×

জাতীয়

ঢাকায় নিয়ন্ত্রণহীন শব্দসন্ত্রাস

Icon

কাগজ প্রতিবেদক

প্রকাশ: ০২ এপ্রিল ২০২৩, ০৮:৪০ এএম

ঢাকায় নিয়ন্ত্রণহীন শব্দসন্ত্রাস

ফাইল ছবি

উপেক্ষিত হাইকোর্টের নির্দেশনা

কানে কম শোনেন ৫৬ ভাগ ট্রাফিক পুলিশ

ভারী কলকারখানা, রাসায়নিক প্ল্যান্ট, যানবাহনের হাইড্রোলিক হর্ন ও নির্মাণকাজের উচ্চ শব্দে ঢাকাবাসী নানা সমস্যার সম্মুখীন হচ্ছেন। ঢাকায় যানবাহনে হাইড্রোলিক হর্নের উৎপাতে অতিষ্ঠ নগরবাসী। গণপরিবহনসহ ব্যক্তিগত যানবাহনে হাইড্রোলিক হর্নের ব্যবহার বেড়েছে। দেশের বিভাগীয় শহর এবং রাজধানী ঢাকায় নিয়ন্ত্রণহীন হয়ে পড়েছে শব্দসন্ত্রাস।

পরিবেশ বাঁচাও আন্দোলনের (পবা) এক জরিপে দেখা গেছে, রাজধানীর অনেক জায়গায় শব্দের মাত্রা ‘মানমাত্রার’ চেয়েও দেড়-দুইগুণ বেশি। কোনো নিময়নীতি না মেনেই যেখানে সেখানে হর্ন দিচ্ছেন চালকরা। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, হাসপাতাল ও বিভিন্ন অফিস আদালতের সামনে হর্ন ব্যবহারে নিষেধাজ্ঞা থাকলেও তা মানছেন না অনেকেই। উচ্চ আদালতের নিষেধাজ্ঞা থাকলেও আইনের প্রতি বৃদ্ধাঙ্গুলি দেখিয়ে বাস, মিনিবাস, ট্রাক, কাভার্ড ভ্যানসহ নানা ধরনের যানবাহনে তা ব্যবহার হয়ে আসছে। শব্দসন্ত্রাস নিয়ন্ত্রণে দূষণের প্রধান উৎস গাড়ির হর্ন, মাইক, হাইড্রোলিক হর্র্ন বাজানোর ক্ষেত্রে বিধিমালা প্রণয়নসহ সবার সচেতনতা বাড়ানোর বিকল্প নেই বলে মনে করছেন বিশেষজ্ঞরা।

৩ মার্চ বিশ্ব শ্রবণ দিবসে স্পিচ এন্ড হিয়ারিং এসোসিয়েশনের প্রকাশিত এক প্রতিবেদনে জানা গেছে, রাজধানী ঢাকায় ৫৬ ভাগ ট্রাফিক পুলিশ কানে কম শোনেন। শব্দ দূষণে প্রতি বছর প্রায় আড়াই থেকে তিন লাখ মানুষ ক্যানসারে আক্রান্ত হচ্ছে। থাইরয়েড রোগী বাড়ছে। যাদের অধিকাংশ ৪০ বছরের নারী। এছাড়া পরিবেশ দূষণ, বায়ু দূষণ এবং শব্দ দূষণের কারণে বন্ধ্যাত্ব বাড়ছে।

নয়েজ, ব্লেজেস এন্ড মিসম্যাচেস’ শীর্ষক প্রতিবেদন অনুযায়ী, বিশ্বের সবচেয়ে দূষিত শব্দের শহরের তালিকায় এক নম্বরে আছে ঢাকা। জাতিসংঘ পরিবেশ কর্মসূচির (ইউএনইপি) করা এই বৈশ্বিক প্রতিবেদনে চতুর্থ স্থানে রয়েছে রাজশাহী। প্রতিবেদনে বলা হয়, বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার নির্দেশনা অনুযায়ী, মানুষের জন্য আবাসিক এলাকায় শব্দের গ্রহণযোগ্য মাত্রা ৫৫ ডেসিবেল। আর বাণিজ্যিক এলাকার জন্য ৭০ ডেসিবেল। অথচ ঢাকায় এই মাত্রা ১১৯ ডেসিবেল ও রাজশাহীতে ১০৩ ডেসিবেল। চিকিৎসা বিজ্ঞানীদের মতে, যদি টানা ৮ ঘণ্টা ৯০ থেকে ১০০ ডেসিবেল শব্দ প্রতিদিন শোনা হয়, তা হলে ২৫ বছরের মধ্যে শতকরা ৫০ জনের বধির হওয়ার আশঙ্কা রয়েছে।

