×

মুক্তচিন্তা

কবি-সাহিত্যিকরাই খতিয়ানবিহীন প্রয়োজন সাহিত্য মন্ত্রণালয়

Icon

অনলাইন ডেস্ক

প্রকাশ: ১৮ মে ২০২৩, ১২:৪৮ এএম

কবি-সাহিত্যিকরাই খতিয়ানবিহীন প্রয়োজন সাহিত্য মন্ত্রণালয়

তথ্য-প্রযুক্তিতে বাংলাদেশ যেভাবে এগিয়ে চলেছে, তা সত্যিই অভাবনীয়। বর্তমান সরকারের বিভিন্ন কর্মকাণ্ডের সফলতার মধ্যে এটিও একটি। তারই ধারাবাহিকতায় সম্প্রতি বাংলাদেশ শিল্পকলা একাডেমি দেশের সব শ্রেণির শিল্পী এবং সাংস্কৃতিক সংগঠন/প্রতিষ্ঠানগুলোর সার্বিক তথ্য সংগ্রহপূর্বক ডাটাবেজ তৈরি করার এক মহান উদ্যোগ গ্রহণ করেছে। কারণ দেশের প্রত্যন্ত অঞ্চলে অনেক শিল্পী ও সংগঠন/প্রতিষ্ঠান আছে যারা অগোচরে, অবহেলায় কাটিয়ে যাচ্ছে তাদের সারাটি জীবন। করোনাকালে সরকারের এই মহতি উদ্যোগকে সাধুবাদ না জানিয়ে পারা যায় না। ডাটাবেজ তৈরি করার জন্য বাংলাদেশ শিল্পকলা একাডেমি নির্ধারিত যে ফরম সরবরাহ করেছে, সেখানে সব শ্রেণির শিল্পীর তথ্য চাওয়া হয়েছে। দুর্ভাগ্য হলো, কোনো কবি-সাহিত্যিক বা সাহিত্য সংগঠনের কোনো তথ্য চাওয়া হয়নি। তারপরও জেলা শিল্পকলা একাডেমি যে ফরমগুলো কবি-সাহিত্যিকদের এবং সাহিত্য সংগঠন/প্রতিষ্ঠানগুলোকে সরবরাহ করেছে পূরণ করে জমা দেয়ার জন্য- এটা নেহায়েতই তাদের অনুগ্রহ বা বদান্যতা। ফরমে নাটক, সংগীত, যন্ত্রসংগীত, নৃত্য বিভাগ/উপবিভাগ উল্লেখ আছে আর যাত্রা, আবৃত্তি, কবিগান, মূকাভিনয়, জাদু, লাঠিখেলা, চিত্রকলা, ভাস্কর্য নির্মাণ, কারুশিল্প, চলচিত্র নির্মাণ, আলোকচিত্রশিল্পী বিভাগ/উপবিভাগকে হাতে লিখে দেয়ার পরামর্শ দেয়া হয়েছে। অথচ কবি-সাহিত্যিক বা সাহিত্য সংগঠন/প্রতিষ্ঠানগুলোর কোনো তথ্য চাওয়া হয়নি। তারপরও কবি-সাহিত্যিক এবং সাহিত্য সংগঠনগুলো কাটাছেঁড়া বা হাতে লিখে ফরম পূরণ করে জমা দিয়েছেন। এখানে প্রশ্ন জাগে- কবি-সাহিত্যিক বা সাহিত্য সংগঠন/প্রতিষ্ঠানগুলো কোন মন্ত্রণালয়ের অধীনে? তথ্য-উপাত্ত নিয়ে ডাটাবেজ তৈরি হচ্ছে, অথচ এরা কি বাদ পড়বেন? এখন ঘরে বসে ক্লিক করলেই ইউনিয়ন, উপজেলা, জেলা, বিভাগ এবং দেশের যে কোনো তথ্যই পাওয়া যায়। যেমন- জনসংখ্যা, স্কুল, কলেজ, ব্যাংক, মাদ্রাসা, মসজিদ, মন্দির, গরু, মোষ, ছাগল, হাঁস-মুরগি, বন্যপ্রাণী, হাতি, বাঘ, ইত্যাদির সব তথ্যই মেলে। এমনকি অভয়ারণ্যে বন্যপ্রাণী সংরক্ষণ এবং বংশ বিস্তারের জন্য সরকার ও পরিবেশবিদরা সব ধরনের কার্যক্রম গ্রহণ করতে তৎপর। কেবল তথ্য নেই কবি-সাহিত্যিক বা সাহিত্য