×

জাতীয়

ভারতের আস্থা অর্জনে তৎপর বিএনপি

Icon

কাগজ প্রতিবেদক

প্রকাশ: ৩০ মার্চ ২০২৩, ০৮:৩৯ এএম

ভারতের আস্থা অর্জনে তৎপর বিএনপি

ফাইল ছবি

দ্বাদশ সংসদ নির্বাচনকে সামনে রেখে অবাধ, সুষ্ঠু নির্বাচনের দাবি আদায়ে সরকারের ওপর আন্তর্জাতিক চাপ সৃষ্টি করতে চায় বিএনপি। এ লক্ষ্যে সর্বাগ্রে প্রতিবেশী ভারতের আস্থা ও সমর্থন অর্জনে তৎপর দলটি। পাশাপাশি ভারতের নীতি নির্ধারকরাও বাংলাদেশে অন্যতম প্রধান রাজনৈতিক শক্তি হিসেবে বিএনপিকে বিবেচনায় রাখতে চাইছে।

সম্প্রতি ভারতের আদালত থেকে বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য সালাহউদ্দিন আহমেদের বেকসুর খালাস, ভারতীয় হাইকমিশনারের নৈশভোজে বিএনপি নেতাদের অংশ নেয়াসহ বেশ কিছু ইস্যুতে ভারত-বিএনপির সম্পর্ক ‘অত্যন্ত নির্ভরযোগ্য’ পর্যায়ে পৌঁছেছে বলে দলীয় সূত্রের দাবি।

বিএনপির উদারপন্থি নেতারা বলেন, আঞ্চলিক ও আন্তর্জাতিক রাজনৈতিক মেরুকরণে ভারত একটি গুরুত্বপূর্ণ দেশ। ভারতের সমর্থন এড়িয়ে ক্ষমতায় যাওয়া বড় দুষ্কর- এ বিষয়টি বিএনপি উপলব্ধি করেছে। এছাড়া দলের ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানের ব্যাপারে ভারতের নেতিবাচক যে অবস্থান রয়েছে সেটি পরিবর্তন করা জরুরি। অন্যদিকে বিএনপি যে বাংলাদেশে এখনো একটি গুরুত্বপূর্ণ রাজনৈতিক শক্তি, তারা ফের ক্ষমতায় আসতে পারে- এমন বিবেচনাও ভারত সরকারের নীতিনির্ধারকরা একেবারে বাদ দিতে চাইছেন না।

বিশ্লেষকদের মতে, রাজনীতি কোনো নিশ্চল বিষয় নয়। এটি গতিশীল। বিএনপির একটি রাজনৈতিক অবস্থান ছিল ভারত প্রশ্নে। পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে সেটিও পরিবর্তন হয়েছে। এটি ইতিবাচক লক্ষণ। ভারত প্রশ্নে বিএনপির আগের নীতিকে ভুল বলে চিহ্নিত করা যাবে না, সময়ের পরিপ্রেক্ষিতে একটি অবস্থান মাত্র। তবে অনেকের ধারণা, আওয়ামী লীগের সঙ্গে ভারতের বহুদিনের যে সুসম্পর্ক তা ভেদ করে আগামী নির্বাচনকে ঘিরে ভারতের সমর্থন পাওয়া বিএনপির জন্য দুষ্কর হবে।

প্রতিবেশি দেশ ভারতের সঙ্গে বিএনপির সম্পর্ক এখন কেমন- জানতে চাইলে বিএনপির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর ভোরের কাগজকে বলেন, একটি দেশের বিরোধী দলের সঙ্গে অন্য একটি দেশের সরকারের যেমন সম্পর্ক হওয়া উচিৎ বিএনপির সঙ্গে ভারতের ঠিক তেমনই সম্পর্ক। অর্থাৎ কারো সঙ্গে আমাদের কোনো বিরোধ নেই। তিনি বলেন, বিএনপিকে যারা ভারতবিরোধী বলে প্রচার করে আসছে তারা আসলে সরকারকে সুবিধাজনক অবস্থায় দেখতে চায়।

