×

মুক্তচিন্তা

বিবিএসের জরিপে বেকারত্ব বনাম উন্নয়ন পরিকল্পনা

Icon

অনলাইন ডেস্ক

প্রকাশ: ০৯ মে ২০২৩, ১২:২৩ এএম

বিবিএসের জরিপে বেকারত্ব বনাম উন্নয়ন পরিকল্পনা

সম্প্রতি শ্রমশক্তি জরিপ ২০২২ প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরো (বিবিএস)। বিবিএসের জরিপে বলা হয়েছে, দেশে বেকারের সংখ্যা ২৬ লাখ ৩০ হাজার, যার মধ্যে ১৬ লাখ ৯০ হাজার পুরুষ আর ৯ লাখ ৪০ হাজার নারী। এ সময় বেকারত্বের হার ৩ দশমিক ৬ শতাংশ অথচ ৫ বছর আগে ২০১৬-১৭ সালে সংখ্যাটি ছিল ২৭ লাখ। ক্রমবর্ধমান অর্থনৈতিক সংকটে যেখানে বেকারত্বের হার বেড়েছে, বিশেষ করে কোভিড-১৯ চলাকালে অনেককেই কর্মস্থল থেকে ছাঁটাই করা হয়েছে, বর্তমানেও রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ, ডলারের বিপরীতে টাকার অবমূল্যায়নের পরিপ্রেক্ষিতে কর্মসংস্থানে স্থবিরতা বিরাজ করছে, সেখানে বিবিএসের জরিপ যে বাস্তবতার সঙ্গে কতটুকু সামঞ্জস্য, তা নিয়ে প্রশ্ন রয়েছে। ২০১৬-১৭ অর্থবছরে বাংলাদেশে কাজে নিয়োজিত মানুষের সংখ্যা ছিল ৬ কোটি ৮ লাখ। ৫ বছরের ব্যবধানে ২০২২ সাল শেষে দেশে এ সংখ্যা হয় ৭ কোটি ৭ লাখ ৮০ হাজার। এই ৫ বছরে দেশে ৯৯ লাখ ৮০ হাজার নতুন কাজের ক্ষেত্র তৈরি হয়েছে, যেখানে এই সংখ্যক মানুষ এসব কাজে যুক্ত হয়েছেন। এই তথ্য বিশ্লেষণে দেখা যায়, প্রতি বছর দেশে নতুন করে ২০ লাখ মানুষের চাকরি হয়েছে, পাশাপাশি বেকারত্বের হার ৪ দশমিক ২ শতাংশ থেকে কমে নেমে এসেছে ৩ দশমিক ৬ শতাংশে। সপ্তাহে যারা এক ঘণ্টা কাজ করেছেন, তাদের কর্মরত ধরা হয়েছে। যারা বাসায় ২টি মুরগি পালন করেছেন তাদেরও কর্মরত ধরা হয়েছে। অবশ্য এক্ষেত্রে আন্তর্জাতিক শ্রম সংস্থার (আইএলও) বেকারত্বের সংজ্ঞার কথা বলা হচ্ছে। আইএলওর ১৮৭টি সদস্য রাষ্ট্র যারাই শ্রম জরিপ করে, এ সংজ্ঞাগুলো অনুসরণ করে। এর বাইরে বিভিন্ন দেশের জন্য অভিন্ন মানসম্মত সংজ্ঞা এখনো নির্ধারণ হয়নি বলে আইএলওর দাবি। বস্তুত আইএলওর জরিপে সপ্তাহে অন্তত ১ ঘণ্টা মজুরির বিনিময়ে কাজ করার সুযোগকে কর্মসংস্থানে নিয়োজিত হিসেবে ধরা হয়েছে। এমনকি পরিবারের জন্য হাঁস-মুরগি পালন করলেও বেকার বলা যাবে না এমন মানদণ্ডও রয়েছে। আবার উৎপাদনশীল কাজে মজুরি না পেলেও বেকার না বলার কথা বলা হয়েছে। এ রকম সংজ্ঞা বাংলাদেশের মতো উন্নয়নশীল দেশের ক্ষেত্রে প্রযোজ্য কিনা, সেটি মোটা দাগে চিহ্নিত করা যায়। আবার বিবিএসের জরিপে আইএলওর সংজ্ঞাকে মাধ্যম হিসেবে ব্যবহার করা হলেও আইএলও বেকারত্বের আলাদা পরিসংখ্যান প্রকাশ করে থাকে। আইএলওর আরেকটি প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে, বাংলাদেশে