×

মুক্তচিন্তা

স্বাধীনতা দিবস ও সমকালীন বাংলাদেশ

Icon

অনলাইন ডেস্ক

প্রকাশ: ২৬ মার্চ ২০২৩, ১২:১৪ এএম

ভারতীয় উপমহাদেশে ধর্ম এখন রাষ্ট্রপরিচালনা ও ক্ষমতা অর্জনে বেশ গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠেছে। বাংলাদেশ তার বাইরে নয়। ভারতের বর্তমান রাষ্ট্রশাসকদের বিরুদ্ধে সেই অভিযোগ প্রথমদিকে বারবার উঠলেও বর্তমানে তা স্তিমিত হয়েছে। তার পেছনে দুটি কারণ উল্লেখ করা যেতে পারে। প্রথম কারণ উত্তর প্রদেশে হিন্দুত্ববাদী ভারতীয় জনতা পার্টির রাজ্যে ফের ক্ষমতায় আসা। ২০১১ সালের জনগণনা অনুযায়ী উত্তরপ্রদেশের ভোটারদের মধ্যে প্রায় ১৯ শতাংশ হলো মুসলিম। জনসংখ্যার বিচারে রাজ্যের অন্তত ৮৫টি আসনে মুসলিম জনসংখ্যা ৩০-৫০ শতাংশের কাছাকাছি। অথচ সেই রাজ্যে হিন্দুত্ববাদী ভারতীয় জনতা পার্টি ক্ষমতায় আসার পেছনে মুসলমানদের সমর্থন ছিল। উন্নয়ন নিরিখে তারা ভোট দিয়েছেন বিজেপিকে। দ্বিতীয় কারণ কাশ্মিরে ৩৭০ ধারা তুলে নেয়ার পরে এখন কাশ্মিরে আবার শান্তি বিরাজ করছে। সমর্থন করছে সংখ্যাগরিষ্ঠ মুসলমানরাই। কেন? কাশ্মিরের সাংবিধানিক রক্ষাকবচ তুলে নেয়ার পর থেকে দীর্ঘদিন টেলিফোন, মোবাইল, ইন্টারনেট যেমন বন্ধ করে দেয়া হয়েছিল, তেমনই বন্ধ থেকেছে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান থেকে শুরু করে ব্যবসা-বাণিজ্য। কাশ্মিরিদের আয়ের অন্যতম প্রধান উৎস ছিল যে পর্যটন, তাও বন্ধ ছিল। ভেঙে পড়া অর্থনীতি চাঙ্গা হলো লকডাউন ওঠার পর। পর্যটনই হোক বা আপেল উৎপাদন হোক, কাশ্মিরের মানুষ আজ খেয়ে-পরে আনন্দে আছে। পাশের পাক অধিকৃত কাশ্মিরের মানুষের মতো অনাহারের যন্ত্রণা পাচ্ছে না। কাজেই নির্বাচনী প্রচারের হিন্দুত্ববাদী চিৎকারকে মুসলমানরা খুব একটা গুরুত্ব দিচ্ছে না। কিন্তু বাংলাদেশে বর্তমানে ধর্মের ভূমিকা কী? বাংলাদেশের প্রথম আইনমন্ত্রী কামাল হোসেন ২০১৮ সালে এক সাক্ষাৎকারে বলেছিলেন, ১৯৭১-এর যুদ্ধের সময় ধর্মনিরপেক্ষতা নীতিটির গুরুত্ব উদ্ভাসিত হয়েছিল। তৎকালীন প্রাইম মিনিস্টার-ইন-এগজাইল তাজউদ্দীন আহমদ ইসলামের নামে পূর্ব পাকিস্তানের ওপর নেমে আসা পাক-আক্রমণের মুখে এই মতবাদের প্রচার করেছিলেন। ১৯৭১-এর মে মাসে আঠারো দফা ঘোষণাপত্রে তিনি দেশবাসীকে আহ্বান জানান ‘ধর্ম দল ও শ্রেণি-নির্বিশেষে বাঙালি হিসেবে ঐক্যবদ্ধ’ হতে। বাংলাদেশ বেতারে নিয়ম করে কুরআন, গীতা, ত্রিপিটক