×

মুক্তচিন্তা

মাতৃত্বের সম্মান ও করপোরেট মা দিবস

Icon

অনলাইন ডেস্ক

প্রকাশ: ১৪ মে ২০২৩, ১২:২২ এএম

মে মাসের দ্বিতীয় রবিবার বিবেচনায় বিশ্ব ‘মা দিবস’ আজ। একশ বছরেরও আগে যুক্তরাষ্ট্রের এনা জারভিস মায়েদের অনুপ্রাণিত করার মাধ্যমে দরিদ্র জনগোষ্ঠীকে স্বাস্থ্য সচেতন করে তুলতে উদ্যোগী হয়েছিলেন। এর ফলোআপ হিসেবে ১৯১৪ সালের ৮ মে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের তৎকালীন প্রেসিডেন্ট উড্রো উইলসন মে মাসের দ্বিতীয় রবিবারকে মা দিবস ঘোষণা করেন। বিশ্বের প্রায় অর্ধশত দেশে যার যার প্রেক্ষিত দৃষ্টে পালিত হয় দিনটি। দিনটির নেপথ্যে রয়েছে আবেগঘন ইতিহাস। ভার্জেনিয়ার শান্তিবাদী সমাজকর্মী এনা মাদার্স ডে ওয়ার্ক ক্লাব বানিয়ে সমাজের পিছিয়ে পড়া নারীদের কর্মসংস্থানসহ সামনে এগিয়ে নেয়ার চেষ্টা করেন। তার সেই চেষ্টার জেরেই বিশ্ব মা দিবস। প্রেক্ষিত বিচারে তাই বাংলাদেশে দিবসটির তাৎপর্যে কিছু ভিন্নতা অবশ্যই রয়েছে। পশ্চিমা ধাঁচের হলেও দিনটির মাঝে বাঙালির চিন্তা ও উপলব্ধির এক অকৃত্রিম রসায়ন। এ বাস্তবতায় সরকারের দিক থেকে দিনটিকে অন্য করপোরেট দিবস ধরনে না রেখে বাঙালিত্ব দেয়ার একটি প্রয়াস রয়েছে। ‘স্বপ্ন প্যাকেজ’ নামের একটি প্রকল্পের আওতায় সৃষ্টিকর্তা প্রদত্ত ‘বটম লাইনিং’ মাকে নিয়ে প্রধানমন্ত্রীর ঐকান্তিক দরদি কিছু প্রকল্প রয়েছে, যা কারো কারো জানার বাইরে। প্রধানমন্ত্রীরই সিদ্ধান্তে ২০২২-২৩ অর্থবছরে মাতৃত্ব ও শিশু সহায়তা কর্মসূচিতে বরাদ্দকে ‘বিনিয়োগ’ হিসেবে প্রাধান্য দেয়া হয়েছে। এ কর্মসূচির কলেবর বাড়িয়ে মাপ্রতি ৮০০ টাকা মাস হারে ৫ বছর মেয়াদে ১২ লাখ মাকে এ ভাতা দেয়া হচ্ছে। মাতৃত্ব সন্তান জন্মের পর নয়, মাতৃত্ব শুরু হয় সন্তানটির ভ্রæণ গর্বে আসার লগ্ন থেকেই- এ ধারণা রয়েছে সরকারের ‘স্বপ্ন প্যাকেজে’। সেই বিবেচনায় বাঙালি মা আর বিশ্বের অন্যান্য মায়ের মাঝে কিঞ্চিত তফাৎ আছে। এখানে ম্যাক্সিম গোর্কির মায়ের সঙ্গে বাংলার মাদের এক করা সমীচীন নয়। একইভাবে সরকারের নানা প্রকল্পের সঙ্গে এ প্রকল্পটির তুলনাও খাটে না। মাতৃত্বের যে অর্থ ও গুরুত্ব এ প্রকল্পটিতে লুকানো রয়েছে এর মর্ম ভীষণভাবে উপলব্ধির দাবি রাখে। কিন্তু গণমাধ্যমসহ সরকারি প্রচার ব্যবস্থাপনায় প্রকল্পটির সেরকম ভ্যালু নেই। মাতৃত্বের এমন ধারণার প্রবক্তক একজন সাদাসিধে ধরনের নিভৃতচারী মানুষের। এ এইচ নোমান নামের এই চিন্তাশীল মানুষটির দেশজ চিন্তাধারায় তৈরি স্বপ্ন প্যাকেজটির অভিভাবকত্ব করছে সরকার। আর কার্যকর করছে মহিলাবিষয়ক অধিদপ্তর। এর আগে তিনি নিজেই ক্ষুদ্র পরিসরে শুরু করেছিলেন কাজটি। তার ওই ধারণায় শনাক্ত করা প্রথম মা গাজীপুরের কালিয়াকৈর উপজেলার আশাপুর গ্রামের ফিরোজা বেগম। ২০০৫ সালে মাত্র ১০০ টাকা মাসিক হারে দেশের প্রথম ভাতাপ্রাপ্ত মা। তার ২টি কন্যা হওয়ায় শ্বশুরবাড়ি থেকে তাড়িয়ে দেয়। স্বামীসহ অসহায় ও অন্ধকারে নিমজ্জিত ফিরোজা বাপের বাড়ি গিয়ে সংসার পাতেন। তৎকালীন ইউপি সদস্য সেলিনা আক্তার ক্রাইটেরিয়া অনুযায়ী ফিরোজাকে চিহ্নিত করেন। প্রধানমন্ত্রীর পৈতৃক বাড়ি ও জন্মস্থান গোপালগঞ্জের টুঙ্গিপাড়া উপজেলার গোপালপুরেও এমন একজন মা আছেন। নাম নন্দিতা মণ্ডল। ব্যক্তি পর্যায়ে শুরু হওয়া প্রকল্পটি এখন চলছে সরকারের মা ও মাতৃত্ববান্ধব প্রকল্প হিসেবে। এর আগে এক পর্যায়ে স্পেনের রানি সোফিয়ার পৃষ্ঠপোষকতায় এ এইচ নোমানের প্রতিষ্ঠান ডর্পের আবেদনে স্পেন সংস্থা এইসিআইডির সহায়তায় দেশের ৫ উপজেলায় স্বপ্ন প্যাকেজ ২০০৯-১২ পর্যন্ত সফলভাবে বাস্তবায়ন করেছে। পরে মহিলা ও শিশুবিষয়ক মন্ত্রণালয়ের আওতায় দেশের ১০ উপজেলায় পাইলট আকারে স্বপ্ন প্যাকেজ বাস্তবায়ন হয়। এর উপকারভোগীরা অত্যন্ত দরিদ্র্র, ভিটামাটিহীন ও অবহেলিত। সংসারে অভাব ও দুঃখকষ্ট লেগেই থাকত। জীবনে জীবিকা দূরে থাক মাথা গোঁজার জায়গাও ছিল না। প্রশিক্ষণ কাজে লাগিয়ে শাকসবজির চাষ, হাঁস-মুরগি লালন-পালনে তাদের ভাগ্য বদলে গেছে। কেউ কেউ দোকান দিয়েছেন, কলা বাগান করেছেন, মাছের চাষ করছেন। গোবর দিয়ে মুঠা তৈরি করে আয় করছেন। তারা এখন স্বাবলম্বী। দুয়েকজন জাতীয় পর্যায়ে পুরস্কারও পেয়েছেন। ইনোভেটিভ এ প্রকল্পটি দেখভাল করছে মহিলাবিষয়ক অধিদপ্তর। প্রথম দিকে শর্তযুক্ত টার্গেটকৃত মা চিহ্নিতকরণে কিছুটা হাসি-মশকরা ছিল। সরকারের সঙ্গে রাজস্ব খাতে অন্তর্ভুক্তির জন্য অনেক দরবার করতে হয়েছে। ২০০৭-০৮ এর তত্ত্বাবধায়ক সরকার আমলে গরিব মাদের জন্য এ মাতৃত্বকালীন ভাতা বাজেটে অন্তর্ভুক্ত হয়। ৩ হাজার ইউনিয়নে ৪৫ হাজার মাকে মাসে ৩০০ টাকা হারে ২ বছর মেয়াদে ভাতা প্রদান শুরু হয়। পরবর্তী সময়ে ২০০৯-১০ থেকে সামাজিক নিরাপত্তা জালের আওতায় এর বিস্তার ঘটে। ২০২২-২৩ অর্থবছরে কলেবর বেড়ে মাসে ৮০০ টাকা হারে ৪ বছর মেয়াদে ১২ লাখ গরিব মা এই ভাতা পাচ্ছেন। কিন্তু দিবসটি পালনের মাঝে প্রায়ই করপোরেট চর্চা লক্ষণীয়। মাতৃত্বের মর্যাদার চেয়ে মায়ের সৌন্দর্য, ত্বক, খাদ্য রুচিকে সামনে এনে একে নারী দিবসের মতো আরেকটি দিবস বানিয়ে ফেলার চেষ্টা লক্ষণীয়। করপোরেট প্রতিষ্ঠানগুলো তার প্রচার-প্রসারে দিবস উদযাপনে একটু বাড়াবাড়ি করেই থাকে। তাই বলে মে মাসের দ্বিতীয় রবিবারের মা দিবস আর ৮ মার্চের নারী দিবসকে এক করে ফেলায় একটু বোধজ্ঞানের পরিচয় অত্যন্ত প্রত্যাশিত। কিছু পদক-পুরস্কার বা সোশ্যাল মিডিয়ায় মায়ের ছবি আপ করাই দিনটির তাৎপর্য নয়। মাতৃত্বকালীন ছুটি, কর্মস্থলে মায়েদের সুযোগ-সুবিধা নিয়ে আলোচনা যথেষ্ট আছে। এ ধরনের আলোচনায় শিক্ষিত, চাকরিজীবী মাদের বিষয়টি আসে। নদীভাঙন, বেড়িবাঁধে ঝুঁপড়িতে থাকা কৃষি শ্রমিক, ভূমিহীন, দিনমজুর, শহরের বস্তিতে