প্রতিহিংসার সাম্প্রদায়িক রাজনীতি

আগের সংবাদ

ভারত মহাসাগরীয় সম্মেলন : চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় প্রধানমন্ত্রীর ছয়টি প্রস্তাব আমলে নেয়া জরুরি

পরের সংবাদ

৭ নভেম্বর হত্যাকাণ্ডের বিচার কেন?

ড. মোস্তফা সারোয়ার

অধ্যাপক, নগর ও অঞ্চল পরিকল্পনা বিভাগ, খুলনা প্রকৌশল ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়

প্রকাশিত: মে ১৫, ২০২৩ , ২:০৭ পূর্বাহ্ণ আপডেট: মে ১৫, ২০২৩ , ২:০৭ পূর্বাহ্ণ

একটি মূলধারার বেসরকারি টেলিভিশন চ্যানেল ঘূর্ণিঝড় ‘মোকার’ ওপর আমার একটি লাইভ সাক্ষাৎকার প্রচার করেছিল গত বৃহস্পতিবার (১১ মে) তাদের সান্ধ্যকালীন একটি প্রোগ্রামে। হঠাৎ টেলিভিশনের স্ক্রলে চোখ দুটি আটকে গেল একটি ব্রেকিং নিউজ দেখে। মুক্তিযুদ্ধকালে কে-ফোর্সের অধিনায়ক সেক্টর কমান্ডার, পরবর্তী সময়ে মেজর জেনারেল খালেদ মোশাররফের সহযোদ্ধা কর্নেল হুদা এবং লে. কর্নেল হায়দারের নিরস্ত্র হত্যাকাণ্ডের বিচার চেয়ে মামলা দায়ের হয়েছে। সুদীর্ঘ প্রায় ৪৭ বছর পর মামলাটি করেছেন নিহত কর্নেল হুদার মেয়ে নাহিদ ইজাহার খান। বিচারের আবেদনটি তার ব্যক্তিগত হলেও জাতীয় প্রেক্ষাপটে এটির তাৎপর্য অনস্বীকার্য। কেন এই ৪৭ বছর পর বিচার চেয়ে মামলা? এর উত্তর খুঁজতে আমাদের একটু পেছনের দিকে ফিরে যেতে হবে। স্বাধীনতা-উত্তর বাংলাদেশে যে তিনটি রাজনৈতিক হত্যাকাণ্ড একই সূত্রে গাথা, পঁচাত্তর সালের ৭ নভেম্বর খালেদ মোশাররফসহ নাহিদের বাবার হত্যাকাণ্ড তাদেরই একটি। নিঃসন্দেহে ১৫ আগস্ট বঙ্গবন্ধুর সপরিবারে হত্যাকাণ্ড এবং ৩ নভেম্বর রাতে জাতীয় চার নেতার জেল হত্যাকাণ্ড, ৭ নভেম্বরের হত্যার পরিকল্পনাকারী এবং খুনিদের সাহসী হতে সহায়তা করেছিল। কেন এই ৭ নভেম্বরের হত্যাকাণ্ড- এ নিয়ে ’৭৫-পরবর্তী সময়ে দেশের প্রতিক্রিয়াশীল দক্ষিণপন্থি শক্তি রাজনৈতিক পৃষ্ঠপোষকতা পেয়ে নিজেদের মতো করে একপেশে ব্যাখ্যা হাজির করেছে। এমনকি হত্যাকাণ্ডকে জায়েজ করার জন্য সেক্টর কমান্ডার খালেদ মোশাররফ ও তার সহযোগী কর্নেল হুদা এবং লে. কর্নেল হায়দারদের ৩ নভেম্বরের বীরোচিত প্রতিরোধকে ভারতীয় ষড়যন্ত্র হিসেবে প্রচার করে এসেছে।
