×

জাতীয়

সত্যের নির্মোহ প্রকাশ- বঙ্গবন্ধুই স্বাধীনতার ঘোষক

Icon

কাগজ প্রতিবেদক

প্রকাশ: ২৬ মার্চ ২০২৩, ১২:০০ এএম

সত্যের নির্মোহ প্রকাশ- বঙ্গবন্ধুই স্বাধীনতার ঘোষক

জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। ফাইল ছবি

সত্যের নির্মোহ প্রকাশ- বঙ্গবন্ধুই স্বাধীনতার ঘোষক

বাংলাদেশের প্রতিষ্ঠাতা তথা মহান স্থপতি ও সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ বাঙালি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের জীবন ও কর্ম বিশ্লেষণ করলে এ কথা সুস্পষ্ট যে, তিনি ছিলেন অসামান্য মানবদরদি। এটা ছিল তার সহজাত আবেগ ও বিশ্বাস এবং সেই তাড়নাতে তিনি সেই ছোটবেলা থেকেই ছিলেন জনকল্যাণমুখী। ছোটবেলা, কৈশোর ও যৌবনের সেই আবেগ ও স্পৃহা তাকে রাজনীতিতে টেনে এনেছিল এবং রাজনীতিতে থেকেই তিনি কল্যাণমূলক রাষ্ট্রের স্বপ্নে বিভোর ছিলেন। ব্রিটিশ শাসনের মধ্যে তিনি তা অসম্ভব ভেবেই হয়তো লাহোর প্রস্তাবভিত্তিক পাকিস্তান আন্দোলনে গভীরভাবে সম্পৃক্ত হয়েছিলেন। কিন্তু ১৯৪৬ সালের দিল্লিভিত্তিক পাকিস্তান প্রস্তাবে তিনি তার স্বপ্নের অপছায়া দেখেই হয়তো ১৯৪৭ সালের ১৪ আগস্ট বাঙালিদের বাঁচানোর স্বপ্ন নিয়ে প্রস্তুতি নিতে থাকেন। সেদিনই তিনি বলেছিলেন, আমরা বাঙালিরা শেষ হয়ে গেলাম, তবে আমি তা হতে দেব না। মূলত, সেদিন থেকেই তিনি এমন একটি রাষ্ট্রের স্বপ্ন লালন শুরু করলেন, যার মাঝে মানবিকতা অর্থাৎ গণতন্ত্র, সমাজতন্ত্র, ধর্মনিরপেক্ষতা ও জাতীয়তাবাদ সর্বোচ্চ গুরুত্ব পাবে। তার স্বপ্ন, ইচ্ছা ও আদর্শের সঙ্গে সঙ্গতিময় বলেই তিনি সিলেটকে পাকিস্তান অন্তর্ভুক্তির জন্য রাত-দিন পরিশ্রম করেন। পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার পর তার ঢাকায় আগমন, ছাত্রলীগের পুনর্জীবন দান ও গণতান্ত্রিক যুবলীগ প্রতিষ্ঠা ছিল সে জাতীয় রাজনীতির পূর্ব অনুরাগ। ভাষা আন্দোলনে তার অংশগ্রহণ ছিল ‘রাষ্ট্রভাষা বাংলার চেয়ে’ ‘বাংলা ভাষার রাষ্ট্র কায়েমের’ প্রত্যাশা। ভাষা আন্দোলনের সঙ্গে সঙ্গে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চতুর্থ শ্রেণির কর্মচারীদের আন্দোলনে তার সম্পৃক্ততা শোষিত-বঞ্চিত মানুষের ভাগ্যোন্নয়নের প্রয়াসের সঙ্গে অঙ্গীভূত ছিল।

