×

মুক্তচিন্তা

এড়াব কী করে

Icon

অনলাইন ডেস্ক

প্রকাশ: ২১ মে ২০২৩, ০১:৪৬ এএম

পুঁজিবাদের বিরুদ্ধে লড়বে কারা? প্রশ্নটার জবাব এক কথাতেই দেয়া সম্ভব; লড়বে সমাজতন্ত্রীরা। পৃথিবী এখন সুস্পষ্টরূপে ভাগ হয়ে গেছে। পুঁজিবাদী ও সমাজতন্ত্রীতে। পুঁজিবাদীরা পরিচিত, সমাজতন্ত্রীরা পরিচিত নন। পুঁজিবাদীরা সুসংগঠিত, সমাজতন্ত্রীরা নন। মূল কারণ পুঁজিবাদীদের হাতে ক্ষমতা আছে, সেই ক্ষমতাকে তারা পরিপূর্ণরূপে ব্যবহার করে সমাজতন্ত্রীদের দমন করার কাজে। তাদের প্রথম ও প্রধান কাজ মুনাফা শিকার, দ্বিতীয় কাজ মুনাফার নিশ্চয়তা বিধানের ও মুনাফাব্যবস্থা রক্ষা করার স্বার্থে সমাজতন্ত্রীদের দমন করা। পুঁজিবাদীরা দমন করে ছলে, বলে, কৌশলে। তারা ছাড় দেয়; ‘কল্যাণ রাষ্ট্র’ কায়েমের মনোহর শোভা উপস্থিত করে। মেহনতিদের জন্য কিছু কিছু সুযোগ-সুবিধার ব্যবস্থা যে করে না এমনও নয়, লুণ্ঠন করে আনা সম্পদের খুদকুঁড়ো ছড়িয়ে-ছিটিয়ে দেয়। যখন-তখন বলে আমরা আধুনিকতা এনেছি, যার অর্থ দাঁড়ায় আদিম বর্বরতাকে নতুন মোড়কে ঢেকে দিয়েছি। প্রদর্শনী ঘটায় গণতন্ত্রের, যে গণতন্ত্র আসলে টাকার-থলির গণতন্ত্র ভিন্ন অন্যকিছু নয়। পুঁজিবাদীদের হাতে আছে মিডিয়া, আলাদিনের জাদুর প্রদীপের মতো অপরিসীম তার ক্ষমতা, দিনকে রাত বানাতে পারে, ইচ্ছা করা মাত্র। মিডিয়ার সাহায্যে তারা পুঁজিবাদের মাহাত্ম্য প্রচার করে সর্বক্ষণ এবং চোখ-কান খোলা রাখে সমাজতন্ত্রীরা যাতে কোনোখান থেকে কোনো প্রকার প্রচার-সহায়তা না পায়। সমাজতন্ত্রের বিরুদ্ধে কাজ করা মিডিয়ার নিত্যদিনের দায়িত্ব। সমাজতন্ত্র প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে সারা পৃথিবীতে এখন আন্দোলন চলছে, কিন্তু তার খবর মিডিয়াতে আসে না। সমাজতন্ত্রীদের বিপক্ষে মিডিয়া যে কতটা অন্ধ ও নির্লজ্জ হতে পারে, তার প্রমাণ বাংলাদেশেও আমরা পাই। গত ২০১৭ সালের ৭ অক্টোবর বিপ্লবের শতবার্ষিকী উদযাপন উপলক্ষে ঢাকায় যে সমাবেশ ও মিছিল হয়েছিল তেমনটি সচরাচর দেখা যায় না, কিন্তু পুঁজিবাদী মিডিয়াতে তার খবর প্রায় আসেইনি; যেখানে এসেছিল সেখানে আসতে পেরেছিল নিতান্ত সংকোচের সঙ্গে। অনেক জাতীয় দৈনিক তো দেখা গেল লজ্জা শরমের মাথা খেয়েছে, একটা অক্ষরও ছাপেনি। আসল সত্য অবশ্য ওই ভাগ হয়ে যাওয়াটা। পুঁজিবাদের শেষ বিধান এই যে মধ্যপন্থা বিলুপ্ত হবে, উদারনীতির ছদ্মবেশটাও থাকবে না, থাকবে পুঁজিপন্থি ও সমাজতন্ত্রীরা, পরস্পরের মুখোমুখি অবস্থানে। বুর্জোয়ারা প্রচার করছে সমাজতন্ত্র বিলুপ্ত হয়ে গেছে। তারা জানে কিন্তু মানে না যে সমাজতন্ত্র