×

জাতীয়

ভোটের হাওয়ায় জোটের মিশন

Icon

কাগজ প্রতিবেদক

প্রকাশ: ২৯ মার্চ ২০২৩, ০৮:৫৩ এএম

ভোটের হাওয়ায় জোটের মিশন

ছবি: সংগৃহীত

** বামের পাশাপাশি ইসলামী দলকেও কাছে আনবে আওয়ামী লীগ ** সমমনাদের নিয়ে বিএনপি জোটের লক্ষ্য নির্দলীয় সরকার ** বিকল্প শক্তি হতে চায় ‘গণতন্ত্র মঞ্চ’
আসন্ন জাতীয় সংসদ নির্বাচনকে সামনে রেখে ক্ষমতাসীন দল আওয়ামী লীগ ও চিরপ্রতিদ্বন্দ্বী বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল (বিএনপি) তাদের সমমনা রাজনৈতিক দলগুলোকে নিজেদের দিকে টানার চেষ্টা করছে। এই উদ্যোগের অংশ হিসেবে আওয়ামী লীগ তাদের জোটের পরিধি বাড়াতে স্বাধীনতার সপক্ষের রাজনৈতিক শক্তিগুলোকে দলে টানার চেষ্টা করছে। একই সঙ্গে ১৪ দলীয় জোটকে আরো শক্তিশালী করার উদ্যোগ নিচ্ছে। অন্যদিকে বিএনপি বাকি সব বিরোধী দলগুলোর সঙ্গে একই ধরনের সমঝোতায় পৌঁছার বিষয়ে নজর দিয়েছে। ফলে জোটের রাজনীতির দরকষাকষিতে গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠেছে ভোটের মাঠে ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র দলগুলো। নিজেদের শক্তিপ্রদর্শনে ছোট ছোট দলগুলোকেও কাছে টেনে নিচ্ছে প্রধান রাজনৈতিক দলগুলো। সংশ্লিষ্টরা এসব তথ্য জানিয়েছেন। অন্যদিকে, বড় বড় রাজনৈতিক দলের বাইরে গিয়েও বিকল্প শক্তি হিসেবে একই প্ল্যাটফরমে দাঁড়িয়ে আন্দোলনের স্বপ্ন দেখছে সমমনা ছোট দলগুলোও। সবমিলিয়ে ভোটের হাওয়ায় রাজনৈতিক দলগুলোতে ইতোমধ্যেই শুরু হয়েছে ভাঙাগড়ার খেলা। নির্বাচনের তফসিল ঘোষণার আগমুহূর্ত পর্যন্ত নানান রাজনৈতিক খেলা চলতে থাকবে বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা। সূত্রমতে, নির্বাচনকে ঘিরে নির্বাচনী জোট বাড়াচ্ছে আওয়ামী লীগ বিএনপি উভয় দলই। ইতোমধ্যেই জোট সম্প্রসারণের কাজে অনেক দূর এগিয়েছে দুই দলই। জাতীয় পার্টির সঙ্গে অন্য বাম দল এমনকি কিছু ইসলামী দলকেও জোটে আনবে আওয়ামী লীগ। প্রয়োজনে কিছু ইসলামী দলের সঙ্গে সমঝোতা করা হবে। অন্যদিকে আওয়ামী লীগের অধীনে নির্বাচন ব্যাহত বা বাতিল করার চেষ্টা করবে বিএনপি। এক্ষেত্রে ব্যর্থ হলে যতটুকু আদায় করা যায়, ততটুকু নিয়েই নির্বাচনে অংশ নেয়ার সিদ্ধান্ত খালেদা জিয়ার পক্ষ থেকে জানানো হয়েছে মির্জা ফখরুলকে। যদিও এই সিদ্ধান্তের সঙ্গে তারেক রহমান মোটেও একমত নন। যে কোনো মূল্যে নির্বাচন ব্যাহত করার পক্ষে তিনি। সূত্রমতে, নির্বাচনে অংশ না নেয়ার ভুল করবে না বিএনপি। এক্ষেত্রে সরকারের ট্রাম্পকার্ড খালেদা জিয়া। নির্বাচনে না গেলে দুর্নীতি মামলায় ফের কারাগারে যেতে হবে খালেদা জিয়াকে। আর নির্বাচনে গেলে কারামুক্ত থাকার সুবিধা