×

মুক্তচিন্তা

মেয়াদোত্তীর্ণ একজন কাজী সালাউদ্দিন

Icon

অনলাইন ডেস্ক

প্রকাশ: ১২ মে ২০২৩, ১২:২১ এএম

মেয়াদোত্তীর্ণ একজন কাজী সালাউদ্দিন

সাম্প্রতিক সময়ে আলোচনা ও সমালোচনার শীর্ষে বাফুফে এবং বাফুফের কর্মকর্তারা। এককথায় বিতর্কিত তারা। প্রচলিত দলীয় রাজনীতিকদের শিষ্টাচারবহির্ভূত আচরণ থেকেও বাফুফের কর্মকর্তাদের বর্তমান আচরণ নিম্নস্তরের বলা যায়। বিস্মিত হতে হয়েছে, প্রচণ্ডরকম বিস্মিত হয়েছি, হয়েছি লজ্জিত। বিশ্বাস করা কঠিন, অসুস্থ মানসিকতা নিয়ে কী করে তারা জাতীয় ফুটবল ফেডারেশনের মতো একটা গুরুত্বপূর্ণ সংগঠনের বড় বড় চেয়ারে বসে আছেন, বসে থাকেন বা থাকছেন। যার মধ্যে বাফুফের সভাপতি কাজী সালাউদ্দিনের নাম বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। এ কথা তো বলা অনস্বীকার্য, যখন তিনি একজন ফুটবল খেলোয়াড় ছিলেন, তখন তার জনপ্রিয়তা ছিল আকাশচুম্বী। স্বাধীনতা-উত্তর বাংলাদেশে দর্শকদের যে ফুটবলপ্রীতি, তার পেছনে ফুটবলার কাজী সালাউদ্দিনের অবদান বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। যুদ্ধবিধ্বস্ত একটা দেশে যুব ও তরুণ সমাজকে ফুটবলের প্রতি দৃষ্টি নিতে, আগ্রহ বাড়াতে কাজী সালাউদ্দিন, জাকারিয়া পিন্টু, মেজর হাফিজের মতো বেশকিছু খেলোয়াড়ের নাম উল্লেখ করতেই হয়। সবার মাঝে কাজী সালাউদ্দিনের নামটাই যেন মাঠে বেশি ধ্বনিত হতো। পায়ের জাদুতে তিনি ফুটবল খেলেছেন। সেই খেলা দর্শক দেখেছেন, উপভোগ করেছেন, উচ্ছ¡সিত হয়েছেন। এমন কিছু খেলোয়াড়ের পারদর্শিতার কারণেই স্বাধীনতা-উত্তর বাংলাদেশে ফুটবলই হয়ে ওঠে সবচেয়ে জনপ্রিয় এক খেলা। সত্য যে, মাঠে দর্শকদের উপস্থিতি একজন কাজী সালাউদ্দিনের ফুটবল খেলার পারদর্শিতাকে যেমন উপভোগ করার বিষয়টিকে নিশ্চিত করেছিল, ঠিক তেমনি মাঠে উপস্থিত নয় এমন ফুটবলপ্রেমীদের মাঝে প্রচারমাধ্যম কর্মীরা একজন ফুটবল খেলোয়াড় কাজী সালাউদ্দিনের খেলার ক্রীড়া নৈপুণ্য ও পারদর্শিতার সংবাদ পৌঁছে দিয়েছিলেন। অর্থাৎ সালাউদ্দিনকে পরিচিত করেছিলেন। তার ক্রীড়া নৈপুণ্য সম্পর্কে ধারণা দিয়েছিলেন। ক্রীড়া সাংবাদিকরাই খেলোয়াড়দের সঙ্গে দর্শকদের যোগাযোগের ধারাটা অব্যাহত রাখেন, খেলোয়াড়দের ভক্তদের দুয়ারে পৌঁছে দেন। সম্প্রতি কাজী