×

জাতীয়

রোহিঙ্গাদের মাঝে ভীতির সঞ্চার করতেই ক্যাম্পে আগুন আরসার!

Icon

কাগজ প্রতিবেদক

প্রকাশ: ৩১ মার্চ ২০২৩, ১২:৪২ পিএম

রোহিঙ্গাদের মাঝে ভীতির সঞ্চার করতেই ক্যাম্পে আগুন আরসার!

ছবি: সংগৃহীত

মিয়ানমার সরকারের নিপীড়নের পর বাস্তুচ্যুত হয়ে কক্সবাজারের উখিয়া-টেকনাফের ৩৩ ক্যাম্পে আশ্রয় পেয়েছে ১০ লাখের বেশি রোহিঙ্গা। সেসব ক্যাম্পেই মিয়ানমারের বিচ্ছিন্নতাবাদী দুর্বৃত্ত সংগঠন আরাকান রোহিঙ্গা স্যালভেশন আর্মির (আরসা) সদস্য বিপথগামী কিছু রোহিঙ্গা প্রায়ই বিভিন্ন অপকর্ম করে বেড়াচ্ছে। বেশ কিছু ক্যাম্পে তারা নির্বিঘেœ অপরাধকাণ্ড ঘটালেও উখিয়ার বালুখালী ক্যাম্পে প্রতিরোধের মুখে পড়েছে বারবার। এ কারণে আধিপত্য বিস্তার ও নিজেদের সম্পর্কে ভীতির সঞ্চার করতে বালুখালী রোহিঙ্গা ক্যাম্পে আগুনের ঘটনা ঘটাচ্ছে কথিত সন্ত্রাসী গোষ্ঠী আরসা- এমনটি মনে করছেন সাধারণ রোহিঙ্গারা।

এসব অগ্নিকাণ্ডের ঘটনায় বেশির ভাগ সময়ই পুড়ছে রোহিঙ্গাদের হাজার হাজার ঘর। অনেক সময় ক্ষয়ক্ষতির পাশাপাশি বড় ধরনের প্রাণহানির নজিরও রয়েছে। গত পাঁচ বছরে তিন শতাধিক অগ্নিকাণ্ডের ঘটনা ঘটেছে। এতে পুড়েছে রোহিঙ্গাদের ঘর, নিঃস্ব হয়েছে কয়েক লাখ মানুষ। ঘুরেফিরে ক্যাম্পগুলোতে কেন অগ্নিকাণ্ডের ঘটনা ঘটছে এমন প্রশ্ন কয়েক বছর ধরে সাধারণ মানুষের মনে একটি রহস্যের জন্ম দিয়েছে।

গত ১৫ ফেব্রুয়ারি প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত সংসদীয় স্থায়ী কমিটির প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ২০২১ সালে আশ্রয় শিবিরে ২২২টি অগ্নিকাণ্ডের ঘটনা ঘটেছে। এর মধ্যে ৯৯টি দুর্ঘটনাজনিত, ৬০টি নাশকতামূলক ও ৬৩টির কারণ জানা যায়নি।

এদিকে ফায়ার সার্ভিসের তথ্য অনুযায়ী, ২০১৮ সালে ৮টি, ২০১৯ সালে ১০টি এবং ২০২১ সালে কক্সবাজারের শরণার্থী শিবিরগুলোতে ৬৫টি অগ্নিকাণ্ডের ঘটনা ঘটেছে। যদিও সংসদীয় কমিটির প্রতিবেদনে ছিল ২২২টি। ২০২০ সালে ঘটেছিল ৮২টি। যদিও রোহিঙ্গাদের হিসাবে এই সংখ্যা আরো বেশি। এছাড়া চলতি বছর গত তিন মাসে ছোট বড় ১৫টি অগ্নিকাণ্ডের ঘটনা ঘটেছে।

