×

সারাদেশ

লক্ষ্মীপুরে আ.লীগের গলারকাঁটা কাশেম জেহাদী

Icon

কাগজ প্রতিবেদক

প্রকাশ: ০৭ মে ২০২৩, ১২:০৮ পিএম

লক্ষ্মীপুরে আ.লীগের গলারকাঁটা কাশেম জেহাদী

ছবি: ভোরের কাগজ

লক্ষ্মীপুরে আ.লীগের গলারকাঁটা কাশেম জেহাদী

ছবি: ভোরের কাগজ

আবুল কাশেম জেহাদী। লক্ষ্মীপুর সদর পূর্বাঞ্চলে মূর্তিমান এক আতঙ্কের নাম। ১৯৯৬ সালের আগে জামায়াতের রাজনীতির সাথে সম্পৃক্ততার কারণে নামের শেষে জেহাদী শব্দটি উপহার দেয়া হয় তাকে। সেই থেকে তার নাম আবুল কাশেম জেহাদী।

জনশ্রুতি রয়েছে, লক্ষ্মীপুর সদর পূর্বাঞ্চলের বশিকপুর থেকেই সন্ত্রাসের বীজ বপন হয় আবুল কাশেম জেহাদীর হাত ধরে। এরপর, এই অঞ্চলের ৯টি ইউনিয়নে ছড়িয়ে পড়ে ২২টি সশস্ত্র সন্ত্রাসী বাহিনী। ১৯৯৬ সালের ১২ জুনের জাতীয় নির্বাচনে আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় আসলে আবুল কাশেম জেহাদী বোল পাল্টে আওয়ামী লীগে যোগ দেন।

এরপর থেকেই তার সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ডের পরিধি আরো প্রসারিত হতে থাকে। শুরু হয় খুন-জখম, চাঁদাবাজিসহ নানা ধরনের অপরাধ। ১৯৯৬ সালের শেষ দিকে এবং ২০২১ সাল পর্যন্ত ক্ষমতায় থাকাকালীন সময়ে শুধু আওয়ামী লীগেরই বিভিন্ন ইউনিয়নে ২৯ জন নেতাকর্মী খুন হয়েছেন। একই সময়ে বিএনপিসহ অন্যান্য রাজনৈতিক দলের নেতাকর্মীও খুন হয়।

২০০১ সালের ১ অক্টোবরের নির্বাচনে বিএনপি-জামায়াত জোট ক্ষমতায় আসলেও হত্যার রাজনীতি অব্যাহত থাকে। এ সময় বশিকপুর, দত্তপাড়া, উত্তর জয়পুর, হাজিরপাড়া, চন্দ্রগঞ্জ, চরশাহী, মান্দারীসহ সদর পূর্বাঞ্চলে বিভিন্ন নামে সন্ত্রাসী বাহিনী মাথাছাড়া দিয়ে ওঠে। হত্যা, মারামারি, চোখ উপড়ে ফেলা, বাড়ি-ঘরে অগ্নিসংযোগ, প্রবাসীদের থেকে চাঁদাবাজি নানাবিধ অপরাধ কর্মকাণ্ড চলতে থাকে।

২০১৩, ১৪ ও ১৫ সালে চলমান সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করেন, তৎকালীন পুলিশ সুপার শাহ মিজান শাফিউর রহমান। সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে ওই অভিযানে বিরাজমান ২২টি সশস্ত্র বাহিনীর কতিপয় সদস্য ও বাহিনী প্রধানরা নির্মূল হলেও বশিকপুর ইউনিয়নকে সন্ত্রাসমুক্ত করা সম্ভব হয়নি। জেলা আওয়ামী লীগের কতিপয় নেতার আশীর্বাদে বেঁচে যায় শীর্ষ সন্ত্রাসী আবুল কাশেম জেহাদী।

এদিকে আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর সাঁড়াশি অভিযানে বিভিন্ন বাহিনীর প্রধানরা বন্দুকযুদ্ধে নিহতসহ অনেকে বিদেশে পাড়ি জমালেও তাদের ব্যবহৃত অস্ত্র উদ্ধার না হওয়ায় এখনো বিক্ষিপ্তভাবে বশিকপুর, দত্তপাড়াসহ কিছু কিছু এলাকায় সন্ত্রাসীরা মাঝে মাঝে হত্যাকাণ্ডে মেতে ওঠে।

সর্বশেষ গত ২৫ এপ্রিল রাতে বশিকপুর ইউনিয়নের নাগেরহাটে সন্ত্রাসীদের গুলিতে নিহত হন জেলা যুবলীগের সাবেক সাধারণ সম্পাদক আব্দুল্লাহ আল নোমান ও জেলা ছাত্রলীগের সাবেক সাংগঠনিক সম্পাদক রাকিব ইমাম। এ ঘটনার মাত্র ৬/৭ মাস আগে একই এলাকায় খুন হয় আলাউদ্দিন নামে যুবলীগের আরো এক কর্মী।

