×

সারাদেশ

ধান-চাল সংগ্রহে লক্ষ্যমাত্রা পূরণ নিয়ে সংশয় 

Icon

কাগজ প্রতিবেদক

প্রকাশ: ০৮ মে ২০২৩, ০৮:৪২ এএম

ধান-চাল সংগ্রহে লক্ষ্যমাত্রা পূরণ নিয়ে সংশয় 

ছবি: সংগৃহীত

কৃষকদের আগ্রহ স্থানীয় বাজারে

২৬ হাজার টাকা পেয়ে ৩ হাজার টাকা ঘুষ

সুনামগঞ্জের ছাতক উপজেলার গোবিন্দগঞ্জ সৈদেরগাঁও ইউনিয়নের দয়ারাই গ্রামের কৃষক সঞ্জয় তালুকদার জানান, সরকারের কাছে ধান বিক্রি করতে যেসব নিয়ম মানতে হয় তা পূরণে ৪-৫ দিন ঘুরতে ঘুরতে তিনি ক্লান্ত হয়ে পড়েন। ধান বিক্রি করতে আগ্রহী সব কৃষককেই এমন ভোগান্তির শিকার হতে হয়। সেই নিয়ম মানার পর নিজে ভ্যান ভাড়া দিয়ে উপজেলা সদর ছাতকে নিয়ে গিয়ে ধান দিয়ে আসতে হয়। সেখানে নেয়ার পর নানা অজুহাতে কৃষকদের কাছ থেকে বাড়তি ‘খরচ’ নেয়া হয়। সেই সঙ্গে কয়েক দিনের শ্রমঘণ্টা নষ্ট হয়। যে কারণে সরকারের কাছে না বেচে ধান ব্যবসায়ীর কাছে কিছু কমে বিক্রি করে দেন তিনি।

ছাতকের উত্তর খুরমা ইউনিয়নের আব্দুল কুদ্দুস বলেন, সরকারের কাছে ধান বিক্রি করতে গেলে হয়রানির শিকার হতে হয়। দিনের পর দিন হাঁটো! তাছাড়া এ বছর ১২শ টাকা মণ দরে ধান ব্যবসায়ীরা ধান কিনছে। তাই হয়রানির শিকার হয়ে সরকারের কাছে বিক্রি করার ইচ্ছে থাকে না। মাঠপর্যায়ে এমন চিত্রের মধ্যেই গত রবিবার থেকে সরকার ধান-চাল কেনার কাজ শুরু করেছে।

গতকাল খাদ্যমন্ত্রী সাধন চন্দ্র মজুমদার এই কার্যক্রমের উদ্বোধন করেন। এ মৌসুমে অভ্যন্তরীণ বাজার থেকে ১৬ লাখ ৫০ হাজার টন ধান ও চাল কিনবে সরকার। এর মধ্যে চার লাখ টন ধান, ১২ লাখ ৫০ হাজার টন সিদ্ধ চাল সংগ্রহের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছে। প্রতি কেজি বোরো ধানের সংগ্রহমূল্য ৩০ এবং সিদ্ধ চাল ৪৪ টাকা।

সংশ্লিষ্টদের অভিযোগ, গেলবারের মতো এবারো সরকার নির্ধারিত লক্ষ্যমাত্রা ধরে ধান-চাল কিনতে পারবে না। সরকারি ধান-চাল কিনতে কৃষকরা যে হয়রানির মুখে পড়েন- তা থেকে রেহাই পেতে তারা স্থানীয় বাজারেই ধান বেচে দেন। ফলে সরকার কৃষকের কাছ থেকে কিনতে পারে না। সঙ্গত কারণেই লক্ষ্যমাত্রাও পূরণ হয় না। তবে সরকারের তরফে খাদ্য মন্ত্রণালয় বলছে, এবার আশা করা হচ্ছে- নির্ধারিত লক্ষ্যমাত্রা অনুযায়ী সরকার ধান-চাল কিনতে পারবে।

