×

জাতীয়

জাতীয় পার্টির নেতাদের মুখে ঐক্যের কথা, ভেতরে গুমোট

Icon

কাগজ প্রতিবেদক

প্রকাশ: ০১ এপ্রিল ২০২৩, ১১:১৬ এএম

জাতীয় পার্টির নেতাদের মুখে ঐক্যের কথা, ভেতরে গুমোট

ছবি: সংগৃহীত

কিছুদিন আগে পাল্টাপাল্টি বক্তব্য, বিবৃতি, বহিষ্কার ও রওশন এরশাদের কাউন্সিল আহ্বানকে কেন্দ্র করে জাতীয় পার্টির আকাশে ভাঙ্গনের কালো মেঘ ঘনিভূত হয়েছিল। পরবর্তীতে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সঙ্গে দলটির চেয়ারম্যান জি এম কাদের ও প্রধান পৃষ্ঠপোষক সংসদের বিরোধীদলীয় নেতা রওশন এরশাদের বৈঠকের পর পরিস্থিতি পাল্টে যায়। উভয় নেতার পক্ষ থেকে আসে সমঝোতার সুবাতাস।

দুই পক্ষই সব দ্বন্দ্ব ভুলে গিয়ে ঐক্যবদ্ধভাবে দল পরিচালনার কথা বলে। তবে বেশ কিছুদিন চুপচাপ থাকলেও আদতে সমস্যার দৃশ্যমান কোনো উন্নতি হয়নি বরং দলে পুরোমাত্রায় দুটি ধারা বিদ্যমান। এ পরিস্থিতিতে নেতাকর্মীদের অনেকে বলছেন, আসলে এই ঐক্যের ডাক ছিল এক ধরনের ‘মেকআপ’, মুখে ঐক্যের কথা বললেও ভেতরে বরাবরই গুমোট অবস্থা বিরাজমান।

গত বছরের ৩১ আগস্ট জাপার প্রধান পৃষ্ঠপোষক ও সংসদের বিরোধীদলীয় নেতা রওশন এরশাদ হঠাৎ দলের কাউন্সিল আহ্বান করেন। এটাকে কেন্দ্র করে দলের মধ্যে দ্বন্দ্ব-বিরোধ প্রকাশ্যে রূপ নেয়। একপর্যায়ে সংসদের বিরোধীদলীয় নেতার পদ থেকে রওশন এরশাদকে বাদ দিয়ে জি এম কাদেরকে ঘোষণা করতে দলের ২৪ জন সংসদ সদস্য স্বাক্ষরিত চিঠি স্পিকারকে দেয়া হয়।

এ নিয়ে উভয়পক্ষে প্রায় চার মাস ধরে পাল্টাপাল্টি বক্তব্য, বিবৃতি ও চেয়ারম্যান কর্তৃক কয়েকজন শীর্ষ নেতাকে অব্যাহতির ঘটনাও ঘটে। এ পরিস্থিতিতে দলটি দুই ভাগে বিভক্ত হয়ে যাওয়ার উপক্রম হয়েছিল। কিন্তু পরবর্তীতে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সঙ্গে জাপার উভয় নেতার বৈঠকের পর উত্তেজনা প্রশমিত হয়।

এরপর জি এম কাদের ও রওশন এরশাদ ঐক্যবদ্ধভাবে দল পরিচালনার ঘোষণা দেন। কিন্তু এই ঘোষণার তিন মাসের মধ্যে কেউ কারো সঙ্গে ঠিকমতো কথাবার্তা বা যোগাযোগ করেননি। দুই অংশের দুই শীর্ষ নেতা দলের প্রতিষ্ঠাবার্ষিকী ছাড়া কোনো প্রোগ্রামেও একসঙ্গে অংশ নেননি। এ পরিস্থিতিতে দলের ভেতরে আবারো ‘গোলমাল’ তৈরি হয়েছে বলে জানা যায়।

