×

জাতীয়

হাওড়জুড়ে কৃষকের মুখে সোনার হাসি

Icon

কাগজ প্রতিবেদক

প্রকাশ: ২৭ এপ্রিল ২০২৩, ০৯:৩২ এএম

হাওড়জুড়ে কৃষকের মুখে সোনার হাসি

ছবি: সংগৃহীত

হাওড়জুড়ে কৃষকের মুখে সোনার হাসি

মাথার ওপর সূর্য খাঁ খাঁ করছে। কাঠফাটা রোদে বুকের ছাতি ফেটে যাওয়ার মতো অবস্থা। তবু সেদিকে ভ্রুক্ষেপ নেই কারো। এমনকি, প্রকৃতিকে ভ্রæকুটি হেনে কেউ কেউ বেসুরো গলায় প্রিয় কোনো গানের দুয়েক লিরিক গাইছেন কখনো কখনো। তবে সবার মন নিবিষ্ট কাজে। সেখানে কারো বিরাম নেই। কি ছেলে, কি বুড়ো। পরিবারের সবাই এসেছেন বিস্তীর্ণ হাওড়ের বুকে ধান কাটার এ উৎসবে। যেদিকে চোখ যায় হাওড়ের বুকজুড়ে নানা বয়সি মানুষের বোরো মৌসুমের স্বতঃস্ফূর্ত ব্যস্ততা। হাওড়ের হাজারো কৃষকের মুখে এখন সোনার হাসি। হাওড়ের খলায়-খলায় এখন ধান কাটা, মাড়াই, শুকানো ও সিদ্ধ করার কাজে ব্যস্ত তারা। আমাদের প্রতিনিধি মো. সাজ্জাদ হোসেন শাহ (সুনামগঞ্জ), ম. শফিকুল ইসলাম (নেত্রকোনা), আলি হায়দার (কুলিয়ারচর, কিশোরগঞ্জ), সুমন বৈদ্যর (শ্রীমঙ্গল, মৌলভীবাজার) পাঠানো তথ্য নিয়ে প্রতিবেদন।

দেশের পূর্বাঞ্চলের সবচেয়ে বড় এই জলভাণ্ডারের নিচু জমি দেশের খাদ্যশস্যের বড় জোগানদার। বোরো মৌসুমে হাওড়াঞ্চল দেশের ২০ শতাংশের মতো চালের জোগান দেয়। সাত জেলার হাওড়ে এ বছর বোরো আবাদ হয়েছে ৪ লাখ ৫২ হাজার হেক্টর জমিতে। আর হাওড় ও হাওড়ের বাইরে উঁচু জমি মিলে মোট বোরো আবাদ হয়েছে ৯ লাখ ৫৩ হাজার হেক্টর জমিতে। উৎপাদন লক্ষ্যমাত্রা ৪০ লাখ টন চাল। এবার বৃষ্টি না হওয়ায় হাওড়ের সব ধান কৃষকের ঘরে উঠবে। কিশোরগঞ্জের অষ্টগ্রাম, মিঠামইন ও ইটনা উপজেলায় এবার ধানের বাম্পার ফলন হয়েছে।

সম্প্রতি কিশোরগঞ্জের হাওড়বেষ্টিত অষ্টগ্রাম ও বাজিতপুর উপজেলার বিভিন্ন ইউনিয়নের কয়েকটি হাওড়ে সরজমিনে দেখা গেল, বোরো ধান কাটার এ উৎসবে শুধু কৃষান-কৃষানিই নয়, বাড়ির সব বয়সি মানুষই এসে হাত লাগিয়েছে ধানকাটা, মাড়াই এবং গোলায় তোলার উৎসবে। এদের কেউ ক্ষেত থেকে ধান কাটছে। কেউ কেউ ক্ষেতেরই ফাঁকা স্থানে ‘খলা’ (ধান মাড়াই ও শুকানোর স্থান) তৈরিতে ব্যস্ত। ধান কাটা শেষে ইঞ্জিনচালিত ট্রাক্টর দিয়ে তা জমি থেকে খলায় নিয়ে আসা হচ্ছে। খলায় বুংগা মেশিন (মাড়াই কল) দিয়ে চলে মাড়াই। পরে সেখানেই শুকানো হচ্ছে মাড়াইকৃত ধান। তীব্র রোদে শুকানো ধান বস্তাভর্তি করে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে গোলায়। এছাড়া জেলার নিকলী, বাজিতপুর ও তাড়াইল উপজেলার হাওড়ে লেগেছে বোরো ধান কাটা ও মাড়াইয়ের ধুম।

