×

জাতীয়

বাজারে ক্রেতার নাভিশ্বাস

Icon

কাগজ প্রতিবেদক

প্রকাশ: ২৭ মার্চ ২০২৩, ০৮:৪৭ এএম

বাজারে ক্রেতার নাভিশ্বাস

ছবি: ভোরের কাগজ

দেশে ধর্মীয় উৎসবসহ যে কোনো উৎসবকে কেন্দ্র করে একধরনের ব্যবসায়ী সিন্ডিকেটের অপতৎপরতা দেখা যায়। বৈশ্বিক অস্থিরতা, ডলারের বাড়তি দামের প্রভাবে গত বছরের আগস্ট মাসে বেড়ে যায় জ্বালানি তেলের দাম। আর এ অজুহাতে নিত্যপণ্যসহ বাজারের প্রতিটি জিনিসের দামই ধাপে ধাপে বেড়ে সাধারণ মানুষের নাগালের বাইরে চলে যায়। এর মধ্যেই রমজান মাসকে ঘিরে বাজারে সক্রিয় হয়ে ওঠে অতি মুনাফালোভী ব্যবসায়ী সিন্ডিকেট। রমজান শুরুর আগেই বাজারে সবকিছুর দাম ব্যাপক হারে বেড়ে গেছে। ফলে কোনো পণ্য কিনেই স্বস্তি পাচ্ছেন না সাধারণ ক্রেতা। মধ্যবিত্তরাও এখন দামের চাপে ব্যাগের তলানিতে পণ্য নিয়ে ফিরছেন ঘরে। নিম্নবিত্তদের অবস্থা অবর্ণনীয়। সব মিলিয়ে ক্রেতাদের নাভিশ্বাস তোলা এই দ্রব্যমূল্যের কারণেই হয়তো এবারের রমজান চিহ্নিত হবে সর্বকালের সর্বোচ্চ খরুচে মাস হিসেবে!

রমজানের তৃতীয় দিন রবিবার রাজধানীর কারওয়ান বাজার, মালিবাগ রেলগেট বাজার ও শান্তিনগর বাজার ঘুরে দেখা গেছে, মানুষের সমাগম থাকলেও ‘ব্যাগ ভরে’ বাজার করতে পারছেন না অনেকেই। কারণ মুরগি, ডিম, ছোলা, ভোজ্য তেল, গরুর মাংস, খাসির মাংস, চিনি, খেজুর, চাল, আটাসহ সব ধরনের সবজির দামই বেড়েছে অস্বাভাবিকভাবে। কোনো কোনো পণ্য কিনতে ক্রেতাদের গুনতে হচ্ছে দ্বিগুণ টাকা।

বিক্রেতারা জানান, সব সময় রমজানে বাজারে পণ্য কেনার হিড়িক পড়ত। তবে এ বছর রমজানে আগের মতো ক্রেতা নেই। এমনকি যারা আসছেন তারা কম কম কিনছেন। ক্রেতারা জানান, বাজারে কোনো ধরনের পণ্য কম দামে পাওয়া যাচ্ছে না। খেজুর থেকে শুরু করে নিত্যপ্রয়োজনীয় সবকিছুর দাম অতিরিক্ত বেড়ে গেছে।

রাজধানীতে রিকশা চালিয়ে জীবিকা নির্বাহ করেন মন্টু মিয়া। রোজার মাসে খাবারের জন্য মন্টু মিয়ার বাজেট ১২ হাজার টাকা। পাঁচ দিনের বাজার করতে গিয়ে তিনি দেখেন, কোনোরকম মাছ কিনতে পারলেও মুরগি কেনা সম্ভব হচ্ছে না। গরুর মাংস তো বিলাসী খাবার, আর ইফতারিতে ফল বাদ দেয়ার সিদ্ধান্ত আগেই নিয়েছেন। শুধু মন্টু মিয়াই নন, বাজার করতে আসা নিম্নমধ্যবিত্ত কিংবা নিম্ন আয়ের সব ভোক্তারই একই গল্প। তারা বলছেন, এবারের রমজানে কম খেয়েই রোজা রাখতে হবে।

রাজধানীর মানিকনগর এলাকার বাসিন্দা রহমত হোসেন বলেন, এক ছেলে, এক মেয়ে ও স্ত্রীকে নিয়ে ২ রুমের একটি ভাড়া ফ্ল্যাটে থাকি। বেতন পাই ৩৫ হাজার টাকা। নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের দাম অস্বাভাবিক বৃদ্ধি ও জীবনযাত্রার ব্যয় বেড়ে যাওয়ায় সংসার খরচ চালাতে বেশ বেগ পেতে হচ্ছে। তাই এবারের রমজানে প্রথমবারের মতো পারিবারিকভাবে ইফতার আইটেম না খাওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছি। খেজুর দিয়ে রোজা খুলে ভাত বা কলা-চিঁড়ায় ইফতার করব এবার।

