×

জাতীয়

একটি চক্রের হাতেই অপহৃত তিন শতাধিক শিশু!

Icon

কাগজ প্রতিবেদক

প্রকাশ: ০৭ মে ২০২৩, ১২:২৯ পিএম

একটি চক্রের হাতেই অপহৃত তিন শতাধিক শিশু!

ছবি: সংগৃহীত

ঢাকা মহানগর পুলিশের উত্তরা বিভাগের ডিসি মোহাম্মদ মোর্শেদ আলম জানিয়েছেন, গত ৬ থেকে ৭ বছর ধরে এ চক্রটি শিশুদের অপহরণ করে আসছিল। এরপর বাবা-মায়ের কাছ থেকে তাদের ছেড়ে দেয়ায় পুলিশ পর্যন্ত ঘটনাগুলো গড়ায়নি। এরা সাধারণত ৫ হাজার টাকা থেকে ৫০ হাজার টাকা দাবি করত।

তিনজনকে গ্রেপ্তারের তথ্য জানিয়ে শনিবার (৬) ডিএমপি মিডিয়া সেন্টারে আয়োজিত সংবাদ সম্মেলনে এসব কথা জানান তিনি। গত ২৪ মার্চ উত্তরা পূর্ব থানায় নিখোঁজ হওয়া ৬ বছরের শিশুর বিষয়ে একটি সাধারণ ডায়েরি করার পর তা তদন্ত করতে গিয়ে ওই অপহরণকারী চক্রটির সন্ধান মেলে। এরপর গত শুক্রবার উত্তরা-পূর্ব থানা পুলিশ চক্রের মূলহোতা মিল্টন মাসুদ ও তার সহযোগী সাহিনুর রহমান এবং সুফিয়া বেগমকে গ্রেপ্তার করলে বিস্তারিত তথ্য বেরিয়ে আসে।

পুলিশ বলছে, বহু বছর ধরে অপহরণকারী একটি চক্র স্কুল, মাদ্রাসা, কোচিং সেন্টার ও শপিংমলের সামনে থেকে শিশুদের অপহরণ করে এভাবে টাকা হাতিয়ে নিচ্ছিল। অভিভাবকরা টাকা দিয়ে সন্তানকে ফেরত পাওয়ার পর বিষয়টি আর পুলিশকে জানানো হয় না। ৮ থেকে ১৬ বছরের শিশুরা এই চক্রের টার্গেট ছিল।

পুলিশ জানায়, মিল্টন অপহরণ করত, কথিত অনলাইন নিউজ পোর্টালের ‘সাংবাদিক’ শাহিনুর মোবাইল ফাইনান্সিং থেকে মুক্তিপণের টাকা সংগ্রহ করতে। সুফিয়া অপহরণ করা শিশুদের হেফাজতে রাখত। মিল্টন মাদকের কারবারেও জড়িত। তার বিরুদ্ধে ৫টি এবং শাহিনুরের বিরুদ্ধে ঢাকা ও গাজীপুরের বিভিন্ন থানায় ৩টি মামলা রয়েছে।

পুলিশ কর্মকর্তা মোর্শেদ বলেন, অপহরণের পর শিশুদের মারধর বা নির্যাতন করত না। চক্রটি তাদের খাওয়াত, বন্ধুত্বপূর্ণ আচরণ করত এবং এরপর মুক্তিপণ পাওয়া পর শিশুদের ছেড়ে দিত। টাকা না পাওয়া পর্যন্ত চক্রটি শুধু শিশুদের নিয়ে বিভিন্ন এলাকায় ঘোরাফেরা করত। এমন উদাহরণ রয়েছে যে, কখনো কখনো তারা অপহরণের ৩ বা ৪ ঘণ্টা পরে কোনো টাকা না নিয়েও বাচ্চাদের ছেড়ে দিয়েছে। যেসব শিশু তাদের অভিভাবকদের মোবাইল নম্বর জানত, চক্রটি শুধু তাদেরই টার্গেট করত। অপহরণের পর কোনো শিশু যদি তাদের মা-বাবার মোবাইল নম্বর বলতে না পারত, তাহলে মুক্তিপণ না নিয়ে তাদের ছেড়ে দিত।

