×

ফিচার

বিলুপ্তির পথে কুমিল্লার গ্রামীণ জনপদের কাচারি ঘর

Icon

কাগজ প্রতিবেদক

প্রকাশ: ২৬ এপ্রিল ২০২৩, ০৩:২৮ পিএম

বিলুপ্তির পথে কুমিল্লার গ্রামীণ জনপদের কাচারি ঘর

ছবি: সাকলাইন যোবায়ের, কুমিল্লা সদর

একসময় গ্রামীণ জনপদের অধিকাংশ গৃহস্থের বাড়িতেই ছিল কাচারি ঘর। কাচারি ঘর ছিলো গ্রাম বাংলার ইতিহাস ঐতিহ্য, কৃষ্টি ও সংস্কৃতির একটি অংশ। কালের বিবর্তনে আজ কাচারি ঘর বাঙালির সংস্কৃতি থেকে হারিয়ে যাচ্ছে। গেস্টরুম কিংবা ড্রয়িং রুমের আদি ভার্সন কাচারি ঘর। এখন আর গ্রামীণ জনপদে কাচারি ঘর দেখা যায় না।

আদিকালে মূল বাড়ি থেকে একটু দূরে আলাদা খোলামেলা জায়গায় কাচারি ঘরের অবস্থান ছিল। অতিথি, পথচারী কিংবা সাক্ষাৎপ্রার্থীরা এই ঘরে এসেই বসতেন। প্রয়োজনে এক-দুই দিন রাত যাপনেরও ব্যবস্থা থাকতো কাচারি ঘরে।

কাচারি ঘর ছিল বাংলার অবস্থাসম্পন্ন ও মধ্যবিত্তের গৃহস্থের আভিজাত্যের প্রতীক। চারিদিকে ঢেউ টিনের বেড়া সঙ্গে কাঠের কারুকাজ করে উপরে টিন অথবা ছনের ছাউনি থাকতো কাচারি ঘরে। যা অতি প্রাকৃতিকবান্ধব পরিবেশ দিয়েআবেষ্টিত ছিল।

তখনকার যুগে বৈদ্যুতিক পাখা না থাকলে কাচারি ঘড় ছিল আরামদায়ক শীতল পরিবেশ। তীব্র গরমেও কাচারি ঘরের খোলা জানালা দিয়ে হিমেল বাতাস বইতো। আলোচনা, শালিস বৈঠক, গল্প-আড্ডার আসর, বসতো কাচারি ঘরে।

আগের দিনে নিজেদের পারিবারিক অনুষ্ঠানে মানুষজন বেশি হলে ছেলেরা কাচারি ঘরে থাকতেন আর মেয়েরা থাকতেন ভিতর বাড়িতে।

বর্ষা মৌসুমে গ্রামের লোকজনদের উপস্থিতিতে কাচারি ঘরে বসতো পুঁথি পাঠ ও জারি গান। পথচারীরা এই কাচারি ঘরে ক্ষণিকের জন্য বিশ্রাম নিতেন। বিপদে পড়লে রাত যাপনের ব্যবস্থা থাকতো কাচারি ঘরে।

গৃহস্থের বাড়ির ভিতর থেকে খাবার পাঠানো হতো কাচারি ঘরের অতিথিদের জন্য। আবাসিক গৃহশিক্ষকের (লজিং মাস্টার)ও আররি শিক্ষার ব্যবস্থার জন্য কাচারি ঘড়ের অবদান অনস্বীকার্য। মাস্টার ও আররি শিক্ষকগণ কাচারি ঘরে থাকার ব্যবস্থা থাকার ব্যবস্থা করা হত। কোন কোন বাড়ির কাচারি ঘর সকাল বেলা মক্তব হিসেবেও ব্যবহৃত হত।

জানা যায়, ঈশা খাঁর আমলে কর্মচারীদের খাজনা আদায়ের জন্য কাচারি ঘর ব্যবহার করা হতো। জমিদারী প্রথার সময়ও খাজনা আদায় করা হতো গ্রামের প্রভাবশালী গ্রাম্য মোড়লের বাড়ির সামনের কাচারি ঘরে বসে। এখন আর কাচারি ঘর তেমন চোখে পড়ে না।

কুমিল্লার গোমতী নদীর ওপারে সীমান্তবর্তী এলাকা, শাহপুর, শাওয়ালপুর, গোলাবাড়ি, জেলার দেবিদ্বারের, বুড়িচং, মেঘনা,দাউদকান্দির এলাকার কিছু গ্রামে অত্যন্ত জীর্ণ শীর্ণ অবস্থায় কাচারি ঘর দেখতে পাওয়া যায়।

কালের সাক্ষী হয়ে সংস্কারের অভাবে আজো অযত্ন অবহেলায় দাঁড়িয়ে রয়েছে কাচারি ঘর।

গোমতী  নদীর ওপারে শাহপুর গ্রামের প্রবীণ ব্যক্তি মো. আবদুল বারেক বলেন, আমার দাদা আম্বর আলী সর্দারের আমলে আমরা কাচারি ঘর দেখেছি। সেখানে মেহমানরা আসতেন ও বৈঠক এবং দেন-দরবার হত।

নগরীর ১৫০ বছরের উপরে নগরীর প্রাচীন কাটাবিল কাটাবিল মুন্সীবাড়ীর মোহাম্মদ রুহুল আমিন সাবের বলেন জানান, আমাদের বাড়ি থেকে একটু দূরে একটি কাচারি ছিল। আমরা দাদা মকবুল আহমেদ কুমিল্লা ভিক্টোরিয়া সরকারি কলেজের এফ এ পাশ করেন। যে বছর ভিক্টোরিয়া কলেজের পথচলা শুরু সে বছর ইন্টারমিডিয়েট পাশ করেন। সে আমলে আমাদের একটি কাচারি ঘর ছিল ৪০ বছর আগে তা ভেঙে ফেলা হয়েছে।

নগর ইতিহাসবিদ আহসানুল কবির ভোরের কাগজকে জানান, প্রাচীন জনপদের ইতিহাস থেকে জানা যায়, কাচারি ঘরের কনসেপটা প্রায়  ৪০০ বছরের পুরনো। মূল ঘর থেকে একটু বাইরে কাচারি ঘরের অবস্থান ছিল। আগের দিনে দিনে যার কাচারি ঘর যত সুন্দর তাকে ঠিক সেভাবে মূল্যায়ন করা হতো। যারা মেহমান কিন্তু পরিবারের সঙ্গে ঘনিষ্ঠ আত্মীয়তার বন্ধনে আবদ্ধ না, তাদেরকে কাচারি ঘরে থাকতে দেয়া হতো। সামাজিক বিচার, দেন-দরবার, আগের দিনের একেবারে প্রাথমিক শিক্ষার শুরুটা কাচারি ঘর থেকে হত। এখন কাচারি ঘর বিলুপ্তির পথে। কাচারি ঘর এখন দেখা যায় না।

সাবস্ক্রাইব ও অনুসরণ করুন

সম্পাদক : শ্যামল দত্ত

প্রকাশক : সাবের হোসেন চৌধুরী

অনুসরণ করুন

BK Family App