×

জাতীয়

চতুর্মুখী সংকটে ব্যবসায়ীরা

Icon

কাগজ প্রতিবেদক

প্রকাশ: ১৩ এপ্রিল ২০২৩, ০৮:৪৫ এএম

চতুর্মুখী সংকটে ব্যবসায়ীরা

ছবি: সংগৃহীত

ক্রেতারা খুঁজছেন পরিচিত ব্যবসায়ীদের খোলা আকাশের নিচে গরমে হাঁসফাঁস

ভয়াবহ অগ্নিকাণ্ডে ভস্মীভূত হওয়ার ৮ দিন পর রাজধানীর বঙ্গবাজার মার্কেটে চৌকি পেতে জামাকাপড় বিক্রি শুরু করেছেন ব্যবসায়ীরা। অগ্নিকাণ্ডের স্থলে ইট ও বালি বিছিয়ে নিচের অংশ মার্কেটের উপযোগী করে গড়ে তোলা হয়েছে। তবে ওপরে নেই কোনো ছাউনি। বিদ্যুৎ কিংবা পয়ঃনিষ্কাশন ব্যবস্থাও নেই। এমন বাস্তবতায় তপ্ত রোদেই খোলা আকাশের নিচে চৌকি বসিয়ে এক হাতে ছাতা ধরে, অন্য হাতে মাল বিক্রি করতে হচ্ছে ব্যবসায়ীদের। এই অবস্থায় কেউ কেউ পেটে ভাতে বাঁচার যুদ্ধের কথা জানালেও হতাশায় দোকান শুরু করেননি বেশিরভাগ ব্যবসায়ী। দোকান না শুরুর পেছনে চতুর্মুখী সংকটের কথা বলছেন তারা।

ভুক্তভোগী ব্যবসায়ীদের দাবি, তারা বেশিরভাগই পাইকারী ব্যবসায়ী। এই ছোট চৌকিতে বেশি মালামাল না ধরায় তারা ব্যবসা করতে পারবেন না। যদি চৌকির উপরে কাপড়ের স্যাম্পল রেখে বিক্রি করেন, তাহলে গোদামের দরকার। যা এই মুহূর্তে তাদের পক্ষে নেয়া সম্ভব নয়। এরসঙ্গে রয়েছে মালামালের সংকট। যে গার্মেন্টস ও কারখানা থেকে মালামাল আনতেন তারা, সেখানে লাখ লাখ টাকা বকেয়া। ফলে তাদের কাছে নতুন করে বাকিতে মালামাল চাওয়া সম্ভব হচ্ছে না। আবার দোকান খুললে সেই পাওনাদাররা টাকার জন্য এসে বসে থাকবে।

কেউ যদি আত্মীয় স্বজনের কাছ থেকে হাত পেতে টাকা এনে মালামাল উঠাতে চায়, তাও সম্ভব নয়। কারণ রাতের বেলা মালামাল রাখবে কোথায়? গোদাম ভাড়া নিলেও মালামাল আনা নেয়ার জন্য আলাদা লেবার লাগবে। সবচেয়ে বড় কথা, রোদের যে তেজ, খোলা আকাশের নিচে ব্যবসা করতে গেলেই কাপড়ের রং জ্বলে যাবে। ফলে এই নিঃস্ব দশাতে আবার লোকসান গুনতে হবে। তবে, বেশিরভাগ ব্যবসায়ী অনুরোধ করেছেন, যত দ্রুত সম্ভব সহায়তা তহবিলের টাকা তাদের হাতে তুলে দিতে। তাহলে কিছুটা বেশি মালামাল তুলতে পারবেন না। এদিকে, বঙ্গবাজারে আগুনে ক্ষতিগ্রস্ত ব্যবসায়ীদের সহায়তার জন্য ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের (ডিএসসিসি) পক্ষ থেকে দুই কোটি টাকা অনুদান দেয়ার ঘোষণা দিয়েছেন মেয়র ফজলে নূর তাপস। পর্যায়ক্রমে সেখানে বিদ্যুৎ সংযোগ ও ছাউনির ব্যবস্থা করা হবে বলে জানিয়েছেন তিনি।