১৯৫৪ সালে সোহরাওয়ার্দী ও মওলানা ভাসানীর প্রভাবহেতু তিনি যুক্তফ্রন্টের সঙ্গে জড়িয়ে গিয়ে নির্বাচন করেছিলেন, জয়ীও হয়েছিলেন। তবে সেই ১৯৫৪ সালেই নির্বাচনের ছত্রছায়ায় তিনি কয়েকবার জামালপুর গমন করেন এবং স্বাধীনতার উদ্দেশ্যে নিবেদিত কিছু বিশ্বস্ত কর্মী সৃষ্টি করেন। ১৯৫৪ সাল পরবর্তী পাকিস্তানের ভানুমতি খেলার পরও তিনি ঊর্ধ্বতন নেতাদের চাপে পড়ে মন্ত্রিত্বও গ্রহণ করেন। এমনকি সোহরাওয়ার্দী সাহেবের প্ররোচনায় সিয়াটো-সেন্টোর ন্যায় ঘৃণ্য চুক্তি বা এক ইউনিট প্রবর্তন ও অনেকটা গণবিরোধী ১৯৫৬ সালের পাকিস্তান প্রণীত শাসনতন্ত্রে মৌন সম্মতি দিয়েছিলেন। ১৯৫৮ সালে পাকিস্তানে সেনাশাসন প্রবর্তিত হলে গভীর হতাশা নিয়ে তিনি জামালপুরে ইস্ট বেঙ্গল লিবারেশন আর্মি বা পার্টি গঠনে সমর্থন জ্ঞাপন করেন। একই সময়ে ইস্ট বেঙ্গল লিবারেশন ফ্রন্টও গঠিত হয়। যাদের দিয়ে সংগঠনের গোড়াপত্তন করা হয়েছিল তারা একেবারে কম আগায়নি, তবে জেল-জুলুম-নির্যাতনের শিকার হয়ে যখন তারা হাল ছেড়ে দেন, তখন তিনি তাদের কাউকে কাউকে ঢাকায় নিয়ে আসেন, আলফা ইন্স্যুরেন্সে চাকরিও দেন। নিজেই তিনি ১৯৬১ সালে ইস্ট বেঙ্গল লিবারেশন ফ্রন্ট পুনর্জীবিত করেন। এবারে তিনি তার মফস্বলের সহকর্মীদের দায়-দায়িত্ব গ্রহণ সমেত সশস্ত্র আন্দোলনের দায়িত্বও কাঁধে নিয়ে নেন।

পাশাপাশি তিনি সমমনা মণি সিংহ, খোকা রায় ও মোজাফ্ফর আহমদের সঙ্গে বাংলার স্বাধীনতা নিয়ে যোগসূত্র সৃষ্টি করেন। মাঠের আন্দোলন চাঙ্গা রাখার জন্যে তিনি ১৯৬২-৬৩ সালের শিক্ষা আন্দোলন, ১৯৬৪ সালের ঢাকা বিশ^বিদ্যালয়ে সমাবর্তন ভণ্ডুল বা পাকিস্তানি আইয়ুব সরকারের পররাষ্ট্রমন্ত্রী মঞ্জুর কাদেরের নাজেহালের পৃষ্ঠপোষক ও উৎসাহদাতা হিসেবে কাজ করেন। তারও আগে মন্ত্রিত্ব ছেড়ে দলের সাধারণ সম্পাদকের দায়িত্ব গ্রহণও ছিল একটা দূরদর্শী ও পূর্ব পরিকল্পিত পদক্ষেপ, যার মাধ্যমে আওয়ামী লীগ নাম দলটিকে স্বাধীনতা সংগ্রাম ও যুদ্ধের উপযোগী করে গড়ে তুলতে সক্ষম হয়েছিলেন। ১৯৬৪ সালে তিনি সশস্ত্র পন্থায় স্বাধীনতাকামী লে. কমান্ডার মোয়াজ্জেম হোসেন ও আর বেশ ক’জনের অগ্রগামিতার ব্যাপারে সম্মতি জ্ঞাপন করেছিলেন। তবে যখন এটা স্পষ্ট হলো যে তাদের সৃষ্ট দেশে সেই ঘৃণিত সেনাশাসনই স্থায়িত্ব পাবে এবং সাধারণ মানুষের শোষণ, বঞ্চনা বা বৈষম্যের পথ প্রশস্ত হবে, তখন তিনি সংগ্রামটাকে গণমুখী করতে মোয়াজ্জেমের বাধা সত্তে¡ও বাঙালির মুক্তি সনদ হিসেবে ৬ দফা দাবি পেশ করেন। তিনি জানতেন এবং পাকিস্তানিরা জানত যে এই ৬ দফা মানে ১ দফা। সে কারণে তিনি অবশ্য নির্যাতন, কারাবাস এবং সামান্য হলেও দৈহিক নির্যাতনের সম্মুখীন হন এবং আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলার ১ নম্বর আসামি হিসেবে রাষ্ট্রদ্রোহের মামলায় অভিযুক্ত হন। ছাত্রদের ১১ দফা আন্দোলন সফল না হলে হয়তো শেখ মুজিবের স্বপ্ন-সাধ ও স্বাধীনতার প্রত্যাশা সেখানেই সমাপ্ত হয়ে যেত। সৌভাগ্য আমাদের, তা হয়নি।

আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা থেকে মুক্ত হয়ে তিনি আবারো নিয়মতান্ত্রিক ও সশস্ত্র যুগপৎ পন্থায় বাংলাকে মুক্ত করার পদক্ষেপ নেন। ১৯৬৯ সালে তিনি চিকিৎসার অজুহাতে লন্ডন গিয়ে আপাতত দৃশ্যমান যুদ্ধে ইন্ধিরা গান্ধীর সহায়তার পূর্ণ আশ্বাস লাভ করেন। ১৯৭০ সালে পাকিস্তানব্যাপী নির্বাচনে সংখ্যাগরিষ্ঠতা নিয়ে নির্বাচিত হওয়ার পর ক্ষমতায় যেতে পারবেন না বলেই সশস্ত্র পন্থায় বাংলাদেশ সৃষ্টির প্রয়াস বঙ্গবন্ধু বেগবান করেন। তার ইচ্ছাটাকে সর্বজনীন ইচ্ছায় রূপান্তরে রাজপথের অন্যান্য কর্মকাণ্ডের সঙ্গে অসহযোগের কর্মসূচিও জড়িত করেন। ৬ দফাভিত্তিক শাসনতন্ত্রের মাধ্যমে শাসনের প্রত্যয় থেকে এক বিন্দুও পিছু হটার পথ না ধরলে পাকিস্তানি শাসক ইয়াহিয়া খান এবার ঠিকই বাঙালির মুক্তির সনদ ৬ দফার জবাব অস্ত্রের মাধ্যমে দিতে শুরু করেন। বঙ্গবন্ধু ৭ মার্চের ভাষণের চেয়ে আরো কয়েক ধাপ এগিয়ে পূর্ণাঙ্গ স্বাধীনতার ঘোষণা দেন।

কী ছিল সেই ঘোষণায় : অনেকের মতে ১৯৭১ সালের ৭ মার্চে বঙ্গবন্ধুর ভাষণটিই আদপে স্বাধীনতার প্রথম ঘোষণা। হ্যাঁ, এটা বাঙালিদের জন্য স্বাধীনতার ঘোষণাই বটে। তবে তাকে সাংবিধানিক লেবাস পরানো হয়নি। ২৫-২৬ মার্চ ১৯৭১ সালে তিনি তিনটি ঘোষণা দেন যার প্রথমটি ছিল- ‘THIS MAY BE MY LAST CALL. FROM TODAY BANGLADESH IS INDEPENDENT. I CALL UPON THE PEOPLE OF BANGLADESH WHEREVER YOU MIGHT BE AND WITH WHATEVER YOU HAVE, TO RESIST THE ARMY OF OCCUPATION TO THE LAST. YOUR FIGHT MUST GO ON UNTIL THE LAST SOLDIER OF THE PAKISTAN OCCUPATION ARMY IS EXPELLED FORM THE SOIL OF BANGLADESH AND FINAL VICTORY IS ACHIEVED.’

এই ঘোষণাটি তিনি ২৫ মার্চের প্রথম প্রহরেই দিয়েছিলেন এবং নূরুল হক নামের একজন বিভাগীয় প্রকৌশলীর অতি শক্তিশালী ট্রান্সমিটারের মাধ্যমে তা প্রচারিত হয়েছিল। ২৫ মার্চ রাত ১০টার আগে পাকিস্তানিদের অপারেশন সার্চলাইটের প্রস্তুতির অগ্রগতি জেনেই তিনি এই ঘোষণাটি নূরুল হকের কাছে হস্তান্তর করেছিলেন। রাত ১২টার পূর্বেই তা নূরুল হক ইথারে ছড়িয়ে দিয়েছিলেন, যা বঙ্গবন্ধুর একান্ত সহকারী হাজি মোর্শেদের কণ্ঠে উচ্চারিত হয়েছে নিম্নরূপ :

‘আমি বলদা গার্ডেন থেকে বলছি। মেসেজ পাঠানো হয়ে গিয়েছে, মেশিন নিয়ে কী করব’? বঙ্গবন্ধু, হাজি গোলাম মোরশেদের মাধ্যমে উত্তর দিলেন ‘মেশিনটা ভেঙে পালিয়ে যেতে বল’।

বঙ্গবন্ধু রাত ১০টার আগেই হাজি মোর্শেদকে স্পষ্ট জানালেন ‘আমরা স্বাধীন হয়ে গেলাম’ অর্থাৎ তার স্বাধীনতার ঘোষণাটি তিনি ১০টার আগেই হস্তান্তরিত করেছিলেন। এক ঘোষণাটি স্বাধীনতার একতরফা ঘোষণা বলে বিবেচিত হয়ে যেত, যদি না অপারেশন সার্চলাইটের সময়সীমা প্রায় দুই ঘণ্টা এগিয়ে না এনে রাত সাড়ে ১১টায় করা হতো। অপারেশন সার্চলাইটের দুষ্কর্ম শুরুর পরই বঙ্গবন্ধু তার দ্বিতীয় ঘোষণাটি প্রচারের ব্যবস্থা করেন এবং তার নির্দেশে ইপিআর সুবেদার শওকত আলী তা প্রচার করেন। শওকত আলী তার সংরক্ষিত ওয়্যারলেস সেটটি ব্যবহার করেন কিন্তু তিনি ইপিআর চিফের মাস্টটি ব্যবহার করেছিলেন। সে সময় একমাত্র এই মাস্টটি ছাড়া অন্যান্য মাস্টগুলো সম্পূর্ণ অকেজো করে ফেলা হয়েছিল। তার দ্বিতীয় ঘোষণার ভাষ্য ছিল- ‘To-day Bangladesh is a sovereign and independent state. On Thursday night West Pakistani armed forces suddenly attacked the police barracks at Rajarbagh and the EPR Headquarters at Peelkhana in Dacca. Many innocent and unarmed people have been killed in Dacca city and other places of Bangladesh. Violent clashes between the East Pakistan Rifles and Police on the one hand and the armed forces off Pindi on the other, are going on. The Bengalis are fighting the enemy with great courage for an independent Bangladesh. Resist the treacherous enemy in every corner of Bangladesh. May Allah help us. ‘JOY BANGLA’

তিনি বন্দি হওয়ার কিছু আগে তৃতীয় আরও একটি ঘোষণাও প্রচার করেন, যার ভাষ্য ছিল- The enemy has struck us. Hit them back. Victory is ours. Insa Allah, Joy Bangla, Mujibur Rahman. কথিত আছে যে তিনি পুলিশের ওয়্যারলেস সেটের মাধ্যমে এই ঘোষণাটি প্রচার করিয়েছিলেন।

