×

মুক্তচিন্তা

সৌদি-ইরান চুক্তি : মধ্যপ্রাচ্যের নতুন সমীকরণ

Icon

অনলাইন ডেস্ক

প্রকাশ: ৩০ মার্চ ২০২৩, ০১:২৯ এএম

সৌদি-ইরান চুক্তি : মধ্যপ্রাচ্যের নতুন সমীকরণ
ভৌগোলিকভাবে মধ্যপ্রাচ্য ইউরোপ-এশিয়ার দেশগুলোর মধ্যে সেতু হিসেবে বিবেচিত। তাই বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্তের মানুষের মেলবন্ধন ঘটে এখানে। প্রাচীনকাল থেকেই বিভিন্ন সভ্যতার প্রাণকেন্দ্র হিসেবে স্বীকৃত মধ্যপ্রাচ্য, বহু ধর্মের উল্লেখযোগ্য পুণ্যভূমির অবস্থান মধ্যপ্রাচ্যেই। তাই সেকাল থেকেই মধ্যপ্রাচ্যকে বাদ দিয়ে আন্তর্জাতিক রাজনীতি ভাবাও যায় না। কারণ বিংশ শতাব্দীর সবচেয়ে আলোচিত বিষয়বস্তু হচ্ছে মধ্যপ্রাচ্য সংকট। আর এই মধ্যপ্রাচ্য সংকটের মূল কারিগর মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এবং তার মিত্ররা। মধ্যপ্রাচ্যের ১৮টি দেশের মধ্যে ১৯৩২ সালে সৌদি আরবে তেলক্ষেত্র আবিষ্কার হওয়ার পর যুক্তরাষ্ট্রের লোলুপ দৃষ্টি পড়ে মধ্যপ্রাচ্যে। অতএব তেলখনিগুলোতে আধুনিক তথ্যপ্রযুক্তির জোগানদাতা হিসেবে এগিয়ে আসে মার্কিন শক্তিরা। বাস্তবতার নিরিখে বলা যায়, ইউএস এবং তার পুঁজিবাদী মিত্ররা কখনোই মধ্যপ্রাচ্যভিত্তিক কোনো ঐক্য প্রতিষ্ঠা হোক তা চায় না। তাই তারা বহুকাল থেকেই উল্লেখযোগ্য ইন্ধন জুগিয়েছে যাতে মধ্যপ্রাচ্যভিত্তিক প্রধান সংকটগুলোর নিরসনের পথ প্রশস্ত না হয়। এ ছাড়া মধ্যপ্রাচ্যে চলমান নানা সংঘাত ও সংকটগুলো দীর্ঘতর হওয়ার অন্যতম কারণ মধ্যপ্রাচ্য ও উপসাগরীয় অঞ্চলের মুসলিম রাষ্ট্রগুলোর মধ্যে ইতিবাচক বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক না থাকা। এই যেমন বর্তমান সৌদি আরব, বাহরাইন, আরব আমিরাতসহ অনেক আরব রাষ্ট্র বর্তমানে নিজেদের নিরাপত্তার বিবেচনায় ইসরায়েলি বৈরিতার বিষয়টি আর গুরুত্ব দিতে চাইছে না। অন্যদিকে ইরানে ১৯৭৯ সালে ইসলামী বিপ্লবের পর নেতৃত্বে আসা ধর্মীয় নেতারা এখন পর্যন্ত ইসরায়েলের অস্তিত্ব অস্বীকার করে। তারা বিবেচনা করে ইসরায়েল অবৈধভাবে মুসলমানদের ভূমি দখল করে রেখেছে। এবং ইসরায়েল তাদের অস্তিত্বের জন্য ইরানকে হুমকি হিসেবে দেখে থাকে। ঠিক একইভাবে ফিলিস্তিনিদের স্বাধীনতা আন্দোলন, সিরিয়া, ইয়েমেন ও লেবানন