খাদ্য মন্ত্রণালয় সূত্রে জানা গেছে, দেশজুড়ে সরকার ধান-চাল কেনার জন্য জেলাওয়ারি তালিকা করে খাদ্য নিয়ন্ত্রক কর্মকর্তা ও জেলা প্রশাসকদের কাছে পাঠিয়েছে। এতে দেখা গেছে, সবচেয়ে বেশি ধান রংপুর বিভাগ থেকে কিনবে সরকার। এই বিভাগ থেকে ৬৫ হাজার ৯৮৪ টন ধান কেনা হবে। এছাড়া রাজশাহী বিভাগে ৬৫ হাজার ৮১৭, ঢাকা বিভাগে ৫৮ হাজার ৮৫০, খুলনা বিভাগে ৫১ হাজার ৬৮৪, চট্টগ্রাম বিভাগে ৫০ হাজার ৭২, সিলেট বিভাগে ৩৫ হাজার ৫৩৬, বরিশাল বিভাগে ১৬ হাজার ২৩১ এবং ময়মনসিংহ বিভাগে ৫৫ হাজার ৮২৬ টন ধান কিনবে সরকার।

জানতে চাইলে বগুড়া জেলা খাদ্য নিয়ন্ত্রক কাজী সাইফুদ্দিন গতকাল ভোরের কাগজকে বলেন, ধান-চাল কিনতে সরকার দর বাড়ানোর কারণে এবার পরিস্থিতি ভিন্ন। উৎপাদনও বেশি। এছাড়া বাজারের চাহিদা অনুযায়ী সরকার ধান-চাল কেনার দামও বাড়িয়ে দিয়েছে। এতে কৃষকরা খুশি হওয়ায় সরকারও লক্ষ্যমাত্রা অনুযায়ী ধান-চাল কিনতে পারবে।

অনুসন্ধানে জানা গেছে, সরকার ধান-চাল কেনার দাম বাড়ালেও কৃষকরা সেখানে ধান বেচতে আগ্রহী নয়। তারা দুয়েক শ টাকা কমে স্থানীয় বাজারেই ধান বিক্রি করছেন। অন্যদিকে স্থানীয় ব্যবসায়ীরাও সুযোগ বুঝে কৃষকের বাড়ি চলে যাচ্ছেন। ধান মাড়াই হওয়ার পর যে কৃষকরা ধান বিক্রি করতে চাচ্ছেন তাদের কাছ থেকে ধান কিনে আনছেন। এতে কৃষকরাও খুশি।

নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক একজন কৃষক ভোরের কাগজকে বলেন, গত মৌসুমে সরকারের কাছে ২৫ মণ ধান বিক্রি করার জন্য তিনি মনোনীত হয়েছিলেন। যথারীতি ধান রোদে শুকিয়ে এক হাজার টাকা ভাড়া দিয়ে ট্রাক্টর দিয়ে ২৫ মণ ধান তিনি উপজেলা খাদ্যগুদামে নিয়ে যান। সেখানে ধান নেয়ার পর সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তা দুটো ধান মুখে দিয়ে দাঁত দিয়ে কাটেন। তারপর বলেন, আপনার ধান কম শুকানো হয়েছে। এই ধান নেয়া যাবে না। উপায়ান্তর না পেয়ে ওই কৃষক কর্মকর্তাকে পাঁচশ টাকা হাতে ধরিয়ে দেন। টাকা পেয়ে ওই কর্মকর্তা শ্রমিকদের নির্দেশ দিয়ে বলেন, ধানগুলো নামিয়ে পরবর্তী কাজ শেষ করো। শ্রমিকরা ট্রাক্টর থেকে ধান নামিয়ে বস্তা থেকে তা খুলে খোলা জায়গায় রাখেন। এ সময় শ্রমিকরা কৃষককে বলেন, আপনার ধানে খড় বেশি রয়েছে। এই ধান স্যার দেখলে নেবে না। তখন ওই কৃষক শ্রমিকদের বলেন, আপনারা ঠিক করে দিন। এ জন্য আরো ৭শ টাকা দিলেন। তারপর আরেকজন কর্মকর্তা এসে বললেন, আপনার ধানে আর্দ্রতা কম। এই ধান নিলে সরকারের পছন্দসই চাল পাওয়া যাবে না। এই ধান সরকার কিনে কী করবে? এই কর্মকর্তাকে আরো ৫ শ টাকা দিলেন। তারপর কয়েকটি সইসাবুদ করার পর প্রায় ২৬ হাজার টাকা পেলেন এই কৃষক। টাকা পাওয়ার পর কয়েকজন শ্রমিক এসে বললেন, আপনার ধানের জন্য কত পরিশ্রম করলাম। চা-সিগারেটের টাকা দিন। তাদের কথা শুনে ওই কৃষক আরো ৩শ টাকা দিলেন।