জেলা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর সূত্রে জানা গেছে, এ বছর কিশোরগঞ্জ জেলার ১৩টি উপজেলায় ১ লাখ ৬৬ হাজার ৪২০ হেক্টর জমিতে বোরো ধান আবাদ হয়েছে। তাতে অর্জনের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছে ১ লাখ ৬৯ হাজার ২৯০ হেক্টর। জেলার হাওড়াঞ্চলেই বোরো ধান চাষ হয়েছে ১ লাখ ৩ হাজার ৭৭৫ হেক্টর জমিতে।

কিশোরগঞ্জ জেলা কৃষি স¤প্রসারণ অধিদপ্তরের উপপরিচালক মো. আব্দুস সাত্তার জানান, এখন পর্যন্ত কিশোরগঞ্জের হাওড় এলাকায় প্রায় ৬২ শতাংশ ধান কাটা শেষ হয়েছে। আগামী মে মাসের ১০ তারিখের মধ্যে হাওড়ে ধান কাটা সম্পূর্ণ হবে বলে তিনি জানান।

১ চলতি বোরো মৌসুমে হাওড়ের জেলা সুনামগঞ্জের ১২টি উপজেলায় সরকারি হিসাব অনুযায়ী গতকাল বুধবার পর্যন্ত ৭০ শতাংশ ধান কাটা হয়ে গেছে। এর মধ্যে হাওড়ে ৮৫ শতাংশ এবং নন হাওড়ে ৭০ শতাংশ ধান কাটা হয়েছে। জেলা কৃষি স¤প্রসারণ অধিদপ্তর সূত্রে জানা গেছে, চলতি বোরো মৌসুমে জেলার ১২ উপজেলা- সুনামগঞ্জ সদর, বিশ্বম্ভরপুর, তাহিরপুর, জামালগঞ্জ, মধ্যনগর, ধর্মপাশা, দিরাই, শাল্লা, ছাতক, জগন্নাথপুর, দোয়ারাবাজার ও শান্তিগঞ্জের ছোট বড় ১৩৭টি হাওড়ে বোরো আবাদ করা হয়েছে।

আগাম বন্যা ও পাহাড়ি ঢলের আশঙ্কায় জেলা প্রশাসন জেলার সব উপজেলার কৃষকদের দ্রুত ধান কাটার জন্য মাইকিং করেছে। কৃষি স¤প্রসারণ অধিদপ্তর সুনামগঞ্জের উপপরিচালক বিমল চন্দ্র সোম গতকাল এ প্রতিবেদককে জানান, জেলার হাওড়ের ধান কাটতে আর ৫ দিন সময় এবং নন হাওড়ে ২০ দিন সময় লাগবে। জেলা প্রশাসক দিদারে আলম মোহাম্মদ মাকসুদ চৌধুরী জানিয়েছেন, এ বছর জেলায় আবাদকৃত জমি থেকে ১৩ লাখ ৫৩ হাজার মে. টন ধান উৎপাদনের আশা করা হচ্ছে। আশা করি কোনোরকম প্রাকৃতিক দুর্যোগ দেখা না দিলে লক্ষ্যমাত্রা অর্জন করা সম্ভব হবে।

নেত্রকোনার হাওড়ের ৮৫ ভাগ বোরো ধান কাটা শেষ : নেত্রকোনায় এ বছর হাওড় ও সমতলে বোরো ধানের ফলন ভালো হয়েছে। কৃষান-কৃষানিরা এখন ধান কাটা মাড়াইয়ে ব্যস্ত সময় পার করছেন। জেলার হাওড়াঞ্চলে বোরো ধান কাটা প্রায় শেষের দিকে। গতকাল বুধবার পর্যন্ত হাওড়ে ৮৫ ভাগ ধান কাটা শেষ হয়েছে বলে কৃষি বিভাগ সূত্রে জানা গেছে। আবহাওয়া অধিদপ্তর থেকে বলা হয়েছিল, নেত্রকোনায় ২০ এপ্রিল থেকে ২৪ এপ্রিল পর্যন্ত ভারি বৃষ্টিপাতসহ পাহাড়ি ঢল নেমে হাওড়ের বোরো ধান তলিয়ে যেতে পারে। আর সেজন্য মাইকিংও করা হয়েছিল। এতে চাষিরা মাইকিং শুনে বন্যার আশঙ্কায় দ্রুত জমির ধান কর্তন করেন। কিন্তু ২০ এপ্রিল রাতে সামান্য বৃষ্টি হলেও তা সব জায়গায় হয়নি।

