×

জাতীয়

জাতিসংঘে বাংলাদেশের গণহত্যা নিয়ে পাকিস্তানের মিথ্যাচার

Icon

কাগজ প্রতিবেদক

প্রকাশ: ২১ এপ্রিল ২০২৩, ০৯:৪৯ এএম

জাতিসংঘে বাংলাদেশের গণহত্যা নিয়ে পাকিস্তানের মিথ্যাচার

জাতিসংঘে ১৯৭১ সালের ২৫ মার্চের গণহত্যার চিত্র প্রদর্শনী করার পর বাংলাদেশের বিরুদ্ধে চরম মিথ্যাচারে নেমেছে পাকিস্তান। দেশটির পত্রিকা ‘দ্য নেশন’ গত ৪ এপ্রিল বলেছে, ‘একতরফা এবং বিতর্কিত’ ছবির প্রদর্শনী বাতিল করার জন্য পাকিস্তান জাতিসংঘের প্রশংসা করেছে। অথচ জাতিসংঘে গণহত্যার ছবি প্রদর্শন তো বাতিল হয়নি, বরং ৩ দিনে গণহত্যার ছবি প্রদর্শন করা এবং প্রতিটি ছবির নেপথ্যের গল্প বিশ্ববাসীকে জানিয়ে দিয়ে বাংলাদেশ বড় অগ্রগতি অর্জন করেছে। সব মিলিয়ে পাকিস্তানি গণমাধ্যমের এমন মিথ্যাচারের কড়া প্রতিবাদ জানিয়েছে ঢাকা।

প্রসঙ্গত, গত ২৯ থেকে ৩১ মার্চ বাংলাদেশ জাতিসংঘে বীভৎস এই গণহত্যার প্রদর্শনীর আয়োজন করে সেখানকার বাংলাদেশ মিশন ও মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘর। প্রদর্শনীতে গণহত্যার ২৭টি ছবি প্রদর্শিত হয়, সঙ্গে যুক্ত হয় মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘর দ্বারা প্রদত্ত সংশ্লিষ্ট ঐতিহাসিক বর্ণনা। বাংলাদেশের পররাষ্ট্র সচিব মাসুদ বিন মোমেন প্রদর্শনীর উদ্বোধন করেন। সংশ্লিষ্টরা বলেছেন, বাংলাদেশ যেন জাতিসংঘে গণহত্যার সেই চিত্র জাতিসংঘে প্রদর্শন করতে না পারে সেজন্য বহু দেনদরবার করেছে পাকিস্তান। কিন্তু প্রদর্শনী আটকাতে পারেনি। বাংলাদেশ প্রথমবারের মতো জাতিসংঘে গিয়ে গণহত্যার চিত্র প্রদর্শনী করে। এরপরেই পাকিস্তান তার দেশের দৈনিক দ্য নেশনসহ বেশ কয়েকটি গণমাধ্যমে চিত্র প্রদর্শনী এবং গণহত্যা নিয়ে নোংরামিসহ মিথ্যা প্রচারণায় নেমেছে। পত্রিকাগুলো বলেছে, বাংলাদেশ জাতিসংঘে ১৯৭১ সালের ২৫ মার্চের গণহত্যা নিয়ে কোনো প্রদর্শনী করতে পারেনি। নিয়ম না মেনে বা ইতিহাস বিকৃত করে প্রদর্শনী আয়োজন করায় জাতিসংঘ প্রদর্শনী বন্ধ করে এবং বিতর্কিত ছবিগুলো নামিয়ে ফেলে।