ও বাইবেল পাঠ সম্প্রচারিত হতো, ঠিক যেন গান্ধীর বহুধার্মিক প্রার্থনাসভার মতো। তাজউদ্দীন আহমদ বাংলাদেশের পক্ষে সমর্থনে আরববিশ্বকে আহ্বান জানিয়েছিলেন। ‘ইয়াহিয়া খানের সেনারা ইসলামের অধিকারের জন্য লড়ছে’, এই পাক অপপ্রচারের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়িয়েছিলেন। একই কাজ করেন মওলানা ভাসানীও, মিসরের আনোয়ার সাদাত, আরব লিগের আবদেল খালেক হাসুনাসহ বিশ্বের নেতাদের উদ্দেশ্যে লেখা তার চিঠিতে বলেন, এক মুসলিম সেনাবাহিনী কী অকথ্য নির্যাতন চালাচ্ছে প্রধানত মুসলমান এক জনগোষ্ঠীর উপরে। ১৯৫৬-তে পাকিস্তানের প্রথম সংবিধান গৃহীত হওয়ার আগে গণপরিষদের বিতর্কে শেখ মুজিবুর রহমান প্রতিবাদ করেছিলেন বিনা বিচারে কারাবন্দি করে রাখার বিষয়ে, পবিত্র ধর্মগ্রন্থের উদ্ধৃতি দিয়ে বলেছিলেন, বিনা বিচারে কাউকে শাস্তি দেয়া যায় না, এমনকি সৃষ্টিকর্তাও তা করেন না। কিন্তু তথাকথিত ‘ইসলামিক সংবিধান’ কিনা বলে, ‘শৃঙ্খলা রক্ষায় ও পাকিস্তানের স্বার্থে’ যে কাউকে বিনা বিচারে বন্দি করা যেতে পারে। করাচি বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ছাত্রদের বলা হয়, তারা যেন পাকিস্তানের পক্ষে অবমাননাকর কোনো কর্মকাণ্ডে না জড়ানোর শপথ নেয়, মুজিব এরও বিরোধিতা করেছিলেন : ছাত্ররা দেশবিরোধী, এ ভাবনা নিতান্ত অমূলক। দেশের নাম হবে পাকিস্তানি ‘ইসলামি প্রজাতন্ত্র’, রাষ্ট্রপ্রধান হবেন শুধু মুসলিম মুজিব ও সুরাবর্দির মতো নেতারা এ সবের প্রতিবাদ করেন। তা সত্ত্বেও, চৌদ্দ বছর পর যখন জেনারেল ইয়াহিয়া খান ঘোষণা করলেন যে, ‘লিগ্যাল ফ্রেমওয়ার্ক অর্ডার’-এর (এলএফও) যে পাঁচটি মৌলিক নীতির অধীনে দেশে নির্বাচন হবে তার একটি হলো ইসলামি মতাদর্শের প্রতি আনুগত্য এবং এটিই ‘পাকিস্তানের উদ্ভবের ভিত্তি’, আওয়ামী লীগ তা মেনে নিয়েছিল। কাজেই বাংলাদেশে শেখ মুজিবুর রহমান ও তার কিছু ঘনিষ্ঠ ছাড়া ধর্মনিরপেক্ষতার নীতি কখনই গুরুত্ব পায়নি। কিন্তু ১৯৭০ থেকে হাওয়া ঘুরতে শুরু করল। ইসলামের নামে নিপীড়নের ফলে ধর্মনিরপেক্ষতার পালে বাতাস এলো। কিন্তু সেটা কতটা ধর্মনিরপেক্ষতা ছিল? যুদ্ধ শেষের কিছুদিন পরই তাজউদ্দীন আহমদ এক বৌদ্ধ প্রতিনিধি দলের সঙ্গে সাক্ষাৎ করেন। বাংলাদেশ অবজারভার পত্রিকার রিপোর্ট বলছে, প্রধানমন্ত্রী ঘোষণা করেন বাংলাদেশ হবে এক সম্পূর্ণ ধর্মনিরপেক্ষ রাষ্ট্র, যেখানে প্রতিটি