×

সাহিত্য

‘বরিষ ধরা মাঝে শান্তির বারি’

Icon

কাগজ প্রতিবেদক

প্রকাশ: ৩০ মার্চ ২০২৩, ০৭:৩৬ পিএম

‘বরিষ ধরা মাঝে শান্তির বারি’

প্রতীকী ছবি

‘বরিষ ধরা মাঝে শান্তির বারি’ প্রতিপাদ্যে মঙ্গল শোভাযাত্রা আয়োজন উপলক্ষে চারুকলা প্রাঙ্গন এখন মুখর। চারদিকজুড়ে বাঁশ-পেরেকের ঠোকাঠুকির শব্দ, কেউ দিচ্ছেন মাটির সরায় তুলির আঁচড়, কেউ তৈরি করছেন কাগজের পাখি, কেউবা তৈরী করছেন বাঘ, রাজা-রানি। বর্ষবরণের আর মাত্র ১৩ দিন বাকি। এ নিয়ে মঙ্গল শোভাযাত্রার প্রস্তুতির কর্মযজ্ঞে শিক্ষার্থীরা ব্যস্ত সময় কাটাচ্ছেন।

বৃহস্পতিবার (৩০ মার্চ) সকালে চারুকলা প্রাঙ্গনে গিয়ে এমন দৃশ্য দেখা গেছে।

প্রধান ফটকে বাম পাশে শোভা পাচ্ছিল জল রঙে তরুণ শিল্পীদের আঁকা চিত্রকর্ম। এর পাশেই দাঁড়িয়ে গভীর মনোযোগে আঁকছিলেন পেইন্টিং শেষ বর্ষের ছাত্র রকি। জলরঙে আকা তার চিত্রকর্মটিতে দেখা যাচ্ছে একজন মানুষের গলায় আটকে যাওয়া কাটা টেনে বের করার চেষ্টা করছেন আরেকজন মানুষ! তিনি চিত্রকর্মটির নাম দিয়েছেন ‘গলার কাটা’। ছবিটি সম্পর্কে তিনি বলেন, আমাদের দেশে মৌলবাদ একটা গলার কাঁটা হয়ে দাঁড়িয়েছে। এই কাঁটা রাজনৈতিক দলগুলো সরাতে পারছে না বা চাচ্ছে না। এই কাঁটায় আমরা প্রতিনিয়ত ক্ষতবিক্ষত হচ্ছি। দিন দিন যন্ত্রণা বাড়ছেই। আমরা অসুস্থ হয়ে পড়ছি। এই বিষয়টি আমি প্রতীকী হিসেবে শিল্পে রূপ দিতে চেয়েছি। একটু সামনে এগুতেই দেখা গেল ড্রইং এন্ড পেইন্টিং বিভাগের শেষ বর্ষের শিক্ষার্থী দীপাঞ্জলী দত্ত রঙ তুলিতে রাঙাচ্ছিলেন সরার বুক। জিওমেট্রিক ফর্মে তিনি আকছিলেন রানীর মুখ। এতো সুন্দর রানী।

দীপাঞ্জলী বলেন, ক্লাসের ফাঁকে ফাঁকে আমরা কাজ করছি। পড়াশোনার পাশাপাশি মঙ্গলশোভাযাত্রার এই কাজগুলো করা আমরা মনে করি এক ধরনের রিফ্রেশমেন্ট। বৈশাখ একধরণের উদ্দীপনা নিয়ে আসে মনে। মুলত ২০ মার্চ থেকে পেইন্টিং ও সরার কাজ শুরু করেছি। তবে এখনো জোরে শোরে শুরু হয়নি। যা তৈরী করেছি তা বিক্রিও হচ্ছে।