বিএনপির সিনিয়র নেতাদের মতে, নিরপেক্ষ সরকারের দাবি আদায়ের আন্দোলনের চেয়ে এ ব্যাপারে সরকারের ওপর আন্তর্জাতিক চাপ সৃষ্টি অনেক বেশি কার্যকর। ইতোমধ্যে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র বাংলাদেশের ওপর বিভিন্ন বিষয়ে চাপ দিচ্ছে। সরকারপ্রধান থেকে শুরু করে গূরত্বপূর্ণ মন্ত্রীরাও এ কথা স্বাীকার করছেন। নেতারা বলছেন, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র যেমন বিভিন্ন ইস্যুতে সরকারকে চাপ দিচ্ছে; ভারতের পক্ষ থেকেও যদি চাপ দেয়া হয় তবে নিরপেক্ষ সরকারের দাবি আদায় কঠিন হবে না।

এক যুগেরও বেশি সময় পর গত ১৬ মার্চ সন্ধ্যায় ভারতের হাইকমিশনার প্রণয় ভার্মার আমন্ত্রণে নৈশভোজে অংশ নিতে তার বাসভবনে যান বিএনপির পাঁচ নেতা। এ সময় তিন ঘন্টাব্যাপী বৈঠকে আগামী জাতীয় নির্বাচন, চলমান সরকারবিরোধী আন্দোলন, ভারত-বিএনপি সম্পর্ক নিয়ে খোলামেলা আলোচনা হয় উভয় পক্ষের মধ্যে। বৈঠক সূত্র জানায়, নির্দলীয়, নিরপেক্ষ সরকার ছাড়া আওয়ামী লীগের অধীনে নির্বাচনে না যাওয়ার দলীয় সিদ্ধান্ত ভারতীয় হাইকমিশনারকে স্পষ্ট করে জানিয়ে দিয়েছে বিএনপি।

বিগত নির্বাচনগুলোতে সরকার কীভাবে নিজেদের প্রভাব বিস্তার করে ক্ষমতায় বসেছে তা বিস্তারিত তুলে ধরে দলের নেতারা দাবি আদায় না হওয়া পর্যন্ত চূড়ান্ত আন্দোলন গড়ে তোলার কথা জানিয়েছেন। এমনকি বিএনপির চলমান আন্দোলনে হামলা, মামলা ও নির্যাতনের চিত্রও ভারতীয় হাই কমিশনারের কাছে তুলে ধরেন দলটির নেতারা। আলোচনার এক পর্যায়ে ভারতের সঙ্গে বিএনপির সম্পর্কের অবনতি হওয়ার বিষয়টি উঠে আসে। বিএনপির নেতারা বলেছেন, ১০ ট্রাক অস্ত্র চোরাচালানের ঘটনায় বিএনপি জড়িত ছিল না। বিএনপি সরকার যদি জানত তাহলে পুলিশ ওই চালান আটক করত না। এখন অনুপ চেটিয়াকে দিয়ে নানা কথা বলানো হচ্ছে।

ওই বৈঠক সম্পর্কে বিএনপির এক নেতা জানান, ভারতের হাইকমিশনার চীনের সঙ্গে বিএনপির বর্তমান সম্পর্কের বিষয়ে ধারণা চান। জামায়াত বিএনপির সঙ্গে এখন কোন ফরমেটে রয়েছে জানতে চাইলে দলটির নেতারা জানান, জামায়াতের সঙ্গে জোটগত আর কোনো সম্পর্ক নেই। পাশাপাশি বিএনপির চেয়ারপারসন খালেদা জিয়ার শারীরিক অবস্থারও খোঁজ খবর নেন ভারতের হাই কমিশনার।