বেকারের সংখ্যা ৩ কোটি। যা কয়েক বছরে তা দ্বিগুণ হয়ে ৬ কোটিতে দাঁড়াবে, যা মোট জনসংখ্যার ৩৯ দশমিক ৪০ শতাংশ হবে। আইএলওর হিসাবটিকেই পর্যবেক্ষকরা বাংলাদেশের প্রকৃত বেকারের সংখ্যা বলে মনে করেন। যদি তাই হয়, তাহলে বিবিএসের জরিপে আইএলওর অন্যান্য সংজ্ঞাকে পাশ কাটিয়ে যে সংজ্ঞার আলোকে বেকারত্ব কম দেখানো যাবে এমন সংজ্ঞাকে বেছে নেয়ার কারণ কী? একটা বিষয় তো সহজে বোধগম্য, বিভিন্ন জরিপের আলোকেই উন্নয়ন পরিকল্পনা সাজানো হয়ে থাকে। এক্ষেত্রে বেকারত্ব জরিপে যদি বেকার সংখ্যা কম দেখানো হয়, সেটি তো পরবর্তী পদক্ষেপগুলোকে ক্ষতিগ্রস্ত করবে। কারণ সঠিক তথ্যের আলোকে সামগ্রিক কর্মপরিকল্পনা প্রণয়ন করা যাবে না। যেমন কর্মসংস্থানের ক্ষেত্রে সরকারি দপ্তরগুলোয় যে শূন্য পদগুলো রয়েছে, সেগুলো পূরণে প্রত্যাশিত গতি দুষ্কর হয়ে উঠবে। এছাড়া সামগ্রিক উন্নয়নসহ দেশের আইনশৃঙ্খলা রক্ষায় প্রয়োজনীয় সিদ্ধান্ত প্রণয়নও সম্ভব হবে না। কারণ বেকারত্ব বৃদ্ধি পেলে অপরাধ সংঘটনের হার বেড়ে যায়, তখন আইন প্রয়োগকারী বাহিনীর প্রয়োজনীয় তৎপরতাও বৃদ্ধির প্রয়োজন হয়। আইএলও, বিশ্বব্যাংক, কমনওয়েলথের হিসাব মতে, এক দশকে বেকারত্বের হার বেড়েছে ১ দশমিক ৬ শতাংশ, বাংলাদেশ অর্থনীতি সমিতির এক গবেষণায় বলা হয়েছে, বাংলাদেশে বছরে ২২ লাখ মানুষ শ্রমবাজারে প্রবেশ করছে, এদের মধ্যে মাত্র ৭ লাখ মানুষের কর্মসংস্থান হয়। এর মধ্যে শিক্ষিত-অশিক্ষিত বেকার রয়েছে। দেশের একটি ইংরেজি দৈনিকে প্রকাশিত প্রতিবেদন অনুযায়ী দেশে উচ্চশিক্ষিত বেকার প্রায় পৌনে এক কোটি। প্রতি বছর এর সঙ্গে বেকারদের নতুন তালিকা যুক্ত হচ্ছে। পরিসংখ্যানগত তথ্য অনুযায়ী, বাংলাদেশে কর্মসংস্থানের সবচেয়ে বড় মাধ্যম বেসরকারি প্রতিষ্ঠান। এসব প্রতিষ্ঠান শতকরা ৯৫ ভাগ কর্মসংস্থান করে। এর মধ্যে এককভাবে সবচেয়ে বেশি কর্মসংস্থান করছে পোশাক শিল্প, এ খাতে প্রায় ৪০ লাখ লোক কাজ করছে। বেকারত্ব নিয়ে বিবিএসের যে জরিপ দেখানো হয়েছে তাতে দারিদ্র্যের সঙ্গে সংযোগ ঘটানো হয়নি। পরিসংখ্যান ব্যুরোর হিসাবে, দেশে এখনো ৪ কোটির বেশি মানুষ দারিদ্র্যসীমার মধ্যে রয়েছে, যা মোট জনসংখ্যার ২৪ দশমিক ৪৭ শতাংশ। বিশ্বব্যাংকের হিসাব মতে, যে ব্যক্তির দৈনিক আয় ১ দশমিক ২৫ ডলার বা প্রায় ৯৭ টাকা সে দরিদ্র। এ হিসাবে দেশের ৪ কোটিরও বেশি মানুষ দৈনিক এ আয় করতে পারছে না, তারা দরিদ্র রয়ে গেছে। এর সঙ্গে বেকার বা যার কোনো আয় নেই তা যুক্ত হয়ে দেখা যাচ্ছে, দেশের প্রায় অর্ধেক জনগোষ্ঠী দারিদ্র্যসীমা অতিক্রম করতে পারেনি। ২০২২ সালের শ্রমশক্তি জরিপ বলছে, বাংলাদেশে কর্মরত শ্রমিকের মধ্যে ৩ কোটি ২২ লাখ শ্রমিক কৃষি খাতে, শিল্প খাতে ১ কোটি ২০ লাখ ৫০ হাজার আর সেবা খাতে কাজ করেন ২ কোটি ৬৬ লাখ ৫০ হাজার মানুষ। ৫ বছর আগে ২০১৬-১৭ অর্থবছরে বাংলাদেশে কর্মরত শ্রমিকের মধ্যে ২ কোটি ৪৭ লাখ শ্রমিক কৃষি খাতে কাজ করতেন। এখন বেকারত্বের হার কমা আর কৃষি খাতে শ্রমিক বাড়া নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে। উন্নত অর্থনীতিতে কৃষি খাত থেকে শ্রমিক কমে সেবা খাতে বা শিল্প খাতে যায়, বাংলাদেশে এর উল্টো চিত্র দেখা যাচ্ছে কেন- এই প্রশ্নও উঠেছে। এর উত্তরে পরিকল্পনা প্রতিমন্ত্রী বলেন, ‘আমি মনে করি এই কৃষিতে বাড়তি শ্রমিক এটা সাময়িক, এটা আবার ঠিক হয়ে যাবে, আমি বলেছি প্রাথমিক তথ্য প্রকাশ করতে, মূল গবেষণায় তথ্য অন্য রকম আসতে পারে।’ এমন পরিস্থিতিতে পরিসংখ্যান ব্যুরোর জরিপ আরো যাচাই করে নেয়া উচিত ছিল। কারণ আইএলওর যে সংজ্ঞার আলোকে জরিপ করা হয়েছে, তা পুনর্বিবেচনার দাবি রাখে। বিবিএস সপ্তাহে ১ ঘণ্টার কাজকে কর্মসংস্থানের আওতায় নিয়ে এলেও এটি মূলত ছদ্ম বেকারত্ব, যা কৃষিতে বেশি লক্ষণীয়। আমাদের দেশে এমন ছদ্ম বেকারত্ব অনেক আছে। যেমন সপ্তাহে অল্প কিছু সময়/দিন কাজ পায় বাকি সময় পায় না। কিন্তু এ কর্মঘণ্টার আয়ে ব্যক্তি দারিদ্র্যসীমাকে অতিক্রম করতে পারে কিনা তা বিবেচনা করা দরকার। আর উৎপাদনশীল কাজে যুক্ত থেকে পারিশ্রমিক না পেলেও সেটিকে আইএলওর সংজ্ঞায় কর্মসংস্থান গণ্য করা হয়েছে। এটিও দারিদ্র্যকে অতিক্রম করতে পারার সঙ্গে জড়িত। আইএলওর সংজ্ঞার ক্ষেত্রে উদ্ভূত বিতর্ক প্রসঙ্গে বলা যায়, ১৯৭২ সাল থেকে বাংলাদেশ আইএলওর সদস্য হিসেবে এ সংজ্ঞায় সম্মতি দিয়েছে এবং এ সংজ্ঞা বৈশ্বিকভাবে গ্রহণযোগ্য, যে কারণে বাংলাদেশসহ অন্যান্য উন্নয়নশীল দেশ এটি অনুসরণ করে। এর কারণ হলো আন্তর্জাতিক মানদণ্ড বজায় রাখা, আমাদের দেশের কর্মসংস্থানের সংজ্ঞা অন্য দেশের সংজ্ঞার সঙ্গে যেন আলাদা না হয়ে যায়। এখন আয়ের ক্ষেত্রে সেটি আসলে দারিদ্র্য, ক্রয়ক্ষমতা এবং অসমতাকে বোঝায়। শ্রমবাজারের জরিপে মাঠ পর্যায়ে তথ্য সংগ্রহ করার সময় একজন শ্রমিক হয়তো সপ্তাহে ১/২/৩ ঘণ্টা কাজ করতে পারেন, কিন্তু দেখা যাবে যে জরিপ শেষ হওয়ার পরই সে পরের তিন সপ্তাহে ১০ ঘণ্টা কাজ করছেন। এখানে সময়ের ব্যাপারও রয়েছে, যেমন গ্রামীণ এলাকায় কৃষিকাজের ক্ষেত্রে ফসল কাটা ও ঘরে তোলার সময় যদি জরিপ চালানো হয়, তাহলে সবাই বলবে তারা কাজ বেশি করেছে, অন্য মৌসুমে যদি জিজ্ঞাসা করা হয় তাহলে তো বলতে পারবে না বেশি কাজ করেছে। এক্ষেত্রে