ভোগ করবেন বিএনপি চেয়ারপারসন। এক্ষেত্রে সরকারবিরোধী আন্দোলনের পাশাপাশি নির্বাচনী মাঠ গোছাতে জোট মিশনেও নামছে দলটি। বিএনপি নেতারা জানিয়েছেন, তারা সমমনা দলগুলোর সঙ্গে আলোচনা শুরু করেছেন, যাতে সবাই এক হয়ে সুষ্ঠু নির্বাচনের জন্য নির্দলীয় সরকারের দাবি বাস্তবায়ন করা যায়। রাজনীতিতে জোটের খেলা : মূলত এ অঞ্চলে জোটের রাজনীতির শুরু ১৯৫৪ সালে, যুক্তফ্রন্ট গঠনের মধ্য দিয়ে। ওই নির্বাচনে শেরে বাংলা এ কে ফজলুল হক, মওলানা ভাসানী ও হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দীর যুক্তফ্রন্ট পাকিস্তানের ক্ষমতাসীন মুসলিম লীগের বিরুদ্ধে অংশ নিয়ে বিপুল জয় পায়। স্বাধীনতার পর ১৯৭৩ সালে ১১টি সংগঠন নিয়ে সিরাজ সিকদারের নেতৃত্বে গঠিত হয় জাতীয় মুক্তিফ্রন্ট। চুয়াত্তরে ‘সর্বদলীয় যুক্তফ্রন্ট’ করেন মওলানা ভাসানী। পঁচাত্তরে সপরিবারে বঙ্গবন্ধু হত্যাকাণ্ডের পর নেপথ্যে থেকে জাগদল গঠন করেন জিয়াউর রহমান। অন্যদিকে আওয়ামী লীগ, সিপিবি, জাতীয় জনতা পার্টি, ন্যাপ (মোজাফফর), গণআজাদি লীগ ও পিপলস পার্টির সমন্বয়ে গঠিত হয় গণতান্ত্রিক ঐক্যজোট। ’৮০ সালের শেষ দিকে আওয়ামী লীগের নেতৃত্বে গঠিত ১০ দলীয় জোট। নব্বইয়ে আওয়ামী লীগ ও সমমনা দলগুলোর ১৫ দলীয় জোট (বাম দলগুলো বেরিয়ে যাওয়ার পর ৮ দল), বিএনপির সাতদলীয় জোট ও বাম জোটের দীর্ঘ আন্দোলনের ফসল স্বৈরাচারের পতন। আওয়ামী লীগ সরকারের বিরুদ্ধে আন্দোলন গড়ে তুলতে ১৯৯৯ সালে গড়ে ওঠে বিএনপি নেতৃত্বাধীন চারদলীয় জোট। পরে বিএনপির থেকে বেরিয়ে এরশাদ ইসলামপন্থী কয়েকটি দল নিয়ে গঠন করেন ইসলামী জাতীয় ঐক্যফ্রন্ট। অন্যদিকে চারদলীয় জোটের শাসনের শেষ দিকে সক্রিয় হয়ে ওঠে ১১ দলীয় বাম জোট। ২০০৫ সালে এই জোটের সঙ্গে আওয়ামী লীগের ঐক্য প্রক্রিয়া শুরু হলে সিপিবি, বাসদের দুই অংশ এবং শ্রমিক কৃষক সমাজবাদী দল ওই জোট থেকে বেরিয়ে যায়। অন্য সাতটি দল, জাসদ (ইনু) ও ন্যাপ মোজাফ্ফর নিয়ে গঠিত হয় ১৪ দলীয় জোট। ২০০৭ সালে এরশাদ ও খেলাফত মজলিসকে সঙ্গে নিয়ে মহাজোট গঠন করে ১৪ দলীয় জোট। এরপর ভোটের রাজনীতিতে বিএনপির ২০ দলীয় জোট, মহাজোট থেকে এরশাদের বেরিয়ে যাওয়া, ইসলামিক ডেমোক্রেটিক অ্যালায়েন্স (আইডিএ), বাম গণতান্ত্রিক জোট, ড. কামাল হোসেনের জাতীয় ঐক্যফ্রন্ট গঠন আবার ঐক্যফ্রন্টে ভাঙনের খেলা চলমান সংস্কৃতিতে পরিণত হয়। এদিকে ২০০৮ সালের জাতীয় নির্বাচনের আগে আওয়ামী লীগ স্বাধীনতার স্বপক্ষের দল ও বামপন্থি দলের সমন্বয়ে একটি ১৪ দলীয় জোট গঠন করে। একই সময় তারা জাতীয় পার্টিসহ মহাজোট তৈরি করে এবং নির্বাচনে অংশ নেয়। সরকারে ছোট দলগুলোর প্রতিনিধিত্ব কম থাকায় ২০১৮ সালের নির্বাচনের পর আওয়ামী লীগের সঙ্গে ১৪ দলীয় জোটের শরিক দলগুলোর মধ্যে সম্পর্কের অবনতি হয়। কয়েকটি শরিক দল বিভিন্ন বিষয়ে সরকারের সমালোচনায় মুখর হয়ে ওঠে। বর্তমানে ক্ষমতাসীন ১৪ দলীয় জোট নতুন করে সক্রিয় করার চেষ্টা চলছে। এ জোটে অনেকদিন ধরেই পাওয়া না পাওয়ার হিসাব চলছে। এছাড়া প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সঙ্গে কাদের সিদ্দিকীর বৈঠকও রাজনীতিতে কৌতূহল তৈরি করেছে। কিছুদিন আগে প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে দেখা করেন রওশন এরশাদ ও জি এম কাদের। সব মিলিয়ে জোট রাজনীতিতে নয়া মেরুকরণ স্পষ্ট হচ্ছে দ্রুত। আওয়ামী লীগের সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য কর্নেল (অব.) ফারুক খান ভোরের কাগজকে বলেন, জোট হয় আদর্শগতভাবে, শুধু নির্বাচন কেন্দ্রিক নয়। সমমনা দলগুলো নিয়েও জোট হয়। আগেও জোটের রাজনীতি প্রাসঙ্গিক ছিল, বর্তমানেও আছে, ভবিষ্যতেও থাকবে। ওয়ার্কার্স পার্টির সভাপতি রাশেদ খান মেনন বলেন, আমাদের দেশে জোট হয় নির্বাচন কেন্দ্রিক। কিন্তু নির্বাচন শেষে ক্ষমতায় এসে জোটের রাজনীতির চর্চা আর হয় না। গুরুত্ব হারিয়ে ফেলে। বিকল্প শক্তি হতে চায় ‘গণতন্ত্র মঞ্চ’: গত একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের আগে বিকল্প শক্তি হিসেবে মাঠে নেমেছিল বামঘরানার রাজনৈতিক দলগুলোর একটি অংশের ‘বাম গণতান্ত্রিক জোট।’ তফসিল ঘোষণার আগে জাতীয় সংসদ ভেঙে সরকারের পদত্যাগ, সব দল ও সমাজের অপরাপর অংশের মানুষের মতামতের ভিত্তিতে নির্বাচনকালীন নিরপেক্ষ সরকার গঠন, নির্বাচন কমিশনের পুনর্গঠন এবং গোটা নির্বাচনী ব্যবস্থার আমূল সংস্কারের দাবিতে মাঠগরম করেছিল ওই জোট। তবে বেশিদিন জোটের অবস্থান ধরে রাখতে পারেননি তারা। এবার আসন্ন দ্বাদশ নির্বাচনকে ঘিরে গত জোটের আদলেই ‘গণতন্ত্র মঞ্চ’ করে প্রায় অভিন্ন দাবিতে মাঠে নেমেছেন বাম নেতাদের একটি অংশ। রাজনীতিতে ‘তৃতীয় শক্তি’ হিসেবে নির্বাচনে ও আন্দোলনে নিজেদের উপস্থিতি জানান দিতে চায় তারা। মঞ্চের অন্যতম নেতা, বিপ্লবী ওয়ার্কার্স পার্টির সাধারণ সম্পাদক সাইফুল হক ভোরের কাগজকে বলেন, আমরা বিকল্প শক্তি হিসেবে গণতন্ত্র মঞ্চকে গড়ে তুলতে চাই। রাজপথে আন্দোলনেও থাকব, আবার ভোটের প্রস্তুতিও চলবে। তিনি বলেন, ঐক্যমত হলে বিএনপির সঙ্গে আমরা যুগপৎ আন্দোলনে যাব, তবে কখনোই বিএনপি জোটে যাব না কিংবা বিএনপির সঙ্গে ঝুলে পড়া নয়, এটি স্পষ্ট। বিএনপির সঙ্গে আমাদের সবকিছু মিলবে না। পার্থক্য থাকবে।

সাবস্ক্রাইব ও অনুসরণ করুন

সম্পাদক : শ্যামল দত্ত

প্রকাশক : সাবের হোসেন চৌধুরী

অনুসরণ করুন

BK Family App