×

মুক্তচিন্তা

প্রতিহিংসার সাম্প্রদায়িক রাজনীতি

Icon

অনলাইন ডেস্ক

প্রকাশ: ১৫ মে ২০২৩, ০২:০৬ এএম

বিজেতা ও পরাজিতের লিখিত ইতিহাস কখনো এক হয় না এবং হওয়ারও নয়। পরস্পরবিরোধী দুপক্ষ। ক্ষমতার প্রতাপে বিজেতার বীরত্ব আর পরাজিতের প্রতি ধিক্কারের ইতিহাস লিপিবদ্ধ হয়ে থাকে। ইতিহাসের এই ধারা নতুন নয়। সুদূর অতীত থেকেই চলমান। তাই প্রকৃত নির্মোহ ইতিহাস জানতে শত শত বছর অপেক্ষা করতে হয়। স্মরণ করা যাক, ১৭৫৭ সালের পলাশী যুদ্ধের ইতিহাস। যুদ্ধজয়ী ব্রিটিশ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি ভারতীয় আজ্ঞাবহ লেখকদের দিয়ে ইতিহাস রচনা করিয়েছিল। নবাব সিরাজউদ্দৌলাকে লম্পট, মাতাল, চরিত্রহীন, দুর্বৃত্ত ঘৃণ্য শাসক রূপে উপস্থাপন করেছিল ভারতীয়দের কাছে। যাতে তাদের বাণিজ্যের ছদ্মবেশে দেশ দখলের বৈধতা লাভ সহজ-সম্ভব হয় এবং হয়েও ছিল, কিন্তু টেকেনি। পলাশীর যুদ্ধের ১৩৯ বছর পরে অক্ষয়কুমার মৈত্রেয় তার ‘সিরাজউদ্দৌলা’ গ্রন্থে সর্বপ্রথম পলাশী যুদ্ধের তথ্য-উপাত্ত, প্রমাণাদিসহ উপস্থিত করে ব্রিটিশ অনুগত দালাল লেখকদের লিখিত মিথ্যা, বানোয়াট ইতিহাসকে সম্পূর্ণ মিথ্যা প্রমাণ করে দিয়েছেন। নবাব সিরাজের বীরত্ব, দেশপ্রেম এবং ঔপনিবেশিক ব্রিটিশদের বিরুদ্ধে প্রথম ভারতীয় শহীদ হিসেবে নবাব সিরাজকে তিনি উল্লেখ করেছেন। এর পরই পলাশীর প্রহসন যুদ্ধ এবং নবাব সিরাজের প্রতি ভারতীয়দের দৃষ্টিভঙ্গি ১৮০ ডিগ্রি ঘুরে যায়। ঔপনিবেশিক ইংরেজদের স্বরূপ উন্মোচিত হয়ে পড়ে। ইংরেজবিরোধী জাগরণে অক্ষয়কুমার মৈত্রের বইটি অসামান্য অবদান রেখেছিল। বিজেতা এবং পরাজিতের পরস্পরবিরোধী ইতিহাস ধারাবাহিকভাবেই ঘটে এসেছে এবং ঘটছেও। ভারতের হিন্দু জাতীয়তাবাদী বিজেপির শাসনামলে ইতিহাস বিকৃতি এবং পাঠ্যক্রম ও দেশটির ইতিহাস থেকে মুসলিম শাসকদের ৬৬৪ বছরের শাসনামলকে মুছে ফেলা হয়েছে। এমনকি গান্ধীর অসাম্প্রদায়িক বক্তব্য এবং গান্ধী-হত্যাকারী নথুরাম গডসের বিরুদ্ধে ঘৃণ্য বক্তব্যও বাতিল করে দিয়েছে। হিন্দুত্ববাদের শ্রেষ্ঠত্বকে তুলে ধরতে ইতিহাস বিকৃত ও ইতিহাস মুছে ফেলার ঘৃণ্য তৎপরতার বিরুদ্ধে ইতিমধ্যে বাদ-প্রতিবাদ চলছে ভারতজুড়ে। এ মাস থেকে দেশটির শিক্ষার্থীরা (ব্রিটিশ আমলের ধারাবাহিকতায় ভারতে এখনো এপ্রিল-মার্চ অর্থবছর গোনা হয়।) সাম্প্রদায়িক