থাকা মায়েরা কি মা নন? তাদের মাতৃত্ব কি আমল দেয়ার বাইরেই থাকবে? দীর্ঘকাল ধরে নানা পর্যায়ে অব্যাহত প্রচেষ্টার পরও বাংলাদেশে গর্ভকালীন জটিলতা এবং সন্তান প্রসবের সময় গড়ে প্রতি ঘণ্টায় একজন করে নারীর মৃত্যু হচ্ছে। এখন পর্যন্ত মাত্র ২১ শতাংশ মা গর্ভকালীন স্বাস্থ্য পরীক্ষা করান। এই একবিংশ শতাব্দীতেও ৮২ শতাংশ নারী সন্তান প্রসবের সময় ডাক্তার বা প্রশিক্ষিত ধাত্রীর সাহায্য পান না। কেন বাংলাদেশে এখনো এই পরিস্থিতি থাকবে? মায়ের সঙ্গে মাতৃত্বকে প্রাসঙ্গিক করলে তা হওয়ার কথা নয়। বিশ্বের সব নারীই মা হয়ে ওঠে মাতৃত্বের মহিমা নিয়ে। নারীর স্বাভাবিক ও জৈবিক মাতৃত্বের ক্ষমতাকে প্রাতিষ্ঠানিকতায় মায়ের শরীর ও মাতৃত্বকে নিয়ন্ত্রণ করে। তাই ‘নারীরা মায়ের জাত’ ‘মাতৃত্বেই নারীর সার্থকতা’ ধরনের মিথগুলো নিয়েও কিছু কথা থেকে যায়। নাড়ির টান মিথটিও সংক্ষিপ্ত ও আপেক্ষিক। এর পুরোটাই সন্তানের সঙ্গে মায়ের নিরবচ্ছিন্ন যোগাযোগ আর মনোযোগের সম্পর্ক। এখানে সন্তান জন্মদানের জৈবিক ক্ষমতার সঙ্গে সামাজিকভাবে নির্মিত মাতৃত্বের ভূমিকাকে মিলিয়ে না ফেলাই ভালো। মাতৃত্ব মানে সন্তানকে স্নেহ দিয়ে, যতœ দিয়ে শারীরিকভাবে ও মানসিকভাবে বিকাশপ্রাপ্ত হতে সাহায্য করা। তাই পুরুষরাও চাইলে মাতৃত্ব অর্জন করতে পারেন। সন্তানের সঙ্গে বাবারও নাড়ির টান গড়ে উঠতে পারে। পৃথিবীতে প্রচুর একা বাবা আছেন যারা পূর্ণ মাতৃত্ব দিয়েই সন্তান বড় করছেন। আবার অনেক নারী আছেন যারা সন্তান গর্ভে না ধরেও চমৎকার ‘মা’ হয়েছেন। মাকে বলা হয় সর্বংসহা, ধরিত্রী। কথার কথা না হয়ে এসব উপমায় মাতৃত্বের বোধ হোক নারীর জন্য আত্মসমৃদ্ধির। পুরুষ ও নারীর সঙ্গে সঙ্গে মাতৃত্ব সার্থক হোক, পুরুষও মহিমান্বিত হোক। মাতৃত্বের সংজ্ঞা কেবল গর্ভধারণ এবং সন্তান জন্মদানে সীমাবদ্ধ না থাকুক। মাদার তেরেসা, বেগম রোকেয়া, নবাব ফয়জুন্নেসাদের মা হয়ে উঠতে কিন্তু গর্ভধারণ করতে হয়নি। একজন বাবাও কিন্তু হয়ে উঠতে পারেন মা, যেমন একজন মা হয়ে উঠতে পারেন বাবা। যাবতীয় বিবেচনায় দিবসটি বাংলাদেশের মাদের জন্য আশা জাগানিয়া। সরকার স্বপ্ন প্যাকেজের মাধ্যমে মাকে যে মর্যাদা দিয়েছে তা আংশিক হলেও সাহস ও দীপ্ত প্রত্যয়নে মাদের এগিয়ে নিচ্ছে। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের অসমাপ্ত আত্মজীবনীর ৮৭ নম্বর পৃষ্ঠার কয়েকটি লাইন এখানে বড়ই প্রাসঙ্গিক… ‘যে ছেলেমেয়েরা তাদের বাবা-মায়ের স্নেহ থেকে বঞ্চিত, তাদের মতো হতভাগা দুনিয়াতে আর কেউ নেই। আর যারা বাবা-মায়ের স্নেহ আর আশীর্বাদ পায়, তাদের মতো সৌভাগ্যবান কয়জন’? মোস্তফা কামাল : সাংবাদিক ও কলাম লেখক; বার্তা সম্পাদক, বাংলাভিশন। [email protected]

সাবস্ক্রাইব ও অনুসরণ করুন

সম্পাদক : শ্যামল দত্ত

প্রকাশক : সাবের হোসেন চৌধুরী

অনুসরণ করুন

BK Family App