বিলোপ হওয়ার পাত্র নয়; এটি একটি আদর্শ, যেটি থাকবে; পুঁজিবাদই বরং বিদায় হবে- ঐতিহাসিক ও বৈজ্ঞানিক কারণে এবং পুঁজিবাদ নিজেই শর্ত তৈরি করে দিচ্ছে সমাজতন্ত্রের প্রতিষ্ঠার জন্য। সাম্যের স্বপ্নটা মানুষ বহুকাল ধরে দেখেছে। সাম্য প্রতিষ্ঠার জন্য বিপ্লব হয়েছিল ১৭৮৯ সালে, ফরাসি দেশে, সাম্য প্রতিষ্ঠিত হয়নি; বিপ্লব সফল হয়েছিল ১৮৭১ সালে, ওই দেশেরই রাজধানী প্যারিসে। টিকে ছিল ৭২ দিন। সমাজতান্ত্রিক ব্যবস্থা বড় আকারে গড়ে তোলা হয়েছিল রাশিয়াতে, তার প্রভাব গিয়ে পড়েছিল সারা বিশ্বে। ব্যবস্থাটা এবার টিকে ছিল ৭২ বছর। এসব অভিজ্ঞতা সঞ্চয় করেই সমাজতান্ত্রিক আন্দোলন এগোচ্ছে, কোনো এক দেশে বা অঞ্চলে নয়, বিশ্বজুড়ে। তার সফলতা অনিবার্য। বিপ্লব ভারতবর্ষেও ঘটতে পারত। সমাজতন্ত্রীরা ছিলেন কিন্তু তারা সফল হননি। কারণ আছে। বড় একটা কারণ পরনির্ভরতা। পরনির্ভরতা ভিক্ষুকদের গুণ, বিপ্লবীদের নয়। গল্পের সেই ভিক্ষুকটি লটারিতে ভাগ্য বদলাবে ভেবেছে, কিন্তু ভিক্ষাবৃত্তি যে ছাড়বে এমনটা স্বপ্নেও ভাবতে পারেনি। বিপ্লবীদের পথ ভিন্ন। তারা ভিক্ষা করে না, যুদ্ধ করে। ভারতে সমাজতান্ত্রিক বিপ্লবীরা নিজের পায়ে দাঁড়ালে মেহনতি মানুষ ভরসা করে তাদের কাছে চলে আসতেন, তারাও মেহনতিদের সঙ্গে একাত্ম হতে পারতেন। তেমনটা ঘটেনি। গাছের প্রথম অঙ্গীকার তো এটা হওয়া চাই যে, সে পরগাছা হবে না। আর পরগাছারই বা সাধ্য কি গাছ হওয়ার? সাম্রাজ্যবাদবিরোধী আন্দোলনে জাতীয়তাবাদীরা ছিলেন, তারা সবাই ছিলেন পুঁজিবাদী। তাদের পক্ষে সম্ভব ছিল না ব্যক্তিমালিকানার ধারণা ত্যাগ করে সামাজিক মালিকানায় আস্থা রাখা। তাদের ভেতর উদারপন্থিরা ছিলেন, ছিলেন তারাও নিজেদের যারা সমাজতন্ত্রী মনে করতেন, যেমন কংগ্রেস সোশ্যালিস্ট পার্টির সদস্যরা। এমনও দেখা গেছে, একই পরিবারে দুই ভাইবোনের একজন জাতীয়তাবাদী, অপরজন সমাজতন্ত্রী। যেমন সরোজিনী নাইডু (১৮৭৯-১৯৪৯) এবং বীরেন্দ্রনাথ চট্টোপাধ্যায় (১৮৮০-১৯৪৩)। এরা এক বছরের ছোট-বড়। দুজনেই পড়াশোনা করেছেন বিলেতে। কিন্তু বোনের সাফল্যটাই দৃশ্যমান হয়েছে, কারণ তিনি কংগ্রেসে ছিলেন; ভাইটি কম প্রতিভাবান ছিলেন না, কর্মে তার উদ্যোগ ছিল অসামান্য, কিন্তু তিনি হারিয়ে গেছেন, কারণ জাতীয়তাবাদের প্রশ্রয় ত্যাগ করে তিনি কমিউনিস্ট হতে গিয়েছিলেন। ব্রিটিশ গভর্নমেন্ট তাকে আর দেশেই ঢুকতে দিল না। তিনি রাশিয়াতে চলে গিয়েছিলেন, সেখানেই শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেছেন। স্বামী বিবেকানন্দ (১৮৬৩-১৯০২) এবং ভূপেন্দ্রনাথ দত্ত (১৮৮০-১৯৬১) সহোদর