×

মুক্তচিন্তা

মুক্ত সাংবাদিকতা কোথাও ছিল-আছে?

Icon

অনলাইন ডেস্ক

প্রকাশ: ০৩ মে ২০২৩, ১২:২০ এএম

মুক্ত সাংবাদিকতা কোথাও ছিল-আছে?

দিবস থাকলেও সাংবাদিকতা মোটেই মুক্ত পেশা নয়। কঠিন, অপ্রিয় এ সত্যটি সম্প্রতি নতুন করে জানিয়ে দিয়েছে বিশ্বসভ্যতার গণতান্ত্রিক সৌন্দর্যের অন্যতম দেশ কানাডা। অনলাইন স্ট্রমিং অ্যাক্ট নামে দেশটিতে নতুন একটি আইন পাস হয়েছে। এ আইন দিয়ে অনলাইন বা ডিজিটাল প্ল্যাটফর্ম নিয়ন্ত্রণ করবে কানাডা সরকার। কারো তোয়াক্কা না করে বিশ্ব মুক্ত সাংবাদিকতা দিবসের আগে আগে কানাডা আইনটি করেছে। বিশ্বের বিভিন্ন দেশের সঙ্গে সমন্বয় ও জাতিসংঘের সঙ্গে সংহতি রেখে ৩ মে মুক্ত সাংবাদিকতা দিবস পালন করে কানাডাও। ১৯৯১ সালে ইউনেস্কোর সাধারণ সভার প্রস্তাব ও ৯৩ সালের সভার সিদ্ধান্ত অনুযায়ী এ দিবসটি ঘোষণা হয়। মুক্ত সাংবাদিকতার মৌলিক আদর্শগুলো চিহ্নিত করাই ছিল ওই ঘোষণার মূল উদ্দেশ্য। জাতিসংঘের সর্বজনীন ঘোষণাপত্রের ১৮ ধারায় বলা হয়েছে প্রত্যেকের চিন্তা, বিবেক ও ধর্মীয় স্বাধীনতার অধিকারের কথা। সাংবাদিকদের দায়িত্ব-কর্তব্য-যোগ্যতার কথাও এখানে প্রাসঙ্গিক। কারণ সাংবাদিকসহ সবার বাকস্বাধীনতারই সীমানা আছে। রাজনীতিতে মত প্রকাশ বা বাকস্বাধীনতা অনেকটাই আপেক্ষিক। কত কথা বলতে পারলে বাকস্বাধীনতা হয়, তার সীমানা মানা হয় না। সেখানে যে আরেকজনেরও বাকস্বাধীনতা থাকতে পারে, তা গ্রাহ্য হচ্ছে না। আর সংবাদপত্র, টেলিভিশন, রেডিও ইত্যাদি গণমাধ্যমে বাকস্বাধীনতার তাত্ত্বিক অর্থ প্রেস ফিডম অথবা ফ্রিডম অব প্রেস। প্রায়োগিকভাবে এ ব্যাখ্যায় প্রেস অর্থ ‘সংবাদক্ষেত্র’ (ছাপাখানা নয়)। আবার সংবাদক্ষেত্রেরও বহুমাত্রিক অর্থ। যেখানে সংবাদ, সাংবাদিক, সংবাদমাধ্যম, সংবাদমাধ্যম কর্তৃপক্ষ বা মালিকপক্ষ সবাই আছেন। তাদের সবার অর্থাৎ সংবাদের স্বাধীনতা, সাংবাদিকের স্বাধীনতা, সাংবাদিকতার স্বাধীনতা, সংবাদমাধ্যমের স্বাধীনতা, সংবাদমাধ্যম মালিকের স্বাধীনতা মিলিয়ে স্বাধীনতার চৌহদ্দি বেশ বড়। অথচ স্বাধীনতা বা অধিকারের সমান্তরালে দায়দায়িত্ব ও জবাবদিহিতার বিষয়টি সামনে আনলে ক্ষিপ্ত হয়ে ওঠার প্রবণতা রয়েছে। সাংবাদিকদের সব আইনের ঊর্ধ্বে রাখা এবং তাদেরকে অবারিত মুক্ত ভাবার মানসিকতাও রয়েছে। জগতে কারো স্বাধীনতাই অ্যাবসলিউট, আনলিমিটেড বা নিরঙ্কুশ নয়। সব স্বাধীনতাই মাত্রাযুক্ত। জাতিসংঘের মানবাধিকার ঘোষণার বাক ও চিন্তার স্বাধীনতার কথা ভাবার্থ বাংলাদেশের সংবিধানের ৩৯ অনুচ্ছেদে ইংরেজি ভার্সনে বলা হয়েছে ‘প্রেস ফ্রিডম’। বাংলা ভার্সনে তা ‘সংবাদক্ষেত্রের স্বাধীনতা’। ৩৯ অনুচ্ছেদের ২ ধারায় এ স্বাধীনতার সঙ্গে সংবাদমাধ্যমের দায়দায়িত্ব তথা সীমানা উল্লেখ আছে। রাষ্ট্রের নিরাপত্তা, বিদেশি রাষ্ট্রগুলোর সঙ্গে বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক, জনশৃঙ্খলা, শালীনতা বা নৈতিকতার স্বার্থে কিংবা আদালত অবমাননা, মানহানি বা আরোপিত যুক্তিসঙ্গত বিধিনিষেধ সাপেক্ষে সংবাদক্ষেত্রের ওই স্বাধীনতা। এছাড়া ছাপাখানা ও প্রকাশনা (ঘোষণা ও নিবন্ধীকরণ) আইন, প্রেস কাউন্সিল আইন, কপিরাইট অধ্যাদেশও তো রয়েছেই। বিশ্বের সভ্য-উন্নত দেশগুলোতেও এ ধরনের আইন কম-বেশি বিদ্যমান। গণতন্ত্র, বাকস্বাধীনতা, গণমাধ্যমের স্বাধীনতা ইত্যাদি প্রশ্নে উদার ঐতিহ্য ও সভ্যতার আইডল ব্রিটেনেও সাংবাদিকদের জন্য কঠোর আচরণবিধি রয়েছে। বিশ্বের আরেক সভ্য দেশ যুক্তরাষ্ট্রে সংবাদমাধ্যমের স্বাধীনতার পাশাপাশি জুড়ে দেয়া হয়েছে নিয়ন্ত্রণের বেশকিছু ধারা-উপধারা। তাদের ‘ডকট্রিন অব পুলিশ পাওয়ার’ নামের খড়গে পড়া সাংবাদিকরা তা হাড়ে হাড়ে টের পান। প্রতিবেশী রাষ্ট্র ভারতে গণমাধ্যমের স্বাধীনতার সঙ্গে তাদের সংবিধানের ১৯ (ক) অনুচ্ছেদের বিপরীতে ১৯ (২) অনুচ্ছেদে স্পষ্ট উল্লেখ আছে ‘পরিপূরক দায়দায়িত্ব ছাড়া সংবাদপত্রসমূহ একতরফা স্বাধীনতা ভোগ করতে পারে না’। প্রশ্ন হচ্ছে, দেশে দেশে কেন সংবাদমাধ্যমকে নীতিমালা বা আচরণবিধিতে আনা হয়? ইতিহাসে দেখা যায়, সাংবাদিকতার বিকাশ আর আচরণবিধি অনেকটাই সমান্তরাল। যত নীতিমালা এসেছে তত বিকাশ ঘটেছে। ভারত উপমহাদেশে ওয়াকিয়া নবিশ, খুফিয়া নবিশ, আখবর নবিশ ইত্যাদি নামের সাংবাদিকদের মধ্যে অসত্য-অর্ধসত্য তথ্য পরিবেশনের বহু নজির রয়েছে। তা কখনো ইচ্ছাকৃত-উদ্দেশ্যমূলক, কখনো অনিচ্ছাকৃত বা অসাবধানতায়। ওই ইতিহাস ও উদাহরণ বেশ দীর্ঘ। ১৮৪৪ সালে প্রকাশিত স্যার উইলিয়াম সিøম্যানের বিখ্যাত ‘র‌্যাম্বলেস এন্ড রিকালেকশনস’ গ্রন্থে ওয়াকিয়া নবিশদের দুর্নীতির কথা উল্লেখ করে বলা হয়েছে : অযোধ্যার গোলাম হোসেন যুদ্ধে হেরে গিয়ে তার রাজ্যের ২০ মাইল সীমানার মধ্যে সব সাংবাদিককে ঘুষ দিয়েছিলেন তার যুদ্ধ পরাজয়ের কথা প্রচার না করতে। বিশ্বের কোথাও সাংবাদিক বা সাংবাদিকতা মুক্ত বিহঙ্গ নয়। যা ইচ্ছা ঢালাও প্রচার-প্রকাশের এনওসি নেই। মত প্রকাশের ক্ষেত্রে আইনত সাংবাদিক আর জনসাধারণের একই অধিকার। কিন্তু পেশার সুবাদে সাংবাদিকদের তথ্য ও মত প্রকাশের