বঙ্গবন্ধু একজন রহস্যময় মানুষও ছিলেন। তিনি তার সব কর্মকাণ্ড সবার কাছে উন্মুক্ত করতেন না। যেমন তার সশস্ত্র যুদ্ধের সিদ্ধান্ত। ২৮ ফেব্রুয়ারিতে তার সঙ্গে শেষ দেখার সৌভাগ্য আমার ও শেখ ফজলুল হক মনির জীবনে ঘটেছিল। সেদিন তার মুখে সশস্ত্র যুদ্ধের অবশ্যম্ভাবিতা ও প্রস্তুতির কথা আমাদের জানার সৌভাগ্য হয়েছিল; কথাগুলো তেমন স্পষ্ট ছিল না, তবুও স্পষ্টত বুঝে নিতে কষ্ট হচ্ছিল না। রহস্যময়তার কাহিনী কিন্তু তার তিনটি ঘোষণার মধ্যেও বিধৃত যাতে তিনি সাপও মেরেছেন, লাঠিও ভাঙেননি। তিনি অতি ধীরস্থির ও সুকৌশলীও ছিলেন। কনফেডারেশনের ব্যাপারে সম্মতিটি ছিল শেষ মুহূর্তে আলোচনা ভেঙে দেয়ার মোক্ষম কৌশল। ছাত্র ও যুব নেতাদের জ্ঞাতসারেও সম্মতিতে তিনি তা করেছিলেন। ছাত্র ও যুব নেতাদের পরামর্শ ছিল এক লাখ প্যারামিলিশিয়া ও দুটি মুদ্রা ব্যবস্থার কথা আলোচনায় সংযোজন। যেহেতু মিলিশিয়ার কথাটি আগেই বলা হয়েছিল তাই শেষ মুহূর্তে দুই প্রদেশের জন্য দুটি পৃথক মুদ্রা ব্যবস্থার কথা বলা হলো। যা ধন্বন্তরী ওষুধের ন্যায় কাজ করল এবং ক্র্যাকডাউনের সিদ্ধান্ত চ‚ড়ান্ত করে পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খান ঢাকা ত্যাগ করল।

বঙ্গবন্ধুর স্বাধীনতার ঘোষণাগুলো মুক্তিযুদ্ধকালে কিংবা তার শাসনামলে কোনো বিতর্কের জন্ম দেয়নি। তার অপমৃত্যুর পরই এসবের সূত্রপাত হয়েছে এবং জিয়াউর রহমানের শাসনামল পেরিয়ে খালেদা জিয়ার শাসনামলে ফুলে-ফসলে পল্লবিত হয়েছে। এসব অপপ্রচারকে প্রতিহত করার প্রয়াস লক্ষণীয়, তবে দুঃখের বিষয় মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের বুদ্ধিজীবীদের কারো লেখায় বা বক্তৃতায় স্পষ্ট এসব ঘোষণার কথা এই সেদিনও উল্লেখ ছিল না। সাম্প্রতিককালে তার স্পষ্টতা ঘটেছে দুটি কারণে- একটি হচ্ছে মহামান্য হাইকোর্টের একটি রায়ে আর একটি তাজউদ্দীন কন্যার প্রকাশিত একটি গ্রন্থে।

শারমিন আহমেদের কিছু বিশ্লেষণ ও অনুসিদ্ধান্ত বিস্ফোরণমূলক। সেগুলো প্রকাশিত হয়েছে তার রচিত গ্রন্থ তাজউদ্দীন আহমদ- নেতা ও পিতা গ্রন্থের প্রথম দিকে। ২০১৩ সালে প্রকাশিত বইটির ভ‚মিকায় কিন্তু এসবের স্থান নেই, স্থান পেয়েছে পরবর্তী অধ্যায় ক’টিতে।

