×

মুক্তচিন্তা

নিরাপত্তা এবং দেশের বাইরে ব্যবসা

Icon

অনলাইন ডেস্ক

প্রকাশ: ২৮ মার্চ ২০২৩, ১২:১৮ এএম

নিরাপত্তা এবং দেশের বাইরে ব্যবসা
হঠাৎ নয়, প্রায়ই এমন সংবাদ উঠে আসে, ফাঁসির আসামি ঘুরে বেড়াচ্ছে বহাল তবিয়তে আর শাস্তি ভোগ করছে নিরীহ নিরাপদ মানুষটি দিনের পর দিন, বছরের পর বছর। একদিকে যেমন অপরাধের সঙ্গে সরাসরি যুক্ত না হয়েও হিংসা, বিদ্বেষ বা প্রতিশোধের শিকার হয়ে দিনের পর দিন শাস্তি ভোগ করছে কেউ কেউ, আবার অন্যদিকে নিরীহ কাউকে ফাঁসিয়ে প্রকৃত আসামিকে বিশেষ বন্দোবস্তে নিরাপদ রাখার কতিপয় পুলিশ সদস্যের পাঁয়তারার গল্পও শোনা যায়। শুধু পলিশ সদস্য বললে ভুল বলা হবে। এমন কাজে রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক প্রভাব ও শক্তি লাগে। অনেকে মনে করে, এই শক্তিই আসলে সবকিছু নিয়ন্ত্রণ করে এবং সেটা সব রাজনৈতিক সরকার আমলেই থাকে, থাকতে দেখা যায়। যাই হোক, অপরাধ করেও নিরাপদ থাকার পেছনকার গল্প কমবেশি সবাই জানে এই সমাজে। দুঃখজনক হলেও সত্য, এই জানাটা খুব বেশি কাজে আসে না, কাজে দেয় না এই সমাজটাকে নিরাপদ রাখতে। কই দিচ্ছে। দিচ্ছে না। সংশ্লিষ্ট দায়িত্বশীলরা জেনেও আদতে কিছু করতে পারে বলে মনে হয় না। মনে হওয়ার মতো তো কোনো দৃশ্যমান ঘটনা ঘটে না। বরং কোনো কোনো পুলিশ সদস্য প্রকৃত আসামিকে রক্ষা করেছে, এ ধরনের গল্পের প্রচলন আছে বেশ। সমাজে দুটো বাক্য আপন গতিতে এবং নির্বিঘেœ চলে- এক. ‘পুলিশি হয়রানি’ এবং দুই. ‘গরিব বিচার পায় না কিংবা বিচার প্রক্রিয়ার দীর্ঘসূত্রতা সব শেষ করে ফেলে’। যদি হিসাব বা গবেষণা করা হয় তাহলে দেখা যাবে, অপরাধ না করে শাস্তি ভোগের এক ভয়ংকর চিত্র ফুটে উঠেছে। সাধারণত গ্রামাঞ্চলে জমিজমার বিরোধ, দখলের বিরোধ, প্রভাব ও আধিপত্যের পাশাপাশি দলীয় রাজনৈতিক বিরোধ দেখা যায়। এই বিরোধের সূত্র ধরে রক্তক্ষয়ী সংঘর্ষে মারাত্মক হতাহত হলেও সংঘর্ষকারীদের ক্ষান্ত হতে দেখা যায় না। দিনের পর দিন সংঘর্ষকারীরা বেপরোয়া হয়ে ওঠে, উঠছে। ঘটনাগুলো স্থানীয় প্রশাসন, পুলিশ প্রশাসনের সামনেই ঘটে। তারা পূর্বের থেকে জানে না, টের পায় না, এমন কথা কিন্তু বিশ্বাস করা কঠিন। কারণ এলাকার সব খবরই তাদের কাছে থাকে। থাকার কথা। ঘটনা ঘটলে তারা অ্যাকশনে যায়। তৎপর হয়। কিন্তু ততক্ষণে যা হওয়ার অধিকাংশ ক্ষেত্রেই তাই হয়ে যায়। ক্ষোভ, প্রতিহিংসায় একে অন্যকে সর্বস্বান্ত করে, ধ্বংস করে। দুর্ভাগ্যজনক, এমন পরিস্থিতির নির্মম শিকার হয় সাধারণ জনগণ। এমন সংঘর্ষমূলক ঘটনায় অনেক সময় অনেক নিরীহ মানুষকে ধরে নেয়ার অভিযোগ ওঠে। সাধারণত আমরা দেখি এবং জানি, পুলিশ আসামি ধরে এবং আদালত তার বিচার করে। মানে, সাক্ষ্য প্রমাণে আদালতে তার বিচার