বৈঠকে উপস্থিত এক নেতা নাম প্রকাশ না করার শর্তে ভোরের কাগজকে বলেন, প্রণয় ভার্মার আমন্ত্রণের নেপথ্যে ভিন্ন একটি বিষয় আঁচ করা গেছে। তার মতে, ভারতের আদানি গ্রুপের সঙ্গে সরকারের বিদ্যুৎ চুক্তিকে রাষ্ট্রবিরোধী ‘অসম চুক্তি’ আখ্যা দিয়ে বিএনপির পক্ষ থেকে যে জোর দাবি তোলা হচ্ছে এ নিয়ে একটি সমঝোতামূলক অবস্থানে পৌঁছাতে চায় ভারত। দেশটির হাই কমিশনের কথাবার্তায় তার কিছুটা ইঙ্গিত মিলেছে। তিনি বলেন, তাছাড়া বিএনপির জন্য কিছু ইতিবাচক বিষয়ও ছিলো আলোচনায়। এর বেশি কিছু বলা সম্ভব নয়। বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীরের নেতৃত্বে নৈশভোজে অংশ নেন দলের স্থায়ী কমিটির সদস্য ড. খন্দকার মোশাররফ হোসেন ও আমীর খসরু মাহমুদ চৌধুরী, ভাইস চেয়ারম্যান আব্দুল আউয়াল মিন্টু এবং কেন্দ্রীয় কমিটির সাংগঠনিক সম্পাদক শামা ওবায়েদ।

দলীয় সূত্র জানায়, গত এক মাসে বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য আমীর খসরু মাহমুদ চৌধুরীর নেতৃত্বে দলের মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীরসহ কয়েকজন নেতা ভারতের কয়েকটি থিংকট্যাংকের সঙ্গে কয়েক দফা বৈঠক করেছেন। ‘অভ্যন্তরীণ রাজনীতি’ প্রশ্নে ভারতবিরোধী মনোভাব থেকে দলটি বের হয়ে এসেছে-এমন বার্তা পৌঁছে দেয়ার চেষ্টা করছে বিএনপি।

এ লক্ষ্যে ঈদের পরেই বিএনপির ৭ সদস্যের একটি প্রতিনিধি দল ভারত সফরে যাবে বলে জানিয়েছেন দলটির নেতারা। জানতে চাইলে বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য ড. খন্দকার মোশাররফ হোসেন বলেন, সফরের বিষয়ে আলোচনা হয়েছে। তবে কবে নাগাদ যাওয়া হবে এ বিষয়ে আমার জানা নেই।

ভারতের সঙ্গে সম্পর্ক উন্নয়নের প্রশ্নে তিনি বলেন, দেশের জাতীয় স্বার্থের পক্ষে কথা বলার অর্থ ভারত বিরোধিতা নয়। ভারত বিরোধী বা অ্যান্টি ইন্ডিয়া- এটি বিএনপিকে নিয়ে সরকারের অপপ্রচার। ভারতের সঙ্গে আমরা ‘সমতাভিত্তিক ও বন্ধুত্বপূণর্’ সম্পর্ক চাই।

বিএনপির ফরেন অ্যাফেয়ার্স কমিটির দায়িত্বপ্রাপ্ত নেতারা জানান, আস্থা অর্জনে ভারতের সঙ্গে বিএনপির পক্ষ থেকে কিছু বিষয়ে সমঝোতাও হয়েছে। এরমধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো- চীন নীতি পরিবর্তন ও পুনঃমূল্যায়ন, সংখ্যালঘুদের স্বার্থসংশ্লিষ্ট ব্যাপারে বিএনপির অবস্থান আরো স্পষ্ট করা, জামাতসহ ভারতীয় বিচ্ছিন্নতাবাদীদের সঙ্গে সম্পর্ক ত্যাগ। বিনিময়ে ভারতের পক্ষ থেকে দেয়া আশ্বাসের ভিত্তিতেই নতুন করে আন্দোলনের মাঠ সাজাচ্ছে বিএনপি। দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতিকে টার্গেট করে তৃণমূলে আান্দোলনের ক্ষেত্র প্রস্ততির বার্তা দিচ্ছে দলটি। এ বিষয়ে বিএনপির আন্তর্জাতিক সম্পর্ক কমিটির প্রধান ও স্থায়ী কমিটির সদস্য আমীর খসরু মাহমুদ চৌধুরী ভোরের কাগজকে বলেন, বিএনপি দল পুনর্গঠনের পাশাপাশি আন্তজার্তিক পরিমণ্ডলে যোগাযোগ বাড়াতে বেশি মনোযোগী। তিনি বলেন, ভারতের বিভিন্ন থিংকট্যাংক প্রতিষ্ঠান, গণমাধ্যম, রাজনীতিবিদ ও সেখানকার সুশীল সমাজের প্রতিনিধিদের সঙ্গে কথা হয়েছে। এই মুহূর্তে দেশে যে সংকট চলছে, সে সম্পর্কে তাদের জানানো হচ্ছে। বিএনপি সম্পর্কেও ভারতের রিয়েলাইজেশন হয়েছে।