বইটি প্রকাশের পর এবং বিশেষত তার ওপর সুধীজনের আলোচনাকে ঘিরে প্রচণ্ড বিতর্কও জমে উঠেছিল। ২৫ মার্চ সন্ধ্যা রাত শারমিনের কিছু উক্তি যথা- ‘তিনি (বঙ্গবন্ধু) আব্বুকে বললেন, বাড়ি গিয়ে নাকে তেল দিয়ে ঘুমিয়ে থাকো, পরশু দিন (২৭ মার্চ) হরতাল ডেকেছি’ কিংবা ‘পূর্ব পরিকল্পনা অনুযায়ী আব্বু স্বাধীনতার ঘোষণা লিখে নিয়ে এসেছিলেন এবং টেপ রেকর্ডারও নিয়ে এসেছিলেন। টেপে বিবৃতি দিতে বা স্বাধীনতার ঘোষণায় স্বাক্ষর প্রদানে মুজিব কাকু অস্বীকৃতি জানান। কথা ছিল, মুজিব কাকুর স্বাক্ষরকৃত স্বাধীনতার ঘোষণা হোটেল ইন্টারকন্টিনেন্টালে অবস্থিত বিদেশি সাংবাদিকদের কাছে পৌঁছে দেয়া হবে এবং তারা আন্ডারগ্রাউন্ডে গিয়ে স্বাধীনতা যুদ্ধ পরিচালনা করবেন।’ আব্বু বলেছিলেন, ‘মুজিব ভাই, এটা আপনাকে বলে যেতেই হবে, কারণ কালকে কি হবে, আমাদের সবাইকে যদি গ্রেপ্তার করে নিয়ে যায়, তাহলে কেউ জানবে না, কি তাদের করতে হবে। এই ঘোষণা কোনো না কোনো জায়গা থেকে কপি করে আমরা জানাব। যদি বেতার মারফত কিছু করা যায়, তাহলে সেটাই করা হবে।’ মুজিব কাকু তখন উত্তর দিয়েছিলেন, ‘এটা আমার বিরুদ্ধে দলিল হয়ে থাকবে। এর জন্য পাকিস্তানিরা আমাকে দেশদ্রোহের জন্য বিচার করতে পারবে।’

‘আব্বুর লেখা ঐ স্বাধীনতা ঘোষণারই প্রায় হুবহু কপি পরদিন আন্তর্জাতিক মিডিয়ায় প্রচারিত হয়। ধারণা করা যায় যে ২৫ মার্চের কয়দিন আগে রচিত এই ঘোষণাটি আব্বু তাঁর আস্থাভাজন কোনো ছাত্রকে দেখিয়ে থাকতে পারেন। স্বাধীনতার সমর্থক সেই ছাত্র হয়তো স্ব-উদ্যোগে বা আব্বুর নির্দেশেই স্বাধীনতার ঘোষণাটিকে বহির্বিশ্বের মিডিয়ায় পৌঁছে দেন’ (পৃ. ৬০, তাজউদ্দীন আহমদ : নেতা ও পিতা)।

এসব কথা বইটির প্রায় শুরুতেই পড়ে কার মাথা ঠিক থাকবে! গাফ্ফার চৌধুরী, সোহরাব হাসান, মইনুল হাসান বা আমার প্রতিক্রিয়া সে দৃষ্টিকোণ থেকে বিচার্য। কিন্তু ক্রমশ শারমিন নিজের ধ্যান-ধারণাকে উন্মোচন শুরু করেন বইয়ের ৭১ পৃষ্ঠায় প্রথমে এইভাবে ‘২৬ মার্চ চট্টগ্রাম বেতার কেন্দ্র থেকে চট্টগ্রাম জেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক আবদুল হান্নান বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবের পক্ষ থেকে সর্বপ্রথম বাংলাদেশের স্বাধীনতার ঘোষণা করেছিলেন’। শারমিন এখানেও একটি ভুল করে বসলেন। আবদুল হান্নান থেকে শুরু করে জিয়াউর রহমান কিংবা যে বা যারা স্বাধীনতার ঘোষণা যেখান থেকে করে থাকুক না কেন আইনত কিংবা কার্যত স্বাধীনতার ঘোষণা দেয়ার কর্তৃত্ব বা অধিকার বঙ্গবন্ধু ছাড়া আর কারো ছিল না। স্মরণীয় যে ১৫ ফেব্রুয়ারি আওয়ামী লীগের সংসদীয় কমিটি বঙ্গবন্ধুকে নেতা নির্বাচন করে সব সিদ্ধান্তের ক্ষমতা তাকে অর্পণ করে। যার সদ্ব্যবহার তিনি করেন। তাই ১৫ ফেব্রুয়ারি ১৯৭১ সাল থেকে তাই স্বাধীনতার একমাত্র ঘোষক হচ্ছেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব এবং তা তিনি ঢাকা থেকেই প্রচার করেন, অন্যরা কেবলমাত্র পাঠক।

