×

মুক্তচিন্তা

নজরুল সত্তায় প্রেম

Icon

অনলাইন ডেস্ক

প্রকাশ: ২৫ মে ২০২৩, ১২:৩২ এএম

নজরুল সত্তায় প্রেম

কী দ্রোহ, কী সাম্য, কী প্রেম প্রতিটি ক্ষেত্রেই যিনি বাংলা সাহিত্যে নিজেকে উজাড় করে ঢেলেছেন তিনিই হচ্ছেন আমাদের প্রিয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম। তার সাহিত্যের এ ত্রয়ী সত্তার কোনোটিকেই ক্ষুদ্র জ্ঞান করার এতটুকু সুযোগ আমাদের নেই। তবুও এ ত্রয়ী সত্তার মূল সত্তা হিসেবে প্রেম সত্তাই যেন তার সাহিত্যকে অন্য মাত্রার শক্তি জুগিয়েছে। অবশ্য কোনো সাহিত্যিকের পক্ষেই এ সত্তার আবেদনকে অগ্রাহ্য করা সম্ভব নয়। কবি নজরুল সাহিত্যের ক্ষেত্রেও তাই এ সত্তার উপস্থিতি সে যেন আরো শাশ্বত সত্য। যে সত্যে ভর করেই সাহিত্যের নানাবিধ কাঠিন্যকে পাশ কাটিয়েও পদ্যে-গদ্যে-গীতে বাংলা সাহিত্যে আজো তিনি নক্ষত্রসম উজ্জ্বল। প্রায় সমভাবে উজ্জ্বল তিনি নাটক ও উপন্যাস সৃষ্টিতেও। তবে দ্রোহ থেকে বিদ্রোহী নজরুলের এ প্রেম সত্তার প্রকৃত স্বরূপ আমরা তখনই সহজে খুঁজে পাই, যখন দেখি প্রেয়সীর টানে কবিপ্রাণ দুর্দমনীয়তার পরিবর্তে সে কী চঞ্চল, সে কী অভিমানী, সে কী বেদনাহত! সত্যি সে যেন বিস্ময় এক, ‘মম এক হাতে বাঁকা বাঁশের বাঁশরী আর হাতে রণ-তূর্য (বিদ্রোহী, অগ্নি-বীণা কাব্যগ্রন্থ। ‘অর্থাৎ জীবনের প্রয়োজনে তিনি কখনো বিদ্রোহী দেশপ্রেমিক, কখনো প্রকৃতিপ্রেমিক, কখনো বা প্রেয়সীর মায়াজালে আচ্ছন্ন আত্মসমর্পিত সরল প্রাণ এক প্রেমিক মানুষ। যার সহজ প্রকাশই হচ্ছে তার সাহিত্য সম্ভারে। প্রতিনিয়ত জীবনযুদ্ধে প্রেম অন্বেষণই যেন তার প্রকৃত ধ্যান ছিল। কী দরিদ্রতা, কী আশাভঙ্গের বেদনা, কী আনন্দ, কী হর্ষ-ক্লেদ- সর্বত্রই তিনি যেন প্রেমময় ছিলেন। তাই তো এত সহজে তার পক্ষেই কেবল প্রকাশ সম্ভব হয়েছিল ‘হে দারিদ্র্য, তুমি মোরে করেছ মহান, তুমি মোরে দানিয়াছ খ্রিস্টের সম্মান…। ‘প্রকাশ সম্ভব হয়েছিল’ বাগিচায় বুলবুলি তুই ফুল শাখাতে দিসনে আজি দোল…।’ অনেকে কবির বিচিত্র এ উপলব্ধির প্রকাশকে বিভিন্ন মাত্রায় সমালোচিতও করেছেন। কেউ কেউ আবার নিজের দর্শনের সঙ্গে যায় কবির এমন সাহিত্য কর্মকেই শুধু উৎকৃষ্ট সাহিত্য হিসেবে প্রচারে সচেষ্ট হয়েছেন। ফলে কারো কাছে তিনি বিদ্রোহী কবি, কারো কাছে সাম্যের কবি, কারো কাছে তিনি প্রেমের কবি ও কারো কারো কাছে তিনি দিকভ্রান্ত কবি হিসেবেও আদৃত অথবা সমালোচিত হয়েছেন। কেউ কেউ আবার তাকে রোমান্টিক কবি হিসেবেও ভাবতে সচেষ্ট হয়েছেন। যদিও রোমান্টিসিজমের ধারণা তাদের কাছে শুধু লৌকিক প্রেম কি-না সে বিষয়ে সন্দেহ জাগে! কেননা বাস্তব আর নিয়ম-নীতির গণ্ডি পেরিয়ে কল্প ডানায় ভর করে সাহিত্যে প্রাণ সঞ্চারই ছিল রোমান্টিক যুগের কবিদের কবিতার অন্যতম বিশেষত্ব। প্রকৃতির রূপ-রস-গন্ধের মধ্যেই তারা তাদের সাহিত্যে অপার্থিব ঐন্দ্রজালিক সুখের সন্ধান করেছেন। অর্থাৎ রোমান্টিসিজমে লৌকিক প্রেমের স্থান খুবই সীমিত, প্রেমের অলৌকিক ঐন্দ্রজালিক আবহেই তার প্রকৃত মুক্তি। শেলি, কিটস ও ওয়ার্ডসওয়ার্থের কবিতাই তার উৎকৃষ্ট উদাহরণ। তাছাড়া এটি ছিল ১৮ শতকের মধ্যবর্তী সময়ের একটি দ্রুত গতিশীল সাহিত্য আন্দোলন (১৭৮৫-১৮৩০)। যে আন্দোলনের মধ্য দিয়েই সাহিত্যের নিউক্লাসিকাল যুগের অবসান ঘটেছিল। তবে রোমান্টিসিজমের সে ধারা আধুনিক কবিদের অনেককেও যে প্রভাবিত করেনি তা নয়। বাংলা সাহিত্যে তাদের মধ্যে মাইকেল মধুসূদন দত্ত, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ও জীবনানন্দ দাশের নাম অগ্রগণ্য। এদের মধ্যে জীবনানন্দ দাশের কবিতাতেই বিশেষভাবে রোমান্টিসিজমের প্রত্যক্ষ প্রভাব আমরা লক্ষ্য করি। যেমন ‘অন্ধকার’ কবিতায় কবি জীবনানন্দ এমনি এক পরাবাস্তব আবহে নিজেকে খুঁজতে চেষ্টা করেছেন ‘গভীর অন্ধকারের ঘুম থেকে নদীর ছল ছল শব্দে জেগে উঠলাম আবার;…।’ নজরুল সাহিত্যে অতিপ্রাকৃত এ ঐন্দ্রজালিক শক্তির প্রভাব নেই বললেই চলে। বরং বাস্তবের সঙ্গেই সাহিত্যে কবির নিরন্তর ছুটে চলা। অন্যায়ের বিরুদ্ধে সর্বদা বিদ্রোহ ঘোষণাই তার সাহিত্যের অন্যতম রসদ। ব্রিটিশ উপনিবেশবাদের বিরুদ্ধে তাই আমরা দেখি তার কলমে এমনি স্পর্ধা ধ্বনিত হয়েছে- ‘বল বীর- বল উন্নত মম শির,…’(বিদ্রোহী)। শুধু তাই নয়, সমাজের অসাম্যতা ও ধর্মান্ধতার বিপক্ষেও তিনি লিখেছেন দ্বিধাহীন চিত্তে। আবার একই কবি সত্তায় বিভিন্ন ধর্মের মানবিক স্বরগুলোও জাগ্রত করেছেন তার গীত বা সংগীতে। অবলীলায় লিখেছেন ও সুর