[caption id="attachment_428176" align="alignnone" width="1229"] ছবি: ভোরের কাগজ[/caption] সাম্প্রতিক জোড়াখুনের ঘটনায় নড়েচড়ে বসে প্রশাসন। খুনিদের ধরতে মাঠে নামে র‌্যাব-পুলিশসহ আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর বিভিন্ন সংস্থা। ঘটনার পর থেকে গত এক সপ্তাহে জোড়াখুনের ঘটনায় জড়িত ১১জনকে গ্রেপ্তার করা হয়। কিন্তু, অধরা থেকে যায় হত্যা মামলার প্রধান আসামি আবুল কাশেম জেহাদী।

র‌্যাব-১১ এর সিপিসি-৩ নোয়াখালী ক্যাম্পের কোম্পানি কমান্ডার লে. মাহমুদুল হাসান জানান, আবুল কাশেম জেহাদী ১৯৯৬ সালে নিজ নামে জেহাদী বাহিনী গড়ে তোলেন। তার সন্ত্রাসী বাহিনীর সদস্য সংখ্যা প্রায় ৩০০ জন। এ বাহিনীর মাধ্যমে আধিপত্য বিস্তার করে এলাকায় চাঁদাবাজি, টেন্ডারবাজি, খুনসহ বিভিন্ন অপরাধমূলক কার্যক্রম পরিচালনা করে আসছিল।

তিনি আরো জানান, জেহাদী ২০১৩ সালে দত্তপাড়া ইউপি চেয়ারম্যান নুর হোসেন শামীম হত্যা মামলা, ২০০০ সালে লক্ষ্মীপুরের আইনজীবী নুরুল ইসলাম, দত্তপাড়া এলাকার আবু তাহের, বশিকপুরের নন্দীগ্রামের মোরশেদ আলম, করপাড়ার মনির হোসেন, উত্তর জয়পুরের সেলিম ভূঁইয়া ও কামাল হোসেন হত্যা মামলাসহ সাম্প্রতিক চাঞ্চল্যকর বশিকপুর ইউনিয়নের জোড়াখুনের মামলার প্রধান আসামি। তাকে গ্রেপ্তারে র‌্যাবের কার্যক্রম অব্যাহত রয়েছে বলে জানান র‌্যাবের এই কর্মকর্তা।

লে. মাহমুদুল হাসান জানান, বিগত ২০২১ সালের ২৮ ডিসেম্বর ইউপি নির্বাচনে নোমানের বড় ভাই মাহফুজুর রহমানের কাছে বিপুল ভোটে পরাজিত হওয়ার ক্ষোভে এ হত্যাকাণ্ড সংগঠিত হয়েছে। মূলত- নিহত যুবলীগ নেতা নোমানের সাংগঠনিক দক্ষতার কারণেই তার ভাই মাহফুজুর রহমান চেয়ারম্যান পদে নির্বাচিত হন। এতে তাদের দুই ভাইয়ের উপর চরম ক্ষুব্ধ হন কাশেম জেহাদী।

অভিযুক্ত আবুল কাশেম জেহাদী জেলার চন্দ্রগঞ্জ থানা আওয়ামী লীগের সহ-সভাপতি এবং বশিকপুর ইউনিয়ন পরিষদের দুইবারের চেয়ারম্যান ছিলেন। অভিযোগ রয়েছে, আবুল কাশেম জেহাদী ৮ মাস আগে চন্দ্রগঞ্জ থানা আওয়ামী লীগের সম্মেলনে কেন্দ্রীয় নেতাদের ঘোষণায় তাকে ৩ নম্বর সাংগঠনিক সম্পাদক করা হয়। কিন্তু, জেলা আওয়ামী লীগের প্রভাবশালী এক নেতার আশীর্বাদে তাকে সাংগঠনিক সম্পাদক থেকে পদোন্নতি দিয়ে কমিটির সহ-সভাপতি পদে রাখা হয়েছে।

এ ব্যাপারে জানতে চন্দ্রগঞ্জ থানা আওয়ামী লীগের সভাপতি আবুল কাশেম চৌধুরীকে তার মোবাইল ফোনে কল করলে তিনি বলেন, কোনো অপরাধীর পক্ষে আমরা নাই। আবুল কাশেম জেহাদী অপরাধী হলে আইন অনুযায়ী ব্যবস্থা নেবে প্রশাসন।

এদিকে জোড়াখুনের ঘটনায় এ পর্যন্ত ১১ জনকে গ্রেপ্তার করেছে র‌্যাব ও পুলিশ। তাদের মধ্যে ৩ নম্বর আসামি দেওয়ান ফয়সাল ও ১৮ নম্বর আসামি কদু আলমগীর জোড়াখুনের সাথে সরাসরি জড়িত দোষ স্বীকার করে ১৬৪ ধারায় আদালতে স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দিয়েছেন। এরা দুজনই আবুল কাশেম জেহাদীর ঘনিষ্টজন বলে জানিয়েছেন স্থানীয় এলাকাবাসী।

