×

জাতীয়

সরকারের সবুজ সংকেতে হেফাজতের সবাই ‘মুক্ত’

Icon

কাগজ প্রতিবেদক

প্রকাশ: ০৪ মে ২০২৩, ০৮:৩১ এএম

সরকারের সবুজ সংকেতে হেফাজতের সবাই ‘মুক্ত’

ছবি: সংগৃহীত

সরকারের সঙ্গে দফায় দফায় বৈঠকের পর হেফাজত ইসলামের ভেতরে স্বস্তি ফিরতে শুরু করেছে। কারাবন্দি শীর্ষ নেতারা একে একে জামিনে মুক্তি পাচ্ছেন। গ্রেপ্তার আতঙ্কে পলাতক থাকা নেতারাও নিজ নিজ মাদ্রাসায় ফিরতে শুরু করেছেন। হেফাজতের পক্ষ থেকে মামলা ও কারাবন্দি নেতাকর্মীদের তালিকা সরকারকে দেয়া হয়েছে। তারা মামলাগুলো প্রত্যাহার চাচ্ছেন। স্বরাষ্ট্র ও আইন মন্ত্রণালয় এ নিয়ে পর্যালোচনা শুরু করছে। এর মধ্যে প্রায় ২৫০টি মামলা রয়েছে বলে জানা গেছে। গতকাল বুধবার দুপুরে এ নিয়ে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর সঙ্গে বৈঠক করেছেন হেফাজতের শীর্ষ তিন নেতা।

এ প্রসঙ্গে হেফাজতের নায়েবে আমীর মাওলানা মহিউদ্দিন রাব্বানী গতকাল ভোরের কাগজকে জানান, গতকাল বুধবার দুপুর সোয়া একটা থেকে দেড় ঘণ্টা স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর সঙ্গে বৈঠক করেন তারা। এ সময় হেফাজতের সাংগঠনিক সম্পাদক মাওলানা মীর ইদ্রিস, প্রচার সম্পাদক মাওলনা কেফায়েত উল্লাহ আজহারী উপস্থিত ছিলেন। বৈঠকে ব্রাহ্মণবাড়িয়ার দুটি মামলায় চার্জশীট হওয়া নিয়ে আলোচনা হয়েছে। এ ব্যাপারে পরবর্তী করণীয় ঠিক করতে সংশ্লিষ্টদের নির্দেশ দিয়েছেন মন্ত্রী। বিচারাধীন মামলা দ্রুত নিষ্পত্তি এবং আটককৃতদের মুক্তির ব্যাপারে প্রধানমন্ত্রী দেশে ফেরার পর সিদ্ধান্ত হবে বলে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী তাদের জানিয়েছেন। রাব্বানী বলেন, আগেও মন্ত্রীর সঙ্গে বিভিন্ন সময়ে তাদের বৈঠক হয়েছে। বুধবারের বৈঠক এর ধারাবাহিকতায় হয়েছে।

হেফাজতের সাবেক সহ-সাংগঠনিক সম্পাদক মাওলানা আতাউল্লাহ আমিন বলেন, হেফাজত নেতারা প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে দেখা করেও মামলা প্রত্যাহারের দাবি জানিয়েছিলেন। কিন্তু মামলাগুলো থেকে যাচ্ছে। আশা করি, এবার মামলাগুলো প্রত্যাহার করা হবে। কারণ, আমরা কোনো রাজনৈতিক দল নই। আমাদের কোনো রাজনৈতিক কর্মসূচিও থাকবে না। ইসলামের জন্য আমাদের ১৩ দফা কর্মসূচি আছে সেটা নিয়ে কাজ করি। আশা করি, কুরবানির ঈদের আগেই আমাদের নেতাকর্মীরা মুক্তি পাবেন।

এদিকে, গ্রেপ্তারের দুই বছর পর গতকাল বুধবার ৫ মামলায় হাই কোর্ট থেকে জামিন পেয়েছেন হেফাজতে ইসলামের সাবেক যুগ্ম মহাসচিব মামুনুল হক। রাজধানীর পল্টন ও চট্টগ্রামের হাটহাজারী থানায় করা মামলাগুলোতে বুধবার মামুনুলকে জামিন দেন বিচারপতি মোস্তফা জামান ইসলাম ও বিচারপতি মো. আমিনুল ইসলামের যৌথ বেঞ্চ। মামুনুল হকের আইনজীবী হেলাল উদ্দিন মোল্লা জানান, তার (মামুনুল) বিরুদ্ধে আরো মামলা রয়েছে। তিনি ১৭টি মামলায় জামিন পেয়েছেন। মুক্তি পেতে হলে আরো তাকে আরো ২৩ মামলায় জামিন পেতে হবে।