এক শব্দে সমস্যা বহুমুখী : বাস, ট্রাক বা যে কোনো ধরনের যানবাহনের শব্দ, আবাসিক এলাকায় বিল্ডিং তৈরির সময় ইট ভাঙার মেশিনের শব্দ, ক্যাসেটের দোকানে বা বিয়ে বাড়িতে উচ্চ শব্দে গান বাজানো, মাইকে বিজ্ঞাপন প্রচারসহ বিভিন্নভাবে শব্দদূষণ হচ্ছে। জনস্বাস্থ্য বিশেজ্ঞদের মতে, সাধারণত কোনো ধরনের শব্দ কানে প্রবেশের দুটি স্তর রয়েছে। এর একটি পরিবহন হিসেবে কাজ করে, একে কনডাকশন বলে। অন্যটি শব্দ গ্রহণ করে মস্তিষ্কে নিয়ে যায়, যাকে পারসেপশন বলে। শব্দদূষণের ভেতরে থাকলে কানের পারসেপশন স্তর ক্ষতিগ্রস্ত হয়ে ধীরে ধীরে শব্দ শোনার ক্ষমতা হারিয়ে যায়। শব্দদূষণ শরীরে ধীরে ধীরে ক্ষতি করে, ফলে আমরা এর ভয়াবহতা সহজে বোঝা যায় না। যখন ক্ষতি হয়ে যায়, তখন কিছু করারও থাকে না। শব্দদূষণের কারণে শ্রবণশক্তি হ্রাস পেতে পেতে একপর্যায়ে কানে

শোনার ক্ষমতা সম্পূর্ণ লোপ পেতে পারে। এছাড়া মেজাজ খিটখিটে হয়ে যায়, সামান্যতেই বিরক্তিবোধ করা এবং মানসিকভাবে দুর্বল হয়ে পড়ারও অন্যতম কারণ এই শব্দদূষণ। উচ্চ মাত্রার শব্দের কারণে হৃদরোগীর রক্তচাপ ও হৃদকম্পন বেড়ে গিয়ে মৃত্যুঝুঁকিও রয়েছে। সবচেয়ে বেশি ক্ষতির শিকার হচ্ছে শিশুরা। মাত্রাতিরিক্ত শব্দের কারণে শিশুরা ভয় পাচ্ছে। তাদের মনোযোগে ব্যাঘাত ঘটছে। মানসিক বিকাশ ব্যাহত হচ্ছে।

জানতে চাইলে জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ ডা. লেলিন চৌধুরী ভোরের কাগজকে বলেন, কান দিয়ে শ্রবণ করি। শব্দ দূষিত হলে শ্রবণযন্ত্র নষ্ট হয়। কানে শোনার প্রবণতা কমে যায়। ঢাকায় মধ্য ও মিশ্রমানের বধিরতায় ভুগছেন অনেকেই। শব্দদূষণ মস্তিষ্কের বিরক্তির একটি কারণ। তখন পালস রেট বাড়ে। এতে হৃৎপিণ্ডে সমস্যা হয়। হার্টের অসুখ, ব্লাড প্রেশ্রার বেড়ে যায়। তখন স্ট্রোক হতে পারে। মস্তিষ্কে এই চাপের কারণে রক্তে স্টেস হরমোন বেড়ে যায়, গ্লুকোজ বেড়ে যায় এবং ডায়াবেটিকস হয়। আমাদের মনোযোগ কমে যায়। ঢাকার রাস্তায় প্রায়ই দেখি অতি তুচ্ছ কারণে রিক্সা ও গাড়ি চালকের মধ্যে বাকবিতণ্ডা থেকে মারা মারি হয়ে যায়। এটি এই শব্দদূষণের প্রভাব। এছাড়া মস্তিষ্ক উত্তেজিত হওয়ার কারণে ব্যক্তিত্বের বিকাশ ঠিকমতো হয় না।