ভাই; বিবেকানন্দ জাতীয়তাবাদী। ভূপেন্দ্রনাথ সমাজতন্ত্রী। ভূপেন্দ্রনাথও শুরুটা করেছিলেন জাতীয়তাবাদী হিসেবেই। প্রথমে ছিলেন নরমপন্থি সুরেন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায়ের দলে, পরে যোগ দিয়েছেন উগ্রপন্থি অরবিন্দ ঘোষের সঙ্গে, জেলও খেটেছেন। এক সময়ে আমেরিকায় চলে যান। প্রথম বিশ্বযুদ্ধ শুরু হলে আমেরিকা ছেড়ে জার্মানিতে যান, নৃবিজ্ঞানে পিএইচডি করেন, যোগাযোগ ঘটেছিল লেনিনের সঙ্গে, দেশে ফিরে আইন-অমান্য আন্দোলনে যুক্ত হয়ে জেল খাটেন, আবারও। সমাজতন্ত্রী হয়ে পড়েছিলেন অনিবার্য রূপে, দ্বা›িদ্বক বস্তুবাদের আলোকে বই লিখেছেন গুরুত্বপূর্ণ। কিন্তু তিনি তেমন খ্যাতিমান হননি, কারণটা ওই একই, সমাজতন্ত্রী হয়ে গিয়েছিলেন সমাজতান্ত্রিক আন্দোলনটা প্রবল হয়নি, প্রবল হয়েছিল জাতীয়তাবাদী আন্দোলনই, যে আন্দোলনের হাল ধরেছিলেন মহাত্মা গান্ধী। জাতীয়তাবাদী গান্ধীর সঙ্গে সমাজতান্ত্রিক লেনিনের মিল খুঁজতে যাওয়াটা বিড়ম্বনা; তবে গান্ধীর সাফল্যের ভেতর একটা ব্যাখ্যা পাওয়া সম্ভব ভারতে কেন বিপ্লব ঘটল না এবং চরম রক্ষণশীল নরেন্দ্র মোদি কেন প্রধানমন্ত্রী হতে পারলেন, এই দুই ঘটনারই। ঘটনা ঘটে একই দলের মধ্যেও। বাংলাদেশে জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দলের অভ্যুদয় ঘটেছিল তৎকালীন সরকার বিরোধিতার ক্ষেত্রে বামপন্থিদের আপেক্ষিক অনুপস্থিতির কারণে। নতুন দলে জাতীয়তাবাদীরা ছিলেন নেতৃত্বে, সমাজতন্ত্রী তরুণরা দলে দলে চলে এসেছিল বিপ্লবের স্বপ্নকে বুকের ভেতর ধারণ করে। নেতারা অধিকাংশই হয় সরে গেছেন, নয় তো বসে পড়েছেন। সরে গেছেন যারা, তারা অধিকাংশই মিলে গেছেন জাতীয়তাবাদী ধারায়। সমাজতান্ত্রিক অবস্থানে অবিচল থেকেছেন যারা, তাদের মধ্যে অত্যন্ত প্রতিভাবান, তেজস্বী ও অনড় ছিলেন আ ফ ম মাহবুবুল হক। আততায়ীদের আক্রমণে মারাত্মকভাবে আহত হয়েছিলেন; এবং তিনি মারা গেছেন। জাতীয়তাবাদী ধারায় চলে গিয়ে তিনি যদি সরকারি দলে আশ্রয় নিতেন, তাহলে আততায়ী তার নাগাল পেত না, অসুস্থ হয়ে দীর্ঘকাল তাকে শয্যাশায়ী হয়ে থাকতে হতো না এবং মৃত্যুর পরে শোকপ্রকাশের রীতিমতো মোচ্ছব পড়ে যেত। সমাজতান্ত্রিক ধারায় অকুতোভয় অবস্থানের দরুন নীরবে প্রস্থান ঘটল, শোকাপ্লুত হওয়ার মতো প্রচুরসংখ্যক মানুষ দেখা গেল না, তার বান্ধবেরা একটি স্মরণসভার আয়োজন করেছিলেন, সেটারও কোনো প্রচার পায়নি। সমাজতন্ত্রী হলে পুরস্কার যা পাওয়া যায় তা এই রকমেরই। তবু সমাজতন্ত্রীরা আছেন এবং থাকবেন। প্রাপ্তিটা পুরস্কারের হবে না, হবে চরিতার্থতার। জলও