দিয়েছেন গজল ও শ্যামাসংগীতে। এই যে বিচিত্র সত্তায় তার বিচরণ বিশ্বসাহিত্যে এটিই তো বিরল এবং এটি একমাত্র সম্ভব হয়েছে তার হৃদয় গহিনের প্রবলতর প্রেম শক্তির জোরে। কিন্তু তবুও কবির সে প্রেমের সহজ প্রকাশে বাধা এসেছে বারবার। সংকীর্ণ সাম্প্রদায়িক কূপমণ্ডূকদের দ্বারা বহুবার তিনি তিরস্কৃত হয়েছেন; হয়েছেন আক্রান্তও। এমনকি বাস্তবে প্রিয়ার চোখেও নিজেকে অসহায় বোধ করেছেন কখনো কখনো। তারই একটি কঠিন প্রকাশ দেখি আমরা মোতাহার হোসেনকে লেখা কবির একটি চিঠিতে। যে চিঠিতে কবির একপক্ষীয় ভালোবাসার ব্যর্থ আকুতি প্রকাশিত হয়েছে (কবির প্রেমের আহ্বানে ঢাকা কন্যা ফজিলাতুন্নেছার অস্বীকৃতির বর্ণনা)। কোনো এক বিশেষ কারণে বাসরের প্রথম রাতেই ছেড়ে আসা প্রথম স্ত্রী নার্গিসের (মূল নাম সৈয়দা খানম) প্রতিও কবির লেখক জীবনের শেষ মুহূর্ত পর্যন্ত ভালোবাসার অসহায় আকুতি প্রকাশিত হয়েছে (স্মৃতি বিভ্রমের আগ পর্যন্ত)। যেমন- ‘…বুলবুলি নীরব নার্গিস- বনে…’ এ গানের ভেতরেই সে সত্যের প্রমাণ মেলে। একইভাবে তার আরো বহু গান ও কবিতায় প্রেয়সীর প্রতি তার এমনি অসহায় বেদনার্ত সুর অনুরণিত হয়েছে। কিন্তু এখানে কবিচিত্তে কোনো প্রতিশোধ স্পৃহা আমরা লক্ষ্য করি না, লক্ষ্য করি না কোনো অধিকারের ঔদ্ধত্য; প্রেয়সীর প্রতি অভিযোগের বিপরীতে এ ক্ষেত্রে বরং কবিচিত্তে আমরা খুঁজে পাই কবির নিজের সীমাবদ্ধতার সরল কিছু উপলব্ধি। এই যে প্রেয়সীর অবজ্ঞা/ফেলা আসা ভালোবাসার প্রতি কবির অসহায় আত্মসমর্পণ, এখানেই তো কবির প্রকৃত স্বরূপ খুঁজে পেতে আমাদের আর এতটুকু কষ্ট হয় না! অর্থাৎ কবির অন্তর্লোকের যে কোমলতা- দ্রোহ ও সাম্য চেতনায় তাকে আমরা নির্দ্বিধায় এখানে আত্মার স্বরূপ খুঁজে পাই এবং প্রেয়সীর অবজ্ঞা বা অবহেলাতে কবিকে এখানে আমরা খুঁজে পাই দৃশ্যমান নতজানু এক রংধনুসম বিস্ময় বোধে! যার নামই তো প্রেম সত্তা। এক চণ্ডাল কবির ভাষায় তাই তো এটাই যেন সত্য, ‘শাদা আলো খুঁড়লেই চিরকাল বর্ণ- কোলাহল!’

এম এ আকাশ : প্রভাষক, ফুলতলা মোজাম মহলদার কলেজ, খুলনা। [email protected]

সাবস্ক্রাইব ও অনুসরণ করুন

সম্পাদক : শ্যামল দত্ত

প্রকাশক : সাবের হোসেন চৌধুরী

অনুসরণ করুন

BK Family App