ডিএমপির উত্তরা বিভাগের এয়ারপোর্ট জোনের এডিসি তৌহিদুল ইসলাম বলেন, গ্রেপ্তার মিল্টন মাসুদ বিভিন্ন স্কুল, মাদ্রাসা, কোচিং সেন্টার ও শপিংমলের সামনে ঘোরাঘুরি করত। ৮ থেকে ১৬ বছর বয়সী কোনো শিশুকে একা পেলে ভাব জমাত। শিশুটির নাম-পরিচয় জিজ্ঞেস করত। এরপর কৌশলে বাবা-মায়ের মোবাইল নম্বর নিত। এক পর্যায়ে বাবা বা অন্য কোনো স্বজন নিজের পরিচিত বলে টার্গেট শিশুকে জানাত মিল্টন। নানা কথাবার্তা বলে ঘটনাস্থল থেকে শিশুকে দূরে নিয়ে যেত। ফাঁকে বাবা বা মাকে মোবাইলে ফোন দিয়ে জানাত, সন্তান তার কাছে রয়েছে। এরপর মুক্তিপণ দাবি করে দ্রুত টাকা দিতে বলত। সাহিনুর মোবাইল ব্যাংকিংয়ের মাধ্যমে সেই টাকা তুলে নিত। টাকার পরিমাণ কম হওয়ায় অপহৃত শিশুদের বাবা-মায়েরা টাকা দিয়ে দিতেন। খারাপ আচরণ না করায় অনেক সময় অপহৃত শিশুটি জানত না যে, সে অপহরণের শিকার হয়েছে।

অপহরণের শিকার হয়ে ফিরে আসা দুই শিক্ষার্থী ও তাদের অভিভাবকদের সঙ্গে কথা হয়। তাদের একজন রাজউক উত্তরা মডেল স্কুলের ছাত্র মাহির আশরাফ জানায়, ৩ মে সে স্কুল থেকে কোচিংয়ে যাওয়ার জন্য অপেক্ষা করছিল। হঠাৎ করেই এক ব্যক্তি তার সঙ্গে কথা বলা শুরু করে। বাবা-মায়ের নাম জানতে চায়। সব জেনে ওই ব্যক্তি তার বাবার ফোন নম্বরও নেয়। সে জানায় যে, তার স্বজনরা পরিচিত। আধা ঘণ্টা তার সঙ্গে কথা বলে ওই ব্যক্তি চলে যায়। এরপর বাসায় ফিরে জানতে পারে সে অপহৃত হয়েছিল।

মাহিরের বাবা মহিউদ্দিন আহমেদ বলেন, তার ছেলে অপহৃত হয়েছে, হাত-পা ভেঙে দেওয়া হবে, চোখ তুলে নেওয়া হবে—এমন হুমকি পাওয়ার পর আর আইনশৃঙ্খলা বাহিনীকে জানানোর সুযোগ পাননি। দ্রুত দাবি করা ২৫ হাজার টাকা অপহরণকারীর দেওয়া মোবাইল ব্যাংকিং নম্বরে পাঠিয়ে ছেলেকে ফেরত পান।

সম্প্রতি উত্তরায় মাদ্রাসাতুল হিকমা ইসলামিয়ার ছাত্র ১২ বছর বয়সী মুত্তাকী হকও এই চক্রের হাতে অপহৃত হয়। ওই ছাত্র জানায়, মাদ্রাসা থেকে বের হয়ে বাসায় যাওয়ার জন্য অপেক্ষা করার সময় এক ব্যক্তি বলেন, ‘তোমার আব্বুর নাম কি বাহার? তোমার বাবা আমার কাছে টাকা পায়। চলো তোমাকে কিছু কেনাকাটা করে দিই।’ কথা বলতে বলতে মায়ের নম্বর চাইলে সে তা ওই ব্যক্তিকে দেয়। এক পর্যায়ে তাকে টঙ্গী বাজারে নিয়ে যাওয়া হয়। সেখানে একটি হোটেলে খাবার খাওয়ানোর জন্য বসিয়ে রেখে চলে যায় ওই ব্যক্তি। পরে তার মা টঙ্গী এসে তাকে বাসায় নিয়ে যান। বাসায় ফিরে ঘটনা জানতে পারে সে।

শিশুটির বাবা বাহার হক বলেন, তার স্ত্রী দুই দফায় ৫ হাজার টাকা করে মোট ১০ হাজার টাকা দিয়ে ছেলেকে ফেরত পান।

উত্তরা-পূর্ব থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) কাজী নাসির উদ্দিন বলেন, তিন অপহরণকারীকে শনিবার আদালতে হাজির করে রিমান্ডের আবেদন করা হয়। দুজনকে তিন দিন করে রিমান্ডে পাওয়া গেলেও সুফিয়া বেগমকে কারাগারে পাঠানোর আদেশ দিয়েছেন আদালত।

সাবস্ক্রাইব ও অনুসরণ করুন

সম্পাদক : শ্যামল দত্ত

প্রকাশক : সাবের হোসেন চৌধুরী

অনুসরণ করুন

BK Family App