিতে বসবাসও চাষাবাদ করেন তারা ক্ষতিপুরন পাবেন না বলে জানান তিনি। এছাড়া হাতি মানুষের দ্বন্দ্ব নিরসনে গারো পাহাড়ে হাতির খাদ্য সংকট দূরীকরণে অভয়াশ্রম গড়ে তোলার পরিকল্পনা ও হাতে নেয়া হয়েছে।

শেরপুরের জেলা প্রশাসক সাহেলা আক্তার বলেন, সীমান্তের গারো পাহাড়ে হাতি-মানুষের দ্বন্দ্ব নিরসনে অভয়ারণ্য গড়ে তোলাসহ টেকসই পদক্ষেপ গ্রহণের জন্য উর্ধতন কর্তৃপক্ষকে অবহিত করা হয়েছে । ক্ষতিগ্রস্তদের মাঝে আর্থিক সহায়তা প্রদান কার্যক্রম অব্যাহত রয়েছে। পাহাড়ে হাতিসহ প্রাণবৈচিত্র্য রক্ষায় চেষ্টাও করা হচ্ছে।

সাবস্ক্রাইব ও অনুসরণ করুন

সম্পাদক : শ্যামল দত্ত

প্রকাশক : সাবের হোসেন চৌধুরী

অনুসরণ করুন

BK Family App