অন্যদিকে, উচ্চ আদালতের দেয়া জামিন আদেশে শিগগিরই কারামুক্ত হচ্ছেন হেফাজত নেতা মুফতি হারুন ইজাহার ও শিশুবক্তা রফিকুল ইসলাম মাদানী। মুফতি হারুন ইজাহার ইতোমধ্যে সবগুলো মামলায় জামিন পেয়েছেন। রফিকুল ইসলাম মাদানী হাইকোর্টে সব মামলায় জামিন পেলেও চেম্বার আদালত একটি মামলায় জামিন স্থগিত করে আপিল বিভাগে শুনানির জন্য পাঠিয়েছেন।

হেফাজত ইসলামের নায়েবে আমীর মাওলানা মহিউদ্দিন রাব্বানী বলেন, হেফাজতে ইসলামের আটক নেতাকর্মীদের ৯৯ ভাগই মুক্তি পেয়েছেন। এখন আটক আছেন আট নেতা এবং তিনজন কর্মীসহ মোট ১১ জন। গত রবিবারও দুই নেতা মুক্তি পেয়েছেন। তারা হলেন- মাওলানা কামরুদ্দিন ও মিজানুর রহমান। গতকাল ৫ মামলায় জামিন পেয়েছেন হেফাজতের সাবেক যুগ্ম মহাসচিব মাওলানা মামুনুল হক। ২০২১ সালে হেফাজতের এক হাজারেরও বেশি নেতাকর্মী আটক হয়েছিলেন।

জানা গেছে, হেফাজতের সাবেক যুগ্ম মহাসচিব মাওলানা মামুনুল হক, সহকারী মহাসচিব মুফতি সাখাওয়াত হুসাইন রাজী, সাবেক অর্থ সম্পাদক মুফতী মুনির হুসেন কাসেমী, সাবেক কেন্দ্রীয় নেতা মুফতী হারুন ইজহার, মুফতী নুর হুসাইন নুরানী, রফিকুল ইসলাম মাদানী, আব্দুল মান্নান ও দিদারুল আলম কারাগারে আটক আছেন। এই সাতজন ছাড়া আরো তিনজন কর্মী আটক আছেন। তারা হলেন- অনিক দত্ত (নও মুসলিম), মো. সোহাগ ও আজিজুল হক। পল্টন থানার নাশকতার পৃথক দুই মামলায় জামিন পাননি হেফাজতে ইসলামের সাবেক কেন্দ্রীয় সাংগঠনিক সম্পাদক মাওলানা আজিজুল হক ইসলামাবাদী।

ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির ঢাকা সফর ও পরবর্তী ঘটনায় হেফাজতে এক হাজারে বেশি নেতাকর্মী গ্রেপ্তার হন। পর্যায়ক্রমে তারা জামিনে মুক্তি পেয়েছেন। মুফতি হারুন ইজাহারও সবগুলো মামলায় জামিন পেয়েছেন। তবে তার পাসপোর্ট সংক্রান্ত জটিলতায় তিনি এখনো মুক্তি পাননি।

পুলিশ ও আদালত সূত্রমতে, হেফাজতের নেতাকর্মীদের বিরুদ্ধে ২৫০টির মতো মামলা তদন্ত বা বিচার প্রক্রিয়ায় রয়েছে। ২০২১ সালের মার্চ মাসে স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তী ও বঙ্গবন্ধুর জন্মশতবর্ষ উপলক্ষে ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির ঢাকা সফরকে কেন্দ্র করে বায়তুল মোকাররম, চট্টগ্রামের হাটহাজারী, ব্রাহ্মণবাড়িয়া, নারায়ণগঞ্জ, মুন্সীগঞ্জসহ বিভিন্ন স্থানে সহিংস ঘটনা ঘটে।