সর্বশেষ দুর্বৃত্তের দেয়া আগুনে দুই হাজারের অধিক রোহিঙ্গা বসতি পুড়ে ছাই হয়েছে। এখনো মাথা গোঁজার ঠাঁই করতে পারেনি অনেক রোহিঙ্গা। তবে আইওএমসহ একাধিক সাহায্য সংস্থার তত্ত্বাবধানে বাঁশ-বেড়া ও তাঁবু দিয়ে ঘর তৈরির কাজ এগিয়ে চলছে বলে জানিয়েছেন কক্সবাজার শরণার্থী ত্রাণ ও প্রত্যাবাসন কার্যালয়ের অতিরিক্ত কমিশনার মো. সামছু দ্দৌজা।

এদিকে অগ্নিকাণ্ডে ক্ষতিগ্রস্তদের অন্যতম এক বৃদ্ধা জানান, শুধু এক স্থানে নয়, একযোগে অন্তত ৫/৬ জায়গায় আগুন ধরিয়ে দেয় কথিত সন্ত্রাসীরা। অস্ত্রের ভয় দেখিয়ে সাধারণ রোহিঙ্গাদের ঘরেও আগুন ধরিয়ে দেয়। নাম প্রকাশ না করার শর্তে ক্যাম্পের এক ব্লক মাঝি জানান, আরসার সদস্যরা অন্যান্য ক্যাম্পে তাদের প্রভাব বিস্তার করতে পারলেও ক্যাম্প-১১ ও আশপাশের ক্যাম্প ও ব্লকে বাধা পেয়ে আধিপত্য বিস্তারে ব্যর্থ হচ্ছিল। হয়তো এ কারণে তারা ১১ নম্বর ক্যাম্পে আগুন লাগিয়ে সাধারণ রোহিঙ্গাদের এভাবে ভোগান্তিতে ফেলছে। তার এ শঙ্কার সত্যতা মিলেছে ইউটিউবে কথিত আরসা নেতার উস্কানিমূলক অডিওতে।

গত ৩ মার্চ রোহিঙ্গাভিত্তিক ইউটিউব চ্যানেল ‘রোহিঙ্গা রিয়েল ভয়েস’ এ প্রচারিত একটি ভিডিওতে আরসা নেতাকে উদ্ধৃত করে এক রোহিঙ্গার অডিও প্রচার করা হয়। অডিওতে অজ্ঞাত ওই রোহিঙ্গা নিজেকে আরসার সদস্য দাবি করেন এবং ক্যাম্পে যারা আরসাকে ‘দমনে’ জড়িত তাদের হুঁশিয়ারি দেন। হুমকি দিয়ে আরো বলা হয়, ক্যাম্পে বড় ধরনের ঘটনা ঘটানো হবে, যদি আরসার ওপর ক্ষোভ বন্ধ না হয়। বার্তাটি প্রচারের দুই দিনের মাথায় দিনেদুপুরে ভয়াবহ অগ্নিকাণ্ডের ঘটনা ঘটল।

রোহিঙ্গা সূত্রের দাবি, গত ৫ মার্চ বিকাল ৩টার দিকে আরসা সন্ত্রাসী হিসেবে ক্যাম্পে পরিচিত জনৈক এহসান ও ছমিউদ্দিনের নেতৃত্বে বালুখালী রোহিঙ্গা ক্যাম্প-১১ এর ডি-এ ১৪ ও বি ব্লকে ১০/১৫ জনের একটি সশস্ত্র দুর্বৃত্তদল একটি ঘরে প্রথমে আগুন ধরিয়ে দেয়। এর অল্প সময় আগে পরে ডি-এ ব্লকসহ বি-ব্লকের একাধিক ঘরে আগুন জ্বলে ওঠে। আগুন চারদিকে ছড়িয়ে পড়লে আরসার সশস্ত্র সন্ত্রাসীরা দ্রুত ঘটনাস্থল থেকে সরে যায়। আগুনের লেলিহান শিখা থেকে প্রাণ রক্ষায় বসবাসরত রোহিঙ্গারা দিগবিদিক দৌড়ে পালায়। মুহূর্তে ক্যাম্পের বসতঘর, মসজিদ, মাদ্রাসা, স্কুল, দোকান, দাতা সংস্থার হাসপাতাল, সার্ভিস ও লার্নিং সেন্টার পুড়ে ছাই হয়ে যায়।