হয়। ন্যায়বিচার পাওয়ার জন্য সাক্ষ্য, প্রমাণ অত্যন্ত জরুরি। যার পক্ষে সাক্ষ্য, প্রমাণ যতবেশি শক্তিশালী থাকে সে ততবেশি বিচারের রায় পাওয়ার স্বপ্ন দেখে। বিচারের রায়টা সেইদিকে ঝোঁকে। যাই হোক, আইনসিদ্ধ ও ন্যায়ভিত্তিক সমাজ গঠনে পুলিশ ও আদালত দুটোরই প্রয়োজন খুব বেশি। জনগণ নিরাপত্তার প্রশ্নে এই দুই বিভাগকেই আগে দেখে। সমাজে নিরাপদবোধ না করলে তারা ভেবে নেয়, এই দুই বিভাগ সঠিকভাবে কাজ করছে না কিংবা তারা উপযুক্ত নয়। এই শ্রেণির জনগণ মনে করে বসে, রাষ্ট্রের নিরাপত্তা নিশ্চিত করবে শুধু আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী ও বিজ্ঞ আদালত। আপাতদৃষ্টিতে এটা মনে হলেও বস্তুত পক্ষে রাষ্ট্রে ও সমাজে নিরাপত্তা নিশ্চিতের দায় ও দায়িত্ব সবারই রয়েছে এবং সেটা ভিন্ন আঙ্গিকে ও কৌশলে। রাষ্ট্রের কোনো প্রতিষ্ঠানই এই দায় ও দায়িত্বের ঊর্ধ্বে নয়। সাম্প্রতিক সময়ে একটি ঘটনা প্রাসঙ্গিকভাবে তুলতে হচ্ছে। স্বর্ণ ব্যবসায়ী আরাভ খানের দাওয়াতে বিশ্বসেরা ক্রিকেট অলরাউন্ডার সাকিব আল হাসানের দুবাই যাওয়াকে কেন্দ্র করে একটি তথ্য ফাঁস হয় যে, যার দাওয়াতে সাকিব দুবাই যাচ্ছে স্বর্ণের দোকান উদ্বোধন করতে, সেই আরাভ খান আসলে একজন খুনের আসামি। প্রতিটি মিডিয়ায় কমবেশি ফলাও করে এমন সংবাদ প্রচারিত হয়। সংবাদ এমনভাবে প্রচারিত হচ্ছিল, তাতে মনে হয়েছে আরাভ খান একজন পুলিশ সদস্যকে খুন করে ভারতে গিয়ে সেখানকার নাগরিকত্বে পাসপোর্ট নিয়ে বর্তমানে দুবাইতে যে মহা স্বর্ণ ব্যবসায়ী বনে গেছে, তার থেকে অধিক অপরাধ করে ফেলেছে সাকিব আল হাসান তার আমন্ত্রণে দুবাই যাওয়ার সম্মতি দিয়ে। একটা খুব সাধারণ প্রশ্ন, সাকিব আল হাসান দুবাই যাওয়ার আগে কেন জানা সম্ভব হলো না যে, আরাভ খান প্রকৃতপক্ষে একজন খুনের আসামি। আরাভ খান তার আসল নাম নয়, ছদ্মনাম কিংবা কীভাবে সে এত টাকার পাহাড় গড়েছে যে দুবাইতে মস্ত বড় স্বর্ণের দোকান খুলে বসতে পারে। এই তথ্যগুলো এতদিন না জানতে পারার দায় কী কোনো ব্যক্তি, বিভাগ বা প্রতিষ্ঠানের ওপর বর্তায় কিনা, ভাবতে হবে। এও তো ঠিক, খবর বা খোঁজ নেয়ার গরজ দায়িত্বের মধ্যে না থাকলে বা না পড়লে কারই বা কী এসে যায়। ভাবুন পাঠক, পুলিশের চোখ ফাঁকি দিয়ে কিংবা তাদের সহায়তা নিয়ে আরাভ খান কি উড়ে গেছে ভারতে? তা কিন্তু নয়। তাকে একটা ইমিগ্রেশন পার হতে হয়েছে এবং যেখানে দায়িত্বশীল কতিপয় ব্যক্তি থাকে যাদের রাষ্ট্রের নিরাপত্তার কথা ভেবে সক্রিয় থাকতে হয়, দায়িত্ব পালন করতে হয়। তারা কী করেছে? একটা উত্তর অবশ্য আছে তাদের বলার আর সেটা হলো, এই যাওয়া তো আর একমাত্র যাওয়া নয়। ইতোপূর্বে বহু গেছে। আরাভ খানের দাওয়াতে সাকিব যাওয়াতেই ছক্কা পেটানোর