পুলিশের সঙ্গে সংঘর্ষে ১৯ জনের মৃত্যু হয়। এসব ঘটনায় সারাদেশে ১৩৪টি মামলা হয়। আর ২০১৩ সালের ৫ মে শাপলা চত্বরে তাণ্ডবের ঘটনায় ঢাকা ও ঢাকার বাইরে মোট মামলা হয় ৮৩টি। এর বাইরে আরো মামলা আছে। হেফাজত নেতারা জানান, মামলাগুলো ২০১৩, ২০১৬, ২০১৮, ২০২১ সালের। রাজধানীর পল্টন থানায় করা নাশকতার পৃথক তিন মামলায় হেফাজত নেতা মাওলানা মঞ্জুরুল ইসলাম আফেন্দীর জামিন পেয়েছেন।

হেফাজতে ইসলামের ঢাকা মহানগর শাখার সভাপতি ও কেন্দ্রীয় যুগ্ম মহাসচিব মাওলানা জুনায়েদ আল হাবিব কাশিমপুর কেন্দ্রীয় কারাগার থেকে জামিনে মুক্তি পেয়েছেন। রাজধানীর পল্টন, মতিঝিল থানায় দায়ের হওয়া নাশকতার চার মামলায় হেফাজতে ইসলামের সাবেক প্রচার সম্পাদক মুফতি ফখরুল ইসলাম জামিন পেয়েছেন। চট্টগ্রামের পটিয়া থানায় হামলার অভিযোগে দায়ের হওয়া মামলায় হেফাজত ইসলামের তিনজনকে জামিন দিয়েছেন হাইকোর্ট। জামিনপ্রাপ্তরা হলেন- হেফাজত ইসলামের কর্মী মাওলানা মুফতি আরিফুল ইসলাম, ইমতিয়াজ হোসেন এবং মো. বেলাল উদ্দিন।

গত ১৩ এপ্রিল চট্টগ্রামের হাটহাজারী মাদ্রাসায় গিয়ে হেফাজতের শীর্ষ নেতাদের সঙ্গে বৈঠক করেন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান। ওই বৈঠকে ছিলেন হাটহাজারী মাদ্রাসার সহকারী পরিচালক ও হেফাজত নেতা মুফতি জসিম উদ্দিন। বৈঠকে আটক নেতাকর্মীদের মুক্তির দাবি তুললে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আশ্বাস দেন। ওইদিন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী সেখানে ইফতার মাহফিলে যোগ দেন।

তখন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী বলেন, হেফাজতের পক্ষ থেকে কারাবন্দি নেতাদের একটি তালিকা দেয়া হয়েছে। তালিকার অনুযায়ী তাদের মুক্তির জন্য সুপারিশ করছি আমরা। অধিকাংশ নেতাকে এর মধ্যে মুক্তি দেয়া হয়েছে। আলোচনা চলার মধ্যে গত সপ্তাহে ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় সাতটি মামলার মধ্যে দুটির চার্জশিট দেয়া হয়েছে। যাতে হেফাজতের নেতাকর্মীদের নাম থাকায় তারা বিচলিত হয়েছেন। ২০২১ সালে ব্রাহ্মণবাড়িয়া থেকেই ৭০০ জনকে গ্রেপ্তার করা হয়েছিলো। নেতাকর্মীরা জামিনে মুক্তি পেলেও মামলাগুলো থেকে যাচ্ছে। গতকাল বৈঠকে নেতারা এনিয়ে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর দৃষ্টি আকর্ষণ করে প্রতিকার চেয়েছেন।

প্রসঙ্গত, ২০২১ সালের মার্চের ঘটনার পর হেফাজতের কমিটি বিলুপ্ত করা হয়। পরে নতুন কমিটি করা হলেও বিলুপ্ত কমিটির বলতে গেলে কেউই নতুন কমিটিতে জায়গা পাননি। কিন্তু আটক হেফাজত নেতাকর্মীদের প্রায় সবাই মুক্তি পাওয়ায় বিলুপ্ত কমিটির নেতারাও আশাবাদী হয়ে উঠেছেন। তবে মামলাগুলো থেকে যাওয়ায় তারা উদ্বিগ্ন।

সাবস্ক্রাইব ও অনুসরণ করুন

সম্পাদক : শ্যামল দত্ত

প্রকাশক : সাবের হোসেন চৌধুরী

অনুসরণ করুন

BK Family App