ক্ষমতা অন্যদের চেয়ে বেশি বলে তিনি যথেচ্ছা মত বা তথ্য প্রকাশের অধিকারী নন। কোনো সাংবাদিকের অনিচ্ছাকৃত বা অসাবধানতাবশত ভুল তথ্য পরিবেশনও শাস্তিযোগ্য। এমনকি সংবাদপত্রে পাঠকের চিঠি বা মতামতের জন্যও সংশ্লিষ্ট ব্যক্তি ও সম্পাদক-প্রকাশক দায়মুক্ত নন। যদিও সংবাদপত্রগুলোতে পাঠকের চিঠিপত্র বা মতামত বিভাগে ‘মতামতের জন্য সম্পাদক দায়ী নন’- মর্মে একটি ঘোষণা দেয়া হয়। সংবাদ-সাংবাদিকতা বিষয়ে আইন ও বিচার বিশেষজ্ঞদের মতে, কোনো সংবাদমাধ্যমে যা কিছু (সংবাদ, ফিচার, মতামত এমনকি বিজ্ঞাপনও) প্রকাশ হবে সবকিছুর জন্য ওই সংবাদমাধ্যম কর্তৃপক্ষের দায় রয়েছে। সেই বিবেচনায় সংবাদমাধ্যমে ‘অবাধ’ শব্দটি নিতান্তই তাত্ত্বিক, প্রায়োগিক নয়। একজন সাংবাদিকের ইচ্ছাকৃত বা অনিচ্ছাকৃত যে কোনো ভুল, অসত্য-অর্ধসত্য তথ্য দেশের বিরাট ক্ষতির কারণ হতে পারে। এজন্য বলা হয়ে থাকে, ডাক্তারের ভুল বা অসাবধানতায় সর্বনাশ হয় একজন রোগীর। সাংবাদিকের বা সংবাদমাধ্যমের ভুলে সর্বনাশ হয় গোটা জাতির। এক্ষেত্রে হিটলারের প্রচারমন্ত্রী ইতিহাসে ‘মিথ্যার মহারাজা’খ্যাত জেনারেল গোয়েবলসের একটি বিখ্যাত উক্তি রয়েছে। তিনি বলেছেন, একটি গ্যাস চেম্বার বিস্ফোরণে কয়েকশ লোকের মৃত্যু হতে পারে। একটি পরিকল্পিত মিথ্যায় মৃত্যু হতে পারে লাখ লাখ মানুষের। নিজের অভিজ্ঞতা থেকেই উক্তিটি করেছেন গোয়েবলস। সাংবাদিক অসৎ উদ্দেশ্যপ্রণোদিত না হয়ে বা বিনা স্বার্থে কোনো অসত্য তথ্য দিলে তাও আইনের দৃষ্টিতে অপরাধ। এ ধরনের ঘটনায় আদালতে বাদীপক্ষের আইনজীবীরা শেক্সপিয়রের বিখ্যাত ‘ওথেলোর’ নাটকের একটি মর্মস্পর্শী ডায়ালগের অবতারণা করে ক্ষতিগ্রস্তের পক্ষে যুক্তি দাঁড় করান। ওথেলোর বিখ্যাত ওই উক্তিটি হচ্ছে- সে আমার সুনাম কেড়ে নিয়েছে, কেড়ে নেয়া সেই সুনাম তাকে সমৃদ্ধ করেনি, কিন্তু আমাকে নিঃস্ব করে ছেড়েছে। কথাচ্ছলে ভিন্নমতের স্বাধীনতা ব্যাপক আলোচিত হলেও সবকিছুতে ভিন্নমতের স্বাধীনতা খাটে না। ধর্মীয় বিধান, স্রষ্টা, দেবতা বা কোনো দেশের স্বাধীনতা-সংবিধান নিয়ে ভিন্নমত বিশ্বের কোথাও কখনো স্বীকৃত নয়। স্বাধীনতা সবার জন্যই উপভোগের। কিন্তু নিজে স্বাধীনতা ভোগ করতে গিয়ে অন্যের স্বাধীনতা অক্ষুণ্ন রাখাও সবার দায়িত্ব। সমাজের বিবেকবান, মানবিক গুণসম্পন্ন ও দায়িত্বশীল বিবেচনায় সাংবাদিকদের জন্য আচরণবিধি ও নীতিমালার প্রশ্ন এখানেই। সংবাদপত্রকে রাষ্ট্রের চতুর্থ স্তম্ভ ‘ফোর্থ স্টেট’-এর মর্যাদা দেয়া হয়। রাষ্ট্রের