দলীয় সূত্র বলছে, বর্তমানে দলে পুরোমাত্রায় দুটি ধারা বিদ্যমান। দুই পক্ষই জাতীয় সম্মেলনের জন্য অগ্রসর হচ্ছে। জি এম কাদের তার মতো করে বিভিন্ন জেলা সম্মেলন করছেন, আগামী জুন মাসের মধ্যে তারা সব জেলা সম্মেলন শেষ করবে। এরপর আগামী নির্বাচনের আগে (সম্ভাব্য আগস্ট-সেপ্টেম্বর মাসে) দলের কাউন্সিল করার চিন্তাও আছে জি এম কাদেরের। এছাড়া ঈদুল ফিতরের পর প্রতিটি বিভাগে গণসংযোগের জন্য একটি করে বড় সমাবেশ করার পরিকল্পনাও রয়েছে।

আরেকটি পক্ষ দলের প্রধান পৃষ্ঠপোষক রওশন এরশাদকে সামনে রেখে জি এম কাদেরের বাইরে বলয় তৈরির চেষ্টা করছে। জি এম কাদেরপন্থি নেতাকর্মীরা বলছেন, জি এম কাদের গঠনতন্ত্র অনুযায়ী দল পরিচালনা ও নেতাকর্মীদের মতামতের ভিত্তিতে সিদ্ধান্ত নিতে চান। এভাবে দল পরিচালনা করলে বিপরীত ধারার নেতাদের (রওশনপন্থী) কর্তৃত্ব হুমকির মুখে পড়বে, এমন আশঙ্কা থেকেই তারা নানা সময়ে নানা তৎপরতা চালাচ্ছে। পার্টি চেয়ারম্যানের বিরুদ্ধে মামলা, সময়ে সময়ে সম্মেলন, কমিটি গঠনের মতো কাজেও নেপথ্য ভূমিকা রাখেন এসব নেতা।

অন্যদিকে, রওশনপন্থী নেতাকর্মীরা দাবি করছেন- উভয় নেতা দলের স্বার্থে ঐক্যের কথা বললেও এতদিনেও বাস্তবায়ন হয়নি ঐক্য প্রক্রিয়ার কোনো প্রতিশ্রুতি। দলে ফিরিয়ে নেয়া হয়নি বহিষ্কৃত ও পরীক্ষিত ত্যাগী নেতাদের। দলকে ঐক্যবদ্ধ করতে হলে বহিষ্কৃত ও অব্যাহতি দেয়া নেতাদের দলে ফিরিয়ে নিতে হবে।

নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক জাপার মধ্যম সারির দুই নেতা বলেন, সমঝোতায় উভয় পক্ষকেই ছাড় দিতে হবে। একদিকে যেমন জি এম কাদেরের বিরুদ্ধে করা মামলা প্রত্যাহার হয়নি, অন্যদিকে বহিষ্কৃত নেতাদের বিষয়েও সিদ্ধান্ত নেয়া হয়নি। নিজেদের মধ্যে এসব ভুল সংশোধন করে পার্টিকে শক্তিশালী করতে উদ্যোগ নিতে হবে। তাহলে দল আরো বেশি শক্তিশালী হবে।

এ অবস্থায় দলের সাধারণ নেতাকর্মীরা হতাশা প্রকাশ করেছেন, তারা বলছেন- আসলে রওশন এরশাদ ও জি এম কাদের দুজনই সমঝোতায় আগ্রহী নয়। তারা চেয়ারম্যান পদ চান। মুখে ঐক্যের কথা বললেও দুজনই ভেতরে জিইয়ে রেখেছেন সেই পুরনো দ্বন্দ্ব-বিরোধ।

সংশ্লিষ্টরা বলছেন, দলের শীর্ষ দুই নেতার সেই দ্ব›দ্ব-বিরোধ আবারো প্রকাশ্যে আসতে শুরু করেছে। এরই রেশ ধরে গত ১৩ মার্চ রওশন এরশাদ আহুত জাতীয় সম্মেলন প্রস্তুতি কমিটির বৈঠক করেছেন তার অনুসারিরা।

গুলশানের অস্থায়ী কার্যালয়ে অনুষ্ঠিত হওয়া ওই বৈঠকে রওশন এরশাদ ভার্চুয়ালি অংশ নেন। যদিও এই জাতীয় সম্মেলন প্রস্তুতি কমিটির কার্যক্রম তিন মাস আগে স্থগিত করেছিলেন রওশন। হঠাৎ আবার এই বৈঠক করায় দলের নেতাকর্মীদের মধ্যে গুঞ্জনের পাশাপাশি হতাশা ও ক্ষোভ বিরাজ করছে।

