×

মুক্তচিন্তা

সুদান সংঘাত আর মানবতার অবদমন

Icon

অনলাইন ডেস্ক

প্রকাশ: ১২ মে ২০২৩, ১২:২১ এএম

সুদান সংঘাত আর মানবতার অবদমন

ক্ষমতার রাজনীতি আর ক্ষমতার দ্ব›দ্ব আমাদের প্রধান সমস্যা। পৃথিবীজুড়েই এই দুটি বিষয় অত্যন্ত স্পর্শকাতর অবস্থানে আছে। যারা এই ক্ষমতার প্রকল্প নিয়ে কাজ করেন, তাদের দুটি দিক চিন্তার মধ্যে থাকে। এক. যদি তিনি রাজনীতিক হন, তাহলে তার কাছে রাজনৈতিক কলাকৌশলই প্রধান উপাত্ত হয়ে ওঠে। আর রাজনীতিক যদি দীর্ঘকাল ক্ষমতায় থাকেন, যেমন সুদানের ওমর আল বশির, তাহলে তিনি বা তারা ধীরে ধীরে অন্ধ, লোভী, হিতাহিত জ্ঞানশূন্য হয়ে কর্তৃত্ববাদী হয়ে ওঠেন। তখন আর গণতান্ত্রিকভাবে নির্বাচিত হওয়ার যে রেওয়াজ বা জনগণের ইচ্ছাকে তারা প্রাধান্য দেন না। যেমন জার্মানির হিটলারও দেননি। তখন সেনাবাহিনী, পুলিশ বা আধা সামরিক বাহিনীর ওপর নির্ভরশীল হয়ে ক্ষমতাকে সংহত করে নেয়। সেটা হয়ে ওঠে এক ভয়ংকর রাজনীতির সামরিকীকরণ, যেখানে জনগণ থাকে বহুদূরে এবং তারা হয়ে পড়ে পক্ষে-বিপক্ষের সংঘাতের রাজনৈতিক ও সামরিক শিকার। পাকিস্তান তার এক উদাহরণ। সে দেশের সামরিক বাহিনী মূলত ভোগ করে রাজনৈতিক সরকারের ব্যাকবোনের ক্ষমতা। ফলে কোনো বেসামরিক নির্বাচিত সরকারের কাজ সেনাদের কাছে তাদের স্বার্থহানির হয়ে দাঁড়ায়। পাকিস্তানে ইমরান খানের নির্বাচিত সরকারকে হটিয়ে শাহবাজ শরিফকে ক্ষমতায় এনে দেশটিকে রাজনৈতিকভাবে ভঙ্গুর করে ফেলা হয়েছে। এটা করেছে সে দেশের সামরিক বাহিনী। এতে করে সেই দেশের জনজীবন হয়ে পড়ে মৃত্যুর মিছিলের অধীন। পাকিস্তানের শরিফ সরকার গত ৯ মে ইমরান খানকে গ্রেপ্তার করেছে। ফলে গোটা দেশে এখন চলছে পিটিআইর প্রতিবাদী আন্দোলন। সেই আন্দোলনের ঝুঁকি সামলাতে সরকারকে আশ্রয় নিতে হবে সামরিক দমনের। কারণ সামরিক বাহিনীর আশীর্বাদপুষ্ট ব্যবস্থা পাকিস্তানি ইতিহাসের এক পুরনো রাজনৈতিক রোগ। এই রোগটি দেশটিকে ভেতর থেকে খুবলে খেয়েছে। এখন কেবল গোটা প্রশাসন ও সরকারি দপ্তর ভেঙে পড়ার বাকি। ৮ লাখ সদস্যের পাকিস্তানি সামরিক বাহিনীর খাসলত হচ্ছে নৃশংসভাবে দমন, যার খেসারত তারা দিয়েছে ১৯৭১ সালে বাংলাদেশে, মুক্তিযোদ্ধাদের কাছে পরাজিত হয়ে। পূর্ব পাকিস্তান এখন স্বাধীন হয়ে তার বিজয়ের ৫২ বছর অতিক্রম করছে। এবং আমাদের রাজনৈতিক পরিস্থিতি সামরিক বাহিনীর খপ্পর থেকে রাজনৈতিক ইতিহাসের ৩১ বছর অতিক্রম করছে। মাঝখানে সামরিক বাহিনীর নাজুক হস্তক্ষেপ গেছে ২০০৬-০৮ সালে। সেই পরিস্থিতি টপকে বাংলাদেশ এখন রাজনৈতিকভাবেই কেবল অগ্রসর হয়নি, অর্থনৈতিকভাবেও উন্নতি করছে। আমি বলতে চাই পৃথিবীর যেসব দেশে সামরিক শাসন বা সামরিক বাহিনীর নিয়ন্ত্রণ ও কর্তৃত্ব সুস্পষ্ট, সেসব দেশের সার্বিক পরিস্থিতি জনগণের অনুকূল নয়। সেই সঙ্গে যেসব দেশের গণতান্ত্রিক সরকার কর্তৃত্ববাদী হয়ে উঠেছে, জনগণের সাংবিধানিক অধিকার পথে বাধা হয়ে উঠেছে, সেই সব দেশের সার্বিক উন্নয়ন নানারকম দুর্নীতি আর অব্যবস্থায় কণ্টকিত। সেখানে জনগণের জন্য গৃহীত উন্নয়ন প্রোগ্রামের সুফল জনগণ ভোগ করতে পারে না। মুষ্টিমেয় দলীয় মানুষ সেই ফল ভোগ করে। এর উদাহরণ গোটা পৃথিবীর দেশের তালিকায় বাংলাদেশও আছে।

