×

জাতীয়

৭ দফা যৌথ ঘোষণা নিয়ে ভেতরে-বাইরে মতবিরোধ

Icon

কাগজ প্রতিবেদক

প্রকাশ: ২০ এপ্রিল ২০২৩, ০৯:৪৪ এএম

৭ দফা যৌথ ঘোষণা নিয়ে ভেতরে-বাইরে মতবিরোধ

ছবি: সংগৃহীত

সরকারবিরোধী ১০ দফার পর যুগপৎ আন্দোলনের যৌথ ঘোষণা হিসেবে ৭ দফার খসড়া চূড়ান্ত করেছে বিএনপি। এই খসড়া নিয়ে খোদ বিএনপির ভেতরেই রয়েছে ভিন্ন মত। এমনকি যৌথ ঘোষণায় সবার মতামত নেয়া হয়নি- এমন অভিযোগ জোটের অনেক নেতারও। বিএনপির নেতারা বলছেন, অনেক দিন ধরে চলমান আন্দোলনের যে ১০ দফা দাবি, সেটাকে ৭ দফা করার কোনো সুযোগ নেই।

অবশ্য এসব দফা নিয়ে দল ও জোটের মধ্যে বিভেদ থাকলেও সরকারবিরোধী আন্দোলন ব্যাহত হবে না বলেও দাবি করেছেন তারা। গত বছরের ১০ ডিসেম্বরের সমাবেশ থেকে যুগপৎ আন্দোলনের ১০ দফা ঘোষণা করে বিএনপি। এই দফাগুলো নিয়ে সমমনা দলগুলোর মতামত ও সম্মতি নেয়া হয়েছে বলে সমাবেশের বক্তব্যে দাবি করেন দলের স্থায়ী কমিটির সদস্য খন্দকার মোশাররফ হোসেন। ওইদিন রাতেই জামায়াতসহ ২০ দলীয় জোট ১০ দফার সঙ্গে একত্মতা প্রকাশ করে বিবৃতি দিলেও প্রথম থেকেই এই দফা নিয়ে দ্বিধায় ছিল গণতন্ত্রমঞ্চ।

মঞ্চের নেতারা বরাবরই বলেছেন, বিএনপির সব ধরনের গণতান্ত্রিক প্রতিবাদে তারা রয়েছেন। যুগপৎ আন্দোলনও চলছে। তবে বিএনপি বেশ তাড়াহুড়ো করেই দফাগুলো প্রকাশ করেছে। জানতে চাইলে নাগরিক ঐক্যের আহ্বায়ক ও গণতন্ত্রমঞ্চের নেতা মাহমুদুর রহমান মান্না ভোরের কাগজকে বলেন, বিএনপির সঙ্গে আমাদের মতের কোনো বিরোধ হয়নি। তবে তারা যে ১০ দফা প্রকাশ করেছে সেখানে কিছু সংস্কার জরুরি। এ কারণেই গণতন্ত্রমঞ্চের পক্ষ থেকে একটা খসড়া বিএনপিকে দেয়া হয়েছে। ফেব্রুয়ারির মধ্যে চূড়ান্ত করার কথা থাকলেও এখনো হয়নি।

তবে আশা করছি দ্রুতই এ বিষয়ে যৌথ মতের সমন্বয় হবে। চূড়ান্ত আন্দোলনের ঘোষণাপত্রের ভিত্তিতে আন্দোলন হলে তা আরো গতি পাবে বলে মনে করেন মঞ্চের এই শীর্ষ নেতা। ১০ দফা সামনে রেখে বিভাগীয় সমাবেশ, মানববন্ধন, পদযাত্রার মতো কর্মসূচি পালন করেছে বিএনপি। সূত্র জানায়, যুগপৎ আন্দোলন শুরুর পর সমমনা দলগুলোর মধ্যে ছিল নানা আপত্তি। গত ৩০ ডিসেম্বর গণমিছিলের কর্মসূচি দিয়ে বিএনপিসহ সরকারবিরোধী সব দল ও জোট যুগপৎ কর্মসূচি পালন শুরু করে। প্রথম কর্মসূচির আগেই বিএনপির সঙ্গে যুগপৎ আন্দোলনের ভিত্তি চূড়ান্ত করতে চেয়েছিল গণতন্ত্রমঞ্চ। বারবার বিএনপিকে তাগাদা দিলেও বিষয়টি নিয়ে চুপ ছিল বিএনপি। পরে গণতন্ত্রমঞ্চের পক্ষ থেকে কিছু প্রস্তাবসহ যৌথ