ধর্মের পূর্ণ স্বাধীনতা নিশ্চিত করা হবে। ধর্মনিরপেক্ষতার এই বোধ যে কোনো রকমের সাম্প্রদায়িকতা, কোনো একটি ধর্মের পক্ষে রাজনৈতিকভাবে পাশে থাকা, রাজনৈতিক স্বার্থে ধর্মের অপব্যবহার, কোনো বিশেষ ধর্মের আচরণকারীকে নিপীড়ন বা তার প্রতি বৈষম্য, এসব ক’টির অনুপস্থিতি বাংলাদেশের সংবিধানের ৮নং অনুচ্ছেদে সুরক্ষিত হয়। ১৯৫৬ (এবং ১৯৭৩)-র পাকিস্তান সংবিধানের বিপ্রতীপে বাংলাদেশের ১৯৭২ সালের সংবিধানে রাষ্ট্রপ্রধানের পদ কোনো মুসলিমের জন্য নির্দিষ্ট করা হয়নি। ১৯৭২ সালের সংবিধান বিল পাস হওয়ার আগের ভাষণে নতুন প্রধানমন্ত্রী শেখ মুজিবুর রহমান বলেন, ‘ধর্মনিরপেক্ষতা মানে ধর্মহীনতা নয়। মুসলমানরা তাদের ধর্ম পালন করবে তাদের বাধা দেয়ার ক্ষমতা এই রাষ্ট্রে কারো নেই। হিন্দু তাদের ধর্ম পালন করবে তাদের বাধা দেয়ার ক্ষমতা এই রাষ্ট্রে কারো নেই। বৌদ্ধরা তাদের ধর্ম পালন করবে… খ্রিস্টানরা তাদের ধর্ম পালন করবে, কেউ বাধা দিতে পারবে না। আমাদের শুধু আপত্তি হলো এই যে, ধর্মকে কেউ রাজনৈতিক অস্ত্র হিসেবে ব্যবহার করতে পারবে না।’ কিন্তু সেই বাংলাদেশের বর্তমানের চিত্রটা কী? বাংলাদেশের নির্বাচন কমিশনে নিবন্ধিত ইসলামিক রাজনৈতিক দল হলো ১০টি। শুধু ইসলাম নয় অন্যান্য ধর্মভিত্তিক রাজনৈতিক দলও আছে বাংলাদেশে। যেমন, বাংলাদেশ জাতীয় হিন্দু জোট। ৫০টি হিন্দু রাজনৈতিক দল ও সংগঠনের সমন্বয়ে আছে বাংলাদেশ জনতা পার্টি বা বিজেপি। এই প্রেক্ষিত শুধু সংখ্যালঘুদের কাছে বিপদের নয়। বিপদ উন্নয়নের পক্ষেও। বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী যেভাবে বাংলাদেশকে উন্নয়নের প্রতীকে পরিণত করেছেন সেই অভিযানও রুদ্ধ হবে যদি বাংলাদেশ আজো অসাম্প্রদায়িক গণতন্ত্রের কঠিন অনুসারী না হয়। ধর্মরিপেক্ষতা কোথায় মার খাচ্ছে? এই অবস্থা থেকে তাহলে মুক্তির উপায় কী? এককথায় শিক্ষার প্রসার ঘটানো। শিক্ষার্থীরা বাংলাদেশের নাগরিক হয়ে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস, বাংলাদেশের সংবিধান, অর্থনীতি, আইন, সমাজ ব্যবস্থা, মানবাধিকার এবং নৈতিক জ্ঞান ছাড়া বেড়ে উঠলে সাম্প্রদায়িক এবং ধর্মান্ধতার অন্ধকার সে জাতির সঙ্গী হবে সেটাই স্বাভাবিক। অমিত গোস্বামী : কবি ও লেখক। কলকাতা থেকে

সাবস্ক্রাইব ও অনুসরণ করুন

সম্পাদক : শ্যামল দত্ত

প্রকাশক : সাবের হোসেন চৌধুরী

অনুসরণ করুন

BK Family App