অন্যান্য গ্রেপ্তারকৃত আসামিদের আদালতে হাজির করে রিমান্ড আবেদন করলে আদালত প্রত্যেককে পৃথকভাবে ৪দিন করে রিমান্ড মঞ্জুর করেন। বর্তমানে ৫ দিনের রিমান্ডে থাকা মামলার ২ নম্বর আসামি মশিউর রহমান নিশান ও ১৪ নম্বর আসামি আজিজুল ইসলাম বাবলুকে নিয়ে গত ৪ মে রাতে অস্ত্র উদ্ধার অভিযানে বের হয় পুলিশ।

এতে তাদের দেয়া তথ্যমতে হত্যাকান্ডের ঘটনাস্থলের অদূরে মাঠের পাশে কলাবাগান থেকে কলাপাতা মোড়ানো একটি দুনলা দেশীয় বন্দুক ও ৪ রাউন্ড কার্তুজ উদ্ধার করা হয়। পরদিন ৫ মে রাতে রুবেল দেওয়ানের দেওয়া তথ্যমতে নিশানের বাড়ির একটি লাকড়ি ঘর থেকে একটি একনলা বন্দুক ও ১টি কার্তুজ উদ্ধার করে পুলিশ।

দত্তপাড়া পুলিশ তদন্ত কেন্দ্রের ইনচার্জ (পরিদর্শক) বেলায়েত হোসেন বাদী হয়ে তাদের বিরুদ্ধে চন্দ্রগঞ্জ থানায় অস্ত্র আইনে মামলা দায়ের করেন। গ্রেপ্তারকৃত আসামি মশিউর রহমান নিশান বশিকপুর ইউনিয়ন যুবলীগের যুগ্ম আহ্বায়ক। তিনি হত্যা চেষ্টাসহ একাধিক মামলার আসামি এবং বাহিনী প্রধান আবুল কাশেম জেহাদীর দেহরক্ষী। হত্যা মামলার দ্বিতীয় আসামি নিশান। আরেক আসামি ফয়সাল দেওয়ান এজাহারভূক্ত ৩য় আসামি। তিনি রামগঞ্জ উপজেলা স্বেচ্ছাসেবক লীগের যুগ্ম আহ্বায়ক এবং ওই উপজেলা পরিষদের ভাইস চেয়ারম্যান বাচ্চু দেওয়ানের ছোট ভাই। অন্য গ্রেপ্তারকৃত রুবেল দেওয়ানের বিরুদ্ধে চন্দ্রগঞ্জ থানায় মারামারি ও হত্যাচেষ্টাসহ তিনটি মামলা রয়েছে। এরা সবাই সন্ত্রাসী আবুল কাশেম জেহাদী বাহিনীর সক্রিয় সদস্য।

এ ব্যাপারে অভিযুক্ত আবুল কাশেম জেহাদীর ঘটনার পর থেকে মোবাইল ফোন বন্ধ থাকায় তার বক্তব্য নেয়া সম্ভব হয়নি।

এদিকে নিজ দলের উদীয়মান তরুণ দুই নেতার খুনের সাথে আবুল কাশেম জেহাদীর সংশ্লিষ্টতায় তৃণমূলে ব্যাপক ক্ষোভ বিরাজ করছে। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে দাবি উঠেছে, আবুল কাশেম জেহাদীকে দল থেকে বহিষ্কার করার।

বশিকপুরসহ চন্দ্রগঞ্জ থানা এলাকায় আওয়ামী লীগ দলীয় রাজনীতির সাথে সম্পৃক্ত নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক একাধিক নেতা-কর্মী বলেন, আবুল কাশেম জেহাদীর মত লোক আওয়ামী লীগের জন্য এখন গলার কাঁটা হয়ে গেছেন। তাকে দল থেকে বহিষ্কারের বিকল্প নেই।

এ বিষয়ে লক্ষ্মীপুর জেলা আওয়ামী লীগ সভাপতি মিয়া মো. গোলাম ফারুক পিঙ্কু বলেন, আবুল কাশেম জেহাদী আমাদের দলের হলেও আমরা দলীয়ভাবে তার অপরাধের দায় নিতে পারি না।

তিনি জানান, জেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক অ্যাডভোকেট নুরউদ্দিন চৌধুরী নয়ন দেশের বাইরে আছেন। তিনি দেশে আসলে আমরা দলীয় সভা ডেকে আবুল কাশেম জেহাদীর বিরুদ্ধে সিদ্ধান্ত নেব।

গোলাম ফারুক পিঙ্কু আরো বলেন, আমি ব্যক্তিগতভাবে সন্ত্রাসী লালন-পালন পছন্দ করি না। দলের কেউ সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ডের সাথে জড়িত থাকলে আমার কাছে কেউ আশ্রয় প্রশ্রয় পাবে না।

সাবস্ক্রাইব ও অনুসরণ করুন

সম্পাদক : শ্যামল দত্ত

প্রকাশক : সাবের হোসেন চৌধুরী

অনুসরণ করুন

BK Family App