তথ্য বিশ্লেষণে দেখা গেছে, গত কয়েক মাসে দ্রব্যমূল্যের ভয়াবহ অবস্থার কারণে মধ্য ও নিম্নমধ্য আয়ের মানুষের নাগালের বাইরে চলে গেছে নিত্যপণ্যের বাজার। মাছ-মাংস থেকে শুরু করে সব ধরনের সবজির দামও মানুষের নাগালের বাইরে চলে গেছে। গরিবের মাছ বলে খ্যাত পাঙ্গাস, তেলাপিয়াও এখন বিক্রি হচ্ছে ২০০-২২০ টাকায়। গত ৩-৪ মাস আগেও পাঙ্গাস ১৪০-১৪৫ টাকা ও তেলাপিয়া মাছ বিক্রি হয়েছিল ১৩৫-৪০ টাকা করে। এছাড়া অন্যান্য মাছের মধ্যে মানভেদে রুই মাছ ২৯০-৩৮০ টাকা, সরপুঁটি ২০০-৪০০ টাকা, চাষের মাগুর ৬০০ টাকা, শোল মাছ ৮০০ টাকা, গলদা চিংড়ি এক হাজার টাকা করে বিক্রি করছেন মাছ ব্যবসায়ীরা।

রমজান উপলক্ষে বাজারে দাম বেড়েছে সবজির। শসা প্রতি কেজিতে দাম ১০ টাকা বেড়ে বিক্রি হচ্ছে ৫০-৬০ টাকায়। লম্বা ও গোল বেগুনের কেজি ৬০-৮০ টাকা, টমেটো ৪০-৫০ টাকা। শিমের কেজি ৪০-৫০ টাকা। আর করলার কেজি ১০০-১২০ টাকা, যা দুই সপ্তাহ আগে ছিল ৮০-৯০ টাকা। আকারভেদে লাউ বিক্রি হচ্ছে ৫০-৮০ টাকায়। চাল কুমড়া প্রতিটি ৫০-৬০ টাকা, মিষ্টি কুমড়ার কেজি ৪০ টাকা, চিচিঙ্গা ৮০, পটল ৮০, ঢেঁড়স ১০০, কচুর লতি ১০০, পেঁপে ৩০-৪০, বরবটি ১২০ ও ধুন্দুল ৫০-৬০ টাকা কেজি। পাতা কপি ৩০-৪০ টাকা পিস। আর কাঁচামরিচ প্রতি কেজি বিক্রি হচ্ছে ৮০-৯০ টাকা। বাজারে কাঁচা কলার হালি বিক্রি হচ্ছে ৪০ টাকা। লেবুর হালি বিক্রি হচ্ছে ৩০ থেকে ৬০ টাকা।

লেবু বিক্রেতা মো. শরিফ বলেন, চাহিদা অনুযায়ী লেবু পাওয়া যাচ্ছে না। রোজা উপলক্ষে লেবুর চাহিদা অনেক বেশি। এ কারণেই দাম বেড়েছে। তবে আগের দামেই পেঁয়াজ বিক্রি হচ্ছে। কেজি ৩৫ থেকে ৪০ টাকা। বড় রসুনের কেজি ১৩০-১৪০ টাকা। ছোট রসুনের কেজি বিক্রি হচ্ছে ১২০-১৩০ টাকা। দেশি আদার কেজি ১৪০ থেকে ১৬০ টাকা, চায়না আদা ২২০ টাকা। প্রতি কেজি আলু বিক্রি হচ্ছে ২৫ থেকে ৩০ টাকায়। খোলা চিনির কেজি ১১৫ থেকে ১২০ টাকা, খোলা আটা ৬০ টাকা। তবে প্যাকেট আটা প্রতি কেজি ৬৫ টাকায় বিক্রি হচ্ছে, যা আগে ছিল ৭০ টাকা। আর ২ কেজির প্যাকেট আটা বিক্রি হচ্ছে ১৩০ টাকায়।

বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর হিসাবেই দেখা যায়, গত বছর ফেব্রুয়ারি মাসের তুলনায় এ বছর ফেব্রুয়ারি মাস পর্যন্ত মূল্যস্ফীতি বেড়েছে ২ দশমিক ৬১ শতাংশ। চলতি বছরের ফেব্রুয়ারিতে দেশের গড় মূল্যস্ফীতি ছিল ৮ দশমিক ৭৮ শতাংশ।

যদিও গত মঙ্গলবার একনেক সভা শেষে পরিকল্পনামন্ত্রী এম এ মান্নান জানিয়েছেন, মূল্যস্ফীতি আরো বাড়বে। চৈত্রের খরা ও রোজায় মানুষের অতিরিক্ত মজুতের কারণে এ মূল্যস্ফীতি আরো বাড়তে পারে বলে শঙ্কার কথা বলেছেন তিনি। পরিকল্পনামন্ত্রী বলেন, রমজান মাসে মানুষের প্রবণতা থাকে কিছু বেশি নিত্যপণ্য কেনার। তাছাড়া চৈত্র মাসটি আদিকাল থেকেই মঙ্গার মাস। এই সময়ে প্রকৃতিতে কিছুটা অভাব থাকে। সার্বিক দিক বিবেচনায় দেশে চলতি মার্চ মাসে মূল্যস্ফীতি বাড়বে। তবে আগামী এপ্রিল মাস থেকে এসব মূল্যস্ফীতি কমার সম্ভাবনা রয়েছে।