সংকট ইত্যাদি প্রায় সব বিষয়ে তাদের পরস্পরবিরোধী অবস্থান রয়েছে। ঐতিহাসিকভাবে সৌদি আরব ও ইরান প্রতিবেশী দেশ, যাদের বিভিন্ন বিষয়ে মিল রয়েছে, যেমন ধর্ম, সংস্কৃতি ও ইতিহাস সবদিক থেকে, সাধারণত দুদেশের মধ্যে সুসম্পর্ক বজায় থাকার কথা। কিন্তু সর্বশেষ ২০১৬ সাল থেকে তেহরান ও রিয়াদের মধ্যে কূটনৈতিক সম্পর্ক বন্ধ রয়েছে। ওই বছর সৌদি আরব এক দিনে ৮১ জনের মৃত্যুদণ্ড কার্যকর করে, যাদের বেশিরভাগ ছিলেন শিয়া মুসলিম। শিয়া সম্প্রদায়ের প্রভাবশালী এক ধর্মীয় নেতার মৃত্যুদণ্ড কার্যকর করার প্রতিবাদে তেহরানে সৌদি দূতাবাসে হামলা চালান বিক্ষোভকারীরা। ওই ঘটনার জেরে ইরান ও সৌদি আরব কূটনৈতিক সম্পর্কে ইতি টানে। এ ছাড়া ৮ বছরের বেশি সময় ধরে চলা ইয়েমেন যুদ্ধে পরস্পরবিরোধী অবস্থানে রয়েছে ইরান ও সৌদি আরব। ইয়েমেন সরকারের পক্ষে রয়েছে সৌদি নেতৃত্বাধীন সামরিক জোট। তাদের বিরুদ্ধে লড়ছেন ইরানসমর্থিত হুতি যোদ্ধারা। কথায় আছে, আন্তর্জাতিক রাজনীতিতে স্থায়ী শত্রæ ও বন্ধু বলে কোনো পরিভাষা নেই। বৈশ্বিক রাষ্ট্র প্রধানদের নানা প্রভাবশালী সিদ্ধান্ত, কর্মকাণ্ড এবং নানা পলিসি প্রণয়নে বিশ্বরাজনীতির গতিপথ মুহূর্তে মুহূর্তে পরিবর্তন হয়। জাতীয় স্বার্থের কারণে হঠাৎ চির প্রতিদ্ব›দ্বী রাষ্ট্র গুরুত্বপূর্ণ বন্ধু এবং ঘনিষ্ঠ বন্ধু চরম শত্রæ হয়ে যেতে পারে অবিশ্বাস্যভাবে। ঠিক এভাবেই মধ্যপ্রাচ্যে শান্তি প্রতিষ্ঠায় যুক্তরাষ্ট্র ও মিত্রদের একের পর এক ফর্মুলা যখন ব্যর্থ, তখনই এশিয়ার সুপার পাওয়ারখ্যাত চীনের মধ্যস্থতায় সৌদি আরব এবং ইরানের মাঝে সম্পর্ক পুনঃস্থাপনের খবর আন্তর্জাতিক রাজনীতিতে খুব ভালোভাবেই কম্পন সৃষ্টি করেছে। এখন পাল্টে যেতে পারে মধ্যপ্রাচ্যের পরিস্থিতি। প্রায় ৭ বছর বিচ্ছেদের পর জোড়া লাগছে কূটনৈতিক সম্পর্ক। আগামী দুই মাসের মধ্যে উভয় দেশ দূতাবাস চালু করবে বলে ঘোষণা দিয়েছে। সম্পর্কের এই অগ্রগতি এক বছরের বেশি সময় ধরে আলোচনার ফলে এসেছে। শুরুতে বাগদাদ এবং সম্প্রতি চীনে দুদেশের আলোচনা অনুষ্ঠিত হয়। স্বাভাবিকভাবেই চীনের এই ঐতিহাসিক মধ্যস্থতায় ওয়াশিংটন বেশ অস্বস্তিতে আছে। বেইজিং থেকে ইরান এবং সৌদি আরবের মধ্যে সমঝোতার খবর যখন প্রথম প্রকাশিত