শিক্ষায় দীক্ষিত হয়ে হিন্দুত্ববাদী দৃষ্টিভঙ্গিতে সাম্প্রদায়িক হয়ে উঠবে বলেই বিজেপি ভরসা করছে। নতুন বছরে তাদের হাতে তুলে দেয়া হয়েছে ইতিহাস ও রাজনীতির নতুন হিন্দুত্ববাদী পাঠ্যক্রম। সংখ্যাগরিষ্ঠ হিন্দু ধর্মাবলম্বীদের ভারতে সুদীর্ঘকালের মুসলিম শাসন হিন্দু জাতীয়তাবাদী বিজেপির জন্য বিব্রতকর এবং অস্বস্তিকর ঠেকেছে, তাই মুসলিম শাসনাধীনের ইতিহাসকে পাঠ্যক্রম থেকে প্রত্যাহার করেছে, সাম্প্রদায়িক উদ্দেশ্য হাসিলের অভিপ্রায়ে। ভারতের জাতির পিতা মহাত্মা গান্ধীর হিন্দু-মুসলিম ঐক্যের অবস্থানের কারণেই হিন্দুত্ববাদীরা তাকে হত্যার পরিকল্পনা করেছিল। গান্ধী ভারতকে হিন্দুদের এবং পাকিস্তানকে মুসলিমদের দেশ বলত যারা তাদের বক্তব্যকে অপছন্দ করতেন। ভারতের বহুত্ববাদ ও বৈচিত্র্য ধর্মনিরপেক্ষ ছায়ায় টিকতে পারে বলেও মন্তব্য করেছিলেন। গান্ধীর এসব বক্তব্যও পাঠ্যক্রম থেকে প্রত্যাহার করা হয়েছে। গুজরাটের দাঙ্গার নিন্দা জ্ঞাপন এবং গণতান্ত্রিক রাজনৈতিক সংস্কৃতির জন্য বিপদের আশঙ্কার বক্তব্যও পাঠ্যক্রম থেকে মুছে ফেলা হয়েছে। ভারতকে হিন্দুরাষ্ট্রে পরিণত করার অভিলাষে মুসলিমবিরোধিতা প্রচারণার অংশ হিসেবে পাঠ্যসূচি থেকে মুসলিম শাসকদের ইতিহাস মুছে ফেলে ভারতবর্ষের ইতিহাস শিক্ষা থেকে শিক্ষার্থীদের বঞ্চিত করা হয়েছে। শিক্ষাক্ষেত্রে রাজনৈতিক হস্তক্ষেপ সব দেশেই কম-বেশি ঘটেছে এবং ঘটছেও। তবে ভারতে হিন্দুত্ববাদকে সর্বাগ্রে তুলে ধরার উদ্দেশ্যে মুসলিমবিরোধিতাকে অনিবার্যরূপে ভারতের দ্বিজাতিতত্ত্বে প্রত্যাবর্তন বললে ভুল হবে না। ভারতের কেন্দ্রীয় এবং রাজ্য সরকারগুলো বিকৃত ইতিহাস শিক্ষার নজির পূর্বেও রেখেছে। বিজেপি এক্ষেত্রে হিন্দুত্ববাদী মতাদর্শিক ইস্যু বাস্তবায়নে সবাইকে অতিক্রম করে চরম সীমায় পৌঁছেছে। যেটি স্বাধীন ভারতের অতীতের কোনো সরকার করতে আগ্রহী হয়নি। মহাত্মা গান্ধীর হত্যাকারী নথুরাম গডসেকে বিজেপি দল ব্রাহ্মণ্যবাদী হিন্দু জাগরণের নেতা হিসেবে মান্য করে। গান্ধী হত্যা এবং নথুরামকে বীর আখ্যায়িত করেও তারা প্রকাশ্যে রাজনীতির মাঠ কাঁপিয়েছে। এবার ব্রাহ্মণ্যবাদী নথুরাম গডসেকে ইতিহাসের আস্তাকুঁড়ে থেকে তুলে এনে হিন্দু ধর্মাবলম্বীদের অবতার হিসেবে দাঁড় করানোর চেষ্টায় আছে। কেননা নথুরাম গডসে, সাভারকারকে তারা তাদের