দীপাঞ্জলীর পাশেই মনোমুগ্ধ এক পদ্ম আঁকছিলেন নৈঋতা পাল কৃষ্ণা। যেন পুকুরজুড়ে পদ্মটি হাসি ছড়াচ্ছে একাই। তার পাশে বিশাল দাশ আঁকছিলেন নানা রঙের মাছ। মাছ নয় যেন সরার মধ্যে আস্ত একটি ফুলের বাগান। কারুশিল্প দ্বিতীয় বর্ষের শিক্ষার্থী অর্পিতা দেবনাথ মিতু একে ফেললেন ময়ুরপঙ্খী নাও। পেইন্টিং শেষ বর্ষের শিক্ষার্থী এফ এম রাহিম রবি জলরঙে আকলেন রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের মুখ। তরুণ এই শিল্পীর তুলির আচড়ে এমন নিপুণভাবে ধরা দিলেন রবীন্দ্রনাথ। যে কারুরই চোখ আটকে যাবে। গ্রাফিক ডিজাইন বিভাগের শিক্ষার্থী মো. ফজর আলী আকলেন ছোটবেলায় দেখা রাখাল ছেলে ও তার নারী সঙ্গীকে। এমন চমৎকার এক জুটি ধরা দিল ছোট্ট একটি ক্যানভাসে। মন ছুয়ে দিল। ড্রইং এন্ড পেইন্টিং বিভাগের শিক্ষার্থী ফুয়াদ হাসান আদিবাসী ফর্মে ময়ুর আঁকছিলেন। ময়ুর নয় যেন রঙ্গিন এক বন। ড্রইং এন্ড পেইন্টিং বিভাগের শিক্ষার্থী সালসাবিল তার ক্যানভাসে তুলে আনলেন আস্ত এক কাল্পনিক সমুদ্র। কল্লোলিত সমুদ্র। তার দেখার চোখ এতো সুন্দর। একই বিভাগের শিক্ষার্থী রাফিন নাওয়ারও কল্পনায় সমুদ্র আকলেন। তবে এই সমুদ্র একটু অন্যরকম। নীল জল দিগন্তবেষ্টিত। চোখ বুজে আসা নীল। তরুণ শিক্ষার্থীদের আঁকা এইসব অসামান্য ছবির মূল্য নির্ধারণ করা হয়েছে বড় সরা ৮০০-২০০০ টাকা, ছোট সরা ৩০০-৮০০ টাকা।

আর এসব আয়োজনের পেছনে মঙ্গল শোভাযাত্রার প্রস্তুতিতে নেতৃত্ব দিচ্ছেন চারুকলা অনুষদের ৬৮তম ব্যাচের শিক্ষার্থীরা। তাদেরই একজন ভাস্কর্য শেষ বর্ষের শিক্ষার্থী শিমুল কুম্ভকার। তিনি মাঠে বহেরা তলায় বসে স্ট্রাকচার নির্মাণকর্মীদের কাজে তদারক করছিলেন।

জানতে চাইলে শিমুল কুম্ভকার ভোরের কাগজকে বলেন, গত ১৯ মার্চ লাল ক্যানভাস বানিয়ে হলুদ ও নীল রঙের ব্যবহারে পাখি এঁকে ঢোলের শব্দে বাংলা নববর্ষ ১৪৩০ বরণের আনুষ্ঠানিক প্রস্তুতিপর্বের উদ্বোধন করেন শিল্পী রফিকুন নবী।

শিমুল বলেন, এবার নববর্ষকে বরণ করা হবে ‘বরিষ ধরা মাঝে শান্তির বারি’ প্রতিপাদ্যে। এই লক্ষ্যে ছয়-সাতটি স্ট্রাকচার নির্মাণের কাজ চলছে, আরো বেশিও হতে পারে। সব মিলিয়ে প্রস্তুতি যতটুকু নেয়া সম্ভব আজকে পর্যন্ত সব কিছু ঠিকঠাক আছে। যেহেতু রোজা পড়ে গেছে, আমাদের বিক্রি কম। যে তহবিল থেকে আমাদের অর্থের জোগান হয়, সেটা একটু কমে যাওয়ার কারণে আমাদের একটু ধীরগতি। তবে আমাদের পক্ষ থেকে যতটা সম্ভব আমরা চেষ্টা করে যাচ্ছি, যেন সবাই মিলে ১৪ তারিখে মঙ্গল শোভাযাত্রা উদযাপন করতে পারি।