এ ব্যাপারে পরিবেশ বাঁচাও আন্দোলনের চেয়ারম্যান আবু নাসের খান ভোরের কাগজকে বলেন, শব্দদূষণের কারণে মায়ের পেট থেকেই শিশুরা মারাত্মক ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। প্রাথমিকভাবে শ্রবণযন্ত্র ও হার্টের সমস্যা হয়। কিন্তু এর সামগ্রিক ক্ষতির পরিমাণ ভয়াবহ। মানুষ দিন দিন বধির হয়ে যাচ্ছে। ট্রাফিক পুলিশ ও রাস্তার পাশের মানুষদের সমস্যা সবচেয়ে বেশি। হাইড্রোলিক হর্ন, উচ্চস্বরে নাচ-গান, মাইক বাজানো, ভবন নির্মাণ ও কলকারখানার শব্দসহ নানাভাবে শব্দদূষণ করা হচ্ছে। উচ্চস্বরে কথা বলাও যে সমস্যা, এটিও অনেকেই বুঝতে পারে না। আশার দিক আগের থেকে প্রাইভেট কারে হর্ন এখন কমেছে। তবে বাইকগুলো এখনো অনেক বেশি হর্ন বাজায়।

নিয়ন্ত্রণহীন শব্দসন্ত্রাস : বাংলাদেশে শব্দদূষণকে মোকাবিলায় কিছু আইন, নিয়ম ও বিধান রয়েছে। যেমন, পরিবেশ সংরক্ষণ আইন ১৯৯৫, পরিবেশ সংরক্ষণ বিধান ১৯৯৭, শব্দদূষণ (নিয়ন্ত্রণ) বিধিমালা ২০০৬ ইত্যাদি। এ আইনগুলো শব্দদূষণের সমস্যাকে সমাধান করতে বিস্তারিত দিকনির্দেশনা দেয়। কিন্তু এই আইনগুলোর বাস্তবায়নে কোনো কঠোর উদ্যোগ দেখা যায় না। শব্দ দূষণের জন্য দায়ী হাইড্রোলিক হর্নের ব্যবহার বন্ধের বিষয়ে নির্দেশনা বাস্তবায়নে কী পদক্ষেপ নেয়া হয়েছে তা জানতে চেয়ে দুই সপ্তাহ সময় বেঁধে দিয়েছিল হাইকোর্ট (২০২১ সালের ২১ জানুয়ারি)। এ বিষয়ে হলফনামা আকারে প্রতিবেদন জমা দিতে বিআরটিএ চেয়ারম্যানসহ সংশ্লিষ্ট ছয়জনকে বলা হয়েছিল। ওই ধারাবাহিকতায় ওই বছরের ৫ নভেম্বর সারাদেশে যানবাহনে হাইড্রোলিক হর্ন বন্ধের নির্দেশ দিয়েছিলেন আদালত।

একইসঙ্গে, রাজধানীর ধানমন্ডি, গুলশান, বনানী, অফিসার্স ক্লাব ও বারিধারা এলাকাসহ সারাদেশে আইনে নির্ধারিত মাত্রার চেয়ে বেশি শব্দ হচ্ছে কিনা তা নির্ধারণের জন্য একটি নজরদারি টিম গঠনের নির্দেশ দেয়া হয়। পাশাপাশি এসব এলাকায় শব্দদূষণ সৃষ্টিকারীদের বিরুদ্ধে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নিতে পুলিশের মহাপরিদর্শক, বিভাগীয় পুলিশ কমিশনার (হাইওয়ে), ট্রাফিক পুলিশের যুগ্ম কমিশনার ও বিআরটিএর চেয়ারম্যানের প্রতি এ নির্দেশনা দেয়া হয়েছিল। কিন্তু সে ব্যাপারে তেমন কোনো উদ্যোগ নেই বলে জানিয়েছেন পরিবেশবিদরা।

আবু নাসের খান বলেন, সর্বত্র সমন্বয়হীনতা একটি বড় সমস্যা। এছাড়া আমাদের আইনের প্রাতিষ্ঠানিক সমস্যা আছে। শব্দদূষণ পরিবেশ দূষণ আইনের অধীনে একটি বিধিমালা। পরিবেশ অধিদপ্তরের লোকবল কম। তাদের কাজের গতি হওয়া উচিত। তিনি বলেন, শব্দদূষণের প্রধান উৎসগুলো অগ্রাধিকার ভিত্তিতে বন্ধ করতে হবে এবং পরিবেশ অধিদপ্তর, বিআরটিএ, বিআরটিসি, পুলিশ, রাজউক, সিটি করপোরেশনকে পৃথকভাবে দায়িত্ব ভাগ করে সমন্বয় করে কাজ করতে হবে।

সাবস্ক্রাইব ও অনুসরণ করুন

সম্পাদক : শ্যামল দত্ত

প্রকাশক : সাবের হোসেন চৌধুরী

অনুসরণ করুন

BK Family App