সালাউদ্দিন এই সত্যের যেমন অবমাননা করেছেন, ঠিক তেমনই অমার্জনীয় অপরাধমূলক আচরণ করেছেন সাংবাদিকদের প্রতি। তার শিক্ষা, নৈতিক মূল্যবোধ ও সামাজিক মর্যাদা আজ প্রশ্নবিদ্ধ। সাংবাদিকরা ক্ষুব্ধ হয়েছেন, মর্মাহত হয়েছেন। আর গোটা জাতি হয়েছে লজ্জায় অবনত। জীবনচক্রের সবকিছুরই একটা সময়সীমা থাকে। তেজ ও উদ্দীপনা থাকে। প্রকৃতির নিয়মে এক সময়ে সেসব স্তিমিত হয়ে আসে। কাজী সালাউদ্দিন এই প্রকৃতির নিয়মের বাইরে নন। আমরাও নই। দাপুটে খেলার নৈপুণ্য একসময়ে স্তিমিত হয়ে আসবে- এটাই নিয়ম। সালাউদ্দিনের খেলার সক্ষমতা স্তিমিত নিঃসন্দেহে। কিন্তু জনপ্রিয় ব্যক্তিদের জীবনব্যাপী কাজ করার সুযোগ থাকে। অনেকেই সেই সুযোগ করে নেন, নতুবা লুফে নেন। খেলার সক্ষমতা শেষ হলেও সমাজের প্রতি তাদের দায়বদ্ধতা থাকে, যা তৈরি করেন তার অনুরাগীরা। জনপ্রিয়তার সিঁড়ি বেয়ে সাধারণত মানুষ একটা মর্যাদাকর অবস্থানে বিচরণ করার ইচ্ছে পোষণ করে, স্বপ্ন দেখে। সেটাই আধুনিকতা ও সভ্যতার বড় দৃষ্টান্ত। তাদের কাছ থেকে সমাজ ভালো কিছু আশা করে। প্রতিটি মানুষেরই দায় ও দায়িত্ব থাকে সমাজকে ভালো কিছু দেয়ার। সেলিব্রেটি হলে তার দায় বহু গুণে বেড়ে যায়। কারণ সাধারণ মানুষ যাকে ভালোবাসে তার কাছ থেকে ভালো কিছু পেতে উন্মুখ থাকে। সাকিব আল হাসান, তামিম ইকবাল, মাশরাফির মতো খেলোয়াড় কিছু বললে সাধারণ মানুষ সেটাকেই বেছে নেয়। এটা ঠিক, ফুটবল খেলোয়াড়দের চেয়ে ক্রিকেট খেলোয়াড়দের প্রভাব ও জনপ্রিয়তা সঙ্গত কারণে বেশি। যাই হোক, কোনো কারণে সমাজে প্রিয় খেলোয়াড়দের নিয়ে কোনো অনাকাক্সিক্ষত ঘটনা ঘটলে খেলোয়াড়ের চেয়ে তার ভক্তরা বেশি কষ্ট পায়। এমন আবেগ-অনুভূতি ও প্রতিক্রিয়ার ধারক ও বাহক হলো মিডিয়া তথা সাংবাদিক। শুধু খেলোয়াড়ই নয়, ভক্তকুলও তৈরি হয় সংবাদ প্রচার মাধ্যমে। বলা যায়, কাজী সালাউদ্দিন এসবের কিছুই মনে রাখেননি কিংবা তিনি হয়তো বয়সের কারণে ডিমেনশিয়া আক্রান্ত। যেটাই হোক বিষয়টি অত্যন্ত দুঃখজনক ও শিষ্টাচারবহির্ভূত। ফুটবলের প্রতি কাজী সালাউদ্দিন বা বাফুফের কর্মকর্তাদের ভূমিকা, অবদান বলার মতো নেই বলেই অনেকের ধারণা। আগে ফুটবল মাঠে দর্শক থাকত ঠাসা, এখন হাতেগোনা। বছর বছর কোটি কোটি টাকা বরাদ্দও হয়, ফলাফল তেমন দেখা