×

মুক্তচিন্তা

সিলেটে মেয়র নির্বাচন এবং ‘বহিরাগত’ প্রবাসী

Icon

অনলাইন ডেস্ক

প্রকাশ: ০৬ মে ২০২৩, ১২:১৮ এএম

সিলেটে মেয়র নির্বাচন এবং ‘বহিরাগত’ প্রবাসী

সিলেটের সিটি করপোরেশন নির্বাচন স্থানীয় সরকারের জনপ্রতিনিধি নির্বাচনের একটা অন্যতম প্রধান অংশ। কিন্তু এবারে এ নির্বাচন সিলেটকে ভিন্ন পরিচিতি দিচ্ছে। যেহেতু প্রধান বিরোধী দল বিএনপি এ নির্বাচন বয়কট করছে, খুব স্বাভাবিকভাবেই বিএনপি এ নির্বাচনে দলীয়ভাবে থাকছে না। সে হিসেবে এ নির্বাচনে আওয়ামী লীগের প্রার্থীর ফাঁকা মাঠে গোল করার মতো অবস্থা হওয়ার কথা। কিন্তু এটা কি আদৌ হচ্ছে? কারণ ইতোমধ্যে বিএনপি থেকে নির্বাচিত বর্তমান মেয়র আরিফুল হক চৌধুরী তার প্রার্থিতা হওয়ার ইঙ্গিত দিয়ে সভা-সমাবেশে বক্তৃতা শুরু করেছেন। আর সেজন্যই বিষয়টা আলোচনায় আসছে। আওয়ামী লীগের প্রার্থী যুক্তরাজ্য প্রবাসী আনোয়ারুজ্জামান চৌধুরী, যিনি যুক্তরাজ্য আওয়ামী লীগের প্রভাবশালী নেতা। তিনি প্রধানমন্ত্রীর বোন শেখ রেহানার অত্যন্ত স্নেহভাজন। স্বাভাবিকভাবেই তাই প্রধানমন্ত্রীরও কাছের মানুষ। কিন্তু তারপরও কথা উঠেছে লন্ডন থেকে এসে সিলেট সিটি করপোরেশনের নির্বাচনে কতটা সুবিধা করতে পারবেন তিনি? আওয়ামী লীগ একটা বড় দল, তাছাড়া দীর্ঘদিন থেকে ক্ষমতায়। সিলেটের রাজনীতিতে আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীরা বিভিন্নভাবে আন্দোলন-সংগ্রাম করেছেন, করছেন। সে হিসেবে সিলেটের মতো গুরুত্বপূর্ণ একটা শহরের নির্বাচনে স্থানীয় নেতারাই আশায় আশায় ছিলেন, কিন্তু তাতে বাদ সেধেছে যুক্তরাজ্য আওয়ামী লীগের রাজনীতি। যেহেতু দেশীয় রাজনীতিকে আন্তর্জাতিকীকরণ করা হয়েছে দলীয় সিদ্ধান্তেই। এবং এ দলের সব গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত দলের নেত্রীই নিয়ে থাকেন। এবং তা-ই হয়েছে সিলেটের সিটি করপোরেশনের নির্বাচনকে সামনে রেখে। এতে দলের স্থানীয় প্রার্থীরা অনেকেই ক্ষুব্ধ। কিন্তু স্বাভাবিকভাবেই বিদ্রোহটা প্রকাশ্যে আসেনি। মনোনয়নপ্রত্যাশী কেউই মনোনয়ন না পেয়ে স্বতন্ত্র প্রার্থী হওয়ার ইঙ্গিত পর্যন্ত দেননি। আওয়ামী লীগ-বিএনপির একটা শক্তিশালী ভিত্তি আছে যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য, ইউরোপ এমনকি মধ্যপ্রাচ্যেও। এক সময় দেশে রাজনীতির কর্মীরা বিদেশে এসেও পুরনো নেশাটুকু পরিত্যাগ করতে পারেন না, তাই দেশের বাইরে এসেও দলের ইস্যুগুলো বাস্তবায়নে বদ্ধপরিকর থাকেন। সেজন্য দলীয় রাজনীতিকে সংগঠিত করতে পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে ছড়িয়ে আছেন লাখ লাখ কর্মী। আওয়ামী লীগ কিংবা বিএনপির সুসময়ে ক্ষমতার অংশীদার না হতে পারলেও পার্টির যে কোনো দুঃসময়ে তারা পালন করেন অত্যন্ত শক্ত ভূমিকা। যুক্তরাজ্যের আওয়ামী লীগও এ রকমই। যা এমনকি প্রধানমন্ত্রীও বিভিন্ন সময়ে তার বক্তৃতায় বলে থাকেন। ধরে