ঘোষণাপত্রের খসড়া দেয়া হয় বিএনপিকে। একাধিকবার সভা করলেও যুগপৎ আন্দোলনের ভিত্তি হিসেবে এখনো ‘যৌথ ঘোষণাপত্র’ চূড়ান্ত করতে না পারায় বিএনপির সঙ্গে গণতন্ত্রমঞ্চের নেতাদের মতবিরোধ বাড়তে থাকে। এর জেরেই যুগপৎ আন্দোলনে থেকেও আলাদা কর্মসূচি পালন করতে থাকে গণতন্ত্রমঞ্চ। এমন অবস্থায় জোট ভেঙে যাওয়ার শঙ্কা থেকেই বিএনপির ১০ দফা, গণতন্ত্রমঞ্চের ১৪ দফা ও বাম গণতান্ত্রিক ঐক্যের ১৩ দফার সমন্বয়ে যুগপৎ আন্দোলনে অংশ নেয়া দলগুলোর সঙ্গে বৈঠক করে চূড়ান্ত করা হয় ৭ দফার খসড়া।

সূত্র জানায়, যৌথ ঘোষণার লক্ষ্যে ৭ দফা মানতে নারাজ বিএনপির শীর্ষ নেতৃত্বের অনেকেই। তাদের দাবি দীর্ঘদিন যে দফাগুলো সামনে নিয়ে বিএনপি আন্দোলন করেছে তা কোনো দল বা জোটের দাবির পরিপ্রেক্ষিতে ৭ দফায় নিয়ে আসার সুযোগ নেই। এতে এতদিন আন্দোলন করে প্রতিষ্ঠিত দাবিগুলো গুরত্ব হারাবে। জনমনে বিরূপ প্রভাব পড়বে।

জানতে চাইলে বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য গয়েশ্বর চন্দ্র রায় বলেন, বিএনপি ১০ দফার ভিত্তিইে আনুষ্ঠানিকভাবে আলোচনা করে আন্দোলনে রাজপথে রয়েছে। মাঝপথে কেউ এসে বলবে ১০ দফা না তিন দফা বা পাঁচ দফা হবে- এটা তো হয় না। ১০ দফায় সাড়া দিয়ে যারা যুগপৎ আন্দোলনে আসবে আমরা তাদের নিয়েই শেষ পর্যন্ত রাজপথে থাকব।

বিএনপির স্থায়ী কমিটির অপর সদস্য আমির খসরু মাহমুদ চৌধুরী বলেন, ওরা যে ৭ দফা দিয়েছে সেখানে সব দাবিই রয়েছে। মূলকথা হলো আমরা ন্যূনতম ঐক্যমতের ভিত্তিতে সরকার পতন এবং নিরপেক্ষ সরকারের জায়গায় একমত আছি এবং থাকব।

১০ দফা পরিবর্তিত হয়ে ৭ দফার খসড়া প্রস্তত হলেও সরকারবিরোধী আন্দোলনের দাবি সাত দফা নাকি ১০ দফাই থাকবে তা লিয়াজোঁ কমিটির নেতাদের কাছেও পরিষ্কার নয়। তবে নেতাদের ভাষ্য- দফায় কিছুই যায় আসে না। এরশাদ পতনের আন্দোলনের মতো এবারো জোটবদ্ধ আন্দোলন হবে। জানতে চাইলে বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য নজরুল ইসলাম খান ভোরের কাগজকে বলেন, আমরা এখনো ১০ দফা নিয়ে আন্দোলনে আছি। এর বাইরে সাত দফা না পাঁচ দফা হবে এ নিয়ে আমার আসলে কিছু জানা নেই।

বিএনপির যুগ্ম মহাসচিব মোয়াজ্জেম হোসেন আলাল বলেন, অনেকগুলো জোট মিলে যেভাবে সরকারবিরোধী আন্দোলনে জোটবদ্ধভাবে একটি রূপরেখা দেয়া হয়েছিল; সে লক্ষ্যেই আমরা এগোচ্ছি। আমরা যখন ফাইনাল ঘোষণায় যাব, তখন সব পরিষ্কার হবে- এই দফা কী সাত, দশ নাকি চৌদ্দ দফা হবে। অন্যদিকে, নতুন ৭ দফা নিয়ে ক্ষোভে ফুঁসছেন ২০ দলীয় জোটের নেতারা। তাদের মতে বিএনপির দেয়া ১০ দফা দাবির প্রতি একাত্মতা প্রকাশ করেই জোটের সবাই রাজপথে রয়েছে। এই সময়ে জোটের সবার সঙ্গে আলোচনা না করেই নতুন ঘোষণাপত্র যুগপৎ আন্দোলনে কতটা যুৎসই হবে এ বিষয়ে সন্দেহ রয়েছে।