গতকাল বুধবার সরজমিনে দেখা যায়, পুড়ে ভস্মীভূত হয়ে যাওয়া বঙ্গবাজার মার্কেটস্থলে অর্ধেক জায়গায় ইট বালু দিয়ে উপরে সারি সারি চৌকি বসানো হয়েছে। একেটি চৌকি একজন ব্যবসায়ীর জন্য বরাদ্দ দেয়া হয়েছে। বিশেষ করে নিচতলায় যারা ব্যবসায়ী ছিলেন, তারাই অল্প অল্প মালামাল নিয়ে ব্যবসা শুরু করেছেন। দেড় শতাধিক ব্যবসায়ী দোকান চালু করলেও বেশিরভাগ ব্যবসায়ী চৌকি বসিয়ে নিজের জায়গা দখলে রাখছেন। আদর্শ মার্কেট এখনো অপসারণ না করায়, সেখানকার ব্যবসায়ীরা দোকান বসাতে পারেননি। অস্থায়ী দোকান শুরু করা বঙ্গ মার্কেটের নিচতলার হাফসা গার্মেন্টস নামে ১১৬০ নম্বর দোকানের ব্যবসায়ী ওমর ফারুক ভোরের কাগজকে বলেন, আগুনে ৩০ লাখ টাকার মালামাল পুড়ে ছাই হয়ে গেছে। গার্মেন্টস ও কারখানায় আরো ১০ লাখ টাকা দেনা আছি। সব মিলিয়ে অথৈ সাগরে পড়ে গেছি। এখন দোকান খুললে পাওনাদাররা ভিড় করবেন, তাই প্রথমে দোকান খুলতে চাইনি। পরে পাওনাদারদের সঙ্গে আলাপ করে, আগুনে সময়

রক্ষা করা এক বস্তা মালামাল নিয়ে দোকান শুরু করেছি। এখন একটাই চিন্তা, পেটে ভাতে চলা। আদর্শ মার্কেটের নিচতলার সিয়াম ফ্যাশন নামে ২১১ ও ৩০০ নম্বর দোকানের মালিক মো. আবুল হোসেন ভোরের কাগজকে বলেন, এখনতো আমাদের কিছু নাই। এই ছোট চৌকিতে নতুন করে কিভাবে ব্যবসা শুরু করব? এই জায়গায় স্যাম্পল হিসেবে কিছু মাল রাখা যাবে। বিক্রি করতে হলে গুদাম দরকার। আশপাশে গুদাম নিতে গেলে ১৫-২০ লাখ টাকা লাগবে। এই টাকা পাব কোথায়? পাশাপাশি লেবার নেয়া, রোদে পোশাকের রং জ্বলে যাওয়া, তপ্ত রোদে খোলা আকাশের নিচে কাস্টমার না আসাসহ নানা সংকটের কথা তুলে ধরেন তিনি।

সুমনা গার্মেন্টস নামের দোকানের মালিক মোহাম্মদ তানভীর বলেন, ‘এটা মিথ্যা আশ্বাস। এটা আশ্বাসের কোনো কাতারে পড়ে না। আছে আর দশ দিন। কীভাবে ব্যবসা করব? পাইকারি ব্যবসা তো আর এতদিন চলবে না। ঈদের পরে এখানে বেড়া দেবে। এরপরে বহুতল ভবন হবে। আমাদের চৌকি কেনা, এটাই ব্যর্থ। আয়ান গার্মেন্টসের মালিক আরিফ ব্যাপারী ভোরের কাগজকে বলেন, আজ (গতকাল) বিকেল ৩টা পর্যন্ত ৫০০ টাকা বিক্রি করতে পারছি। আগে লাখ লাখ টাকা বেঁচতাম, এখন হাজার টাকা বিক্রি হওয়াও কষ্ট। একদিক দিয়ে শুকরিয়া, টাকার মুখতো দেখলাম।

এদিকে অস্থায়ী দোকান শুরু হওয়ায় সেখানে উৎসুক জনতার ভিড় দেখা গেছে। সেইসঙ্গে কিছু কিছু পুরনো ক্রেতাও দেখা গেছে। যারা তাদের পরিচিত ব্যবসায়ীদের বিষয়ে খোঁজখবর নেন। ছেলের জন্য ফুল প্যান্ট কিনতে বেগমবাজার থেকে বঙ্গবাজারের পুড়ে যাওয়া মার্কেটে আসেন আনোয়ারা বেগম। তিনি বলেন, ‘২০ বছর ধরে আমি এখান থেকে ছেলেদের জন্য কাপড় কিনি। একটা দোকান থেকে কাপড় নিতাম। সেই চাচার সঙ্গে মহব্বত হয়ে গেছে, কিন্তু যেই চাচার দোকান থেকে কাপড় কিনি ওই চাচার দোকান পুড়ে গেছে। উনি কই বসছে সেটাও খুঁজে পাচ্ছি না। চিনতেও পারছি না। ‘এখানে আসছি ওনাকে খুঁজতে। তাকে পেলে তার দোকান থেকে আমার ছেলের জন্য কিছু কাপড় কিনব। আজকে না পেলে কালকে আবার আসব। তারপরও চাচাকে খুঁজব।

