×

জাতীয়

সড়কে শৃঙ্খলা ফেরেনি, বাসের ই-টিকেটিং ভেস্তে গেছে

Icon

কাগজ প্রতিবেদক

প্রকাশ: ১৮ মে ২০২৩, ০৮:৩৭ এএম

সড়কে শৃঙ্খলা ফেরেনি, বাসের ই-টিকেটিং ভেস্তে গেছে

ফাইল ছবি

যাত্রীসেবায় এগিয়ে নগর পরিবহন

ভাড়া নৈরাজ্য দূর করতে রাজধানীর গণপরিবহনে ই-টিকেটিং পদ্ধতি চালু করা হলেও অল্প দিনের মধ্যেই তা ভেস্তে যেতে বসেছে। একমাত্র বিআরটিসির নগর পরিবহন ছাড়া অন্য কোনো গণপরিবহনে কন্ডাক্টটরের হাতে পজ মেশিনের ব্যবহার দেখা যায় না। যাত্রীরা ই-টিকেট চাইলে জানিয়ে দেয়া হয় ‘মেশিন নষ্ট’। ই-টিকেটিং ছাড়াও সড়কে সবক্ষেত্রে আবারো নৈরাজ্য চললে। বাস চালকরা সড়কের কোনো আইন মানছেন না। চলতি অবস্থায় বাসের গেট বন্ধ রাখার নিয়ম থাকলেও তা শতভাগ ব্যর্থ। সড়কের মাঝখানে বাস থামিয়ে যাত্রী ওঠানামা করানো হচ্ছে। হেলমেট ছাড়াই মোটরসাইকেল চালকরা সড়কে বেপরোয়া চলাফেরা করছেন। সরকারি ও বেসরকারি একটি বাসের সামনেও চালকের পরিচয়পত্র ঝুলিয়ে রাখা নেই।

পরিবহন মালিক সমিতির নেতারা বলছেন, আমাদের কাছে কেউ অভিযোগ করে না। দিন শেষে মালিকরা মেশিনের হিসাবেই টাকা বুঝে নিচ্ছে। তবে অভিযোগ পেলে ব্যবস্থা নেয়া হবে। সড়ক যোগাযোগ বিশেষজ্ঞ ও বুয়েটের অধ্যাপক ড. এম সামছুল হক বলেন, সড়ক ব্যবস্থাপনার জন্য নিদিষ্ট আইন রয়েছে। আইন মানানোর দায়িত্বে যারা রয়েছেন তাদের সদিচ্ছা ও আন্তরিকতা না থাকলে সড়কে শৃঙ্খলা ফিরবে না। পুলিশ ও বিআরটিএ আইন শতভাগ প্রয়োগে উদাসীন। চালকদের এবং কন্ডাক্টরদের ‘বেপরোয়া’ আচরণের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিলেই সড়কে শৃঙ্খলা ফিরবে। তারা উদাসীন থাকলে শৃঙ্খলা ফিরবে না। আসলে কারো কাজ মনিটরিংয়ের কোনো ব্যবস্থা নেই। তাই পুলিশ, বিআরটিএ, পরিবহন মালিক-শ্রমিকরা নিজেদের ইচ্ছেমতো চলছে। তাদের কিছু বলার কেউ নেই। কারো বিরুদ্ধে কোনো অভিযোগেরই তদন্ত হয় না, ব্যবস্থাও নেয়া হয় না।

সড়ক নিরাপত্তার অংশ হিসাবে নেয়া বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ উদ্যোগ পুরোপুরি বন্ধ হয়ে গেছে। সড়কে পরিবহন চালকরা আবারো বেপরোয়া হয়ে উঠেছে। বাস চলার সময় গেট বন্ধ রাখার নিয়ম থাকলেও এখন আর তা চালক ও যাত্রী কারোই মনে নেই। চালকরা নিজেদের ইচ্ছেমতো রাস্তার যে কোনো স্থানে গাড়ি থামিয়ে যাত্রী উঠাচ্ছে ও নামাচ্ছে। ট্রাফিক পুলিশের সামনেই তারা এসব অনিয়ম করছে। কিন্তু পুলিশ শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নিচ্ছে না।