নিলাম সিলেটের আন্দোলন-সংগ্রামে মেয়র প্রার্থী আনোয়ারুজ্জামান চৌধুরীর বড় কোনো অবদান হয়তো নেই, কিন্তু যুক্তরাজ্যে আওয়ামী লীগ কিংবা যুবলীগের একটা শক্ত ভিত আছে। এই ভিত তৈরিতে যে ক’জন মানুষের নাম নেয়া যাবে, তার মাঝে আনোয়ারুজ্জামানকে প্রথম সারিতেই রাখতে হবে। আর সেজন্যই তিনি শেখ রেহানার তথা প্রধানমন্ত্রীর কাছের মানুষ। তাছাড়া আওয়ামী লীগের বর্তমান সাংগঠনিক কার্যক্রমই তো বলে দেয় ভিন্ন জায়গা থেকে একজন নেতা এসে অন্য জায়গাতেও প্রতিনিধিত্ব করতে পারেন। এখানে উদাহরণ টানতে পারি। সিলেট থেকে আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক সম্পাদক হয়েছেন শফিউল আলম চৌধুরী নাদেল, অথচ তিনি সাংগঠনিক জেলার নেতৃত্ব দিচ্ছেন কুমিল্লার। অর্থাৎ দল সংগঠিত করতে নেতৃত্ব প্রয়োজন, এ নেতৃত্ব দলকে কিংবা জনগণকে কতটুকু দিচ্ছে, দিয়েছে, তা বিবেচনায় রেখেই নেতৃত্ব নির্বাচন করা হয়। এই বিবেচনায়ই হয়তো দলনেত্রী তার সিদ্ধান্ত নিয়েছেন, লন্ডনে আওয়ামী লীগ নেতাকেই মেয়র প্রার্থী হিসেবে মনোনয়ন দিয়েছেন। এ মনোনয়নে দলীয় ক্ষোভ-হতাশা আছে। কেউ কেউ শঙ্কিত, ফলগুধারার মতো বয়ে যাওয়া অন্তর্দ্ব›েদ্বর কারণেই কি শেষ পর্যন্ত কোনো অঘটন ঘটে যায়? গণমাধ্যমেও এটা আসছে। কিন্তু এরপরও আওয়ামী লীগের মাঝে অর্থাৎ আনোয়ারুজ্জামানের ভোটের রাজনীতিতে আশার আলোক ঝিলিক দিচ্ছে। প্রভাবশালী নেতা জেলা আওয়ামী লীগের সহসভাপতি আসাদ উদ্দিন (যিনি মেয়র প্রার্থী ছিলেন) এক সভায় আনোয়ারকে তার আরেক ভাই বলে সম্বোধন করার পর সভায়ই আসাদ উদ্দিনের পা ধরে সালাম করা, কেন্দ্রীয় নেতারা এসে আনোয়ারুজ্জামানের পক্ষে জনসংযোগ করা প্রভৃতির মধ্য দিয়ে একটা মনস্তাত্ত্বিক পরিবর্তন আসতে পারে ক্ষুব্ধ নেতাকর্মীদের, এ ধারণাটাও ক্রমেই জোরালো হয়ে উঠছে। এ ধারণাটা এখন আরো যেন ডালপালা ছড়াচ্ছে। মেয়র আরিফের একটা বক্তব্য শুধু যুক্তরাজ্য নয়, সব প্রবাসীকে বিস্মিত করেছে। আনোয়ারুজ্জামান চৌধুরীকে তিনি ‘বহিরাগত’ আখ্যায়িত করেছেন। এতে তিনি শুধু আনোয়ারুজ্জামান চৌধুরীকেই নয়, প্রকারান্তরে সব প্রবাসীকেই অপমান করেছেন। অথচ মেয়র আরিফুল হক একটা ব্যাপার হয়তো খেয়ালই করেননি, এমনকি যার কাছ থেকে মাত্র ক’দিন আগে লন্ডনে গিয়ে উপদেশ কিংবা নির্দেশাবলি নিয়ে এসেছেন, তিনিও এখন প্রবাসী এবং তাদের অর্থাৎ বিএনপির কাণ্ডারি। বিএনপি যদি ভাগ্যক্রমে কোনোদিন ক্ষমতায় চলেই যায়, তাহলে বর্তমান লন্ডন প্রবাসী তারেক রহমান প্রধানমন্ত্রী হয়েই যেতে পারেন। তখন আরিফ সাহেব কি বলতে পারবেন বহিরাগতই দেশের প্রধানমন্ত্রী হয়ে গেছেন। এখানে আরেকটা বিষয় স্মরণ করিয়ে দিতে চাই, বিএনপি একটা ভালো কাজও করেছিল একসময়, যে কারণেই হোক বৃহত্তর সিলেটের একজন যুক্তরাজ্য প্রবাসী বহিরাগত(!) শেখ সুজাত মিয়াকে এমপি (হবিগঞ্জ-১) বানিয়েছিল (২০১১ থেকে ২০১৪)। সিলেট-৩ ও সিলেট-২ আসনে লন্ডন প্রবাসীরাও এমপি হয়েছেন। এখনো এ দুটি আসনে দুজন লন্ডন প্রবাসী এমপি আছেন। সুতরাং মেয়র আরিফুল হক চৌধুরীর ‘বহিরাগত’ শব্দটা একেবারে বেমানান। এবং এ বক্তব্যটার মধ্য দিয়ে আরিফ এমনকি তার পার্টির প্রবাসী নেতাকর্মীদেরও হেয় করেছেন, অপমান করেছেন। স্বাভাবিকভাবে তার এ উক্তি বিএনপিতেও প্রশ্নবিদ্ধ হওয়ারই কথা। আর সেজন্যই এ বক্তব্যটি শুধু বিদেশে অবস্থানরত বাংলাদেশিদের মাঝে নয়, সিলেটেও একটা মিশ্র প্রতিক্রিয়াই সৃষ্টি করেছে। কে বহিরাগত- এই ইস্যুতে বিতর্কে জড়িয়েছেন সিলেট সিটি করপোরেশনের মেয়র আরিফুল হক চৌধুরী ও সিটি নির্বাচনে আওয়ামী লীগের প্রার্থী আনোয়ারুজ্জামান চৌধুরী। দুজনই একে অপরকে ‘বহিরাগত’ হিসেবে আখ্যা দিয়েছেন। নির্বাচনের আনুষ্ঠানিক প্রচারণা শুরুর আগে ও প্রার্থী চূড়ান্ত হওয়ার আগেই এই ইস্যুতে জমে উঠেছে দুজনের কথার লড়াই। সোমবার দুপুরে মহান মে দিবস উপলক্ষে মহানগর শ্রমিক দল আয়োজিত এক সভায় প্রধান অতিথি মেয়র আরিফুল হক চৌধুরী এ বিতর্কিত বক্তব্য দিলে এর জবাবে রাতেই আরেক সভায় আনোয়ারুজ্জামান চৌধুরী মেয়র আরিফুলকে ‘বহিরাগত’ উল্লেখ করে পাল্টা বক্তব্য দেন ওইদিন বিকালেই। তিনি তাকে অন্য জেলার লোক হিসেবে তাকেও বহিরাগত বলেছেন। আরিফুল হক চৌধুরীর যে বক্তব্যটি আঘাত দিয়েছে দেড় কোটি প্রবাসীর, আমার মনে হয় আনোয়ারুজ্জামান চৌধুরীর এ রকম আঘাত না দেয়াটাই উচিত কমলগঞ্জের মানুষকে। সেজন্য আরিফের উত্তর না দেয়াটাই ছিল ভালো। কারণ এর উত্তরটা আমরা পাচ্ছি মানুষের প্রতিক্রিয়ায়। প্রসঙ্গক্রমে একটা ব্যাপার এখানে উল্লেখ করতে চাই। বাংলাদেশিরা পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে আছেন, একটা মজবুত ভিত তৈরি করেছেন তারা পৃথিবীর দেশে দেশে। সেজন্যই বাংলাদেশি মানুষরা বিভিন্ন দেশে বিশেষত যুক্তরাজ্যের নীতিনির্ধারণীর জায়গা অর্থাৎ পার্লামেন্টে ও যুক্তরাজ্যের জনগণের প্রতিনিধিত্ব করছেন। কিন্তু কোনোদিনই তারা কোনো প্রতিদ্ব›দ্বী প্রার্থীর কাছ থেকে কিংবা প্রকাশ্যে কিংবা আড়ালে বহিরাগত শব্দটির উচ্চারণ পর্যন্ত শোনেনি। এখনো যুক্তরাজ্যের প্রধানমন্ত্রী ভারতীয় বংশোদ্ভূত ঋষি সুনাক। কিন্তু তার দলের অভ্যন্তরে কিংবা বাইরে তাকে বহিরাগত হিসেবে কেউ বক্তৃতায় গলা ফাটায়নি। এ রকম কথা উচ্চারণ করা হলে জনগণ তো এটা মেনে নিতই না এবং রাষ্ট্রও তখন আইন প্রয়োগই করত। সুতরাং একজন মানুষ যেখানে জন্ম নিল, যে দেশের সমাজ-রাজনীতিতে অবদান রাখল সেই মানুষটাকে বহিরাগত বলে যেমন একটা অনৈতিক উচ্চারণ করলেন তিনি, সেভাবেই তিনি এই কথাটির মধ্য দিয়ে গোটা প্রবাসী বাংলাদেশিকে একটা গালিই দিয়ে দিলেন, যা কোনোভাবেই সভ্য সমাজে গ্রহণযোগ্য হতে পারে না।

ফারুক যোশী : কলাম লেখক। [email protected]

সাবস্ক্রাইব ও অনুসরণ করুন

সম্পাদক : শ্যামল দত্ত

প্রকাশক : সাবের হোসেন চৌধুরী

অনুসরণ করুন

BK Family App