প্রায় ২ দশকেরও অধিককাল প্রতি বছর ৭ নভেম্বর বিপ্লব ও সংহতি দিবস পালনের নামে ’৭১-এর পরাজিত শক্তি ৭ নভেম্বরের হত্যাকাণ্ডসহ ১৫ আগস্ট ও ৩ নভেম্বরের হত্যাকারীদের জঘন্য কর্মকাণ্ডের বিচারের পথে রাজনৈতিক ও সামাজিক বাধা সৃষ্টি করেছে। আর ’৭৫-পরবর্তী সময়ে বিভিন্ন সামরিক ফরমান জারিসহ সংবিধানের ৫ম সংশোধনীর মাধ্যমে বঙ্গবন্ধুর সপরিবারে হত্যাকাণ্ড তো বটেই, ৭ নভেম্বরের মোশাররফ-হুদা-হায়দারদের হত্যাকাণ্ডেরও দায়মুক্তি দিয়েছিল। কেন সেদিন মোশাররফ-হুদা-হায়দারদের হত্যা করা হয়েছিল? বলতে দ্বিধা নেই, জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের সপরিবারে হত্যাকাণ্ডের পর যেভাবে রাজনৈতিক প্রতিরোধ হওয়ার কথা ছিল, তেমনটি হয়নি নানা কারণে। তবে কিছু স্থানীয় প্রতিবাদ/প্রতিরোধ হলেও তা জাতীয়ভাবে ব্যাপক প্রভাব ফেলতে পারেনি। বরং ’৭৫-এর খুনিচক্র মোশতাককেন্দ্রিক বঙ্গভবনের নিয়ন্ত্রণ গ্রহণ করে এতটাই বেপরোয়াভাবে সামরিক ও বেসামরিক প্রশাসন চালাচ্ছিল, এ নিয়ে খোদ সামরিক বাহিনীর ভেতরেই অসন্তোষ চলছিল। আর আগে থেকেই খালেদ মোশাররফের নেতৃত্বে মুক্তিযোদ্ধা সামরিক অফিসারদের যে অংশটি ’৭৫-এর হত্যাকাণ্ডকে মেনে নিতে পারেনি, তারা প্রাথমিকভাবে সেনাবাহিনীর ভেতরে শৃঙ্খলা ফিরিয়ে আনা এবং পরবর্তী সময়ে খুনিদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণের অভিপ্রায়ে একরকম রক্তপাতহীন অভ্যুত্থান করে ২ নভেম্বর ১৯৭৫ সালে। খুনিদের বিরুদ্ধে খালেদ মোশাররফদের সামরিক প্রতিরোধ রক্তপাতহীন হলেও, নানা কারণেই জিয়াসহ নেতৃস্থানীয় কর্মরত ও অবসরপ্রাপ্ত সামরিক কর্মকর্তা ও অন্যান্য শক্তির দিক থেকে পাল্টা প্রতিরোধ আসার বিষয়টি উড়িয়ে দেয়ার মতো ছিল না। কেননা খালেদদের নতুন নেতৃত্ব সামরিক ও বেসামরিক প্রশাসনে প্রতিষ্ঠিত হওয়ার আগেই দেশের প্রতিক্রিয়াশীল দক্ষিণপন্থি শক্তি, ’৭৫-পরবর্তী তৎকালীন জাসদের একটি অংশ বিপ্লবী সৈনিক সংস্থার সহায়তায় খালেদবিরোধী প্রচারণায় সুচারুভাবে লিপ্ত হয়। প্রচারণায় খালেদ-হুদাদের ভারতীয় আশীর্বাদপ্রাপ্ত হিসেবে তুলে ধরা হয়। এমনকি এটাও প্রচার করা হয়, জেলে আটক জাতীয় চার নেতাকে সামনে এনে খালেদরা ভারতীয় নীলনকশায় দেশ পরিচালনার চেষ্টা করবে। এই প্রচারণার প্রথম শিকার জাতীয় চার নেতা, যাদের ৩ নভেম্বর রাতেই কারাগারে নিরস্ত্র অবস্থায় বর্বরভাবে হত্যা করা হয়। খালেদের নেতৃত্ব গ্রহণের পরপরই নভেম্বরের ৪ তারিখ প্রথমবারের মতো জাতীয় পর্যায়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে আগস্ট হত্যাকাণ্ডের বিচারের দাবিতে যে মিছিল হয়েছিল, তার অগ্রভাগে ছিলেন খালেদের মা এবং ভাই রাশেদ মোশাররফ। সন্দেহ নেই, বঙ্গবন্ধু ও জাতীয় চার নেতার খুনিদের বিচার দাবির ওই মিছিলে খালেদ পরিবারের সদস্যদের উপস্থিতি রাজনৈতিকভাবে আওয়ামী লীগকে ঘুরে দাঁড়ানোর সাহস এবং