সংগঠন/প্রতিষ্ঠানগুলোর। উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা, মাগুরা সদরের সঙ্গে ফোনে আলাপ করে জানতে পারি সাহিত্য সংগঠনগুলোর কোনো তথ্যই তার কাছে নেই। কয়েকদিন আগে মাগুরা সাহিত্যিক কল্যাণ পরিষদের সম্পাদক কবি ও সাংবাদিক এম এ হাকিম এবং আমি জেলা প্রশাসক, মাগুরার সঙ্গে আলাপ করলে তিনিও সাহিত্য সংগঠনগুলোর কোনো তথ্য দিতে পারেননি। যেখানে সংগঠনের তালিকা নেই, সেখানে কবি-সাহিত্যিকদের তথ্যের কোনো প্রশ্নই ওঠে না। সাহিত্য সংগঠনগুলোর নিবন্ধনের কোনো ব্যবস্থাও নেই। থাকলে অন্তত সংগঠনগুলোর একটা খতিয়ান পাওয়া যেত। সমাজকল্যাণ বিভাগ নিবন্ধন দেয় শুধু তাদেরই যারা কল্যাণমূলক কাজ করে। সাহিত্য সংগঠনগুলো তো আর কোনো কল্যাণমূলক কাজ করে না, যে কারণে তারা নিবন্ধিত হতে পারে না। সত্যিকার অর্থে কবি-সাহিত্যিক এবং সাহিত্য সংগঠনগুলো সবসময় অবহেলিত। হাইব্রিড ফসল ফলানোর জন্য প্রয়োজন উন্নত বীজ এবং নিবিড় পরিচর্যা। কিন্তু কবি-সাহিত্যিকদের পরিচর্যার কোনো প্রয়োজন নেই। এদের চাল-চুলো বলতে কিছু নেই; সমাজের কিছু বিত্তবান এবং সহৃদয়বান ব্যক্তিদের পৃষ্ঠপোষকতায় চলে। এমনকি শতকরা ৯৯টি সংগঠনের নিজস্ব অফিস আছে কি-না সন্দেহ। শিল্পকলা একাডেমি হচ্ছে যারা সংগীত এবং নাট্যশিল্পী তাদের স্থান। অন্যদিকে যারা সেই সংগীত এবং নাটক রচনা করেন- তাদের স্থান বটতলা, বকুলতলা অথবা কোনো প্রতিষ্ঠানে দয়ার পাত্র হয়ে। বছর দশেক আগে জেলা প্রশাসকের সভাকক্ষে শুধু মাগুরার জন্য নয়, সারাদেশের জেলা ও উপজেলায় সাংস্কৃতিক কমপ্লেক্স নির্মাণ করার প্রস্তাব করেছিলাম, যেখানে থাকবে প্রতিটি সাংস্কৃতিক এবং সাহিত্য সংগঠনগুলোর জন্য অফিস, ছোট্ট একটা অডিটোরিয়াম এবং কমিউনিটি সেন্টার। ওই সভায় তৎকালীন মাগুরা পৌর মেয়র জননেতা মরহুম আলতাফ হোসেন প্রস্তাবটি মাগুরার ভায়না মোড়ে বাস্তবায়নের সম্মতি দিয়েছিলেন। কিন্তু আজ পর্যন্ত বাস্তবায়ন হয়নি। বাস্তবিক এর কোনো প্রয়োজন আছে কি-না? বাংলা একাডেমি নামে বড় ধরনের একটা প্রতিষ্ঠান আমাদের আছে। বাংলা সাহিত্য, গবেষণা ও প্রকাশনাসহ অন্যান্য কাজ করে থাকে। সেখানে কি কবি, সাহিত্যিকদের কোনো পরিসংখ্যান আছে? একজন কর্মকর্তার কাছে খোঁজ নিয়ে জেনেছি সেখানেও কোনো পরিসংখ্যান নেই। অথচ ক্যাটাগরিওয়ারি যেমন- জাতীয়, বিভাগীয়, জেলা ও উপজেলা পর্যায়ে কবি-সাহিত্যিকদের বিস্তারিত তথ্য থাকা উচিত বলে মনে করি। কোনো তথ্য-উপাত্ত না থাকলে কোনো ধরনের উন্নয়ন