পাকিস্তানি গণমাধ্যমের এমন বিকৃত মন্তব্যের পর বৃহস্পতিবার বাংলাদেশের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় এক বিবৃতিতে জানিয়েছে, জাতীয় গণহত্যা দিবস-২০২৩ উপলক্ষে জাতিসংঘ সদরদপ্তরে বাংলদেশ মিশন কর্তৃক আয়োজিত চিত্রপ্রদর্শনীটি জাতিসংঘ সদর দপ্তরের পূর্ণ সহযোগিতায় এবং প্রতিষ্ঠানটির সব নিয়ম মেনেই আয়োজন করা হয়েছে। অতএব ‘নিয়ম না মেনে বা ইতিহাস বিকৃত করে প্রদর্শনী আয়োজন করায় জাতিসংঘ প্রদর্শনী বন্ধ করে এবং বিতর্কিত ছবিগুলো নামিয়ে ফেলে’ বলে যে দাবি করা হয়েছে তা সত্য নয়, বরং নিতান্তই বানোয়াট। ১৯৭৪ সালে জাতিসংঘে বাংলাদেশের সদস্যপদ প্রাপ্তির পর এবারই প্রথম জাতিসংঘ সদরদপ্তরে ১৯৭১ সালে গণহত্যার শিকার শহীদদের সম্মানে এ ধরনের চিত্রপ্রদর্শনীর আয়োজন করা হয়।

পররাষ্ট্র সচিব মাসুদ বিন মোমেন বিভিন্ন দেশের রাষ্ট্রদূত, কূটনীতিক, প্রবাসী বাংলাদেশি ও বীর মুক্তিযোদ্ধাদের নিয়ে ২৯ মার্চ প্রদর্শনীটি ঘুরে দেখেন। ৩ দিনব্যাপী চলা এই প্রদর্শনী ’৭১-এর গণহত্যা বিষয়ে জাতিসংঘের সদস্যরাষ্ট্রগুলোর মধ্যে সচেতনতা সৃষ্টিতে ভূমিকা রাখবে বলে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় বিশ্বাস করে। ঐতিহাসিক এই আয়োজন সফল করতে সব সহযোগিতা দেয়ার জন্য বাংলাদেশ মিশন ঢাকার মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘর এবং নিউইয়র্কের জাতিসংঘ সদরদপ্তরের প্রতি আন্তরিকভাবে কৃতজ্ঞ। ’৭১-এর গণহত্যার আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি আদায়ে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের নানামুখী প্রচেষ্টা অব্যাহত থাকবে।

জানতে চাইলে মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘরের ট্রাস্টি মফিদুল হক গতকাল ভোরের কাগজকে বলেন, গণহত্যার চিত্র প্রদর্শনী নিয়ে বাংলাদেশ জাতিসংঘে বড় একটি কাজ করে ফেলেছে। পাকিস্তান বুঝতেই পারেনি, বাংলাদেশ কী করেছে। যখন বুঝতে পেরেছে তখন এটি আটকাতে মরিয়া হয়ে ওঠে। কিন্তু না পেরে তার দেশের পত্রিকাগুলো দিয়ে নোংরা মিথ্যাচারে নেমেছে। তিনি বলেন, ওরা যতই মিথ্যচার করুক, তাতে লাভ হবে না। কারণ প্রথমবারের মত ১৯৭১ সালের ২৫ মার্চের গণহত্যার চিত্র ও বর্ণনা নিয়ে বাংলাদেশ বৈশ্বিক প্ল্যাটফর্মে পৌঁছে গেছে। গণহত্যার স্বীকৃতি আদায়ের জন্য জাতিসংঘে এই চিত্র প্রদর্শনী বড় একটি অগ্রগতি বলেও জানান তিনি।

খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, গত ৪ এপ্রিল পাকিস্তানের পত্রিকা দ্য নেশন ১৯৭১ সালের ঘটনা নিয়ে বাংলাদেশের ‘একতরফা’ ছবির প্রদর্শনী বাতিল করার জন্য পাকিস্তান জাতিসংঘের প্রশংসা করেছে শিরোনামে সংবাদ প্রকাশ করে। এতে বলা হয়েছে, জাতিসংঘে বাংলাদেশের স্থায়ী মিশনের ১৯৭১ সালের ঘটনার ‘একতরফা এবং বিতর্কিত’ বর্ণনা নিয়ে আয়োজিত একটি ছবি প্রদর্শনী অবিলম্বে সরিয়ে নেয়ার জন্য জাতিসংঘের দ্রুত পদক্ষেপের প্রশংসা করেছে। পাকিস্তান পররাষ্ট্র দপ্তরের মুখপাত্র এক বিবৃতিতে বলেছেন, তথাকথিত ছবির প্রদর্শনীটি জাতিসংঘে ১৯৭১ সালের ঘটনাকে একতরফা এবং বিতর্কিত বর্ণনা দেয়ার জন্য বাংলাদেশের স্থায়ী মিশনের একটি ‘ব্যর্থ’ প্রচেষ্টা। যখন জাতিসংঘে পাকিস্তানের স্থায়ী মিশন দ্বারা বলা হয়, তখন ইতিহাসের ভুল উপস্থাপনা এবং প্রাসঙ্গিক জাতিসংঘের নিয়ম না মেনে চলার কারণে প্রদর্শনীটি অবিলম্বে বাতিল করা হয়েছিল। আমরা এই বিষয়ে জাতিসংঘের দ্রুত পদক্ষেপের প্রশংসা করি। তিনি বলেন, আমরা বিশ্বাস করি যে ১৯৭১ সালের ঘটনাগুলোর সঙ্গে সম্পর্কিত সমস্যাগুলো ১৯৭৪ সালে পাকিস্তান এবং বাংলাদেশের তৎকালীন নেতৃত্বের মধ্যে একটি চুক্তির মাধ্যমে সমাধান করা হয়েছিল। পাকিস্তান বাংলাদেশের জনগণের সঙ্গে ঘনিষ্ঠ এবং ভ্রাতৃত্বপূর্ণ সম্পর্কের জন্য তার আন্তরিক ভাবনাকে পুনরায় নিশ্চিত করে।

এদিকে বাংলাদেশের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, বাংলাদেশে পাক সেনা কর্তৃক ১৯৭১ সালের গণহত্যার শিকারদের স্মরণে প্রথমবারের মতো এখানে জাতিসংঘের সদর দপ্তরে প্রদর্শনী অনুষ্ঠিত হয়েছে। এই প্রদর্শনীতে ইতিহাসে প্রথমবারের মতো জাতিসংঘ সদর দপ্তরে ১৯৭১ সালের গণহত্যার চিত্র ও গল্প ২৫ মার্চ জাতীয় গণহত্যা দিবস স্মরণে মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘরের সহযোগিতায় আয়োজিত এই প্রদর্শনীর উদ্বোধন করেছিলেন বাংলাদেশের পররাষ্ট্র সচিব রাষ্ট্রদূত মাসুদ বিন মোমেন। উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে রাষ্ট্রদূত, জাতিসংঘের কর্মকর্তা এবং প্রবাসী বাংলাদেশিসহ মুক্তিযোদ্ধা ও শহীদদের পরিবারের সদস্যরা উপস্থিত ছিলেন।

বিশ্লেষকরা বলেছেন, ১৯৭১ সালে দখলদার বাহিনী এবং তাদের সহযোগীরা আমাদের জনগণের বিরুদ্ধে যে ভয়াবহ গণহত্যা করেছিল তার আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি আদায়ের প্রচেষ্টায় এটি একটি ঐতিহাসিক পদক্ষেপ। জাতিসংঘে বাংলাদেশের স্থায়ী প্রতিনিধি রাষ্ট্রদূত মুহাম্মদ এ মুহিত বলেছেন, আমাদের মহান মুক্তিযুদ্ধ এবং গণহত্যার গল্প আন্তর্জাতিক দর্শকদের মধ্যে জানানোর জন্য আমাদের আরো প্রচেষ্টা দরকার। এটি শুধু ১৯৭১ সালের গণহত্যার অত্যাবশ্যকীয় স্বীকৃতি নিশ্চিত করতেই সাহায্য করবে না বরং গণহত্যা এবং অন্যান্য নৃশংসতামূলক অপরাধ প্রতিরোধের প্রয়োজনীয়তা সম্পর্কে সচেতনতা বৃদ্ধিতেও সাহায্য করবে।

প্রদর্শনীতে গণহত্যার ২৭টি ছবি প্রদর্শিত হয় যার সংকলন থেকে মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘর দ্বারা প্রদত্ত সংশ্লিষ্ট ঐতিহাসিক বর্ণনা। এতে ভারতের বিভিন্ন শিবিরে শরণার্থীর সংখ্যা, নারীদের বিরুদ্ধে ব্যাপক সহিংসতা, বুদ্ধিজীবী হত্যা এবং ট্র্যাজেডি সম্পর্কিত সংবাদপত্রের নিবন্ধগুলোর মতো বিশদ বিবরণসহ ছবিও অন্তর্ভুক্ত রয়েছে। এতে বাংলাদেশের প্রতিষ্ঠাতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নেতৃত্বকেও তুলে ধরা হয়েছে।