খালিয়াজুরী হাওড় পাড়ের কৃষক ফারুক আহাম্মেদ বলেন, এ বছর হাওড়ে শিলাবৃষ্টি ও পোকার আক্রমণে ব্রিধান- ২৮ এর ফলন কিছুটা কম হলেও অন্যান্য জাতের ধানের ভালো ফলন হওয়ায় এবং বর্তমানে ধানের বাজারমূল্য ভালো থাকায় তারা লাভবান হবেন।

জেলা কৃষি স¤প্রসারণ বিভাগের উপপরিচালক মো. নুরুজ্জামান বলেন, নেত্রকোনা জেলার ৬টি হাওড় উপজেলায় ৪০,৯৭০ হেক্টর জমিতে বোরোর আবাদ হয়। এর মধ্যে ব্রিধান-২৮, ব্রিধান-২৯, ব্রিধান-৮৮, ব্রিধান-৮৯ ও হাইব্রিড জাতের ধান চাষ করা হয়েছে। আর তিন-চার দিনের মধ্যে হাওড়ের বাকি ধান কাটা শেষ হবে। হাওড়ে মোট ৭৩০টি হারভেস্টার ও ৩৪টি রিপার মেশিন ধান কর্তনে নিয়োজিত রয়েছে। এছাড়া মেশিনের পাাশাপাশি ১৬ হাজার শ্রমিকও হাওড়ে ধান কাটছে। এ সমস্ত শ্রমিকের মধ্যে ৫ হাজারের অধিক শ্রমিক বহিরাগত।

নেত্রকোনা জেলা কৃষি স¤প্রসারণ অধিদপ্তর সূত্রে জানা যায়, হাওড়ের ধান কর্তন প্রায় শেষের দিকে হলেও সমতল জমির বোরো ধান কাটা কেবল শুরু হয়েছে। সমতল জমিতে বোরোর আবাদ হয়েছে ১ লাখ ৪৩ হাজার ৭৬৫ হেক্টর। এই পরিমাণ জমি থেকে বোরো ধান গতকাল পর্যন্ত কাটা হয়েছে ২২ হাজার হেক্টর। উঁচু জমিতে দেরিতে আবাদ হওয়ায় ধান পাকতেও দেরি হয়। তবে আগামী ৭/৮ দিনের মধ্যেও উঁচু জমির ধান অর্ধেক কাটা হয়ে যাবে।

এদিকে ধান মাড়াইয়ের পর বিক্রি শুরু করেছেন কৃষকরা। বিশেষ করে যারা ঋণ নিয়ে ধানের আবাদ করেছেন তারা ঋণ পরিশোধের জন্য মাঠেই কাঁচা ধান বিক্রি করছেন। এতে তাদের আক্ষেপ নেই। কারণ, এ বছর বৃষ্টি না হওয়ায় হাওড়ের ধান শুকনো থাকায় তুলনামূলকভাবে ভালো দাম পাচ্ছেন তারা। ক্ষেত্রবিশেষে ব্রি-২৮, ব্রি-২৯ চিকন ধান ১০০০ থেকে ১১৫০ টাকা দামে মাঠ থেকেই কিনে নিচ্ছেন পাইকাররা। আর মোটা ধান বিক্রি হচ্ছে ৭০০ থেকে ৮০০ টাকা মধ্যে। তবে ব্লাস্টের কারণে চিটা হয়ে যাওয়া ধানের দাম তুলনামূলক কম; সর্বোচ্চ ৬০০ টাকায় বিক্রি হচ্ছে। নেত্রকোনা, সুনামগঞ্জ ও মৌলভীবাজার জেলার কৃষক, পাইকার, চালকল ব্যবসায়ী ও কৃষি কর্মকর্তারা এসব তথ্য জানিয়েছেন।