দুই. সুদানের সাম্প্রতিক সামরিক সংঘাত তারই আর এক উদাহরণ। দেশটির রাজধানী খার্তুম এখন সামরিক সংঘাতের কেন্দ্রে। সেখান থেকে বিদেশি মানুষরা সরে যাচ্ছেন বা সংশ্লিষ্ট দেশগুলো তাদের নাগরিকদের সরিয়ে নিয়ে যাচ্ছে। বাংলাদেশেরও কিছু মানুষ খার্তুমে ছিলেন বা আছেন, তাদেরও সরিয়ে নিয়ে আসা হচ্ছে। সেনাবাহিনী প্রধান জেনারেল আবদেল ফাত্তাহ আল বুরহান ও আধা সামরিক বাহিনী প্রধান জেনারেল মোহাম্মদ হামদান দাগালোর ক্ষমতা ভাগাভাগি নিয়ে যে দ্ব›দ্ব তা মূলত র‌্যাপিড সাপোর্ট ফোর্সেসকে (আরএসএফ) সেনাবাহিনীতে আত্তীকরণ নিয়ে। আর আত্তীকরণের পর সেনাপ্রধান কে থাকবেন, সেই প্রশ্নেই মূলত জেনারেল বুরহানের সঙ্গে ক্ষমতার বিরোধ আজ গড়িয়েছে সামরিক সংঘাতের নগ্ন-নিষ্ঠুরতায়। এই দুই জেনারেল আবদেল ফাত্তাহ আল বুরহান হচ্ছেন সেনাবাহিনীর প্রধান আর জেনারেল মোহাম্মদ হামদান দাগালো ওরফে হেমেদতি হচ্ছেন আধা সামরিক বাহিনী আরএসএফের প্রধান। এই দুই জেনারেল মিলে ৩০ বছর ধরে ক্ষমতায় থাকা ওমর আল বশিরকে ক্ষমতাচ্যুত করেন। সে ঘটনা ২০১৯ সালের। তখনই জেনারেল দাগালোকে সেনাবাহিনী প্রধানের ডেপুটি বা দ্বিতীয় প্রধান করা হয়েছিল। এখন জেনারেল দাগালো চান সেনাবাহিনী প্রধান হতে। কেননা জেনারেল বুরহান এখন রাষ্ট্রক্ষমতার প্রধান হিসেবে আছেন। অর্থাৎ দুজন দুই বাহিনীর প্রধান হলেও ক্ষমতা ও সব প্রশ্নে সমান অধিকার ও ক্ষমতা ভাগাভাগি। সাম্প্রতিক হানাহানির সূচনা এই ক্ষমতার দ্ব›দ্ব নিয়েই। দেশটিতে কোনো বেসামরিক সরকার নেই। মূলত এই দুজনই দেশটির সামরিক ও রাজনৈতিক ক্ষমতাকে দখল করে রেখেছেন। দারফুরের মানুষ জেনারেল দাগালো হচ্ছেন আরবীয় বংশজাত। আর জেনারেল বুরহান দেশটির উত্তরাঞ্চলের মানুষ। আরএসএফ গঠন করা হয় ২০১৩ সালে। কথিত জানজাওয়িদ মিলিশিয়া গ্রুপের সদস্যদের নিয়েই এই আধা সামরিক বাহিনী গঠন করা হয়। দারফুর অঞ্চলে যুদ্ধাপরাধের অভিযোগে অভিযুক্ত এই জানজাওয়িদ মিলিশিয়া গ্রুপ। ২০০০-এর দশকে দারফুর সংঘাতের সময় ওমর আল বশির সরকার বিদ্রোহ দমনে সেনাবাহিনীকে সাহায্য করার জন্য এই মিলিশিয়া গোষ্ঠীকে ব্যবহার করে। ২০১৭ সালে ওমর আল বশির এই গোষ্ঠীকে আনুষ্ঠানিকভাবে একটি আধা সামরিক বাহিনী হিসেবে স্বীকৃতি দিতে একটি আইন পাস করেন। এই আইনের ফলে আরএসএফ একটি স্বতন্ত্র বাহিনীর রূপ পায়। ক্ষমতা কীভাবে ব্যবহার করতে হয় তা জেনারেল দাগালো জানেন। তিনি ২০১০ থেকেই ওমর আল বশিরকে ব্যবহার করে স্বর্ণখনি, নির্মাণ খাত ও খামার ব্যবসার রশিটি নিজের আয়ত্তে নিয়ে আসেন। ফলে তার আর বশিরের কাছ থেকে কিছু পাওয়ার নেই। তিনি ২০১৭ সালে আইনের মাধ্যমে তার বাহিনীকে রাষ্ট্রীয় কাঠামোর মধ্যে আনতে সক্ষম হন। তিনি তখন সেনাবাহিনী প্রধান জেনারেল বুরহানের সঙ্গে হাত মিলিয়ে বশিরের বিরুদ্ধে বিক্ষুব্ধ মানুষের পক্ষে এসে অভ্যুত্থান ঘটিয়ে বশিরকে ক্ষমতাচ্যুত করেন। এভাবেই সুদানের ক্ষমতার কেন্দ্রে উঠে আসে আরবীয় উট চড়ানো গোত্রের বুদ্ধিমান দাগালো। দমিডল ইস্ট কাউন্সিল অন গেøাবাল অ্যাফেয়ার্সের পররাষ্ট্র নীতি ও নিরাপত্তা কর্মসূচির পরিচালক আদিল আব্দেল গাফার বলেন, ক্ষমতার দিক দিয়ে দ্রুত উত্থানের সঙ্গে ওমর আল বশিরের মাধ্যমে দাগালোর ব্যবসায়িক অবস্থানও সংহত হতে থাকে। দাগালোর পরিবার স্বর্ণখনি, নির্মাণ খাত ও খামার ব্যবসা সম্প্রসারিত করে। এই দাগালো পরে প্রেসিডেন্ট ওমর আল বশিরের বিরুদ্ধে অবস্থান নেন। ২০১৯ সালে সুদানে বিক্ষোভ শুরু হলে বশিরকে উৎখাতের পর সামরিক বাহিনীর নেতৃত্বাধীন সরকারে তিনি উপ-প্রধানের দায়িত্ব গ্রহণ করেন। (প্রথম আলো/১ মে/২৩)