একটি প্রদর্শনীতে লেখা হয়েছে- বাংলাদেশে ১৯৭১ সালের গণহত্যা, দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ-পরবর্তী সময়ে ঘটে যাওয়া সবচেয়ে নৃশংস অপরাধগুলোর মধ্যে একটি, দুর্ভাগ্যবশত, বিশ্বের জন্য একটি বিস্মৃত গণহত্যায় পরিণত হয়েছে। এতে আরো বলা হয়েছে, বাংলাদেশের গণহত্যাকে বিশ্বব্যাপী ফোকাসে ফিরিয়ে আনার, সংঘটিত অপরাধগুলোকে স্বীকৃতি দেয়ার এবং এর থেকে শিক্ষা নেয়ার সময় এসেছে ‘আবার কখনও নয়’। ১৯৭১ সালের যুদ্ধটি ২৫ মার্চ মধ্যরাতে পূর্ব পাকিস্তানে বাংলাদেশে পাকিস্তানি সেনাদের আকস্মিক ক্র্যাকডাউনের পর শুরু হয় এবং ১৬ ডিসেম্বর শেষ হয়। কারণ পাকিস্তান পরাজয় স্বীকার করে এবং ঢাকায় বাঙালি মুক্তিযোদ্ধা এবং ভারতীয় সেনাবাহিনীর সমন্বয়ে গঠিত মিত্রবাহিনীর কাছে নিঃশর্ত আত্মসমর্পণ করে।

২০২০ সালের ডিসেম্বরে জাতিসংঘ গণহত্যার শিকারদের আন্তর্জাতিক দিবস হিসেবে চিহ্নিত করায়, ভারত ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধে পাকিস্তান সেনাবাহিনী এবং ধর্মীয় মিলিশিয়াদের হাতে শহীদ হওয়া ৩০ লাখ মানুষ এবং ধর্ষণের শিকার লক্ষাধিক নারীর প্রতি শ্রদ্ধা জানানোর আহ্বান জানায়। জাতিসংঘে ভারতের তৎকালীন স্থায়ী প্রতিনিধি রাষ্ট্রদূত টি এস তিরুমূর্তি এক টুইট বার্তায় বলেছিলেন, ৯ ডিসেম্বর গণহত্যার শিকারদের জাতিসংঘ আন্তর্জাতিক দিবস। আসুন পাকিস্তান সেনাবাহিনীর দ্বারা পূর্ব পাকিস্তানে ৩ মিলিয়ন নিহত এবং ২ লাখ বা এরও বেশি নারীকে ধর্ষিতদের প্রতি শ্রদ্ধা জানাই।

২০১৭ সালের সেপ্টেম্বরে জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদে তার ভাষণে, বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেছিলেন যে পাকিস্তানের সেনাবাহিনী ১৯৭১ সালে একটি ‘জঘন্য’ সামরিক অভিযান শুরু করে যা মুক্তিযুদ্ধের সময় একটি ‘গণহত্যা’ শুরু করেছিল, ৩০ লাখ নিরীহ মানুষ হত্যা করেছিল। ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধে আমরা চরম গণহত্যা সহ্য করেছি। পাকিস্তানের বিরুদ্ধে ৯ মাসব্যাপী মুক্তিযুদ্ধে ৩০ লাখ নিরীহ মানুষ নিহত এবং ২ লাখেরও বেশি নারী নির্যাতনের শিকার হন। পাকিস্তান সামরিক বাহিনী ২৫ মার্চ জঘন্য ‘অপারেশন সার্চলাইট’ শুরু করেছিল- যা ছিল ১৯৭১ সালের গণহত্যার সূচনা।

সাবস্ক্রাইব ও অনুসরণ করুন

সম্পাদক : শ্যামল দত্ত

প্রকাশক : সাবের হোসেন চৌধুরী

অনুসরণ করুন

BK Family App