যায় না। যথাসময়ে বাফুফের নির্বাচন হয়। সভাপতি, সাধারণ সম্পাদকসহ কর্মকর্তারা নির্বাচিত হন। ভালো পরিমাণ বাজেটও বরাদ্দ হয়। কিন্তু খেলার গুণগতমান বৃদ্ধি পায় না, উন্নতি হয়নি। ফুটবল আগের মতো জনপ্রিয় হয়ে ওঠে না। বাফুফের বদৌলতে যা হয়েছে তা হলো, ২০০৮ সালে প্রথম দফায় বাংলাদেশ ফুটবল ফেডারেশনের (বাফুফে) সভাপতি হিসেবে কাজী সালাউদ্দিন আসন গ্রহণ করেন এবং যা আজো আছেন। বহাল তবিয়তে তিনি একই পদে আছেন এবং রাজত্ব চালিয়ে আসছেন। তার আসনের যেমন কোনো পরিবর্তন আসেনি, তেমন আসেনি ফুটবলে পরিবর্তন বা উন্নয়ন। তার আমলে বিশ্ব র‌্যাঙ্কিংয়ে বাংলাদেশ ফুটবল অনেক নেমে গেছে। প্রায় ১৫ বছর তার কোনো জবাবদিহিতা কেউ নিয়েছেন কিনা, সেটাও জানা নেই। অবস্থাদৃষ্টে মনে হয়, কাজী সালাউদ্দিনের মাথার ওপর সম্ভবত একটা ফকফকা আকাশ ছিল। তাই তিনি দায়মুক্ত থেকেছেন। তার দায়মুক্তি তাকে বেপরোয়া করেছে। সাফ ফুটবলে মেয়েদের সাফল্যের পেছনে বড় অবদান বর্তমান সরকারপ্রধানের যেমন, তেমন প্রতিটি মেয়ে খেলোয়াড় ও তার পরিবারের এবং সর্বোপরি কোচদের। সামাজিক প্রতিকূল পরিবেশে অপ্রতিরোধ্য মনোবলে মেয়েরা নিজেদের তৈরি করেছে এবং বিজয় সাফল্য ছিনিয়ে এনেছে। এমন বিজয়ে বাফুফের সভাপতির ম্রিয়মাণ উল্লাস বা আচরণ কোনোটাই ভালো লাগেনি। তিনি এয়ারপোর্টে গিয়ে বিজয়ী মেয়েদের অভ্যর্থনা জানাননি। অথচ তা তিনি জানাতে পারতেন। তার খোঁড়া যুক্তি অনেকেই পছন্দ করেনি। ফেডারেশন অফিসে বসে তিনি অপেক্ষা করেছেন তাদের অভিনন্দন জানাতে। অথচ একজন শ্রদ্ধেয় শিক্ষক জাফর ইকবাল স্যার আমাকে উচ্ছ¡সিত হয়ে বলছিলেন, চাঁদ থেকে ফিরলে নীল আর্মস্ট্রংদের দেখার জন্য, অভিনন্দন জানানোর জন্য প্রথম রাস্তায় নেমেছিলাম, আর দ্বিতীয়বার রাস্তায় নেমেছিলাম সাফ ফুটবলে বিজয়ী মেয়েদের দেখতে ও অভিনন্দন জানাতে। এ যে কত বড় প্রাপ্তি বিজয়ী মেয়েদের জন্য, তা বলার অপেক্ষা রাখে না। জাফর ইকবাল স্যার একা নন, এমন অনেকেই বাঁধভাঙা উচ্ছ¡াসে ভেসেছেন। যাই হোক, বাফুফের সভাপতি কাজী সালাউদ্দিনের উচ্ছ¡াসকে সে দিন প্রাণবন্ত লাগেনি। বরং বিরক্ত লেগেছে। লেগেছে কৃত্রিম। প্রশ্ন, কেন বাফুফের সভাপতি সালাউদ্দিন ও অন্য কর্মকর্তারা সাংবাদিকদের ওপর চটে গেলেন। উত্তর যেটা এখন বাজারে