×

জাতীয়

৩ বছরে ডিএসসিসি এখন আত্মনির্ভরশীল প্রতিষ্ঠান

Icon

কাগজ প্রতিবেদক

প্রকাশ: ১৬ মে ২০২৩, ১১:১২ এএম

৩ বছরে ডিএসসিসি এখন আত্মনির্ভরশীল প্রতিষ্ঠান

ছবি: ভোরের কাগজ

ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের (ডিএসসিসি) মেয়র হিসেবে ব্যারিস্টার শেখ ফজলে নূর তাপসের দায়িত্ব নেয়ার তিন বছর পূর্ণ হলো আজ। অপরিকল্পিত এই নগরীতে সাজাতে নির্বাচনী ইশতেহার পাঁচটি রূপরেখা দিয়েছিলেন তিনি। এগুলো হচ্ছে তার ঐতিহ্যের ঢাকা, সুন্দর ঢাকা, সচল ঢাকা, সুশাসিত ঢাকা ও উন্নত ঢাকা। দায়িত্ব পালনের তিন বছরে নির্বাচনী প্রতিশ্রুতি বাস্তবায়ন, অগ্রগতি, নানা চ্যালেঞ্জ ও ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা নিয়ে ভোরের কাগজের সঙ্গে খোলামেলা কথা বলেছেন তিনি। গত বুধবার তার এই সাক্ষাৎকারটি নিয়েছেন ভোরের কাগজের সিনিয়র রিপোর্টার মুহাম্মদ রুহুল আমিন।

ভোরের কাগজ : ঢাকাকে এগিয়ে নিতে আপনার নির্বাচনী ইশতেহারে ঐতিহ্যের, সুন্দর, সচল, সুশাসিত ও উন্নত ঢাকার কথা বলেছিলেন। তিন বছরে কতটা কাজ করতে পেরেছেন?

শেখ ফজলে নূর তাপস : ঢাকা নিয়ে কখনোই কোনো পরিকল্পনাই করা হয়নি। আগের মেয়ররা ঢাকার ভবিষ্যৎ চিন্তায় নিয়ে দায়িত্ব পালন করেননি। আমি একটি মহাপরিকল্পনা নিয়েছি। ঢাকার বিদ্যমান সংকট নিরসনে নির্বাচনী ইশতেহারে পাঁচটি রূপরেখা দিয়েছি। সবগুলোকে ভাগ করে কাজ এগিয়ে নিচ্ছি।

ভোরের কাগজ : ঐতিহ্যের ঢাকা বিনির্মাণে আপনি কী পদক্ষেপ নিয়েছেন? শেখ তাপস : ৪০০ বছরের ঢাকার ঐতিহ্যকে আমরা ধারণ বা সংরক্ষণ করতে পারিনি। অথচ এটাই মূল কাজ হওয়া উচিত। আমরা একটা ঐতিহ্য বলয় সৃষ্টি করছি। দেশি-বিদেশি পর্যটকরা যেন স্বাচ্ছন্দ্যে আমাদের ঐতিহ্যবাহী স্থাপনাগুলোকে উপভোগ করতে পারে। পর্যটকদের সব ধরনের সুযোগ-সুবিধা থাকবে। পুরো ঢাকাকে ৭টি বলয়ে ভাগ করেছি। এর মধ্যে ইতিহাসবিদ মুনতাসীর মামুনকে সঙ্গে নিয়ে লালবাগ কেল্লা (৫ নম্বর বলয়) পরিদর্শন করেছি। ঢাকা ফটক ও লালকুঠির পুনঃসংস্কার কাজ করছি। কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর নোবেল পুরস্কার পাওয়ার এই লালকুঠিতে তাকে ঢাকাবাসী সংবর্ধনা দিয়েছিলেন।

ভোরের কাগজ : তিন বছরে দায়িত্ব পালনে নাগরিকদের জন্য আপনার কী অর্জন ছিল? দায়িত্ব পালনে বাধা ছিল কি?