সব বাসের সামনে চালকের ড্রাইভিং লাইসেন্সের ফটোকপি ও ছবিসহ পরিচয়পত্র ঝুলিয়ে থাকার নির্দেশনা সরকারিভাবে রয়েছে। কিন্তু বাস্তবে শুধু রাজধানী নয়, দেশের কোনো বাসেই চালকরা পরিচয়পত্র ঝুলিয়ে রাখছেন না।

মোটরসাইকেল দুর্ঘটনা এখন সড়কের আলোচিত বিষয়। সারাদেশে মোটরসাইকেল দূর্ঘটনা বেড়েছে। চালকরা হেলমেট ছাড়া এবং ৩ জন একত্রে চলাচল করছে। বিভিন্ন সড়কে উল্টোপথে যানবাহন চলাচল করছে।

সরজমিনে বিভিন্ন রুটে দেখা গেছে, ই-টিকেটের কোনো ব্যবহার নেই। ভাড়া নিলেও যাত্রীকে সমমূল্যের টিকেট দেয়া হচ্ছে না। আবার কখনো কখনো বেশি ভাড়া নেয়ার অভিযোগে যাত্রীদের সঙ্গে কন্ডাক্টরের ঝগড়া হচ্ছে। টিকেট চাইলে কন্ডাক্টর সাফ জানিয়ে দেয় ‘মেশিন নষ্ট’। মিডলাইন পরিবহন, তরঙ্গ পরিবহন, রমজান পরিবহনসহ এই রুটের সবগুলো বাস থেকে ই-টিকেটিংয়ে ব্যবহৃত পজ মেশিন উধাও হয়ে গেছে। মেশিন থেকে টিকেট দেয়া কোনো ধরনের আগ্রহ কন্ডাক্টরদের মধ্যে দেখা যায়নি। অন্য রুটের স্বাধীন পরিবহন, লাব্বাইক পরিবহন, লাভলী পরিবহন, বিকল্প পরিবহন, আজমেরী পরিবহন, গাজীপুর পরিবহন, বিকাশ পরিবহন, বিকল্প পরিবহন, ঠিকানা পরিবহন, সাভার পরিবহনসহ কোনো বাসেই কন্ডাক্টরের কাছে ই-টিকেটিং মেশিন খুঁজে পাওয়া যায়নি।

তরঙ্গ পরিবহনের কন্ডাক্টর কামাল জানান, মেশিন নষ্ট। মালিকরা ঠিক করে না দিলে তার কিছুই করার নেই। স্বাধীন পরিবহনের কন্ডাক্টর সেলিম জানান, মেশিন বেশি সময় গলায় ঝুলিয়ে রাখা যায় না। এ কারণে মেশিন ব্যবহার করি না।

গুলিস্তান থেকে সাভার রুটে চলাচলরত ঠিকানা পরিবহনের কন্ডাক্টর নাম প্রকাশ না করে জানান, মেশিন ব্যবহার করে জনে জনে টিকেট দিলে তাড়াতাড়ি ভাড়া আদায় করা যায় না। এ কারনে তাদের পরিবহনে এখন আর এই মেশিন ব্যবহার করা হয় না। এই রুটের অন্য কোনো পরিবহনেও আর মেশিন দিয়ে ভাড়া কাটা হয় না। টিকেটে অভিযোগ নম্বর আছে, যাত্রীরা অভিযোগ করতে পারেন। এ কারণেও টিকেট দেয়া হয় না, সব যাত্রীকে টিকেট দেয়া হলে নিজেদের কিছুই থাকবে না।