থাকবে, দুধও থাকবে। তবে দুধ ও জলের এক হতে নেই। কিছুতেই নয়। কেননা এক হলে জলের লাভ দুধের ক্ষতি। সমাজতন্ত্রীদের জন্য এ দায়িত্ব চরিত্রগতভাবেই নির্ধারিত যে তারা জাতীয়তাবাদীদের থেকে আলাদা হবেন। জাতীয়তাবাদীরা সফল হয়েছেন, তারা রাষ্ট্র ক্ষমতার দখলদারিত্ব পেয়েছেন। পুঁজিবাদকে তারা পুষ্ট করছেন। কিন্তু মানুষের জন্য ভরসা তো সমাজতন্ত্রীরাই, তবে তাদের দাঁড়াতে হবে নিজের ওপর ভরসা করেই। বিবেকবান সব মানুষের জন্য এখন করণীয় হচ্ছে পুঁজিবাদকে হটিয়ে দিয়ে সমাজতন্ত্র প্রতিষ্ঠার আন্দোলনে অংশ গ্রহণ করা। ওই আন্দোলনের সাফল্যের ওপর বাংলাদেশের তো বটেই, সমগ্র বিশ্বের ভবিষ্যৎই নির্ভর করছে। এটা না ঘটলে যা ঘটতে থাকবে তার একটি ছোট নিদর্শন দিয়ে শেষ করা যেতে পারে। ২০১৭ সালের বিজয় দিবসে অন্য সব বছরের মতোই অনেক আলো জ¦লে, কিন্তু অন্ধকারও ছিল। রঙেঢঙে উজ্জ্বলতায় উদ্ভাসিত দৈনিকগুলোর একটিতে ছাপা হয় ছোট একটি খবর। সেটি এই রকমের, ‘পারিবারিক কলহের জের ধরে সাহেরা বেগম (৫০) ও ছালমা খাতুন (২২) নামের দুই নারী বিষপানে আত্মহত্যা করেছেন। এরা সম্পর্কে মা ও মেয়ে। বৃহস্পতিবার বিকালে পাবনার ভাঙ্গুড়া উপজেলার পারভাঙ্গুড়া ইউনিয়নের পাথরঘানা গ্রামে এ ঘটনা ঘটে। আত্মহত্যাকারী সাহেরা বেগম ওই গ্রামের আব্দুস সালামের স্ত্রী। গ্রামবাসী জানান, স্বামী পরিত্যক্ত মেয়ে ছালমা খাতুনের দীর্ঘদিন পিত্রালয়ে অবস্থানকে কেন্দ্র করে সকালে আব্দুস সালাম ও তার স্ত্রী সাহেরা বেগমের মধ্যে ঝগড়া হয়। এ ঘটনায় রাগে ও ক্ষোভে ছালমা খাতুন কীটনাশক পান করেন। মেয়ের কষ্ট সহ্য করতে না পেরে তার মা সাহেরা বেগমও ওই কীটনাশক পান করেন। প্রতিবেশী লোকজন টের পেয়ে তাদের ভাঙ্গুড়া উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে নিয়ে যাওয়ার সময় পথে তারা মারা যান। ঘটনার সত্যতা নিশ্চিত করে ভাঙ্গুড়া থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা নজরুল ইসলাম জুয়েল জানান, লাশের ময়নাতদন্ত করতে পাবনা মর্গে পাঠানো হয়েছে।’ খুবই সাধারণ খবর; রোজই পাওয়া যায়, কিন্তু এই খবর যে অন্ধকারের খবর দিচ্ছে সেটি বাড়ছে; আরও বাড়বে, সর্বগ্রাসী হবে, সমাজ-বদলের আন্দোলনটিকে যদি বেগবান না করা যায়। সে দায়িত্ব আমরা এড়াব কী করে? সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী : ইমেরিটাস অধ্যাপক, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়।

সাবস্ক্রাইব ও অনুসরণ করুন

সম্পাদক : শ্যামল দত্ত

প্রকাশক : সাবের হোসেন চৌধুরী

অনুসরণ করুন

BK Family App