দাম কমেছে ব্রয়লার মুরগির, ডিমের দামে হেরফের : বড় কোম্পানিগুলো খামারে ১৯০ থেকে ১৯৫ টাকা কেজিতে ব্রয়লার মুরগি বিক্রি শুরুর পর খুচরা বাজারে এর দাম কমতে শুরু করেছে। গত তিন দিনে বাজারে ব্রয়লার মুরগির দাম কেজিতে ৫০ টাকা পর্যন্ত কমেছে। খুচরায় বিক্রি হচ্ছে কেজিপ্রতি ২০০ থেকে ২৩০ টাকায়। তবে ডিমের দাম একেক জায়গায় একেক রকম। বাজারভেদে ডজনপ্রতি ফার্মের মুরগির বাদামি ডিম বিক্রি হচ্ছে ১৩০ থেকে ১৪০ টাকা পর্যন্ত। আবার পাড়া-মহল্লায় অনেকটা ইচ্ছেমতো ডিমের দাম রাখা হচ্ছে। ডজনপ্রতি ন্যূনতম পাঁচ টাকা, কোথাও কোথাও ১০ টাকার ওপর বেড়েছে দাম।

মালিবাগ বাজারের ডিম ব্যবসায়ী রহিম মোল্লা বলেন, ফার্মের মুরগির বাদামি ডিম ১৩০ টাকা ডজন বিক্রি করছি। সাদা রংয়ের ডিমের দাম আরেকটু কম। একটু সামনেই রেলগেট কাঁচাবাজারে ডিমের ডজনপ্রতি দাম হাঁকানো হচ্ছে ১৪০-১৫০ টাকা। চেইন শপ স্বপ্নের ওয়েবসাইটে গতকাল প্রতিটি খোলা ডিমের দাম উল্লেখ করা হয়েছে ১২ দশমিক ৫০ টাকা। সেই হিসেবে স্বপ্ন থেকে ডিম কিনতে গেলে ক্রেতাদের ডজনপ্রতি ডিমের দাম গুনতে হবে ১৫০ টাকা। বাজারের সাধারণ দরের চেয়ে যা ডজনে ১০ টাকার মতো বেশি। অর্থাৎ রাজধানীতেই জায়গা ও বাজারভেদে একেক স্থানে ডিমের দাম একেক রকম।

রমজানে নিয়ন্ত্রণহীন দ্রব্যমূল্য সম্পর্কে কনজুমারস এসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (ক্যাব) সিনিয়র ভাইস প্রেসিডেন্ট প্রফেসর ড. এম শামসুল আলম বলেন, অসাধু ব্যবসায়ীরা শুধু যে রমজান মাসে দাম বাড়ান, তা নয়। সব সময়ই কোনো না কোনো অজুহাতে দাম বাড়ানোর পাঁয়তারা করেন। আবার তদারকি সংস্থাগুলোও নিয়মিত তদারকি করে, কিন্তু কাজের কাজ কিছুই হয় না। তিনি বলেন, রমজানে সাধারণ মানুষ ঈদ বোনাস পায়, ফলে হাতে কিছু বাড়তি আয় থাকে। এজন্য কেনাকাটা একটু বেশি করে। অসাধু ব্যবসায়ীরা এ সুযোগটাকেই কাজে লাগিয়ে পণ্য বা সেবার মূল্য বাড়িয়ে দেয়। ফলে বিশাল অঙ্কের মুনাফা অন্যের পকেটে চলে যায়।

শামসুল আলম আরো বলেন, আামাদেরকেই আমাদের বাঁচাতে হবে। এর থেকে পরিত্রাণ পেতে অবশ্যই প্রতিকার আছে। কিন্তু যেসব প্রতিষ্ঠান এর প্রতিকারের জন্য রয়েছে তাদের গৃহীত কার্যক্রমের কোনো দৃশ্যমান পদক্ষেপ আমরা পাচ্ছি না। যে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী আমাদের নিরাপত্তা দেবে, তারাই চাঁদাবাজি করে পণ্যের দাম বাড়িয়ে দেয়।

তিনি বলেন, একটি আদর্শ রাষ্ট্র হিসেবে আমাদের সবকিছুই রয়েছে, নেই শুধু আমাদের অধিকারের নিরাপত্তা। তাই অধিকার আদায়ে আমাদেরই এখন একত্রে সোচ্চার হতে হবে।

সাবস্ক্রাইব ও অনুসরণ করুন

সম্পাদক : শ্যামল দত্ত

প্রকাশক : সাবের হোসেন চৌধুরী

অনুসরণ করুন

BK Family App