করা সম্ভব নয়। বাংলা একাডেমি ভাষা, সাহিত্য উন্নয়ন ও প্রকাশনাসহ অন্যান্য কাজ করে থাকে অথচ যারা এ কাজ করে থাকেন তারা উপেক্ষিত। সরকারের প্রতিনিধিত্ব করে মন্ত্রণালয়। সাংস্কৃতিক মন্ত্রণালয় বা সরকার কি এ কাজটি করার প্রয়োজনীয়তা বোধ করে? আবার বড় বড় কথা বলতে শুনি কবি-সাহিত্যিকরা জাতির বিবেক। কথাটা কতটুকু সত্য তা নিয়েও সন্দেহ আছে। এরা কিছু দিতে পারে না সত্য, কিন্তু পথ দেখাতে তো পারে, প্রতিবাদ করতে পারে, কলমের কালি দিয়ে আগুন জ্বালাতে পারে, আগুন নেভাতেও পারে। মহান মুক্তিযুদ্ধের সময় শুধু কি অস্ত্র দিয়েই যুদ্ধ হয়েছিল? কবিতা, গান, নাটক কি কোনো ভূমিকা রাখেনি? একসময় রাজদরবারে এরা বিশেষ আসন পেত আর আজ কেন এই অবস্থা! মহান মুক্তিযুদ্ধে বিজয়ের আর মাত্র বাকি ছিল দুদিন। পাকিস্তানি সামরিক জান্তারা অনুধাবন করতে পেরেছিল যে, তারা আর এখানে টিকতে পারবে না। যে কারণে ১৪ ডিসেম্বর নির্মমভাবে হত্যা করেছিল বুদ্ধিজীবীদের। উদ্দেশ্য জাতিকে বিবেকহীন বা অকার্যকর করা। অতীতের সেই শিক্ষা কি ভুলে গেছি? নীরবে কি চলছে ঘাতকদের সেই বিভীষিকাময় কর্মকাণ্ড? সুকান্ত ভট্টাচার্যকে বলি, তুমি অপরিণত বয়সে দুরারোগ্য ব্যাধিতে চলে গেলে, অথচ মিথ্যে আশ্বাস দিয়েছো- ‘এ বিশ্বকে এ শিশুর বাসযোগ্য করে যাবো আমি/ নবজাতকের কাছে এ আমার দৃঢ় অঙ্গীকার’। কবি, অঙ্গীকার তুমি করেছ ঠিকই কিন্তু রাখতে পারোনি। ত্রিশ লাখ শহীদ, দুই লাখ মা-বোনের ইজ্জত এবং এক কোটি শরণার্থীর অমানবিক কষ্টের বিনিময়ে পেলাম রক্তমাখা পতাকা, পেলাম একখানা জমিন। কিন্তু সেই জমিনে মিলল না খতিয়ান। কবি-সাহিত্যিকরাই রয়ে গেল খতিয়ানবিহীন, কী নির্মম পরিহাস! এর থেকে পরিত্রাণের কি পথ আছে? অবশ্যই আছে। আর সেটা হলো সাহিত্য মন্ত্রণালয় গঠন করা। নিশ্চয় সেখানে মিলবে একটা ঠিকানা। তারপর একে একে মিটবে সব প্রয়োজন। নতুন দিনে সূচিত হবে সোনালি আলো, বাগানে ফুল ফুটবে, পাখিরা গান গাইবে, সবুজ বনানী দেবে ছায়া আচ্ছাদন, সুনীল আকাশ দেবে দীর্ঘ সামিয়ানা, নদীর কলতানে জেগে উঠবে মাঝি-মাল্লারা, গড়ে উঠবে স্মার্ট বাংলাদেশ, আর সেখানেই উজ্জীবিত হবে কবি-সাহিত্যিকরা। বিকল্প কোনো পথ নেই।

পরেশ কান্তি সাহা : মুক্তিযোদ্ধা ও সাহিত্যরতœ সভাপতি, গাঙচিল সাহিত্য-সংস্কৃতি পরিষদ মাগুরা জেলা শাখা। [email protected]

সাবস্ক্রাইব ও অনুসরণ করুন

সম্পাদক : শ্যামল দত্ত

প্রকাশক : সাবের হোসেন চৌধুরী

অনুসরণ করুন

BK Family App