শেখ তাপস : প্রতিকূলতা-প্রতিবন্ধকতা কিছু ছিল, এখনো আছে। করোনা মহামারির মধ্যে দায়িত্ব নিয়েছি। অনেক জঞ্জাল ছিল। কিন্তু একদিনও থেমে থাকিনি। প্রশাসনিক সংস্কার করতে হয়েছে। দুর্নীতির বিরুদ্ধে কঠোরভাবে ব্যবস্থা নিতে হয়েছে। এই সংস্কার চলমান প্রক্রিয়া। আত্মবিশ্বাস নিয়ে বলতে পারি ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশন বাংলাদেশের মধ্যে এখন দুর্নীতিমুক্ত ১ নম্বর প্রতিষ্ঠান। এখানে দুর্নীতি করে পার পেয়ে যাবে বা উš§ুক্তভাবে করবে- এই চিন্তা এখন আর কেউ করতে পারে না। জবাবদিহিতা এসেছে। দায়িত্বশীলতা বেড়েছে। আমরা সুফল পাচ্ছি।

ভোরের কাগজ : ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনকে আত্মনির্ভরশীল প্রতিষ্ঠান হিসেবে গড়তে চেয়েছিলেন, সেটা কি বাস্তবায়ন সম্ভব হচ্ছে?

শেখ তাপস : ২০২০ সালে ১৬ মে দায়িত্ব নেয়ার পর ৩০ জুন রাজস্ব আয় পেয়েছি মাত্র ৫১২ কোটি টাকা। যা দিয়ে পরিচালন ব্যয় হতো না। এক বছরের মাথায় ৭০৩ কোটি টাকা রাজস্ব আয় করেছি। আগে উন্নয়ন কাজ ছিল প্রকল্পনির্ভর। নিজস্ব অর্থায়নে কিছু করার সুযোগ ছিল না। আমরা সেখান থেকে বেরিয়ে এসেছি। গত বছর ৩০ জুন আমাদের রাজস্ব আয় হয়েছে ৮৭৯ কোটি টাকা। এই অর্থবছরে ১০ মাসে আমাদের রাজস্ব আয় ৮০০ কোটি টাকা ছাড়িয়ে গেছে। আশা করছি বাকি দুই মাসসহ প্রায় এক হাজার কোটি টাকা রাজস্ব আয় করব। এভাবেই আমাদের আর্থিক সক্ষমতা বাড়ছে। অনেক কাজ এখন নিজস্ব অর্থায়নে করছি। আমাদের এখন আর প্রকল্প নির্ভর হতে হচ্ছে না।

ভোরের কাগজ : আপনি দায়িত্ব নিয়েছেন তিন বছর। প্রথম বছর মশার উপদ্রব কম ছিল। এখন আবার বাড়ছে। এই মশার সমস্যা থেকে নগরবাসীর মুক্তি মিলবে কবে?

শেখ তাপস : গত দুই বছরে ডেঙ্গু বা এডিস মশার বিস্তারে আমরা কিছু পরিবর্তন দেখছি। আগে দেখেছি আষাঢ় মাস শুরুর আগেই এডিসের উৎপত্তি হতো। থাকত ভাদ্র মাস পর্যন্ত। এরপর এডিসের বিস্তার ধীরে ধারে স্তিমিত হয়ে যেতো। কিন্তু গত বছর আশ্বিন অর্থাৎ নভেম্বর পর্যন্ত এর বিস্তার ছিল। এ বছরও সেই রেশটা এসেছে। এবার জানুয়ারিতে অনেক ডেঙ্গুরোগী পাওয়া গেছে। জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে মশকের প্রজননের এই পরিবর্তনগুলো আসছে। তারপরও মশক নিধন কর্মপরিকল্পনা বর্ধিত করায় ডেঙ্গু অনেকটা নিয়ন্ত্রণে সক্ষম হয়েছি।

ভোরের কাগজ : খাল-নর্দমা থেকে ময়লা অপসারণ করা হলেও কিছু এলাকায় জলাবদ্ধতা সৃষ্টি হয়। এই ভোগান্তি থেকে নগরবাসীর পরিত্রাণ মিলবে কী?