মতো আওয়াজটাই হয়েছে। তাই কী? একজন অতিসাধারণ ব্যক্তি বলছিল, বাংলাদেশের বহু ব্যবসায়ী এখন দুবাই, মালয়েশিয়া, আবুধাবি, কাতার, সিঙ্গাপুর, থাইল্যান্ডে ব্যবসা করে, বসবাস করে। আবাসন, গার্মেন্টস, হোটেল, স্বর্ণের দোকানসহ নানাবিধ ব্যবসা করছে। দিন দিন এর পরিধি বাড়ছে। বিদেশি ব্যাংকে এদের প্রচুর টাকা। বৈধ ও অবৈধভাবে যাচ্ছে এসব টাকা। রাতারাতি অনেক সহায় সম্পত্তি করছে তারা সেসব দেশে। লাগামহীন বলে অনেকেই মনে করছে। তাদের সংশয়, সরকারের কাছে এসব টাকার উৎস, সঠিক হিসাব ও তথ্য আছে কিনা। না থাকলে অত্যন্ত দুঃখজনক। ভয়ংকর তো বটেই। আর জানা থাকলে তা প্রকাশ্যে অবশ্যই আসা বাঞ্ছনীয়। এমন পরিস্থিতিতে দুটো বিষয় লক্ষ্য রাখা দরকার। এক. যারা এভাবে বাইরে অবস্থান করছে তারা কতটা বৈধতার সঙ্গে অবস্থান করছে। তাদের সম্পর্কে কোনো নেতিবাচক রেকর্ড আছে কিনা, যা অদূর ভবিষ্যতে বাংলাদেশের ভাবমূর্তি নষ্ট করতে পারে সেই দেশে। বাংলাদেশের দূতাবাসের এ বিষয়ে সক্রিয় থাকতে হবে। অর্থাৎ পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের কড়া নজরদারির প্রয়োজন। দুই. বাইরে ব্যবসা করার অনুমতি কে দেয়, কীভাবে পাওয়া যায়, বাংলাদেশের বাণিজ্য মন্ত্রণালয় ও পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের কোনো সমন্বয় থাকে কিনা এ বিষয়ে, দেশ থেকে অর্থ পাচারে এই ব্যবসা কতটা ভূমিকা রাখছে তা কে দেখছে, আদৌ দেখা হয় কিনা ইত্যাদি অনেক প্রশ্নের উত্তর খোঁজা জরুরি। এই পরিস্থিতিতে রাষ্ট্রের নিরাপত্তা ঝুঁকিতে পড়ার সম্ভাবনা রয়েছে। বিশেষত অর্থনৈতিক নিরাপত্তাকে ঝুঁকিতে ফেলার আশঙ্কা রয়েছে। এটা তো ঠিক, দুবাই বা মালয়েশিয়া বা কাতার যাওয়া তো মতিঝিল থেকে নারায়ণগঞ্জ যাওয়া নয়। ব্যবসা করাও সহজ নয়। ওসব দেশে ব্যবসা করার, যাওয়ার প্রস্তুতি লাগে, অনুমতি লাগে। সেগুলো কীভাবে অর্জিত হয় তা দেখার জন্য, বোঝার জন্য সরকারের অনেক বিভাগ রয়েছে। সব বিভাগের মধ্যে সমন্বয় না থাকলে এবং প্রতিটি বিভাগের দায় ও জবাবদিহিতা না থাকলে ভালো পরিণতি আশা করা যায় না। রাষ্ট্রের নিরাপত্তার জন্য শুধু পুলিশ, র‌্যাবকে দায়ী করা বোকামি। ইমিগ্রেশন কর্তৃপক্ষ, কূটনৈতিকবৃন্দ এবং সংশ্লিষ্ট বিভিন্ন মন্ত্রণালয়ের দায় ও দায়িত্ব রয়েছে। প্রত্যেকেরই জবাবদিহিতা নিশ্চিত করতে হবে। এটা তো সত্য, দেশের রাঘববোয়ালদেরও অনেক অবিশ্বাস্য কেচ্ছা-কাহিনী আমাদের শুনতে হয়েছে, আজো শুনতে হয়। আসুন না ভাবি, কার কতটুকু ব্যর্থতা, অসততা রয়েছে এর পেছনে। স্বপ্না রেজা : কথাসাহিত্যিক ও কলাম লেখক। [email protected]

সাবস্ক্রাইব ও অনুসরণ করুন

সম্পাদক : শ্যামল দত্ত

প্রকাশক : সাবের হোসেন চৌধুরী

অনুসরণ করুন

BK Family App