শক্তি জুগিয়েছিল। তবে এটিকেও খালেদের বিরুদ্ধে আওয়ামী লীগকে ক্ষমতায় আনার ভারতীয় নকশা হিসেবে সামরিক বাহিনীর ভেতরে এবং বাইরে ব্যাপক প্রচারণা চালানো হয়। সেই প্রচারণার সঙ্গে যোগ হয় নানামুখী ষড়যন্ত্র। এরই ধারাবাহিকতায় ৭ নভেম্বর সকালে সেনাবাহিনীর একাংশের হাতে নির্মমভাবে নিহত হন ’৭১-এর মহান স্বাধীনতাযুদ্ধে মৃত্যুঞ্জয়ী এই বীর খালেদ ও তার সহযোগী হুদা-হায়দারসহ অন্যরা। ইতোমধ্যেই সেনা চেইন অব কমান্ড জিয়ার হাতে চলে গিয়েছিল আর বিপ্লবী সৈনিক সংস্থা ছিল তাহের-জলিলদের হাতে। সেদিন নানা ষড়যন্ত্রে খালেদ-হুদা-হায়দাররা প্রাণ না হারালে বঙ্গবন্ধু হত্যা-পরবর্তী বাংলাদেশ পুনরায় মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় এগিয়ে যেত কিনা, সেটি ইতিহাসই একদিন বলবে। তবে খালেদদের হত্যার পর বাংলাদেশ যে আবার পাকিস্তানি ভাবধারায় দশকের পর দশক পরিচালিত হয়েছে, তা ’৭৫-এ খালেদদের হত্যার পর দক্ষিণপন্থি এবং অন্যান্য প্রতিক্রিয়াশীল শক্তির বিজয় উল্লাস দেখেই অনুমান করা গেছে। স্মৃতির পাতা একবার হাতড়ে দেখুন, কারা খালেদদের হত্যাকাণ্ডের অব্যবহিত আগে ও পরে সেনানিবাসসহ ঢাকা শহরের বিশেষ এলাকাগুলোয় এমনকি মসজিদেও রাতের বেলা লিফলেট বিতরণ করেছিল খালেদদের বিরুদ্ধে প্রচারণায়। একবার স্মরণ করুন, কারা সেদিন সিপাহি-জনতা ভাই ভাই, অফিসারের রক্ত চাই বলে গগনবিদারী সেøাগান তুলেছিল। একবার তাকিয়ে দেখুন, সেই পুরনো ছবি। খালেদ হত্যাকাণ্ড-পরবর্তী বিজয় মিছিলে ট্যাঙ্কের ওপর টুপিধারীরা কারা, নারায়ে তাকবির আল্লাহ হু আকবর বলে উল্লাস প্রকাশ করছিল? কারা ’৭৫-পরবর্তী সময়ে সুদীর্ঘকাল বিপ্লব ও সংহতি দিবস পালনের নামে শুধু খালেদদেরই দেশদ্রোহী হিসেবে চিহ্নিত করেই ক্ষান্ত হয়নি, দেশকে পাকিস্তানি ভাবধারায় চালানোর সব চেষ্টাই করেছে? পরবর্তী সময়ে জিয়া-এরশাদ শাসন আমলে সেই প্রতিক্রিয়াশীল শক্তি, দেশি-বিদেশি অর্থে, বিশেষত মধ্যপ্রাচ্য কানেকশনের কারণে এবং রাজনৈতিক পৃষ্ঠপোষকতায় ব্যবসা-বাণিজ্য করে সমাজ ও রাষ্ট্রের একটি অংশের ওপর গভীর নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা করতে পেরেছে। পাকিস্তানি ভাবধারার এই অংশটুকু এতই শক্তিশালী, স্বাধীনতা ও মুক্তির সংগ্রামের নেতৃত্ব দানকারী যে দলটির প্রায় ৭০ বছরেরও বেশি ঐতিহ্য রয়েছে, তাদেরও ক্ষমতায় ফিরতে হয়েছে দুই দশকেরও অধিককাল অপেক্ষার পর। ওই প্রতিক্রিয়াশীল শক্তির প্রভাব এতটাই সমাজের গভীরে প্রথিত ছিল, ’৭৫-পরবর্তী সময়ে খালেদের সহযোগী