শেখ তাপস : ঢাকা ওয়াসা থেকে খাল বুঝে পেয়েই সেগুলো পরিস্কারের কাজ শুরু করি। আমরা প্রচুর বর্জ্য অপসারণ করেছি। ফলে জলাবদ্ধতা এখন নেই বললেই চলে। এই কাজটি আমরা করেছি সম্পূর্ণ নিজস্ব অর্থায়নে। আমরা সরকারি অর্থের জন্য অপেক্ষা করিনি। জলাবদ্ধতা হয় ঢাকা দক্ষিণে এমন ১৩৬টি স্থান আমরা চিহ্নিত করেছি। ২০২০, ২১ ও ২২ সালে কোথায় কোথায় পানি জমেছে। তা চিহ্নিত করে প্রত্যেকটা স্থানে আমরা অবকাঠামো উন্নয়ন, ধারণ ক্ষমতা বাড়িয়ে কাজ করছি। জলাবদ্ধতাকে গুরুত্ব সহকারেই নিয়েছি। গতবছর ঘূর্ণিঝড় সিত্রাংয়ের মধ্যেও ঢাকা দক্ষিণে মাত্র ৯টি জায়গায় জলাবদ্ধতার সৃষ্টি হয়েছিল। ৫ থেকে ৬ ঘণ্টার মধ্যেই এই ৯ জায়গার পানি নিষ্কাষণ হয়েছে। অথচ সামান্য বৃষ্টির মধ্যেই জলাবদ্ধতা ছিল ঢাকাবাসীর সবচেয়ে বড় সংকট। এখন আরামবাগ, শান্তিনগর, রাজারবাগ পুলিশ লাইন, আজিমপুর পলাশী মোড় নাজিরাবাজারসহ কোনো এলাকায় এখন পানি জমে না।

ভোরের কাগজ : সম্প্রতি বিভিন্ন মার্কেটে অগ্নিসংযোগের ঘটনা, ঝুঁকিপূর্ণ ভবন আর কেমিক্যাল গোডাউন সরানোর বিষয়ে কী ভাবছেন?

শেখ তাপস : পরপর কয়েকটি মার্কেটে আগুন লাগায় আমরা নাশকতার আশঙ্কা করেছিলাম। যখন আমরা সতর্ক হলাম। ব্যবসায়ীদের আরো সতর্ক থাকতে বললাম। প্রধানমন্ত্রী কঠোর হুঁশিয়ারি উচ্চারণ করলেন। প্রয়োজনে মার্কেটগুলোতে পাহারা বসানোর কথা বললেন। তখন থেকেই এটা বন্ধ হয়ে যায়। এতেই প্রমাণিত হয়েছে আমাদের আশঙ্কা অমূলক ছিল না। গোয়েন্দা সংস্থা ও আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর উচিত আরো খতিয়ে দেখা। জড়িতদের অবশ্যই আইনের আওতায় নিয়ে আসা। আরেকটি বিষয় ঢাকা অপরিকল্পিতভাবে গড়ে উঠেছে। আমাদের অনেক স্থাপনা ঝুঁকিপূর্ণ। আমরা কিছু কর্মকৌশল নিয়েছি। ডিএসসিসির প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তার নেতৃত্বে কমিটি করে দিয়েছি। দুর্যোগ মোকাবিলাকে অত্যন্ত গুরুত্ব সহকারে দেখছি। এজন্য বাজেটেও অর্থ বরাদ্দ রাখছি। কেমিক্যাল গোডাউনের জন্য শ্যামপুর শিল্পাঞ্চলে জায়গা নির্ধারণ করেছি। সেখানে ৫০০ কেমিক্যাল গোডাউন স্থানান্তর হবে। জুন মাসের মধ্যে আমরা সেটা আশা করছি।

ভোরের কাগজ : রিকশা ও ব্যাটারিচালিত অটোরিকশা যানজটের একটি বড় সমস্যা। এটা দূর করার বিষয়ে কী পদক্ষেপ নিচ্ছেন?

শেখ তাপস : আমরা পরিকল্পিতভাবে কাজ করছি। ইতোমধ্যে পৌনে দুই লাখ রিকশার নিবন্ধন দিয়েছি। অবৈধ রিকশা ও ব্যাটারিচালিত রিকশার বিরুদ্ধে অভিযান চালিয়ে যাচ্ছি। এখন অনেকেই ব্যাটারি খুলে পায়ে চালিত রিকশায় পরিণত করছেন। এটা আরো কমবে। তাছাড়া সংস্কার করা সড়কগুলোতে আমরা রিকশা দাঁড়ানোর স্থান নির্ধারণ করে দিচ্ছি। একটা নির্দিষ্ট জায়গায় রিকশা দাঁড়াবে। যাত্রীরাও নির্দিষ্ট জায়গা থেকে রিকশায় উঠে তাদের গন্তব্যে যাবে। আমরা ধাপে ধাপে সেই কাজগুলো করছি। ঢাকাবাসী এর সুফল পাবে।

ভোরের কাগজ : নগরীর যানজট কমাতে কী পরিকল্পনা নিয়েছেন?

