×

অর্থনীতি

৭১ শতাংশ পরিবারের সদস্যরা কম খাচ্ছে

Icon

কাগজ প্রতিবেদক

প্রকাশ: ২৯ মার্চ ২০২৩, ১১:০০ পিএম

৭১ শতাংশ পরিবারের সদস্যরা কম খাচ্ছে

প্রতীকী ছবি

দরিদ্র জনগোষ্ঠীর ৭১ দশমিক ১৯ শতাংশ পরিবার এখন প্রয়োজনের তুলনায় কম খাচ্ছে। ছয় মাস আগেও এই হার ছিল ৪২ দশমিক ০৬ শতাংশ। ধার করে চলছে ৭৩ দশমিক ৮ শতাংশ পরিবার। বর্তমানে ঘরে পর্যাপ্ত খাবার না থাকা নিয়ে চিন্তিত থাকে ৭২ দশমিক ৯৪ ভাগ পরিবার। ছয় মাস আগে এই হার ছিল ৪১ দশমিক ২৫ ভাগ। বেসরকারি গবেষণা সংস্থা সানেম আয়োজিত ‘কেমন আছেন নিম্ন আয়ের মানুষ’ শীর্ষক এক জরিপে উঠে এসেছে এমন তথ্য। বুধবার (২৯ মার্চ) রাজধানীর মহাখালীর ব্র্যাক সেন্টারে এই জরিপের ফলাফল প্রকাশ করা হয়।

৯ -১৮ মার্চ পর্যন্ত আট বিভাগের ১ হাজার ৬০০ পরিবারের ওপর এই জরিপ চালানো হয়েছে। এর মধ্যে গ্রাম ও শহরের ৮০০টি করে পরিবার রয়েছে।

ছয় মাস আগে ২০ দশমিক ৩১ শতাংশ পরিবারকে দিনে একবেলা খাবার বন্ধ রাখতে হতো। বর্তমানে এই হার ৩৭ দশমিক ৩৮ শতাংশ। ছয় মাস আগে মারাত্মক খাদ্য নিরাপত্তাহীনতায় ভোগা পরিবার ছিল ১২ দশমিক ২৫ শতাংশ। বর্তমানে এটি দ্বিগুণেরও বেশি বেড়ে ২৫ দশমিক ৪৪ শতাংশে দাঁড়িয়েছে।

সানেম বলছে, ২০২২ সালের সেপ্টেম্বরে একজন নিম্ন আয়ের মানুষের আয় ছিল মাসে ১৪ হাজার ৩০ টাকা। ২০২৩ সালের ফেব্রুয়ারিতেও এটি প্রায় সমান, ১৪ হাজার ২৫ টাকা। তবে আয় না বাড়লেও বেড়েছে খরচ।

জাতীয়ভাবে ব্যয় বেড়েছে ১৩ দশমিক এক শতাংশ। ছয় মাস আগে একটি পরিবারের ব্যয় ১২ হাজার ৮৮০ টাকা থাকলেও এখন এটি ১৪ হাজার ৫৬৯ টাকায় দাঁড়িয়েছে। ছয় মাস আগে গ্রামের একটি পরিবার ১৩ হাজার ৫৯ টাকা খরচ করলেও এখন এর পরিমাণ ১৪ হাজার ৬৭৮ টাকা। অর্থাৎ ব্যয় বেড়েছে ১২ দশমিক চার শতাংশ। শহরের একটি পরিবারের ১২ হাজার ৭০২ টাকার খরচ ছয় মাসের ব্যবধানে এখন ১৪ হাজার ৪৬১ টাকায় পৌঁছেছে। অর্থাৎ ব্যয় বেড়েছে ১৩ দশমিক নয় শতাংশ। সবচেয়ে বেশি খরচ বেড়েছে খাবারের। ছয় মাস আগে খাবার কিনতে লাগত গড়ে আট হাজার ১৪১ টাকা। এখন তা বেড়ে নয় হাজার ৫৪৩ টাকায় দাঁড়িয়েছে। অর্থাৎ খাবারের ব্যয় বেড়েছে ১৭ দশমিক দুই শতাংশ।

