×

মুক্তচিন্তা

শেখ হাসিনা বেঁচে থাকলে ক্ষতি কার?

Icon

অনলাইন ডেস্ক

প্রকাশ: ২৪ মে ২০২৩, ০২:৪০ এএম

খন্দকার মোশতাক পর্যায়ের কেউ নন রাজশাহীর আবু সাঈদ চাঁদ। কথিত আগস্ট বিপ্লবের সূর্যসন্তান রশিদ-ফারুকও নন। তাদের কোনো ভায়রা ভাইও নন। ফ্রিডম পার্টির নেতাও নন। এই চাঁদ রাজশাহী জেলা বিএনপির আহ্বায়ক। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার অপমৃত্যু কামনা করেছেন তাকে কবরস্থানে পাঠানোর হুমকির মাধ্যমে। তিনি এ কাজটি করবেন বা করার সক্ষমতা রাখেন কিনা- তা ভিন্ন প্রশ্ন। ধরে নেয়া যায়, এটি তার কামনা বা অভিপ্রায়। গত শুক্রবার রাজশাহীতে সমাবেশ থেকে চাঁদ প্রধানমন্ত্রীকে হত্যা বা কবরস্থানে পাঠানোর আকাক্সক্ষাটি (আর ২৭ দফা, ১০ দফার মধ্যে আমরা নাই, এক দফা- শেখ হাসিনাকে কবরস্থানে পাঠাতে হবে) ব্যক্ত করেছেন। সেখানে প্রধান অতিথি ছিলেন বিএনপির স্থায়ী কমিটি সদস্য ও সাবেক মন্ত্রী বেগম সেলিমা রহমান। আর প্রধান বক্তা বিএনপি চেয়ারপারসনের উপদেষ্টা ও রাজশাহীর সাবেক মেয়র মিজানুর রহমান মিনু। বিশেষ অতিথি বিএনপির নির্বাহী কমিটির বন ও পরিবেশবিষয়ক সম্পাদক ও আরেক সাবেক মেয়র মোসাদ্দেক হোসেন বুলবুল। ছিলেন বিএনপির সাবেক এমপি এডভোকেট নাদিম মোস্তফাও। তারা কেউ তাদের চাঁদের এমন বক্তব্যে বাধা দেননি। অথবা এমন বক্তব্য রাখায় পরে তাকে একটু ধমক-টমক দিয়েছেন বলেও এখন পর্যন্ত জানা যায়নি। শেখ হাসিনা মারা গেলে বা তার অপমৃত্যু হলে লাভ কার? তিনি বেঁচে থাকলে ক্ষতি কার? হার্ড প্রশ্ন নয়। আবার প্রশ্ন দুটি হলেও জবাব একই। আরেক বিবেচনায় এমন হুমকি বা আকাক্সক্ষা কোনো বিষয়ই নয়। কারণ যেখানে তাকে হত্যাচেষ্টাই অনেকবার হয়েছে, সেখানে হুমকি কি কোনো বিষয়? আগস্ট ট্র্যাজেডির পর ১৯৮১ সালে দেশে ফিরলেও তার সেদিনের যাত্রা আর রাজনীতিতে ফেরা সুখকর ছিল না। অন্তত ১৫ বারের মতো হামলা চালানো হয়েছে তার ওপর। আর চেষ্টা হয়েছে ১৮-১৯ বার। পঁচাত্তরের ১৫ আগস্ট তো বেঁচে গেছেন বিদেশে থাকায়। দেশে থাকলে বোন রেহানাসহ তিনিও একই ট্র্যাজেডির শিকার হতে পারতেন। সেই হিসাবে শেখ হাসিনা-রেহানা বোনাস হায়াত কাটাচ্ছেন। প্রধানমন্ত্রী নিজেও তার জীবন হাতে নিয়ে বেঁচে থাকার কথা বলে থাকেন প্রায়ই। ১৯৮১ সালের ১৭ মে দেশে ফেরার পর থেকেই মৃত্যুর তাড়ায় তিনি। এর ফিরিস্তি বড় দীর্ঘ। বিএনপি-জামায়াত জোট সরকারের আমলে ২০০৪ সালের ২১ আগস্ট গ্রেনেড হামলায় তাকে হত্যাচেষ্টা বেশ আলোচিত হলেও তা প্রথম নয়, শেষও নয়। এর পূর্বাপরে বেশ ক’বার সশস্ত্র হামলা হয়েছে। এরশাদ আমলে ১৯৮৮ সালের ২৪ জানুয়ারি লালদীঘি ময়দানে ৮ দলীয় জোটের সমাবেশে যোগ দিতে চট্টগ্রাম বিমানবন্দর থেকে যাওয়ার পথে ট্রাক-মিছিলে সশস্ত্র হামলা হয়। এতে সাতজন নিহত হন। পরের