জানতে চাইলে কল্যাণ পার্টির চেয়ারম্যান সৈয়দ মুহাম্মাদ ইব্রাহিম বলেন, ৭ দফার কনটেইন্টেন কী সেটা আমরা জানি না। যুগপৎ আন্দোলনে যারা আছেন, সবাইকে নিয়ে যদি ৭ দফা ঘোষণা দেয়ার পরিকল্পনা থাকে তবে সবারই মতামত লাগবে।

যুগপৎ আন্দোলনের নতুন ৭ দফা : ১. বর্তমান সরকারকে অনতিবিলম্বে পদত্যাগ করতে হবে। অবাধ, নিরপেক্ষ, গণতান্ত্রিক ও বিশ্বাসযোগ্য জাতীয় নির্বাচনের জন্য অন্তর্বর্তীকালীন সরকার গঠন করতে হবে। অন্তর্বর্তীকালীন সরকার বর্তমান অবৈধ ও অগ্রহণযোগ্য নির্বাচন কমিশন বাতিল করে সবার কাছে গ্রহণযোগ্য একটি স্বাধীন, দক্ষ ও নিরপেক্ষ নির্বাচন কমিশন গঠন করবে।

২. রাষ্ট্র কাঠামো মেরামত ও গণতান্ত্রিক রূপান্তরের লক্ষ্যে সাংবিধানিক ক্ষমতা কাঠামো এবং রাষ্ট্র পরিচালনার আইনকানুনের ন্যূনতম সংস্কার করতে হবে। ৩. বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়াসহ রাজনৈতিক নিপীড়নের অংশ হিসেবে দণ্ডপ্রাপ্ত সব বিরোধীদলীয় নেতাকর্মীসহ সংশ্লিষ্ট সবার সাজা বাতিল, সব হয়রানিমূলক মিথ্যা মামলা প্রত্যাহার ও সব রাজনৈতিক কারাবন্দিকে অনতিবিলম্বে মুক্তি দিতে হবে। ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন এবং বিশেষ ক্ষমতা আইনসহ গুম, খুন, বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড বন্ধ করতে হবে।

৪. গত ১৫ বছর ধরে বিদেশে অর্থপাচার, ব্যাংকিং ও আর্থিক খাত, শেয়ার মার্কেট, বিদ্যুৎ ও জ্বালানি খাতসহ রাষ্ট্রীয় সব ক্ষেত্রে সংগঠিত রোমহর্ষক নজিরবিহীন দুর্নীতি ও এর দায়-দায়িত্ব চিহ্নিত করতে শক্তিশালী কমিশন গঠন করতে হবে। দুর্নীতি, লুটপাট ও অর্থপাচারের সঙ্গে যুক্তদের বিরুদ্ধে দ্রুত যথাযথ শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নিতে হবে।

৬. নারীর অধিকার ও সব ধর্ম, জাতি ও প্রান্তিক মানুষের নাগরিক মর্যাদা ও অধিকার নিশ্চিত করা রাষ্ট্রের কর্তব্য, এই নীতির প্রতিষ্ঠা করতে হবে। ঘরে-বাইরে নারীর ওপর নির্যাতন বন্ধে কার্যকর আইন, ব্যবস্থা ও উদ্যোগ গ্রহণ করতে হবে। সা¤প্রদায়িক উসকানি সৃষ্টি করে ধর্মীয় ও জাতিগত সংখ্যালঘুদের ঘরবাড়ি, ব্যবসা প্রতিষ্ঠান, উপাসনালয় ভাঙচুর এবং তাদের সম্পত্তি দখলের জন্য দায়ীদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণ এবং তাদের জানমালের নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে হবে।

৭. জাতীয় স্বার্থ, জাতীয় সার্বভৌমত্ব ও জাতীয় নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে হবে। সমতা, ন্যায্যতা, পারস্পরিক স্বার্থের স্বীকৃতি ও আন্তর্জাতিক বিধিবিধান অনুযায়ী দ্বিপক্ষীয় সমস্যাদির সমাধান করতে হবে।

সাবস্ক্রাইব ও অনুসরণ করুন

সম্পাদক : শ্যামল দত্ত

প্রকাশক : সাবের হোসেন চৌধুরী

অনুসরণ করুন

BK Family App