ছয় মাস আগে গ্রামের একটি পরিবারের খাবার কেনা বাবদ খরচ ছিল আট হাজার ৩৮৪ টাকা। সেই খরচ এখন দাঁড়িয়েছে নয় হাজার ৯৮৬ টাকায়। একইভাবে ছয় মাস আগে শহরে খাবার কেনা বাবদ একটি পরিবারের ৭ হাজার ৮৯৮ টাকা খরচ হলেও সেটি এখন ৯ হাজার ৪০১ টাকায় দাঁড়িয়েছে। খাদ্যবহির্ভূত খাতে খরচ বেড়েছে ৫ দশমিক ৮ শতাংশ। ছয় মাস আগে খাদ্যবহির্ভূত খাতে ব্যয় ৪ হাজার ৮৬০ টাকা থাকলেও বর্তমানে এটি বেড়ে ৫ হাজার ১৪১ টাকায় দাঁড়িয়েছে।

চড়া মূল্যস্ফীতির মধ্যে টিকে থাকতে খাদ্যাভ্যাস পরিবর্তন করেছে ৯০ ভাগেরও বেশি পরিবার। ধার করে চলছে ৭৩ দশমিক ৮ শতাংশ পরিবার। খাদ্যবহির্ভূত খাতে ব্যয় কমিয়েছে ৫৫ দশমিক ৯ শতাংশ পরিবার। অতিরিক্ত কাজ করছে ৩৯ দশমিক ৩ শতাংশ পরিবার। সঞ্চয় ব্যবহার করছে ৩৫ দশমিক ৩ শতাংশ পরিবার। সম্পত্তি বিক্রি করছে ১২ দশমিক ৯ শতাংশ পরিবার। সন্তানের পড়ালেখার খরচ কমিয়েছে ১০ দশমিক ৪ শতাংশ পরিবার।

মূল্যস্ফীতির চাপে গত ছয় মাসে ক্ষুদ্রঋণ প্রতিষ্ঠান থেকে ঋণ নিয়েছে ৪৫ দশমিক ৪২ শতাংশ পরিবার। বন্ধু বা আত্মীয়-স্বজন থেকে ধার করেছে ৩৬ দশমিক ৫৩ শতাংশ পরিবার। সমবায় সমিতি থেকে ধার করেছে ২২ দশমিক ৬৩ শতাংশ পরিবার। এ ছাড়া ব্যাংক থেকে ১৩ দশমিক ৯০ শতাংশ এবং মহাজন থেকে ২ দশমিক ৮০ শতাংশ পরিবার ঋণ করেছে।

গত ছয় মাসে ভাত খাওয়া কমিয়েছে ৩৭ শতাংশ পরিবার। মাংস খাওয়া কমিয়েছে ৯৬ দশমিক ৪ শতাংশ পরিবার। মাছ খাওয়া কমিয়েছে ৮৮ দশমিক ২২ শতাংশ পরিবার। ডিম খাওয়া কমিয়েছে ৭৭ শতাংশ পরিবার। তৈলাক্ত খাবার কমিয়েছে ৮১ দশমিক ৪৩ শতাংশ পরিবার।

গ্রামের তুলনায় শহরের পরিবারগুলো তাদের খাবারের পরিমাণ অধিক কমিয়েছে। একই সঙ্গে দরিদ্র জনগোষ্ঠী নিম্মমানের খাবারের দিকে ধাবিত হচ্ছে। নিম্মমানের চাল খাচ্ছে ৫৬ দশমিক ৪৮ শতাংশ পরিবার। নিম্নমানের মাংস খাচ্ছে ৮৬ দশমিক ৩৫ শতাংশ পরিবার। একই মানের মাছ খাচ্ছে ৮৭ শতাংশ পরিবার। তেল খাচ্ছে ৭৬ দশমিক ৩ শতাংশ পরিবার। নিম্মমানের খাবার গ্রহণের হার সবচেয়ে বেশি শহরে বসবাসকারীদের।

গ্রামে নিম্মমানের চাল খাচ্ছে ৪৯ দশমিক ২৭ শতাংশ পরিবার। বিপরীতে শহরে এ হার ৬৩ শতাংশ। গ্রামে নিম্মমানের মাংস খাচ্ছে ৭৮ দশমিক ৩৪ শতাংশ পরিবার। শহরে এ হার ৯৩ দশমিক ৬৪ শতাংশ। গ্রামে নিম্নমানের মাছ খাচ্ছে ৮৩ দশমিক ৪৩ শতাংশ পরিবার। শহরে এ হার ৯০ দশমিক ৩৩ শতাংশ। গ্রামে নিম্মমানের ডিম খাচ্ছে ৪৯ দশমিক ৮৫ ভাগ পরিবার। শহরে এই হার ৬৩ দশমিক ৫৮ ভাগ।