অনেক ইস্যু থাকে। যে কারণে এটি আসলে বলা যায়, আংশিক দৈবচয়নের ভিত্তিতে করা হয়। তাই কিছু ক্ষেত্রে এটি যেমন পরিপূর্ণ তথ্য দেয়, আর কিছু ক্ষেত্রে প্রকৃত তথ্য দেয় না। এখন বেকারত্ব কি আসলেই কমেছে? এটা আইএলওর বেকারত্বের সংজ্ঞার চেয়ে ভিন্ন প্রসঙ্গ। এক্ষেত্রে বিবিএসের তথ্য কীভাবে সংগ্রহ করা হয়েছে, সেখানে তো আইএলওর ভূমিকা নেই এবং এ তথ্য কতটা নির্ভুল ছিল সেটিও তো প্রশ্নবিদ্ধ হতে পারে। আবার বিবিএস চাইলেই কি প্রকৃত তথ্য প্রকাশ করতে পারবে। এক্ষেত্রে কি রাজনৈতিক ইস্যুও জড়িত নয়? আইএলও এ বিষয়ে নিশ্চিত নয় এবং এটি বলার দায়িত্ব আইএলওর নয় বলে সংস্থাটি দাবি করেছে। কিন্তু বাস্তবতার সঙ্গে অমিল থাকার যে প্রশ্নটি উঠেছে, তাতে আইএলওর সংজ্ঞার আলোকে বিবিএসের জরিপ এবং বেকারত্ব নিয়ে তথ্য নতুন করে বিতর্কেরই জন্ম দিয়েছে। কর্মসংস্থান বৃদ্ধির মাধ্যমে বেকারত্বের হার হ্রাসের ওপর যে জোর দেয়া হয়েছে, তার বাস্তবায়ন নিয়ে সন্দেহ রয়েছে। খধনড়ঁৎ ঋড়ৎপব ঝঁৎাবু ২০১৬-১৭তে দেশে শ্রমশক্তির যুব বেকারত্ব হারের উল্লেখ ছিল মোট শ্রমশক্তির ১০ দশমিক ৬ শতাংশ, এ হার বেড়েছে বলে বিভিন্ন সূত্রে জানা যায়। আইএলওর তথ্যের বরাত দিয়ে গত ৬ জানুয়ারি একটি দৈনিকের প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, দেশে তরুণ বেকারের সংখ্যা ৭ কোটি ৩৫ লাখ। অর্থনীতির সংজ্ঞামতে, বেকারত্ব ও দারিদ্র্য একই মুদ্রার এপিঠ-ওপিঠ। সামাজিক নিরাপত্তা কর্মসূচি দারিদ্র্য হ্রাসের একটি উপায় হিসেবে আন্তর্জাতিকভাবে চিহ্নিত হলেও দেশে এ কর্মসূচি দারিদ্র্য হ্রাসে কাক্সিক্ষত সাফল্য বয়ে আনতে পারছে না। যার কারণগুলোর মধ্যে রয়েছে- অর্থ বরাদ্দের স্বল্পতা, উপকারভোগী নির্বাচনে অনিয়ম, দুর্নীতি এবং বিভিন্ন মন্ত্রণালয় ও সংস্থার মধ্যে সমন্বয়ের অভাব। এ ধরনের একটি পরিস্থিতিতে পরিসংখ্যান ব্যুরোর জরিপ কতটুকু গবেষকদের স্বস্তি দেবে তা ভেবে দেখার বিষয়। তবে বিভিন্ন উৎসের একই বিষয়ের তথ্যের ভিন্নতা নতুন কিছু নয় এবং এ ব্যাপারে গবেষকদের নিজস্ব বুদ্ধিমত্তা কাজে লাগাতে হবে। তবে বেকারত্ব হ্রাসে সরকারের কর্মসূচি, যা বর্তমানে চলমান রয়েছে তার শতভাগ বাস্তবায়ন জরুরি এবং সরকারের শেষ বছরে যে বাজেট আগামী জুন মাসে আসছে, তাতে বেকারত্ব নিরসনের বিষয়টি যেন অধিক গুরুত্ব পায় তা বিবেচনায় রাখতে হবে।

ড. মিহির কুমার রায় : কৃষি অর্থনীতিবিদ ও গবেষক; ডিন, সিটি ইউনিভার্সিটি। [email protected]

সাবস্ক্রাইব ও অনুসরণ করুন

সম্পাদক : শ্যামল দত্ত

প্রকাশক : সাবের হোসেন চৌধুরী

অনুসরণ করুন

BK Family App