শেখ তাপস : ঢাকাবাসীর সবচেয়ে বড় সমস্যা যানজট। রাতারাতি এটার সমাধান সম্ভব নয়। এটা নিয়ন্ত্রণ করতে হলে আমাদের বৈজ্ঞানিক ব্যবস্থাপনায় যেতে হবে। আমরা সেদিকেই যাচ্ছি। যান চলাচলে দীর্ঘতম জায়গায় যতই যাতায়াতের সুবিধা করবেন ততই চলাচল দ্রুত ও গতিশীল হবে। এই শহরে যেখানে সেখানে গাড়ি ঘুড়ানো হয়। উল্টোপথে গাড়ি চলে। এগুলো যত কম হবে, ততই স্বাচ্ছন্দ্যে চলাচল করা যাবে। ধানমন্ডি ২৭ নম্বর সড়কে এখন মাত্র দুইটা কাটা রেখেছি। আগে স্কুলের কারণে যানজট হতো। নাভিশ্বাস হতো। এখন মানুষ স্বাচ্ছন্দ্যে চলে।

ভোরের কাগজ : আদি বুড়িগঙ্গা চ্যানেলের অগ্রগতি কতদূর?

শেখ তাপস : বুড়িগঙ্গাকে পুনর্খনন শুরু করেছি। ৫০ বছর ধরে এটা ভরাট করা শুরু হয়েছিল। এটা পুনর্খনন করা যায়, সেই চিন্তাটা শুধু করেছেন প্রধানমন্ত্রী। আর মেয়র হিসেবে আমি বাস্তবায়নে হাত দিয়েছি। এখন নদীর অবয়ব ফিরে এসেছে। অচিরেই সেটা নান্দনিক পরিবেশে রূপান্তর হবে। নদী আবার পুনরুদ্ধার হবে। ঢাকার দীর্ঘমেয়াদি জলাবদ্ধতা নিরসনে এটিও অভূতপূর্ব ভূমিকা রাখবে।

ভোরের কাগজ : ফুটপাত দখলমুক্ত করতে আপনার পদক্ষেপ কী? যে পরিকল্পনাগুলো করছেন সেটি কাজে আসছে কিনা?

শেখ তাপস : আমাদের বড় প্রতিবন্ধকতা আগ্রাসন। হাঁটারপথ দখলের আগ্রাসন। এমনকি নর্দমার মুখের ওপরে গিয়ে বসে পড়ে। তাহলে পানি নিষ্কাশন কীভাবে হবে? এই আগ্রাসন আমাদের সবচেয়ে বেশি পীড়া দিচ্ছে। আমরা প্রতিনিয়ত অভিযান চালাচ্ছি। লাল চিহ্নিত জায়গা করে দিয়েছি। যেখানে হকার বসতে পারবে না। আগে গুলিস্তানে যে পরিমাণ ফুটপাত দখল করে হকার বসত, এখন অনেকটাই কমে এসেছে। মানুষ কিছুটা স্বাচ্ছন্দ হেঁটে চলাচল করতে পারছে। লালচিহ্নিত এলাকাগুলো পরিপূর্ণভাবে হকারমুক্ত রাখব। এই পরিধিটা ধাপে ধাপে বাড়াবো।

ভোরের কাগজ : ওসমানী উদ্যানের উন্নয়ন কাজ দীর্ঘদিন বন্ধ। এটি কবে নাগাদ চালু করা হবে?

শেখ তাপস : এটার জন্য আমি মর্মাহত। এটা একটা মেগা প্রকল্পের আওতায় নেয়া হয়েছিল। পরিকল্পনা, নকশা সবই করা হয়েছিল। কিন্তু ঠিকাদারের গাফিলতির কারণে কাজটি সম্পন্ন হয়নি। আমি দায়িত্ব নেয়ার পর ঠিকাদারকে ডেকেছি। কথা বলেছি কয়েক দফা। পূর্বের পাওনা পরিশোধ করেছি। কিন্তু ঠিকাদারকে কাজে আর ফেরানো যায়নি। পরে আমরা চুক্তি বাতিল করেছি। ফলে দীর্ঘসূত্রিতায় পড়ে গিয়েছি। নতুন করে ঠিকাদার নিয়োগ করব। টেন্ডার দেব। যাতে দ্রুতই ওসমানী উদ্যানের কাজ শেষ করা যায়।

সাবস্ক্রাইব ও অনুসরণ করুন

সম্পাদক : শ্যামল দত্ত

প্রকাশক : সাবের হোসেন চৌধুরী

অনুসরণ করুন

BK Family App