আরেক শিক্ষার্থী সুমিত রায় বলেন, আমরা যেহেতু লোকশিল্পের মোটিভগুলোকে গুরুত্ব দেই, তার ওপর ভিত্তি করে আমরা পেঁচা, রাজা-রানি, ছোট পাখি, বড় পাখি- এগুলো করছি। এ ছাড়া টেপা পুতুল, ঘোড়া-এই ফর্মগুলো নিয়ে আমরা কাজ করছি। এছাড়া, বিলুপ্তপ্রায় অনেক পাখিও এতে অন্তর্ভূক্ত হবে।

অর্থ বিষয়ে তদারকের দায়িত্বে রয়েছেন আবতাহী রহমান উৎসব। তিনি বলেন, রোজা চলছে। রোজা রেখেই পাঁচশতাধিক শিক্ষার্থী বর্ষবরণ প্রস্তুতিপর্বের সঙ্গে কাজ করে যাচ্ছে। কারণ কোনোরকম স্পন্সর ছাড়াই আমরা এ আয়োজন করছি। অনেকে চায় তাদের প্রতিষ্ঠানের স্পন্সর দিয়ে যুক্ত হতে। কিন্তু আমরা তা চাই না। তবে আমরা চাই সব বয়সের মানুষের অংশগ্রহণে এ আয়োজন সফলতা পাক।

মেশ তৈরীর দায়িত্বে থাকা মৃৎশিল্প বিভাগের শেষ বর্ষের শিক্ষার্থী শ্রেষ্ঠ সাহা বলেন, এবারের আয়োজনে ছোট বড় রাজারাণী, ট্যাপা পুতুল, সূর্য, প্যাচাসহ আরো কিছু মোটিফ যুক্ত হবে।

চারুকলা অনুষদের ডিন শিল্পী নিসার হোসেন জানালেন, ‘বরিষ ধরা মাঝে শান্তির বারি’ প্রতিপাদ্যে এবারের বাংলা নববর্ষ ১৪৩০ বরণ করা হবে। সে অনুযায়ী কাজ করছেন শিক্ষার্থীরা। তবে অর্থ সংগ্রহের জন্য কাজ শুরু হয়ে গেছে। চারুকলার শিক্ষার্থীরা জলরং-অ্যাক্রেলিক চিত্র, সরাচিত্র ও মুখোশের পাশাপাশি নানা হস্তশিল্প তৈরি করছেন। এসব বিক্রির অর্থ থেকে হবে শোভাযাত্রার আয়োজন।

২০১৬ সাল থেকে বাংলাদেশের মঙ্গল শোভাযাত্রা ইউনেসকোর ‘অস্পর্শনীয় শিল্পের’ তালিকাভুক্ত হয়। সরকারের পক্ষ থেকে এ আয়োজনে সম্পৃক্ততা থাকলেও চারুকলার শিক্ষার্থীরা চান নিজেদের মতো শিল্পকর্ম তৈরি করে সেসব বিক্রির মাধ্যমে আয়োজন করতে।

নিসার হোসেন জানালেন, এর ফলে শিল্প ও শিল্পীর সঙ্গে মানুষের সম্পৃক্ততা তৈরি হয়। রমজানের মধ্যে বাংলা নববর্ষ হলে আয়োজনের আকারে কিছুটা পরিবর্তন এনে সংক্ষিপ্ত করা হবে, বন্ধ তো আর করা যাবে না। মানুষ অনেক কমে যায়, শিক্ষার্থীদের একটা বড় অংশ রোজা রাখে, শিল্পসংগ্রাহকদের সংখ্যাও কম থাকে। এবার শোভাযাত্রা চারুকলার সামনে থেকে শুরু করে শাহবাগ হয়ে আবার চারুকলার সামনে পৌঁছে শেষ হওয়ার কথা রয়েছে।

এবার কোনো হুমকিধামকি পাচ্ছেন কিনা জানতে চাইলে তিনি বলেন, মৌলবাদের হুমকিধামকি বরাবরই আছে। এখন ইউটিউবে এসব কমে আসার কারণ হচ্ছে, সরকার তৎপর। কেউ কিছু করলে সরকারিভাবে অ্যাকশন নেয়া হচ্ছে। এ কারণে ওরা এতে কম অ্যাকটিভ।

সাবস্ক্রাইব ও অনুসরণ করুন

সম্পাদক : শ্যামল দত্ত

প্রকাশক : সাবের হোসেন চৌধুরী

অনুসরণ করুন

BK Family App