এছাড়া গত সোমবারও পার্টির প্রতিষ্ঠাতা মরহুম হুসেইন মুহম্মদ এরশাদের ৯৪তম জন্মদিন জি এম কাদের ও রওশন এরশাদ পৃথকভাবে পালন করেন। জি এম কাদের কাকরাইলে পার্টির কেন্দ্রীয় কার্যালয়ে নেতাকর্মীদের এরশাদের প্রতিকৃতিতে ফুল দিয়ে শ্রদ্ধা জানান।

অন্যদিকে, রওশন এরশাদ গুলশানে তার বাসভবনে কেক কাটা ও দোয়া অনুষ্ঠানের আয়োজন করেন। সেখানে তার বলয়ের অনুসারীরা অংশ নেন। যদিও পৃথক অনুষ্ঠানের বিষয়ে রওশন এরশাদ বলেছেন, পৃথক অনুষ্ঠান কোনোভাবেই দলের মধ্যে দ্ব›দ্ব প্রমাণ করে না। তিনি বলেন, জাতীয় পার্টিতে কোনো বিভেদ নেই।

জানা যায়, রওশন এরশাদ জাতীয় সম্মেলন কমিটির যে স্থগিতাদেশ দিয়েছিলেন, তা খুব শিগগিরই প্রত্যাহার করতে পারেন। গত ১৩ মার্চ গুলশানে অনুষ্ঠিত সভায় সভাপতিত্ব করেন জাতীয় পার্টির প্রেসিডিয়াম সদস্য মাসুদ পারভেজ সোহেল রানা। ওই সভায় চেয়ারম্যান জি এম কাদের কর্তৃক বহিষ্কৃত ও অব্যাহতি পাওয়া রওশনপন্থি হিসেবে পরিচিত সিনিয়র ও মধ্যম সারির অনেক নেতা উপস্থিত ছিলেন। সভায় স্বাধীনতা দিবস পালনের জন্য বিভিন্ন কর্মসূচি নেয়া হয়।

এ বিষয়ে রওশন এরশাদের রাজনৈতিক মুখপাত্র কাজী মামুনুর রশীদ বলেন, ম্যাডামসহ আমরা সবাই সমঝোতার পক্ষে। পাশাপাশি তৃণমূলের নেতাকর্মীরা অর্থাৎ যারা হুসেইন মুহম্মদ এরশাদকে মনেপ্রাণে ভালোবাসেন তারাও সমঝোতার পক্ষে। ঐক্য না থাকলে দলের শক্তি থাকে না। এতে মধ্যবর্তী রাজনৈতিক শক্তি যারা আছে তারা এ সুযোগ কাজে লাগাতে চেষ্টা করবে। সেজন্য রওশন এরশাদ ঐক্য চান, আমরাও ঐক্য চাই। কিন্তু ঐক্য প্রক্রিয়া যেভাবে হওয়ার কথা- মধ্যখানে কেন জানি এই প্রক্রিয়া থেমে গেছে। এ বিষয়ে রওশন এরশাদ খুব দ্রুতই একটা সিদ্ধান্ত জানাবেন।

জানতে চাইলে জাতীয় পার্টির প্রেসিডিয়াম সদস্য সাইদুর রহমান টেপা বলেন, জাতীয় পার্টির ঐক্য প্রক্রিয়া ঠিক আছে। একেবারেই কোনো বিভাজন নেই। দলের মধ্যে কোনো দ্ব›দ্ব নেই। এসব গুঞ্জন ছাড়া আর কিছুই নয়। জাতীয় পার্টি এক এবং অভিন্ন। এতে জিরো পারসেন্টও বিতর্ক নেই। এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, রওশন এরশাদ পূর্ণ-সমর্থন দিয়েছেন জি এম কাদেরকে। তার সঙ্গে জি এম কাদেরের কোনো দ্ব›দ্বও নেই। কে কি বলল, কে কি করল, এটা নিয়ে আমাদের কোনো মাথাব্যথা নেই। তবে দলে বহিষ্কৃত নেতাদের ফেরানোর বিষয়ে এখনো কোনো আলোচনা হয়নি।

সাবস্ক্রাইব ও অনুসরণ করুন

সম্পাদক : শ্যামল দত্ত

প্রকাশক : সাবের হোসেন চৌধুরী

অনুসরণ করুন

BK Family App