কর্নেল হুদার ৫-৮ বছর বয়সি দুই সন্তানের ভালো স্কুলে ভর্তির চেষ্টার সময়, ৭ নভেম্বর নিহত তাদের পিতার পরিচয় গোপন রাখার শর্তে স্কুলে ভর্তি করতে রাজি হয়েছিল। যদিও দৃঢ়চেতা ও প্রখর ব্যক্তিত্যসম্পন্ন মিসেস হুদা স্কুল কর্তৃপক্ষের সে প্রস্তাব ফিরিয়ে দিয়ে অন্য স্কুলে ভর্তি করেছিলেন। কী এক অদ্ভুত উটের পিঠে সওয়ার হয়েছিল দেশ, মুক্তিযুদ্ধের বীর সেনানীর সন্তানদের আত্মপরিচয় গোপন করতে বলা হয় ভালো স্কুলে ভর্তির শর্ত হিসেবে। বাস্তবতা যখন এ রকম, তখন পিতার হত্যাকারীদের বিচার চাওয়া খালেদ-হুদা-হায়দারদের অপ্রাপ্তবয়স্ক সন্তানদের জন্য ছিল অলিক কল্পনা মাত্র। আজ যারা ৪৭ বছর পর বিচার চাওয়ার উদ্দেশ্য নিয়ে প্রশ্ন তুলছেন, তারা এত নির্বোধ নন যে, বিষয়টা তারা বোঝেন না। তারা বিচারের পথে বাধা সৃষ্টির জন্যই এমনটি করছেন, যদিও রাষ্ট্রীয় ক্ষমতায় এখন মুক্তিযুদ্ধের নেতৃত্বদানকারী দলটি। শুরুতে বলেছিলাম, স্বাধীনতা উত্তর বাংলাদেশে তিনটি হত্যাকাণ্ড রাজনৈতিকভাবে একই সূত্রে গাঁথা। ফলে এই হত্যাকাণ্ডগুলোর বিচার প্রক্রিয়াও একই ধরনের আইনগত, রাজনৈতিক ও সামাজিক প্রতিবন্ধকতার মুখোমুখি হয়েছে। তবে আশার কথা সব প্রতিবন্ধকতা দূর করে, জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু কন্যার সাহস ও দৃঢ়তার কারণে জাতি ১৫ আগস্ট ও ৩ নভেম্বর হত্যাকাণ্ডের বিচার পেয়েছে। যদিও পলাতক অনেক খুনি এখনো ধরাছোঁয়ার বাইরে। তবে ওই দুটি হত্যাকাণ্ডের বিচারের মাধ্যমে জাতি জানতে পেরেছে সেদিন কী হয়েছিল, কারা সেটি করেছিল, কী ছিল তাদের আসল উদ্দেশ্য ইত্যাদি নানা প্রশ্নের উত্তর। আমরা বিশ্বাস করি, স্বাধীনতার বীর সেনানী কর্নেল হুদার এক সময়ের ছোট্ট শিশু মেয়ে নাহিদ ইজাহার খান নানা প্রতিকূলতার মধ্য দিয়ে বড় হয়ে এসে এই পরিণত বয়সে বিচার চেয়ে মামলা করে শুধু পারিবারিক দায় মেটাননি, এটি জাতিরও দায় মেটানোর পথে একধাপ অগ্রগতি। এটি বাংলাদেশের ইতিহাসের এক সন্ধিক্ষণের একটি অমীমাংসিত অধ্যায়ের নির্মোহ মূল্যায়নের সুযোগ করে দেবে ভবিষ্যৎ প্রজন্মকে। এর ন্যায়বিচার নিশ্চিত করা আমাদের ঐতিহাসিক দায়।

ড. মোস্তফা সারোয়ার : অধ্যাপক, নগর ও অঞ্চল পরিকল্পনা বিভাগ, খুলনা প্রকৌশল ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়।
[email protected]

মন্তব্য করুন

খবরের বিষয়বস্তুর সঙ্গে মিল আছে এবং আপত্তিজনক নয়- এমন মন্তব্যই প্রদর্শিত হবে। মন্তব্যগুলো পাঠকের নিজস্ব মতামত, ভোরের কাগজ লাইভ এর দায়ভার নেবে না।

জনপ্রিয়