বিশেষ খাবার খাওয়ার ক্ষেত্রে দরিদ্র জনগোষ্ঠী ছয় মাস আগে মাসে একবার গরুর মাংস খেত। বর্তমানে এই হার অর্ধেকেরও নিচে নেমে এসেছে। ছয় মাস আগে মুরগির মাংস মাসে চারবার খেলেও বর্তমানে তা নেমেছে দুইয়ের ঘরে। ডিম ছয় মাস আগে মাসে আট দশমিক একবার খেলেও বর্তমানে তা পাঁচ দশমিক আটে নেমে এসেছে। রুই বা কাতল মাছ ছয় মাস আগে মাসে ছয় দশমিক তিনবার খেলেও বর্তমানে এটি চার দশমিক তিনে নেমে এসেছে।

পোশাকে খরচ কমিয়েছে ৯২ দশমিক ৪ শতাংশ পরিবার। স্বাস্থ্যসেবায় কমিয়েছে ৬০ দশমিক ৯ শতাংশ পরিবার। সন্তানের শিক্ষায় খরচ কমিয়েছে ৪৫ দশমিক ১ শতাংশ পরিবার।

মাত্র ৪০ ভাগ পরিবার সামাজিক নিরাপত্তার আওতার মধ্যে রয়েছে। টিসিবি এবং ওএমএম-এর পণ্য বিক্রি কার্যক্রম গ্রামের তুলনায় শহরে বেশি। টিসিবির পণ্য কিনে একটি পরিবার অর্ধেক মাস চলতে পারলেও বাকি দিনগুলোতে বাজার থেকে কিনেই সংসার চালাতে হয়।

টিসিবির পণ্য পেতে একটি পরিবারকে ৫ ঘণ্টা সময়ও ব্যয় করতে হচ্ছে। ৫ দশমিক ৯ ভাগ পরিবারের টিসিবির পণ্য কিনতে সময় লাগছে ৫ ঘণ্টা, ১৪ দশমিক ৪৭ ভাগ পরিবারের ব্যয় হচ্ছে ৪ ঘণ্টা, ২৪ দশমিক ১২ ভাগ পরিবারের ব্যয় হচ্ছে ৩ ঘণ্টা। ২৭ দশমিক ৬৩ ভাগ পরিবারের ব্যয় হচ্ছে ২ ঘণ্টা করে।

ভবিষ্যতে কীভাবে চলবে দরিদ্র জনগোষ্ঠী—এ বিষয়ে সানেমের জরিপ বলছে, ৮৫ ভাগ পরিবার চলবে ধার করে। সন্তানের শিক্ষা বন্ধ করে দেবে ২৪ দশমিক ২৫ ভাগ পরিবার। সম্পত্তি বিক্রি করে দেবে ১৬ দশমিক ৮৮ ভাগ পরিবার। কন্যাদের বাল্যবিয়ে দেবে প্রায় সাত ভাগ পরিবার।

জরিপের ফলাফল উপস্থাপন করেন সানেমের নির্বাহী পরিচালক ড. সেলিম রায়হান। তিনি বলেন, ‘দরিদ্র জনগোষ্ঠী বর্তমানে যে মূল্যস্ফীতির কবলে আছে, তা সরকার ঘোষিত মূল্যস্ফীতির চেয়ে অনেক বেশি। দেশে মূল্যস্ফীতি বাড়ার পেছনে বৈশ্বিক কারণের পাশাপাশি অভ্যন্তরীণ আর্থিক অব্যবস্থাপনাও দায়ী। বাজারে কার্যকর পদক্ষেপ নেওয়ার ঘাটতি পরিলক্ষিত হচ্ছে। গুরুত্বপূর্ণ পণ্যের ক্ষেত্রে কিছু করপোরেট গ্রুপ বা ব্যবসায়ীর আধিপত্য দেখতে পাচ্ছি। এই জায়গাগুলোতে অবশ্যই কাজ করার প্রয়োজন রয়েছে।’

তিনি বলেন, ‘বাজারে পণ্যের সরবরাহ ঠিক রাখার বিষয়ে নজর দিতে হবে। তদারকি ব্যবস্থায় জোর দিতে হবে। দরিদ্র জনগোষ্ঠীর কথা মাথায় রেখে খাদ্য ও সামাজিক নিরাপত্তা কার্যক্রম বাড়াতে হবে।’

সাবস্ক্রাইব ও অনুসরণ করুন

সম্পাদক : শ্যামল দত্ত

প্রকাশক : সাবের হোসেন চৌধুরী

অনুসরণ করুন

BK Family App