গত ৬ মার্চ সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে প্রচার পাওয়া একটি ভিডিওচিত্রে দেখা যায়, ক্যাম্পে দাউ দাউ আগুন জ্বলছে। বসতিতে নিজ হাতে আগুন ধরিয়ে দিয়ে পালিয়ে যাচ্ছে একজন। নাম প্রকাশ না করার শর্তে এক ব্যক্তি বলেন, একজন রোহিঙ্গা একটি ঘরের চালে আগুন ধরিয়ে দিচ্ছে দেখে আমি ভিডিও করেছি। বেশ কয়েকটি স্থানে আগুন জ্বলে উঠতে দেখা যায়। এটা পুরোটাই নাশকতা বলে মন্তব্য তার।

ক্ষতিগ্রস্ত রোহিঙ্গাদের অনেকেই জানান, রহস্যজনক আগুন নিয়ন্ত্রণে টানা তিন ঘণ্টা লেগে যায়। এ সময় দুই-আড়াই হাজার ঘর পুড়ে ছাই হয়েছে। ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে ১২ হাজারের বেশি রোহিঙ্গা।

অগ্নিকাণ্ডের কারণ জানতে কক্সবাজার জেলা প্রশাসনের অতিরিক্ত জেলা ম্যাজিস্ট্রেট (এডিএম) মো. আবু সুফিয়ানকে প্রধান করে ৭ সদস্যের তদন্ত কমিটি গঠিত হয়েছে। গত সোমবার (৬ মার্চ) দুপুরের পর থেকে তদন্ত কমিটি ঘটনা অনুসন্ধানের কাজ শুরু করে। তদন্ত কমিটি অগ্নিকাণ্ডের কারণ অনুসন্ধান করে তদন্ত প্রতিবেদন জমা দেবেন।

আগুন লাগার মূল কারণ এখনো অজানা থাকলেও ঘটনাটি রহস্যজনক বলে মন্তব্য করেন কক্সবাজারের শরণার্থী, ত্রাণ ও প্রত্যাবাসন কার্যালয়ের কমিশনার মোহাম্মদ মিজানুর রহমান। তিনি বলেন, আগুন লাগিয়ে দেয়ার একটি ভিডিও ইতোমধ্যে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ভাইরাল হয়েছে। এটা চোখে পড়েছে, তবে লোকটার চেহারা স্পষ্ট নয়। এরপরও এমন সব ভিডিওর সূত্র ধরে তদন্তের কাজ চলছে।

এদিকে গত মঙ্গলবার (৭ মার্চ) সকাল ১০টা থেকে বেলা ১১টা পর্যন্ত ক্যাম্প-১১ এর সিআইসি অফিসে প্রশাসন ও আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর একটি বৈঠক হয়। যেখানে সেনাবাহিনীর ১০ পদাতিক ডিভিশনের জিওসি ও কক্সবাজার এরিয়া কমান্ডার মেজর জেনারেল মো. ফখরুল আহসান, আর্মড পুলিশ ব্যাটালিয়নের ডিআইজি (এফডিএমএন) জামিল হোসেন ও অতিরিক্ত শরণার্থী, ত্রাণ ও প্রত্যাবাসন কমিশনার সামছু দ্দৌজাসহ ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা অংশ নেন।

বৈঠক শেষে জামিল হোসেন জানান, গত রবিবার আগুন ধরিয়ে দেয়ার ঘটনায় সন্দেহজনক এক কিশোরকে নিজেদের নিয়ন্ত্রণে নেয়া হয়েছে। ১৩-১৪ বছরের কিশোরটিকে জিজ্ঞাসাবাদের জন্য তদন্ত কমিটির মুখোমুখি করা হবে। তিনি আরো জানান, সামনের দিনে অনাকাক্সিক্ষত অগ্নিকাণ্ডের ঘটনা ঘটলে আগুন নেভানোর নানা অসুবিধা ও পানির সংকটের বিষয়টি নিয়ে আলোচনা হয়েছে বৈঠকে। পরবর্তী কার্যক্রমের জন্য সংশ্লিষ্ট প্রশাসনকে অবহিত করা হবে।