বছর ১১ আগস্ট শেখ হাসিনা ধানমন্ডির ৩২ নম্বরে আছেন নিশ্চিত হয়ে গুলি চালায় ফারুক-রশিদের ফ্রিডম পার্টির সশস্ত্র সন্ত্রাসীরা। এরশাদ পতনের পর ’৯১ সালের ১১ সেপ্টেম্বর গ্রিন রোডেও হামলা হয় তার ওপর। এর বছর কয়েক পর ১৯৯৪ সালের ২৩ সেপ্টেম্বর ঈশ্বরদী ও নাটোর রেলস্টেশনের প্রবেশমুখে শেখ হাসিনাকে বহনকারী রেলগাড়ি লক্ষ্য করে গুলি ছোড়ে সন্ত্রাসীরা। পরের বছর ৭ ডিসেম্বর রাসেল স্কয়ারের কাছে সমাবেশে ভাষণ দেয়ার সময়ও গুলিবর্ষণ। ২০০০ সালের ২০ জুলাই গোপালগঞ্জের কোটালীপাড়ায় শেখ হাসিনার জনসভার প্রস্তুতি চলা অবস্থায় হেলিপ্যাডের কাছে ধরা পড়ে ৭৬ কেজি ওজনের বোমা। ৩০ মে ২০০১ খুলনার রূপসা সেতুর ভিত্তিপ্রস্তর উদ্বোধন অনুষ্ঠানে তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে হত্যার পরিকল্পনা করে হুজি-বি। তিন দিন আগে সেতুর কাছাকাছি রূপসা নদী থেকে দুটি ইঞ্জিনের নৌকা থেকে ১৫ জঙ্গি ধরা পড়ে যাওয়ায় মিশনটি সফল হয়নি। এর মাস কয়েকের মধ্যে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সময় ২৫ সেপ্টেম্বর ২০০১ সিলেটে নির্বাচনী জনসভায় শেখ হাসিনাকে হুজি-বি বোমা ফাটিয়ে মারার পরিকল্পনা করে। সভাস্থলের ৫০০ গজ দূরে একটি বাড়িতে বোমা বিস্ফোরিত হয়ে জঙ্গিদের দুজন নিহতের মধ্য দিয়ে সেই চক্রান্ত ভেস্তে যায়। পরের বছর ৪ মার্চ ২০০২ তারিখে তার গাড়িবহরে হামলা হয় নওগাঁয় বিএমসি সরকারি মহিলা কলেজের সামনে। একই বছরের ৩০ সেপ্টেম্বর সাতক্ষীরার কলারোয়ায় রাস্তায় ব্যারিকেড দিয়ে শেখ হাসিনার ওপর হামলা চালানো হয়। দুবছর পর ২ এপ্রিল ২০০৪ বরিশালের গৌরনদীতে তার গাড়িবহরে গুলিবর্ষণ। এর ৪ মাসের মাথায় ২১ আগস্ট শেখ হাসিনাকে হত্যার উদ্দেশ্যে চালানো সবচেয়ে বড় হামলায় ২৪ জন নিহত ও কমপক্ষে ৪০০ জন আহত হন। ওই মর্মান্তিক ঘটনা নিয়েও তাচ্ছিল্য হয়েছে। বলা হয়েছিল, এটি নাটক। শেখ হাসিনার ভ্যানেটি ব্যাগেই ছিল গ্রেনেড-বোমা। বাংলাদেশের রাজনীতির ইতিহাসের সবচেয়ে ভয়াল এই হামলা প্রাণ কেড়ে নেয় ২২ জনের। তাদের মধ্যে ছিলেন তখনকার মহিলা আওয়ামী লীগের সভানেত্রী আইভি রহমান। এর বাইরে গ্রেনেডের স্পিøøন্টারে ক্ষতবিক্ষত হন কয়েকশ নেতাকর্মী, যার যন্ত্রণা তারা এখনো বয়ে চলেছেন। ২০০৭ সালে ওয়ান ইলেভেন সরকার আমলে আলোচিত ছিল শেখ হাসিনাকে বিশেষ সাব-জেলে স্লো পয়জনিংয়ে মেরে ফেলার চেষ্টার অভিযোগ। এভাবে বুলেটের তাড়ার মধ্যে শেখ হাসিনা বারবার বেঁচে যাওয়ার মাঝে অলৌকিকতার ছাপ স্পষ্ট। জাতির পিতা বঙ্গবন্ধুকে হত্যার পর কেবল খুনিরা উল্লাস করেনি। রাজনৈতিক কয়েকটি মহলেও ছিল খোশবার্তা। লাল রক্তের স্রোতে তৃপ্তিবোধের এ বিকৃত বাসনা গোটা জাতিকে কালিমালিপ্ত করে। ‘রাখে আল্লাহ, মারে কে’- এর মতো শেখ হাসিনা বা অন্য