×

মুক্তচিন্তা

রমজানে ধর্মীয় গণ্ডগোলের ডিজিটাল পাকনামি

Icon

অনলাইন ডেস্ক

প্রকাশ: ২৯ মার্চ ২০২৩, ১২:২০ এএম

রমজানে ধর্মীয় গণ্ডগোলের ডিজিটাল পাকনামি

রমজানের আগে পঞ্চগড়ে পারেনি, রমজানে দেশের অন্য কোথাও পেরে বসে কিনা-সমূহ শঙ্কা উঁকি দিচ্ছে। এরা পঞ্চগড়ে গণ্ডগোল পাকাতে চেয়েছিল কাদিয়ানিদের ঘিরে। আয়োজনও ছিল ব্যাপক। ক্ষমতাসীন দলের লোকাল কিছু আতিপাতিকে পর্যন্ত খুচরায় ঘোরে ফেলে কাণ্ড ঘটিয়ে ফেলেছিল প্রায়। সফল হয়নি পুলিশসহ স্থানীয় প্রশাসনের ত্বরিত পদক্ষেপের কারণে। তাই বলে কি হেরে গেছে বা ফিল্ড ছেড়ে দিয়েছে? নাকি দম নিচ্ছে? রমজানে গত ক’দিনের নমুনা বলছে- এরা হাল ছাড়েনি, মাঠও ছাড়েনি। গণ্ডগোল-সহিংসতা পাকানোর কৌশল পাল্টে ইস্যু খুঁজছে। রমজানে তাদের ফাঁদ আরো বিস্তৃত, নানা দিকে ছড়ানো। বিশেষ করে তারাবি-ইফতার-সেহরি-ঈদের মতো কিছু ইবাদতকে ইস্যু করে ফেতনার ঘুরপাকে টোকা দিচ্ছে। এ কুকর্মে স্যোশাল মিডিয়াকে নিয়েছে মোক্ষম হাতিয়ার হিসেবে। ডিজিটালে যারপরনাই স্মার্ট এ চক্রটি। এরই মধ্যে তারাবির নামাজ নিয়ে মোটামুটি সামাজিক ফ্যাসাদ জমিয়ে দিয়েছে। তারাবির নামাজ ২০ রাকাত, না ৮ রাকাত- পুরনো প্যাঁচালটি নতুন ফরমেটে মোটামুটি জমিয়ে ফেলেছে। শহর থেকে গ্রাম পর্যন্ত মুসল্লিদের মাঝে আলোচনার খোরাক দিয়েছে। এ নিয়ে এখন পর্যন্ত সহিংস কিছু না ঘটলেও উসকানির ঢোলে বাড়ি পড়ছে হরদম। এ নামাজটি কবে থেকে এসেছে? ইসলাম ধর্মের প্রবর্তক হজরত মুহাম্মদ (সা.) তারাবি কবে পড়েছেন, খলিফা-সাহাবিরা পড়তেন কি না?- এ ধরনের রগরগা প্রশ্নের বাজার জমিয়ে দিয়েছেন ডিজিটাল হুজুররা। দুনিয়ায় একই দিনে চান্দ্রমাসের সূচনা, তাহলে একই দিনে রোজা ও ঈদ নয় কেন?- এ প্রশ্ন উত্থাপনকারীরা সুবিধা পায়নি বাজারে। তবে নিজেদের হিম্মতের খেমটি ছাড়েনি। এবারের রমজানেও তারা যথারীতি একদিন আগে রোজা শুরু করেছে। সৌদিসহ আরব দুনিয়ার সঙ্গে মিল রেখে বাংলাদেশেও একদিন আগে ঈদ করবে তারা। উত্তরবঙ্গের কয়েকটি জেলায় তাদের মতবাদী বাড়ছে। চট্টগ্রাম-চাঁদপুর-শরীয়তপুর অঞ্চলেও তাদের বেশ সম্প্রসারণ। রাজধানী ঢাকায়ও তারা হিতাকাক্সক্ষী হাত করে নিচ্ছে। উদ্দেশ্য পরিষ্কার। কিন্তু এদের নাটের গুরু কারা? যে কোনো কিছুতে বিশেষ করে ধর্মীয় নানান কিছু নিয়ে বিভেদ সৃষ্টি করাই এই গুরুদের উদ্দেশ্য। বিভেদ না থাকলে এরা অস্বস্তিতে পড়ে যায়। অকর্মণ্য বা কর্মহীন হয়ে যায়। ইসলামি পরিভাষায় বিভেদের অর্থ ফেৎনা। ধর্মীয় বিধিবিধান নিয়ে বিভেদ তৈরি করা তুলনামূলক সহজ। শুধু অন্য ধর্মের সঙ্গে নয়, নিজ ধর্মের মধ্যেও বিভেদ-বিরোধ বাধানোর হেন আয়োজন নেই, যা এরা না করছে। আলাদা ধর্মে বিশ্বাস আলাদা। চর্চাও আলাদা। বাংলাদেশের সংবিধানে তা স্পষ্টভাবে স্বীকৃত ও গ্রাহ্য। সংবিধান সব ধর্ম পালনের মর্যাদা ও অধিকার নিশ্চিত করেছে। এর নাম ধর্মনিরপেক্ষতা। এটি রাষ্ট্রের সনদ, অঙ্গীকার। ধর্মীয় এ সৌন্দর্য আমাদের মুক্তিযুদ্ধ ও স্বাধীনতারও অন্যতম চেতনা। কিন্তু মতলববাজ একটি চক্র অন্য ধর্মের সঙ্গে তুলনা ও বিরোধ-সংঘাত বাধিয়েই ক্ষ্যান্ত হয় না; নানা ছুতায় নিজ ধর্মের মধ্যেও নানা গণ্ডগোল পাকাচ্ছে। ওহাবি-সুন্নি, মুহাম্মদি-আহাম্মদি, শরিয়তি-মারফতি, কাদিয়ানি-কাফের, কিয়ামি-লাকিয়ামিসহ বেশুমার উইন্ডোতে উড়ছে তারা। এদের উদ্দেশ্য বুঝতে গবেষক-বিশ্লেষক হওয়া জরুরি নয়। সাদা চোখেই তাদের উদ্দেশ্য বোধগম্য। ‘ধর্মনিরপেক্ষতা’কে ‘ধর্মহীনতা’ অর্থ দাঁড় করানোর একটি নোংরা-সূ² অপচেষ্টা চলে আসছে অনেক দিন থেকে। মৌসুম দৃষ্টে এর তারতম্য হয়। এমনিতেই অন্য ধর্মের সঙ্গে সম্প্রীতি তাদের অপছন্দ। তার ওপর নিজ ধর্মের প্রীতি-সম্প্রীতিও তাদের অসহ্য। ভেজাল না থাকলে তাদের অস্তিত্বও থাকে না। এর সঙ্গে তাদের কারো কারো অর্থনৈতিক সংযোগও রয়েছে। কাদিয়ানিকে ইস্যু করে পঞ্চগড়ে মধ্যম পর্যায়ের দাঙ্গা প্রায় বাধিয়ে ফেলেছিল তারা। রমজানকে উপলক্ষ করে ফুঁ দিচ্ছে নানান দিকে। তারাবির নামাজ ৮ রাকাত না ২০ রাকাত, রোজা-ঈদ ভিন্ন তারিখে উত্তম, না মক্কা-মদিনার সঙ্গে মিল রেখে অভিন্ন তারিখে উত্তম- এ ধরনের প্রশ্ন ছোড়ে বিতর্ক পাকাচ্ছে। এ ছাড়া মিলাদ জায়েজ না না-জায়েজ, নামাজের পর মোনাজাত হালাল না হারাম- এ ধরনের বহু বিতর্কের রসদ তাদের স্টকে থাকেই। হিজাব-বোরকা, লম্বা দাড়ি-চাপ দাড়ি, গোল টুপি-কিস্তি টুপি, মূর্তি-ভাস্কর্য ইত্যাদি সাবজেক্ট চর্চা তো আছেই। সেইসঙ্গে ঠাণ্ডা মাথায় ওহাবি, সুন্নি, দেওবন্দি, মাজারি, বাজারি, খানকাপন্থি, তাবলিগি, কেয়ামি-লাকেয়ামি ইত্যাদি বিভক্তি নিশ্চিত থাকছে। তাদের অনুসারী অগুনতি। ভক্ত-অনুসারীদের কখনো কখনো মারামারিতেও জড়িয়ে দিচ্ছেন তারা। তাদের পাকানো গণ্ডগোল সামলাতে