পূর্বসূরি হিসেবে আখ্যায়িত করে থাকে। অপরদিকে অসাম্প্রদায়িক গান্ধীকে তুলোধুনো করতেও ছাড়ে না। গান্ধী হত্যার পর আরএসএস নিষিদ্ধ হয়। পরে রাজনীতি না করার মুচলেকা দিলে নিষেধাজ্ঞা প্রত্যাহার করা হয়। সবারই জানা আরএসএসের রাজনৈতিক প্ল্যাটফর্ম হচ্ছে বিজেপি। আরএসএসের এসব তথ্য-উপাত্ত পর্যন্ত রাজনীতি ও ইতিহাস পাঠ্যক্রম থেকে প্রত্যাহার করা হয়েছে। মুসলিম শাসকদের শাসনামলে হিন্দু-প্রধান ভারতে হিন্দুধর্ম আক্রান্ত হয়েছে। তারা দাসত্ব বরণ করেছে। মুসলিম শাসনামল প্রসঙ্গে এরূপ দৃষ্টিভঙ্গি বিজেপি নেতৃবৃন্দের। পাশাপাশি প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি নিজেকে গান্ধীর উত্তরসূরি প্রচার করেন, সেটা যে রাজনৈতিক উদ্দেশ্য হাসিলে তাতে সন্দেহ নেই। প্রকৃতই তার দল বিজেপি গান্ধীর অসাম্প্রদায়িক নীতিকে প্রত্যাখ্যান করে এসেছে এবং গান্ধী হত্যাকারী নথুরাম গডসেকে সম্মান প্রদর্শন করার পাশাপাশি দেশপ্রেমিকও বলে এসেছে। ভারতবর্ষে এযাবৎকালের শাসনকালের পরিসংখ্যান হচ্ছে- ১১৯৩ খ্রিস্টাব্দের মুহাম্মদ ঘোরী থেকে শুরু হয় দাস সাম্রাজ্য। যার সমাপ্তি ১২৯০ সালে। শাসনকাল ৯৭ বছর। ১২৯০ খ্রিস্টাব্দে জালালউদ্দিন ফিরোজ খিলজী হতে খিলজী বংশীয় শাসনামল শুরু এবং সমাপ্তি ১৩২০ খ্রিস্টাব্দে। শাসনকাল ৩০ বছর। ১৩২০ সালে গিয়াসউদ্দিন তুঘলক থেকে তুঘলক বংশীয় শাসনকাল শুরু এবং সমাপ্ত ১৪১৪ সাল। শাসনকাল ৯৪ বছর। ১৪১৪ সালে খিজ্র খান থেকে সৈয়দ বংশের শাসনকাল শুরু এবং শেষ হয় ১৪৫১ সালে। শাসনকাল ৩৭ বছর। ১৪৫১ সালে বহলাল লোদী থেকে লোদী বংশের শাসনকাল শুরু এবং সমাপ্তি ১৫২৬ সালে। শাসনকাল ৭৫ বছর। ১৫২৬ সালে জহিরুদ্দিন বাবর থেকে মুঘল শাসনামল শুরু এবং ১৫৩৯ সালে মুঘল বংশের শাসনের মধ্যান্তর ঘটে। ১৫৩৯ সালে শেরশাহ সুরী থেকে সুরী বংশের শাসনকাল শুরু এবং শেষ হয় ১৫৫৫ সালে। শাসনকাল ১৬ বছর। ১৫৫৫ সালে হুমায়ুন দ্বিতীয়বার মুঘল শাসন পুনঃ আরম্ভ করেন এবং সমাপ্তি ঘটে ১৮৫৭ সালে। শাসনকাল ৩১৫ বছর। ১৮৫৮ সালে ভাইসরয় লর্ড ক্যানিং থেকে ব্রিটিশ সাম্রাজ্যের শাসনকাল শুরু হয়। ১৭৫৭ সালে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি পলাশী যুদ্ধ জয়ে বাংলা, বিহার, উড়িষ্যা দখল করে নিলেও দিল্লির অধীনতা তারা স্বীকার করে নিয়েছিল। ১৯৪৭ সালে ব্রিটিশ সাম্রাজ্যের