সব মিলিয়ে ট্রাক্টর ভাড়া এক হাজার, তিন খাতে ঘুষ বাবদ সতেরশ টাকা এবং চা-সিগারেট বাবদ ৩শ টাকা, মোট ৩ হাজার টাকা খরচ করতে হলো ওই কৃষককে। ‘লাভের গুড় পিঁপড়ে খাওয়ার মতো’ অবস্থা জানিয়ে ওই কৃষক বলেন, সরকারের কাছে ধান বিক্রি না করলে আমাকে ওই তিন হাজার টাকা খরচ করতে হতো না। এতসব বাধা পেরিয়ে তিনি সরকারের কাছে ধান বিক্রি করবেন কেন- পাল্টা প্রশ্ন ওই কৃষকের।

কৃষকের এসব বক্তব্যকে অস্বীকার করে সুনামগঞ্জ জেলা খাদ্য নিয়ন্ত্রক মোহাম্মদ মঈনুল ইসলাম ভূঞা জানান, কৃষকরা আমাদের কাছে ধান বিক্রি করতে এ বছর আরো বেশি আগ্রহ প্রকাশ করেছেন।

গতকাল ভোরের কাগজের সঙ্গে আলাপকালে তিনি জানান, সরকারের কাছে ধান বেচতে হলে ৩-৪ দিন হাঁটতে হয়- এমন তথ্য সঠিক নয়। কেননা মাঠপর্যায়ে ব্লক সুপারভাইজারের কাছে ময়েশ্চারাইজার মিটার আছে। তাদের কাছে নিয়ে গেলেই নির্দিষ্ট মাত্রায় শুকানো ধানের পরীক্ষা করা যায়। তবে এটা ঠিক- সরকারের কাছে ধান বেচতে হলে, চিটামুক্ত ও ঝরঝরে শুকনো ধান হতে হবে। তাছাড়া মৌসুমে ধান বিক্রির টাকা কৃষকের একাউন্টে চলে যাবে, তাতে কোনো ধরনের হয়রানি হওয়ার আশঙ্কা নেই।

কিশোরগঞ্জের নিকলী উপজেলার টেংগুরিয়া গ্রামের কৃষক মৃত আব্দুল ছোবানের ছেলে মুকশুদুর রহমান শান্তি এবং দামপাড়া কামাল্পুর গ্রামের মৃত সদর উদ্দিনের ছেলে কামরুল ইসলাম বলেন, অন্যান্য বছরের তুলনায় এবার কৃষি উপকরণের দাম বাড়ায় বোরো ধান উৎপাদনে খরচ বেশি। ৩৫ শতাংশ জমিতে হালচাষে ডিলার ১২শ, বীজধান ৬শ, বীজতলা নির্মাণ ৮শ, সার ১২শ, কীটনাশক ৬শ, নিড়ানি ১২শ, পানিসেচ ২ হাজার একশ, ধানকাটা ৪ হাজার, ধানমাড়াই এক হাজার, শুকানো ও অন্যান্য ৫শ, জমি লিজ ৫ হাজার- প্রান্তিক চাষিদের মোট খরচ হচ্ছে ১৮ হাজার একশ। ৩৫ শতাংশ জমিতে ধান হবে প্রায় ১৮ মণ। বর্তমানে প্রতি মণ ধানের মূল্য ৮শ টাকা। ১৮ মণ ধানের দাম হয় ১৪ হাজার ৪ শত টাকা। তাই ধান কাটায় কৃষকের মুখে এবার হাসি নেই। হাওড়ের যে সমস্ত জমিতে ব্রি ২৮, ব্রি ২৯, ব্রি ৮৯ ধানে ব্লাড এবং ছত্রাক রোগে আক্রান্ত হয়েছিল।