বিভিন্ন এলাকায় পুলিশসহ আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর অনেক ঘাম ঝরছে। ধর্মীয় বিষয়কে স্পর্শকাতর বিবেচনায় তা যেন প্রচার না হয়, গণমাধ্যমে না আসে, সেই চেষ্টা কত দিন কুলাবে? অন্য ধর্মের তাজা বিষয় হাতে না থাকায় স্বধর্মীয় বিষয়াদিতে ধর্মপ্রাণদের বিভ্রান্ত করার এ চক্রটি পবিত্র রমজানে কোন উদ্দেশ্যে আবার তৎপর, তা খতিয়ে দেখা দরকার। অন্য ধর্মে বিশ্বাসীদের তারা ‘বিধর্মী’ নামে ডাকতে অভ্যস্ত, যা না টেকে যুক্তিতে, না দলিলে। সব ধর্মে বিশ্বাসীরাই ধার্মিক, মোটেই বিধর্মী নয়। আমাদের সংবিধানও সব ধর্ম পালন নিশ্চিত করেছে। কোনো ধর্মেই বিশ্বাস না করার ‘অধার্মিক’ জনগোষ্ঠী বাংলাদেশে নেই। তাদের প্রতিও নির্দয় হওয়া সংবিধান অনুমোদন করে না। ইসলাম ধর্মের প্রবর্তক শেষ নবী হজরত মুহাম্মদ (সা.)-এরও এ বিষয়ে পরিষ্কার নির্দেশনা রয়েছে। কারো সঙ্গে ধর্ম না মিললে তাকে যেন মানুষের বাইরে ভাবা না হয়- সেই তাগিদ দিয়ে গেছেন তিনি। বাংলাদেশ প্রাগৈতিহাসিক যুগ থেকেই সব ধর্মের সামাজিক সম্প্রীতিতে অভ্যস্ত। হিন্দুর পোষা গরু মুসলমানের কুরবানিতে জবাই হয়। হিন্দু কারিগর বা দোকানির মিষ্টি মুসলমানের মিলাদে বিলানো হয়। মুসলমানের গরুর দুধ, দোকানের কাপড়, গহনায় পূজা করে হিন্দু সম্প্রদায়। মাঝেমধ্যেই এতে ছেদ ফেলানোর অপচেষ্টায় গণ্ডগোল পাকানো হয়েছে। দাঙ্গাও বাধানো হয়েছে। পরিণাম কারো জন্য ভালো হয়নি। এসব করলে যে গোটা লোকালয়কে অশান্তি ভুগতে হয়, তা যুগে যুগে প্রমাণিত। লোকালয়ে আগুন লাগলে দেবালয়ও রক্ষা পায় না- তা হাড়ে হাড়ে টের পেয়েছে এ দেশ। যে কোনো ধর্মের কথা বলার অধিকার আমাদের রাষ্ট্রীয় আইনে বলবৎ। ইসলাম ধর্মে শুধু স্বীকৃত নয়, অনুমোদিতও। বলা হয়েছে গ্রহণ-বর্জন যার যার স্বাধীনতা। তা না মানাকে ফেতনা বলেছেন মহানবী। ফেতনা বা বিরোধ বাধানোকে ‘হত্যার চেয়েও জঘন্য’ বলা হয়েছে পবিত্র কুরআনের সুরা বাকারায়। কিন্তু দুঃখজনকভাবে এ চর্চার বিস্তার ঘটানো হচ্ছে নানা ইস্যুতে। যাদের এ ব্যাপারে সচেতনতা তৈরির দায়িত্ব বেশি, সেই আলেম সমাজের কিছু ব্যক্তিও জড়িয়ে পড়ছেন এ কুকর্মে। যার দগদগে নমুনা দেখা যাচ্ছে প্রচারিত ওয়াজের ময়দানে। সেখানে এখন ময়দান করে ফেলা হয়েছে সোশ্যাল মিডিয়াকে। বাজারে চলমান ওয়াজের বেশিরভাগের মধ্যেই ধর্ম প্রচারের