বিএনপির সঙ্গে ভারতের দূরত্ব কমেছে কি না, জানতে চাইলে সরাসরি কোনো উত্তর না দিয়ে তিনি বলেন, একটি নির্দিষ্ট দলের সঙ্গে নয়, আমরা পিপল টু পিপল এবং কান্ট্রি টু কান্ট্রি রিলেশনশিপ ডেভেলপ করার চেষ্টা করছি। একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের পর ভারত-বিএনপি সম্পর্কের দিকটা অস্পষ্ট থাকলেও গত দেড় বছর ধরে তা অনেকটা স্পষ্ট। গত বছরের ২৬ মার্চ স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তীতে ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির ঢাকা সফরের বিষয়টি নিয়েও দলটি ছিল নিশ্চুপ। দলীয়ভাবে বিএনপির অবস্থান ছিল অস্পষ্ট। এমনকি ভারত বিরোধী কোনো বিবৃতিও আপাতত দিচ্ছে না দলটি। এ প্রসঙ্গে বিএনপির এক সিনিয়র নেতার বক্তব্য- দলকে বাস্তবতা মেনে অবস্থান ঠিক করতে হবে। কারণ, প্রতিষ্ঠালগ্নে স্নায়ুযুদ্ধের সময় রাশিয়া-ভারতের আন্তর্জাতিক মেরুকরণের বাইরের আঞ্চলিক ও আন্তর্জাতিক শক্তিকে পাশে পেয়েছিল বিএনপি। এখন তা নেই।

বিএনপির নেতারা জানান, ভারতের পাশাপাশি চীন ও যুক্তরাষ্ট্র ছাড়াও যুক্তরাজ্য, ইউরোপীয় ইউনিয়ন ও মধ্যপ্রাচ্যের শক্তিধর দেশগুলোর সঙ্গে ঘনিষ্ট সম্পর্ক গড়ার চেষ্টা চলছে বিএনপির তরফ থেকে। নির্দলীয়, নিরপেক্ষ সরকারের অধীনে আগামী নির্বাচনের দাবিকে সামনে রেখে দেশগুলোর সঙ্গে সম্পর্ক উন্নয়নের নতুন রোডম্যাপ সাজানো হচ্ছে। এরইমধ্যে বাংলাদেশে বিদেশি দূতাবাসগুলোর সঙ্গে বৈঠকের আগ্রহ প্রকাশ করে বিএনপির পক্ষ থেকে চিঠিও দেয়া হয়েছে। দেশগুলোর চাহিদাকে গুরুত্ব দিয়ে নতুন করে সাজানো হচ্ছে দলের পররাষ্ট্রনীতি।

এদিকে, জাতিসংঘে বিএনপি এখন খুব সোচ্চার। বিশ্বসংস্থাটির বিভিন্ন ফোরামে তারা চিঠি দিচ্ছে এবং মানবাধিকার, গণতন্ত্র ও গণমাধ্যমের স্বাধীনতার ইস্যুর সঙ্গে তারা নির্বাচনের বিষয়টিও যুক্ত করছে। এর ফলে শেষ পর্যন্ত জাতিসংঘ আগামী জাতীয় নির্বাচনের আগেই একটি অবস্থান নেবে এবং সে অবস্থানটি বিএনপির পক্ষে যাবে বলেই দলটির দৃঢ় বিশ্বাস।

সাবস্ক্রাইব ও অনুসরণ করুন

সম্পাদক : শ্যামল দত্ত

প্রকাশক : সাবের হোসেন চৌধুরী

অনুসরণ করুন

BK Family App