তবে ‘নগর পরিবহনের’ যাত্রীসেবা এখন জনপ্রিয়তা লাভ করেছে। যাত্রী মনিরুজ্জামান জানান, নগর পরিবহনের সব বাসে পজ মেশিন থেকে দেয়া ই-টিকেট নিয়েই যাত্রীরা বাসে উঠছে। সেবার মানও ভালো। অযথা স্টপেজে সময় নষ্ট করে না, ভাড়া নিয়েও কোনো সমস্যা নেই। পজ মেশিনে নির্ধারিত ভাড়া আদায় করা হচ্ছে। তবে বাস চালকরা বাড়তি টাকা আদায়ের জন্য রাস্তা থেকে যাত্রী উঠানামা করাচ্ছে। এই নিয়ে যাত্রীদের অসন্তোষ রয়েছে। অন্যসব পরিবহন কোম্পানির বাসের সঙ্গে নগর পরিবহনের ভাড়ার কিছুটা বৈষম্য রয়েছে। নগর পরিবহনে দৈনিক বাংলা পর্যন্ত ২০ টাকা এবং শাপলা চত্বর পর্যন্ত ২৫ টাকা আদায় করা হচ্ছে। অন্য গণপরিবহনে শাপলা চত্বর পর্যন্ত ভাড়া ২০ টাকা। মতিঝিল সিটি সেন্টার ও দৈনিক বাংলা মোড় থেকে মতিঝিলের ভাড়া রাখা হচ্ছে হচ্ছে ১৫ টাকা। যাত্রীরা প্রতিবাদ করলে ১০ টাকা রাখা হয়।

সড়কে সার্বিক অব্যবস্থাপনা প্রসঙ্গে বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন মালিক সমিতির মহাসচিব খন্দকার এনায়েত উল্যাহ বলেন, অতিরিক্ত ভাড়া আদায় ও নৈরাজ্য দূর করতে আমরা কাজ করছি। দেশে ই-টিকেট নতুন চালু হয়েছে। অনেক সমস্যা দেখা যাচ্ছে। ৯টি স্পেশাল টিম কাজ করছে। অভিযোগের জন্য হটলাইন নাম্বার দেয়া হয়েছে। কেউ অভিযোগ করছে না। যাত্রীদেরও টিকেট নিতে আগ্রহ নেই। আমরা ই-টিকেটিং বাস্তবায়নে আবারো জোড়ালো ব্যবস্থা নেবো। সব কোম্পানির মালিকদের সঙ্গে কথা বলবো। সব অব্যবস্থাপনা ঠিক হয়ে যাবে।

খন্দকার এনায়েত উল্যাহ বলেন, দীর্ঘ সময় পর গেটলক, সিটিং সার্ভিস বন্ধ করতে পেরেছি। অতিরিক্ত ভাড়া আদায়ের বিষয়টিও বন্ধ হবে। ই-টিকেটিংয়ের বিষয়টি নজরদারির জন্য পরিবহন মালিক সমিতির পক্ষ থেকে একটি মনিটরিং সেল গঠন করা হয়েছে।

রোড সেফটি ফাউন্ডেশনের নির্বাহী পরিচালক সাইদুর রহমান বলেন, ‘সড়ক পরিবহন আইন-২০১৮’ শতভাগ বাস্তবায়ন হয়নি। যে ধারাগুলো বাস্তবায়ন হয়েছে সেগুলোও বাস্তবায়নের ক্ষেত্রে সংশ্লিষ্টদের কোনো আগ্রহ না থাকার কারণেই সড়কে যে শৃঙ্খলা ফিরেছিলো, তা আবার ভেস্তে যেতে বসেছে। এতে সরকার এবং রাষ্ট্রের সদিচ্ছার অভাবই বার বার দৃশ্যমান হয়েছে। সড়কে শৃঙ্খলা ফেরাতে টাস্কফোর্স গঠন করা হলেও এর সুফল এখনো অধরা।

সাবস্ক্রাইব ও অনুসরণ করুন

সম্পাদক : শ্যামল দত্ত

প্রকাশক : সাবের হোসেন চৌধুরী

অনুসরণ করুন

BK Family App