গতকাল দুপুরে চৌকি পেতে বঙ্গবাজারের ব্যবসায়ীদের ব্যবসা কার্যক্রম উদ্বোধন শেষে ডিএসসিসির মেয়র ফজলে নূর তাপস বলেন, ব্যবসায়ীদের পুনর্বাসনে সহায়তা ছাড়াও ঢাকা সিটি করপোরেশন মানবিকভাবে দুই কোটি টাকা ক্ষতিগ্রস্ত ব্যবসায়ীদের সহায়তা দেবে। ঢাকা শহরকে আমরা ব্যবসাবান্ধব নগরী হিসেবে সবাই মিলে গড়ে তুলবো। নিছক একটি দুর্ঘটনার জন্য যে ভয়াবহ ক্ষতি হয়ে গেলো সেটা যেন আর কোনো দিন না হয়। ভবিষ্যতে দুর্যোগ পরবর্তী ব্যবস্থাপনা মোকাবিলার জন্য আমরা সিটি করপোরেশন পক্ষ থেকে স্থায়ী কমিটি গঠন করে দিয়েছি।

ঈদের পরে পূর্ণাঙ্গভাবে পুনর্বাসনের ব্যবস্থা হবে উল্লেখ করে তিনি বলেন, আজকে থেকে পূর্ণোদমে এখানে ব্যবসা পরিচালনা হবে। আমাদের এখানে ৫টি পরিত্যক্ত ভবন ছিল, সেগুলো আমরা সরিয়ে ফেলেছি। আরো একটি বাকি আছে সেটাও আজকের মধ্যে হয়ে যাবে। আগে এখানে দোকান মালিকরা যেভাবে ব্যবসা করতেন তাদের সেভাবেই জায়গা দেয়া হয়েছে। আমরা তালিকাভুক্ত ক্ষুদ্র ব্যবসায়ীদের তাদের স্ব স্ব জায়গায় বসিয়ে দিতে পারছি। আমরা ঈদের আগে যদিও পূর্ণভাবে তাদের ক্ষতিপূরণ করতে পারব না। কিন্তু ঈদের পরে আমরা তাদের পূর্ণভাবে পুনর্বাসনের ব্যবস্থা করব। সেটা কীভাবে করর তা ব্যবসায়ী প্রতিনিধি ও সংশ্লিষ্টদের সঙ্গে পরামর্শ করে সিদ্ধান্ত নেয়া হবে।

সাংবাদিকদের প্রশ্নের জবাবে মেয়র বলেন, আপাতত খোলা আকাশের নিচে দোকানিরা বসছেন। পর্যায়ক্রমে ত্রিপল ও বিদ্যুতের ব্যবস্থা হবে। ব্যবসায়ীরা রাতেও বসতে পারবেন। এ সময় কথা প্রসঙ্গে বঙ্গবাজারের ক্ষতিগ্রস্ত দোকানি ও ব্যবসায়ীদের ইফতারের জন্য সাকিব আল হাসানের দেয়া ২০ হাজার টাকা দেয়া নিয়ে বিতর্কের কথা তুলে ধরেন বাংলাদেশ দোকান মালিক সমিতির সভাপতি হেলাল উদ্দীন। তিনি বলেন, যে ব্যবসায়ী সাকিবের অনুদানের টাকা নিয়ে এসব কথা বলেছেন তাকে আমরা চিনি না। তিনি আমাদের ব্যবসায়ীদের কেউ না। আমরা তার এমন আচরণে অনুতপ্ত।

উল্লেখ্য, ডিএসসিসির তদন্ত প্রতিবেদন অনুযায়ী ক্ষতিগ্রস্ত ব্যবসায়ীর সংখ্যা ৩ হাজার ৮৪৫ জন। এরমধ্যে ভস্মীভূত ৪ মার্কেটের ক্ষতিগ্রস্ত ব্যবসায়ী ২৯৬১ জন। তাদের মধ্যে ৭০০-৮০০ জন ব্যবসায়ী চৌকি বসিয়ে ব্যবসা করার সুযোগ পাবেন। যদিও ডিএসসিসির পক্ষ থেকে জানানো হয়েছে, ক্ষতিগ্রস্তদের তালিকা অনুযায়ী সবাই অস্থায়ীভাবে চৌকি বসিয়ে এখানে ব্যবসা করতে পারবেন।

সাবস্ক্রাইব ও অনুসরণ করুন

সম্পাদক : শ্যামল দত্ত

প্রকাশক : সাবের হোসেন চৌধুরী

অনুসরণ করুন

BK Family App