চালু, সেটা হলো সাংবাদিকদের অনুসন্ধানী দৃষ্টি বাফুফের অনেক অনিয়মের তথ্য প্রকাশ করছেন, যাতে কিনা তারা বিব্রত। জানা যায়, সাম্প্রতিককালে বাফুফের সাধারণ সম্পাদক সোহাগের আর্থিক অনিয়মের কারণে ফিফার অভিযোগ উত্থাপিত হয়েছে। তার বিরুদ্ধে আর্থিক জরিমানাও করা হয়েছে। এতে বাংলাদেশের ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ন হয়েছে। রাষ্ট্রকে হেয় করার ধৃষ্টতা কখনোই চূড়ান্ত শাস্তির বাইরে থাকতে পারে না বলেই প্রায় সবার অভিমত। যে কাজটি করেছে এবং যার উদাসীনতা বা সম্পৃক্ততায় কাজটি হয়েছে, সবাইকেই শাস্তি ও জবাবদিহিতার আওতায় আনা বাঞ্ছনীয় এবং সেটা প্রকাশ্যে। সালাউদ্দিনের এমন ন্যক্করজনক আচরণের পেছনকার কারণ হিসেবে কেউ কেউ বলছেন, সম্প্রতি অনুষ্ঠিত বাংলাদেশ স্পোর্টস প্রেস অ্যাসোসিয়েশনের (বিএসপিএ) ৬০ বছর পূর্তি উপলক্ষে সংগঠনটি দেশের স্বাধীনতা অর্জনের ৫০ বছরে সেরা ক্রীড়াবিদ হিসেবে নির্বাচিত করেছে ক্রিকেটার সাকিব আল হাসানকে। যেখানে দ্বিতীয় অবস্থানে রাখা হয়েছে ফুটবলার কাজী সালাউদ্দিনকে। এটাই নাকি সাংবাদিকদের ওপর চটে যাওয়ার মূল কারণ। তিনি ক্ষোভের সঙ্গে বাফুফের সভা ডেকে প্রেস বিজ্ঞপ্তির মাধ্যমে সেই পুরস্কার প্রত্যাখ্যান করেছেন। তার ক্ষোভ এতটাই লাগামহীন ও শিষ্টাচারবহির্ভূত ছিল, তা বর্ণনাতীত। তিনি বলেছেন, ফুটবল ফেডারেশনে ঢোকার সময় সাংবাদিকরা যেন তাদের বাবার জুতা পরা ছবি দিয়ে প্রবেশ করেন। কী সাংঘাতিক স্পর্ধার কথা! সাবেক ফুটবলার, ক্রীড়া সাংবাদিক, এমনকি ক্রীড়ামন্ত্রী পর্যন্ত ক্ষুব্ধ ও ক্ষোভ প্রকাশ করেছেন। পরিশেষে বলব, সক্ষমতা ও যোগ্যতারও একটা মেয়াদ থাকে। ফুটবলার হিসেবে অনেক আগেই কাজী সালাউদ্দিন মেয়াদোত্তীর্ণ হয়েছেন। দৃঢ়ভাবে বলতে পারি, বাফুফের সভাপতিত্ব করার বিষয়টিও মেয়াদোত্তীর্ণ। সংশ্লিষ্টদের বিষয়টি ভেবে দেখার অনুরোধ জানাই। আর সাংবাদিকদের অভিভাবকদের প্রতি তার যে কুরুচিপূর্ণ বক্তব্য, তার জন্য সম্মিলিতভাবে সাংবাদিকরা মানহানির মামলা করতে পারে। একটা দৃষ্টান্তমূলক নজির থাকুক না!

স্বপ্না রেজা : কথাসাহিত্যিক ও কলাম লেখক। [email protected]

সাবস্ক্রাইব ও অনুসরণ করুন

সম্পাদক : শ্যামল দত্ত

প্রকাশক : সাবের হোসেন চৌধুরী

অনুসরণ করুন

BK Family App