কৃষক সূত্রে জানা যায়, আক্রান্ত ধান কেটে আনলেও এ ধানগুলোর ভেতরে চাল পরিপূর্ণ না হওয়ায় এসব ধান ৪শ টাকা দরেও নিচ্ছে না বেপারিরা। এখানকার কৃষক পরিবার তাদের সারা বছরের সংসার খরচ, ছেলেমেয়েদের শিক্ষা, চিকিৎসাসহ সবকিছুই নির্বাহ করে থাকে বোরো ফসলের উপার্জিত অর্থ থেকে। আর এ অঞ্চলের ৯০ শতাংশ মানুষই কৃষির সঙ্গে সম্পৃক্ত। যারা ভূমিহীন পরিবার তারাও অন্যের জমি লিজ নিয়ে মাথার ঘাম পায়ে ফেলে অনেক স্বপ্ন নিয়ে মাঠে ধান আবাদ করে থাকে। ছত্রাক রোগে আক্রান্ত হওয়ায় প্রান্তিক কৃষকরা দিশাহারা।

জানতে চাইলে উপজলা কৃষি কর্মকর্তা মো. বেলায়েত হোসাইন বলেন, আমাদের পরিসংখ্যান অনুযায়ী ১৪ হাজার ৫শ হেক্টর উঁচু এবং নিচু জমিতে ১৬ প্রজাতির বোরো ধান চাষ করা হয়েছে। হাওড়ে এখন পর্যন্ত প্রায় ৫০ ভাগ ধান কাটা হয়েছে। কোনো প্রাকৃতিক দুর্যোগ না হলে ভালোভাবে বাকি জমিগুলোর ধান কাটা শেষ করবে কৃষকরা। ব্রি ২৮ ও ব্রি ২৯ ধান চাষ করে যারা ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে যদি সরকার কোনোরূপ সাহায্য করে তবে প্রকৃত ক্ষতিগ্রস্ত কৃষকদের মধ্যে তা বিতরণ করা হবে।

হবিগঞ্জের চুনারুঘাট উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা মো. নাহিদুল ইসলাম বলেন, চুনারুঘাটে চলতি মৌসুমে ১১ হাজার ৭২০ হেক্টর জমিতে ২৮ ও ২৯ জাতের বোরো ধানের চাষ হয়েছে। বাম্পার ফলন হয়েছে। এবার পরীক্ষামূলক ৩৩ শতকের ১০টি প্লটে ‘বঙ্গবন্ধু-১০০’ জাতের ধান চাষ হয়েছে। এতে ভালো ফলন হয়েছে। আগামীতে ব্রি ২৮ ধানের পরিবর্তে ব্রি ৮৮, ৮৯ ও বঙ্গবন্ধু-১০০ ধান চাষে উৎসাহিত করা হবে কৃষককে। এ জাতের ধানে রোগবালাই কম হয় বলে জানান ওই কর্মকর্তা।

(প্রতিবেদন তৈরিতে তথ্য দিয়ে সহায়তা করেছেন ভোরের কাগজের ছাতক প্রতিনিধি শংকর দত্ত।)

সাবস্ক্রাইব ও অনুসরণ করুন

সম্পাদক : শ্যামল দত্ত

প্রকাশক : সাবের হোসেন চৌধুরী

অনুসরণ করুন

BK Family App