অন্য তিনটি স্তম্ভ নির্বাহী বিভাগ, বিচার বিভাগ ও সংসদের জন্যও কিছু নীতি ও বিধি রয়েছে। সেই দৃষ্টে চতুর্থ স্তম্ভ সংবাদমাধ্যমও নীতিমালামুক্ত নয়। বলার অপেক্ষা রাখে না, নীতিমালা বা আচরণবিধির উদ্দেশ্য কেবল নিয়ন্ত্রণমূলক নয়, এর সঙ্গে একটি প্রাতিষ্ঠানিক স্বীকৃতি ও মর্যাদাও নিহিত। একাডেমিকভাবে সাংবাদিকদের দায়িত্ব ৩টি। টু ইনফর্ম, টু এডুকেট এবং টু এন্টারটেইন। তথ্য দেয়া, শিক্ষা দেয়া ও বিনোদিত করা। জনগণকে আকর্ষণ বা প্রভাবিত করে এমন বিষয়ে জনগণকে অবহিত রাখাকে সাংবাদিকের দায়িত্ব হিসেবে নির্দিষ্ট করা হয়েছে। এসব বুঝতে একাডেমিক শিক্ষার সঙ্গে প্রশিক্ষণ জরুরি। নইলে তার পক্ষে পেশাগত সীমাবদ্ধতা, পেশাগত আইন ও নীতিমালা, সমাজ স্বীকৃত শালীনতাবোধ, ধর্মীয় ও সাম্প্রদায়িক বিষয়ে সতর্কতা, তথ্য প্রকাশে পরিমিতিবোধ, মিডিয়া ট্রায়াল পরিহার, সংবাদসূত্রের গোপনীয়তা রক্ষা, রাষ্ট্রদ্রোহী বক্তব্যে সতর্কতা, তথ্য আদায়ে চাপ না দেয়া, মানহানি সম্পর্কে পর্যাপ্ত জ্ঞান বা ধারণা আসবে না। কিন্তু বাংলাদেশে এদিকটায় ভীষণ খরা। এখানে তথ্য দেয়া, শিক্ষা দেয়া এবং বিনোদন দেয়ার মতো গুরুদায়িত্ব থাকা সাংবাদিকতার যোগ্যতার মানদণ্ড এখনো ঠিক হয়নি। ক্ষেত্রবিশেষে এখানে সাংবাদিক হওয়া খুবই সোজা কাজ। অসংখ্য পত্রিকা, টিভি, এফএম রেডিও ছাড়াও হাজারে হাজার অনলাইন পোর্টাল গজিয়েছে। হাতেগোনা কিছু পোর্টাল বাদ দিলে বাকিদের বেশিরভাগই চলছে কপিপেস্টে। যার যা ইচ্ছা আইটেম-কনটেন্ট করছে। তাদের দৌরাত্ম্যে কোনটা সংবাদ বা অপসংবাদ, কোনটা তথ্য বা গুজব- ঠাওরের অবস্থা থাকছে না। তাদের কথিত সংবাদের শব্দ-বাক্যের ভাষা আর কনটেন্ট পেশাদারদের কী নিদারুণ আহত করছে তা ভাষায় প্রকাশও লজ্জার-কষ্টের। এসব অনলাইন পোর্টালের হালের নতুন উৎপাত আইপি টিভি। তাও সংখ্যায় অগুনতি। সেখানেও অসংখ্য সাংবাদিক। যোগ্যতা, নিয়োগ, আইডি কার্ড মিলিয়ে এক নাশকতার ঘনঘটা সেখানে। আদৌ এগুলো গণমাধ্যমের মানদণ্ডে পড়ে কিনা প্রশ্ন তোলা যাচ্ছে না। তাদের অন্তত প্রশিক্ষিত করে তোলা, সাংবাদিকতার ন্যূনতম পাঠ-পঠন দেয়ারও গরজ নেই। তারা যার যার জায়গায় পরাক্রমশালী। সাংবাদিকতার যাবতীয় সর্বনাশ করা এই শ্রেণিটিরও জবাবদিহি থেকে মুক্ত থাকার বাসনা।

মোস্তফা কামাল : সাংবাদিক ও কলাম লেখক; বার্তা সম্পাদক, বাংলাভিশন। [email protected]

সাবস্ক্রাইব ও অনুসরণ করুন

সম্পাদক : শ্যামল দত্ত

প্রকাশক : সাবের হোসেন চৌধুরী

অনুসরণ করুন

BK Family App