তিন. ক্ষমতা মানুষকে অন্ধ ও আগ্রাসী শক্তিতে পরিণত করে। তখন সে তার স্বার্থের জন্য যা খুশি করতে পিছপা হয় না। দুই জেনারেলের মধ্যে দ্ব›েদ্বর পাটাতনে ওই কেন্দ্রীভূত ক্ষমতাই রয়েছে। সেখানে জনগণ অত্যন্ত গৌণ। তাদের সুখ-দুঃখের খবর রাখে না কোনো পক্ষই। মানুষের খাদ্য নিরাপত্তা যে চরম হুমকির মুখে জেনারেলদের তা চোখে পড়ে না, মনেও দাগ ফেলে না। তাদের অস্ত্র আর খাদ্যের কোনো সংকট নেই, হলে তাদের মনেও শঙ্কা জেগে উঠত। তাদের যুদ্ধের সরঞ্জামেরও ঘাটতি নেই। হলে তারা অস্ত্রবিরতি নয়, যুদ্ধ শেষ করার চেষ্টা চলাত। ৪ এপ্রিল খার্তুমে গোলা বর্ষণের কথা স্বীকার করে জেনারেল বুরহান বলেছেন, আরএসএফের ঘাঁটি নিশ্চিহ্ন করেই তিনি ক্ষান্ত হবেন। অন্যদিকে আরএসএফ প্রধান বিবিসিকে দেয়া এক সাক্ষাৎকারে বলেছেন সেনাবাহিনী অস্ত্র পরিত্যাগ না করলে বা অস্ত্র রেখে আলোচনায় না বসা পর্যন্ত আমি আলোচনার টেবিলে যাব না। জেনারেল দাগালো সংঘাত নিরসনে আলোচনায় বসতে সম্মত, কিন্তু সেনাপ্রধান জেনারেল ফাত্তাহ আল বুরহান অনেকটাই যুদ্ধংদেহী। ফলে বিশ্বের ক্ষমতাধর দেশগুলো সুদানে শান্তি আনার যে প্রক্রিয়া চালিয়েছিলেন তা অনেকটাই থমকে আছে। সুদানে শান্তি আনার পেছনে আন্তর্জাতিক সমাজের রাঘববোয়ালদের প্রয়াসের পেছনে আছে সুদানের স্বর্ণসহ মূল্যবান ধাতুর বাণিজ্য। যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য, সৌদি আরব, জাতিসংঘসহ অন্যান্য আঞ্চলিক শক্তিশালী দেশ উভয়পক্ষের মধ্যে সমঝোতা সৃষ্টি করে সংঘাত অবসানের চেষ্টা চালাচ্ছে। বেশ কয়েকবারই দুই জেনারেল অস্ত্রবিরতি করে। কিন্তু দুই-তিন দিনের অস্ত্র বিরতি কোনো সুফল দেয়নি। সর্বশেষ অস্ত্রবিরতির পরও রাজধানী খার্তুমে বিমান হামলা চালিয়েছে সেনাবাহিনী। সুদানের রাজনৈতিক পরিস্থিতির তেমন কোনো খবর নেই। দুই বাহিনীর সংঘাতে দেশের মানুষ যে খাদ্য নিরাপত্তার অভাবে মারাত্মকভাবে পুষ্টি সংকটে পড়েছে, সেটা তারা একবারও উচ্চারণ করেনি। কতটা খারাপ অবস্থা যে দেশের শিশু-কিশোর আর যুবকদের শারীরিক অপুষ্টি তার একটি নমুনা দেয়া যাক। সংঘাতের কারণে রাজধানী খার্তুমে বাড়ির ভেতরে অবরুদ্ধ হয়ে আছেন লাখো বাসিন্দা। অনেকে খাবার ও পানির অভাবে রয়েছেন। দুই পক্ষের মধ্যে লড়াইয়ে দেশটিতে একটি মানবিক সংকট সৃষ্টি হয়েছে। অনেক স্থানে লুটপাট ও অগ্নিসংযোগের ঘটনা ঘটেছে। সংবাদের এই ভাষ্যই বলে দিচ্ছে গৃহবন্দি সুদানিজরা কেমনতর খাদ্য ও পানির সংকটে আছেন। এই বিষয়টি যে মানবাধিকার হরণ তা কি দুই জেনারেলের কেউ একজন ভেবেছেন? না ভাবেননি। জেনারেল হেমেদিতে বলেছেন বুরহানের বাহিনী গোলাগুলি বন্ধ না করলে কোনোরকম আলোচনায় তিনি বসবেন না। জেনারেল বুরহানেরও এটা বোঝা উচিত যে দেশের মানুষ মানবিক সংকটে পড়েছে তাদেরই কারণে। বিষয়টি গভীরভাবে ভেবে দেখা জরুরি। কূটনৈতিক পর্যায়ে যে আলোচনা চলছিল তা ভেঙে পড়ার উপক্রম। কারণ ক্ষমতাবান দেশগুলোর কূটনীতিকদের সরিয়ে নিয়ে যাওয়া হয়েছে। সুদানিজরা ভেবেছিল কূটনীতিকরা যুদ্ধবিরতিসহ এই সংকট নিরসনে বিশেষ ভূমিকা পালন করবেন। জাতিসংঘ মহাসচিব সুদানে তার শান্তি প্রতিনিধি পাঠাচ্ছেন। কিন্তু তা কার্যকরী পদক্ষেপ হিসেবে দেখা দেবে তখনই যখন যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্যসহ শক্তিশালী দেশগুলো বিশেষ ভূমিকা নেবে। আমরা জানি না, ক্ষমতা দ্ব›েদ্বর এই হানাহানি প্রকল্পের শেষ কোথায়?

ড. মাহবুব হাসান : সাংবাদিক ও কলাম লেখক। [email protected]

সাবস্ক্রাইব ও অনুসরণ করুন

সম্পাদক : শ্যামল দত্ত

প্রকাশক : সাবের হোসেন চৌধুরী

অনুসরণ করুন

BK Family App