শাসনকালের অবসান হয়। তাদের শাসনকাল ১৯০ বছর। ১৯৪৭ সালে মধ্য আগস্টে স্বাধীন ভারতে ভারতীয় জাতীয়তাবাদীদের শাসন শুরু হয়। হিন্দু জাতীয়তাবাদী বিজেপির শাসনকাল দুই মেয়াদে লাগাতার চলছে। ৭৬৪ বছর মুসলিম ও ব্রিটিশ শাসনাধীনে হিন্দুধর্ম সুরক্ষিত ছিল। অথচ বিজেপির শাসনামলে জোর প্রচার চালিয়েছে হিন্দু খতরেমে হ্যায়। অর্থাৎ হিন্দু বিপদে আছে। ৬৬৪ বছর (১১৯৩-১৮৫৭) তুর্কি, আফগান ও মুঘলরা ভারতবর্ষে রাজত্ব করেছে। ব্রিটিশ করেছে ১৯০ বছর। এই দীর্ঘ শাসনামলে হিন্দুরা সুরক্ষিত ছিল। হঠাৎ বিজেপির শাসনামলে হিন্দুরা বিপন্ন হয়ে গেল! বিজেপির এমন ধারণা পোষণ করার কারণ কী? কারণটি তাদের দলীয় এবং সরকারের প্রচারণায় রয়েছে, যেটি ‘ওহফরধ রং ড়হষু ভড়ৎ ঐরহফঁং’ পরিকল্পনার বাস্তবায়ন। জাতীয় নাগরিক পঞ্জি বিল সংসদে অনুমোদন লাভের পর অহিন্দু নাগরিকদের ভারত ছাড়া করার নীল নকশা তারা এঁটেছে। আর এটা তো সত্য, ভারতীয় জনগণ নির্বিচারে বিজেপিকে ভোট দিয়ে একক সংখ্যাগরিষ্ঠ দল হিসেবে ক্ষমতায় বারবার অধিষ্ঠিত করেছে। ভারতের জনগণ হিন্দু জাতীয়তাবাদে আস্থাশীল। অর্থাৎ অনিবার্যরূপে নিজেদের সাম্প্রদায়িক রূপে প্রমাণ দিয়ে এসেছে। নয়তো সংখ্যাগরিষ্ঠ নাগরিকরা কেন তবে একচেটিয়া হিন্দু জাতীয়তাবাদী বিজেপিকে নিরঙ্কুশ ভোট প্রদান করে থাকে! পাকিস্তান কিংবা বাংলাদেশে মৌলবাদীরা ভোটে জামানত হারায়। এ পর্যন্ত দুই দেশের কোনো দেশেই মৌলবাদীরা ভোটে জয়ী হয়ে ক্ষমতার কাছেও ঘেঁষতে পারেনি। অথচ বিজেপি মেয়াদের পর মেয়াদে জনরায়ে ক্ষমতায় নিজেদের পাকাপোক্ত করে ফেলেছে। নিরঙ্কুশ ক্ষমতার অধিকারী হয়ে ভারতকে সাম্প্রদায়িকতার অভয়ারণ্যে পরিণত করে তুলেছে। প্রকৃত সত্যটি হচ্ছে বিজেপির শাসনামলে হিন্দুরা বিপদে নয়, বিপদে অহিন্দুরা। নিজেদের ঘৃণ্য রাজনৈতিক ইস্যু বাস্তবায়নে ক্ষমতায় টিকে থাকার জন্য ধর্মকে হাতিয়ার করেছে। হিন্দু ধর্মাবলম্বীদের ক্ষেপিয়ে তুলে হিন্দু জাতীয়তাবাদী শাসনকে চিরস্থায়ী করার অভিলাষে ক্রমাগত ঘৃণিত পদক্ষেপ নিয়ে ভারতের বহুত্ববাদের কবর রচনায় আদা-জল খেয়ে নেমেছে। মযহারুল ইসলাম বাবলা : নির্বাহী সম্পাদক, নতুন দিগন্ত। [email protected]

সাবস্ক্রাইব ও অনুসরণ করুন

সম্পাদক : শ্যামল দত্ত

প্রকাশক : সাবের হোসেন চৌধুরী

অনুসরণ করুন

BK Family App