অতিরিক্ত শরণার্থী, ত্রাণ ও প্রত্যাবাসন কমিশনার মো. সামছু দ্দৌজা বলেন, ক্ষতিগ্রস্ত রোহিঙ্গাদের পুনর্বাসনের কাজ শুরু হয়েছে। আন্তর্জাতিক অভিবাসন সংস্থা (আইওএম) আশ্রয়হীন রোহিঙ্গাদের অস্থায়ী ঘর তৈরিতে সহযোগিতা শুরু করেছে। বাঁশ-তাঁবু দিয়ে বসতি করা হচ্ছে। জাতিসংঘের সংস্থা বিশ্ব খাদ্য কর্মসূচি (ডব্লিউএফপি) রোহিঙ্গাদের জরুরি খাদ্য সহায়তা দিচ্ছে।

আইওএমের ন্যাশনাল কমিউনিকেশন অফিসার তারেক মাহমুদ জানান, সোমবার সকাল থেকে আশ্রয়হীন রোহিঙ্গাদের অস্থায়ী তাঁবু দিয়ে পুনর্বাসন কার্যক্রম শুরু হয়েছে।

পালংখালী ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান এম গফুর উদ্দিন চৌধুরী বলেন, সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ছড়িয়ে পড়া ভিডিও দেখে মনে হচ্ছে, এ আগুন পরিকল্পিত নাশকতা। ১২ লাখ রোহিঙ্গার মধ্যে ১০/১৫ হাজার অপরাধের সঙ্গে জড়িত হবে। তাদের শনাক্তে যৌথ প্রচেষ্টা চালানো দরকার। এদের বিচ্ছিন্ন করা সম্ভব হলেই ক্যাম্পে শান্তি বিরাজ করবে।

তদন্ত কমিটির প্রধান অতিরিক্ত জেলা ম্যাজিস্ট্রেট মো. আবু সুফিয়ান জানান, সোমবার দুপুর থেকে আনুষ্ঠানিক ঘটনাস্থল পরিদর্শন ও রহস্য অনুসন্ধানে মাঠে নেমেছে তদন্ত টিম। আমরা অগ্নিকাণ্ডের উৎসস্থল খোঁজার চেষ্টা করছি। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম, গণমাধ্যম- নানাভাবে যেখানে যে তথ্য প্রচার পেয়েছে সবকিছুর লিংক সংগ্রহের কাজ চলছে। সব তথ্যই আমাদের তদন্তের একটি অংশ হিসেবে ধরা হবে। ক্যাম্পে, ক্যাম্পের বাইরে, গণমাধ্যমকর্মীসহ সবাইকে বলেছি যার কাছে যে তথ্য আছে বলে মনে হবে তা যেন আমাদের দিয়ে সহযোগিতা করে। আগামী ৩ দিনের মধ্যে তদন্ত প্রতিবেদন জমা দেয়ার লক্ষ্য রয়েছে।

শরণার্থী, ত্রাণ ও প্রত্যাবাসন কমিশনার মোহাম্মদ মিজানুর রহমান বলেন, ক্ষতিগ্রস্ত রোহিঙ্গাদের দ্রুত ঘর করে দেয়ার চেষ্টা চলছে। পুড়ে যাওয়া এলাকায় ৩৫টি মসজিদ-মক্তব, দুটি প্রাথমিক স্বাস্থ্যকেন্দ্র, একটি হেল্প পোস্ট, একটি যুবকেন্দ্র, একটি নারীবান্ধব কেন্দ্র, একটি শিক্ষাকেন্দ্র, একটি শিশুবান্ধব কেন্দ্র ও একটি মানসিক পরিচর্যা কেন্দ্র বিচ্ছিন্ন হয়েছে। দিনের বেলা হওয়ায় অগ্নিকাণ্ডে হতাহত থেকে পরিত্রাণ মিলেছে।

সাবস্ক্রাইব ও অনুসরণ করুন

সম্পাদক : শ্যামল দত্ত

প্রকাশক : সাবের হোসেন চৌধুরী

অনুসরণ করুন

BK Family App