ব্রাহ্মণবাড়িয়া থেকে ব্যবসায়ী গোলাম আলী প্রতি বছর খালিয়াজুরী হাওড়ে আসেন ধান কিনতে। তিনি বলেন, চিকন ভেজা ধান তিনি ৯৭০ থেকে ৯৮০ টাকা মণ দরে কিনছেন। মোটা ধানে ৮২০ থেকে ৮৩০ টাকা দিচ্ছেন। শুকনো চিকন ধান কিনছেন ১১৪০ থেকে ১১৫০ টাকা করে। আর মোটা শুকনো ৯৫০ টাকা করে নিচ্ছেন। বাংলাদেশ মেজর এন্ড হাসকিং মিল মালিক সমিতির নেত্রকোনা জেলা সাধারণ সম্পাদক এইচ আর খান পাঠান সাকি বলেন, ধান কেনা শুরু হয়েছে। চাল কলগুলো কেনা শুরু করলে ধানের দাম বাড়বে। খালিয়াজুরী সদরের কৃষক মনির হোসেন পাইকারের কাছে ব্রি-২৮ শুকনো ধান বেচেছেন ১১৪৫ টাকা মণ দরে। তার ভাষ্য, দাম তো মোটামুটি ভালোই পাইছি।

তবে সুনামগঞ্জের কৃষকরা ধানের দাম নিয়ে বিশেষ খুশি নয়। তাদের কিছু ধান ব্লাস্টের কারণে নষ্ট হয়েছে, কিছু ধান চিটা হয়েছে। তারা প্রতি মণে দাম পাচ্ছেন ৯০০ টাকা থেকে ১০০০ টাকা। শাল্লা উপজেলার চাকুয়া গ্রামের কৃষক প্রীতম দাস বলেন, হাওড়ের কৃষকের হাত এখন খালি। তাই সংসার চালাতে সস্তায় ধান বিক্রি করছেন তারা। আমাদের এলাকায় ৯০০ টাকায় ধান বিক্রি হচ্ছে। ধর্মপাশা উপজেলার সুখাইর রাজাপুর উত্তর ইউনিয়নের সাবেক চেয়ারম্যান এবং এলাকার বড় কৃষক আমানুর রাজা চৌধুরী বলেন, চৈত্র মাস থেকেই কৃষক অভাবে থাকে। তাই সংসারের চাহিদা মেটাতে আগাম বাজারে প্রচলিত মূল্যের চেয়ে কম দামে ধান বিক্রি করে দেন তারা। এবার ভালো ফলন হলেও দাম কম।

মৌলভীবাজারের হাইল, হাকালুকি ও কাউয়া দীঘি হাওড়ে ব্লাস্ট রোগে বোরো ধানের বেশ ক্ষতি হয়েছে। উৎপাদন কিছুটা কম হওয়ায় পাইকাররা কৃষকদের কাছ থেকে আশানুরূপ ধান সংগ্রহ করতে পারছেন না। শ্রীমঙ্গল উপজেলার ভৈরব বাজার এলাকার পাইকার শহীদ মিয়া জানান, এখন কৃষকরা ধান বিক্রি করছেন কম। ধানের অবস্থা দেখে ৯০০, ১০০০ ও ১০৫০ টাকা দরে কিনছেন।

শ্রীমঙ্গল সদর ইউনিয়নের লালবাগ গ্রামের আদর মিয়া (৫০) বলেন, এবার তাদের এলাকায় ব্লাস্ট রোগের কারণে ধানে চিটা বেশি হয়েছে। ফলে এসব ধান কিনতে ক্রেতারা আগ্রহী হচ্ছেন না। যারা বিক্রি করছেন সর্বোচ্চ সাড়ে ৫০০ থেকে ৬০০ টাকা দাম পাচ্ছেন।

খাদ্য মন্ত্রণালয় জানিয়েছে, সরকার এবার বাজার থেকে ১৬ লাখ ৫০ হাজার টন ধান ও চাল কিনবে। এর মধ্যে চার লাখ টন ধান, ১২ লাখ ৫০ হাজার টন সেদ্ধ চাল সংগ্রহের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছে।

সাবস্ক্রাইব ও অনুসরণ করুন

সম্পাদক : শ্যামল দত্ত

প্রকাশক : সাবের হোসেন চৌধুরী

অনুসরণ করুন

BK Family App