হয়, ওয়াশিংটনে বিস্ময় এবং শঙ্কা তৈরি করে। তাদের অস্বস্তি এবং শঙ্কার মূল কারণ হলো এই সমঝোতায় চীনের ভূমিকা নিয়ে। আন্তর্জাতিক বিশ্লেষক কারেন কোয়াইতকোস্কি বলেন, ইরান-সৌদি শান্তিপূর্ণ সম্পর্ক মেনে নেয়া যুক্তরাষ্ট্রের জন্য কঠিন হবে। এমনকি চুক্তি যাতে ব্যর্থ হয় সে চেষ্টাও করতে পারে। কারণ মধ্যপ্রাচ্যে স্থিতিশীলতা ফিরলে যুক্তরাষ্ট্রের অস্ত্র বাণিজ্যে প্রভাব পড়বে। এ ছাড়া মধ্যপ্রাচ্যে তাদের একক প্রভাবও বাধাগ্রস্ত হবে। অন্যদিকে এই চুক্তি ইসরায়েলের অভ্যন্তরীণ রাজনীতিকেও উত্তপ্ত করেছে। তাদের মধ্যে হতাশার জন্ম দিয়েছে। এমনকি এই কূটনৈতিক সম্পর্ক পুনঃস্থাপনকে ইসরায়েলি প্রধানমন্ত্রীর জন্য একটি প্রতীকী ব্যর্থতা হিসেবেও দেখা হচ্ছে। ইসরায়েলি থিংক ট্যাংক ইনস্টিটিউট ফর ন্যাশনাল সিকিউরিটির পারস্য উপসাগরীয় বিশেষজ্ঞ ইয়োয়েল গুজানস্কি বলেন, গত কয়েক বছর ধরে এই অঞ্চলে ইরানবিরোধী ব্লক গঠনের চেষ্টায় ইসরায়েলের ধারণা ও প্রচেষ্টার ওপর এটি একটি আঘাত। মধ্যপ্রাচ্যকে ‘জিরো-সাম গেম’ হিসেবে বিবেচনা করলে ইরানের একটি কূটনৈতিক জয় ইসরায়েলের জন্য বড় দুঃসংবাদ। পরিশেষে বলা যায়, চীনের মধ্যস্থতায় রিয়াদ-তেহরান দূরত্ব কমলে ইয়েমেন, সিরিয়া, ইরাকের মতো বিবদমান দেশগুলোয় শান্তি ফিরতে পারে। আরব উপসাগরীয় অঞ্চলে যুক্তরাষ্ট্রের প্রভাব কমে চীনের প্রভাব বাড়ার ইঙ্গিত দিচ্ছে এ চুক্তি। অবশ্যই গত কয়েক বছরের মধ্যে মধ্যপ্রাচ্যের কূটনীতির সবচেয়ে বড় পরিবর্তনের ঘটনা এটি। সৌদি আরব ও ইরানের ক্ষমতার লড়াইয়ের রণক্ষেত্রে পরিণত হওয়া সিরিয়া ও ইয়েমেনের মতো দেশগুলো এই ঘোষণায় কিছুটা আশ্বস্ত হতে পারে। আর স্বাভাবিকভাবেই ইরান এবং সৌদি আরবের মধ্যে যদি কূটনৈতিক সম্পর্ক পুনঃপ্রতিষ্ঠিত হয়, সেটি উপসাগরীয় অঞ্চলের ভূ-রাজনৈতিক সম্পর্কে নতুন বিন্যাস তৈরি করবে। সংকটময় মধ্যপ্রাচ্য হয়ে উঠবে শান্তিপূর্ণ এবং ভূরাজনৈতিক স্থিতিশীলতা ফিরে আসার পথ উন্মুক্ত হবে বলে আশা রাখা যায়। আতহার নূর : শিক্ষার্থী, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়। [email protected]

সাবস্ক্রাইব ও অনুসরণ করুন

সম্পাদক : শ্যামল দত্ত

প্রকাশক : সাবের হোসেন চৌধুরী

অনুসরণ করুন

BK Family App