কারো প্রতিবার মৃত্যুর দুয়ার থেকে ফিরে আসা বা তাকে কবরে পাঠানোর বাসনার এ বিকৃতাচারে লাভ কার? ক্ষতিই বা কার? একজন মানুষকে কেন বারবার ভয়াবহ সব সন্ত্রাসী হামলার টার্গেট হতে হচ্ছে। তার দোষ কোন জায়গায়? বা তার প্রতি এত জেদ কেন- এসব প্রশ্নের একটা ফয়সালা জরুরি। বঙ্গবন্ধুর ভাব ও আদর্শ-মিত্র কিউবার গণমানুষের নেতা ফিদেল ক্যাস্ত্রোকে তার ৯০ বছরের জীবনে যুক্তরাষ্ট্র ৬৩৮ বার হত্যার চেষ্টা করেছে বলে প্রচারিত বিশ্ব ইতিহাসে। বহু বিদ্রোহের পর কিউবার প্রধানমন্ত্রী হিসেবে ১৯৫৯ সালে দায়িত্ব নেন ফিদেল কাস্ত্রো। ২০০৮ সালে তার ভাই রাউল ক্যাস্ত্রোর কাছে ক্ষমতা হস্তান্তর করে বিদায় নেন ফিদেল। ফিদেল ক্যাস্ত্রোর মতো আরেক সাম্রাজ্যবাদবিরোধী নেতা ভেনেজুয়েলার হুগো শ্যাভেজকেও রাসায়নিক বিষ প্রয়োগে হত্যা করা হয়েছে বলে অভিযোগ রয়েছে। শেখ হাসিনার ওপর প্রতিটি হামলায় ঘুরেফিরে আসছে বিএনপি-জামায়াতের সংশ্লিষ্টতার কথা। বিএনপির দিক থেকেও বিষয়টি পরিষ্কার করার দাবি রাখে। সেখানে উল্টো তাদের সমাবেশে তাদেরই একজন নেতার মুখ দিয়ে শেখ হাসিনাকে কবরবাসী করার বাসনা। তাকে ডাকদোহাই না দিয়ে কেন্দ্রীয় নেতাদের মঞ্চে বসে মুখ টিপে হাসা, বাদাম চিবানো ভালো বার্তা দেয় না। দেশে ফেরার দীর্ঘ ৪৩ বছরে শেখ হাসিনা তার দলকে করেছেন গতিশীল, নিজেকে নিয়ে গেছেন ভিন্ন উচ্চতায়, যা দেশে-বিদেশে তার শত্রæও বাড়িয়েছে। টানা তিন মেয়াদে ক্ষমতায় প্রধানমন্ত্রীর দায়িত্বে থেকে তার অর্জনের তালিকাটা বিশাল। বঙ্গবন্ধু হত্যা মামলার চূড়ান্ত নিষ্পত্তি, একাত্তরের ঘাতক যুদ্ধাপরাধীদের বিচার, ভারত ও মিয়ানমারের সঙ্গে সমুদ্রসীমা বিরোধ নিষ্পত্তি ও সমুদ্রবক্ষে বাংলাদেশের সার্বভৌমত্ব প্রতিষ্ঠা, ভারতের সঙ্গে সীমান্ত চুক্তি বাস্তবায়ন ও ছিটমহল বিনিময়, নিজস্ব স্যাটেলাইট উৎক্ষেপণ, পদ্মা সেতু নির্মাণ, মেট্রোরেল, পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্র স্থাপন, কর্ণফুলী টানেল, এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ে, নতুন নতুন ফ্লাইওভার, এলএনজি টার্মিনাল স্থাপনসহ বড় বড় প্রকল্প তাকে উজ্জ্বল করেছে। আবার প্রতিহিংসাকারীর তালিকাও দীর্ঘ করেছে। টানা ক্ষমতা, দুর্বার এবং অপ্রতিরোধ্য গতিতে শেখ হাসিনার এগিয়ে যাওয়া ক্ষমতামুখী দল বিএনপি কেন যে কোনো বিরোধী দলের জন্য কষ্টের হওয়া স্বাভাবিক। এ বেদনা ভুক্তভোগী ছাড়া অন্য কারো পক্ষে বোঝা অসম্ভব। তাই বলে প্রতিপক্ষকে কবরবাসী প্রত্যাশা করা? তাও প্রকাশ্য জনসভায়! মোস্তফা কামাল : সাংবাদিক ও কলাম লেখক; বার্তা সম্পাদক, বাংলাভিশন। [email protected]

সাবস্ক্রাইব ও অনুসরণ করুন

সম্পাদক : শ্যামল দত্ত

প্রকাশক : সাবের হোসেন চৌধুরী

অনুসরণ করুন

BK Family App