বদলে বিরোধ বাধানোর যারপরনাই চেষ্টা। এতে সর্বনাশ হচ্ছে ইসলামসহ সব ধর্মেরই। ইসলাম ধর্মের রূপ-সৌন্দর্য ও গুরুত্বকে তারা খেলা করার পাশাপাশি অন্য ধর্মগুলোকে তাচ্ছিল্য শুধু নয়, অবজ্ঞা করছেন নিকৃষ্টমানে। বিদ্বেষও ছড়াচ্ছেন। এই কর্মে চড়া হাদিয়ায় মাঠ দাবড়িয়ে বেড়াচ্ছেন কয়েক ওয়াজিন। তাদের কারো কারো তোফা বা হাদিয়ার অঙ্ক বিশাল। ফেসবুক, ইউটিউবে তাদের বাজার রমরমা। শুধু গ্রামগঞ্জে নয়, শহরাঞ্চলেও এবার ওয়াজের আওয়াজ তুঙ্গে। ক্ষেত্রবিশেষে তা যাত্রাপালা, সার্কাস, সিনেমার ভাঁড় ও জোকারদের হার মানাচ্ছে। তাদের অতিকথন, গানের টান, কনসার্ট ধাঁচের জিকির বরবাদ করে ছাড়ছে ইসলামের মূল সৌন্দর্যকে। ব্যাপক জনপ্রিয়তা তাদের কয়েকজনের। হাসি-ঠাট্টা, মশকরা-তামাশা করেন সমানে। ইউটিউব খুললেই তাদের আসর। হিন্দি ও লোকগানের সুরে বাড়তি বিনোদন তাদের ওয়াজে। সেটা করতে গিয়ে মিথ্যাচার, বানোয়াট গল্প, কিচ্ছা। ভাঁড়ামি, গান, অভিনয়, ব্যঙ্গসহ অসংলগ্ন মন্তব্য, অশালীনতা কিছুই বাদ যাচ্ছে না। মনগড়া মিথ্যাচারকেও সত্য বলে চালিয়ে দিচ্ছেন তারা। কেউ বাদ সাধছেন না। উপরন্তু ভাবাবেগে সমর্থন জোগাচ্ছেন। সোশ্যাল মিডিয়া বা ভার্চুয়ালের কোনো প্রচারণাকে ভ্যালু না দেয়া কাম্য হলেও বাস্তবটা উল্টো। আল্লামা, শায়খুল হাদিস, মুফাসসিরে কুরআন, মুফতি, মুহাদ্দিসের মতো বিশেষণধারীদের ডিজিটাল উৎপাত অনেক সর্বনাশ করে দিচ্ছে। কন্টেন্ট তৈরি করতে তাদের কোনো সময়ই লাগছে না। যার কোনো কোনোটি বড় ভয়ানক। যা দিয়ে মানুষকে বিভাজিত তথা ফেতনায় রাখতে দলাদলি ও তরিকা তৈরিও চলে গেছে ব্যবসার পর্যায়ে। বিভিন্ন রাজনৈতিক সম্পৃক্তায় এরা আরো আগোয়ান। একদিকে রমজান, আরেক দিকে সামনে নির্বাচন। রাজনীতির মাঠ গরমের মধ্যে তারাও তেতে উঠছেন। বিভিন্ন রাজনৈতিক শক্তির সঙ্গে মিতালি পাতছেন। কোথাও কোথাও জনপ্রতিনিধিরাও গিয়ে উঠছেন এসব ওয়াজের মঞ্চে। খরচ করে রাজনৈতিক সমাবেশ আয়োজনের চেয়ে ওয়াজ-মাহফিলের রেডিমেট জমায়েতকে লাভজনক ভাবেন এই শ্রেণির রাজনীতিকরা। এর মধ্য দিয়ে প্রকারান্তরে সর্বনাশকে আলিঙ্গন করা হচ্ছে।

মোস্তফা কামাল : সাংবাদিক ও কলাম লেখক; বার্তা সম্পাদক, বাংলাভিশন। [email protected]

সাবস্ক্রাইব ও অনুসরণ করুন

সম্পাদক : শ্যামল দত্ত

প্রকাশক : সাবের হোসেন চৌধুরী

অনুসরণ করুন

BK Family App