তারপরই বইটির ১৪৭ পৃষ্ঠায় শারমিন উল্লেখ করেন, ‘২০০৯ সালে সুপ্রিম কোর্টের রায় মোতাবেক স্বীকৃত হয় যে ১৯৭১ সালের ২৬ মার্চ বঙ্গবন্ধু স্বাধীনতার ঘোষণা দেন যা তৎকালীন ইপিআরের ট্রান্সমিটার, টেলিগ্রাম ও টেলিপ্রিন্টারের মাধ্যমে বাংলাদেশের সব জায়গায় প্রচারিত হয়’। ‘বঙ্গবন্ধু স্বাধীনতার ঘোষণা দেননি’ জাতীয় অনুসিদ্ধান্তের ব্যাপারে মাধ্যমিক তথ্য ব্যবহার করেছেন বা পরবর্তী সময়ে স্বাধীনতার ঘোষণা দিয়েছেন তা প্রমাণের জন্যও শারমিন শুরুতে মাধ্যমিক সংবাদ উৎস ব্যবহার করেছেন। তবে তিনি প্রকৌশলী নূরুল ইসলামের প্রসঙ্গ টেনে স্বাধীনতার ঘোষণার সম্পূর্ণ নতুন ও প্রাথমিক তথ্য সংযোজন করেন, যা ব্যারিস্টার আমিরুলও তথ্য-যুক্তি দিয়ে সমর্থন করেছেন এবং নূরুল হকের স্ত্রী ও কন্যা অনুসমর্থন করেছেন।

বইতে এসব থাকলেও অন্যদের উল্টাপাল্টা কথাগুলোতে শারমিনের মৌনতা ঘৃতাগ্নি সংযোগের ন্যায় কাজ করল। তিনি প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করলেন জামালপুরে প্রদত্ত খালেদা জিয়ার বক্তব্যের কিয়দাংশ নিয়ে, যা হুবহু তুলে ধরছি : ‘বিএনপি’র সভানেত্রী বেগম খালেদা জিয়া জামালপুরের জনসভায় (২৭ সেপ্টেম্বর, ২০১৪) তাজউদ্দীন আহমদ : নেতা ও পিতা বইটি থেকে আমার লেখার উদ্বৃতি (৫৯-৬০ পৃষ্ঠা) দিয়ে বলেছেন যে তাজউদ্দীন আহমদ স্বাধীনতার ঘোষণা লিখে এনেছিলেন কিন্তু বঙ্গবন্ধু ঘোষণা দেননি। তিনি সচেষ্ট থাকেন এ কথা প্রমাণ করতে যে বঙ্গবন্ধু স্বাধীনতার ঘোষণা দেননি (ভিডিও বক্তব্যের লিংক)। বক্তব্যে তিনি অনুল্লেখিত রাখেন আমার বইয়ের পরবর্তী অধ্যায়গুলোতে উল্লেখিত বঙ্গবন্ধুর স্বাধীনতা ঘোষণার বাকি অংশগুলোর বর্ণনা। বঙ্গবন্ধু আমার বাবা বা দলকে স্বাধীনতার ঘোষণা না দিলেও তিনি যে ভিন্ন মাধ্যমে ২৫ মার্চ মধ্যরাতে প্রথম স্বাধীনতার ঘোষণা দিয়েছিলেন, তা তথ্য ও সাক্ষাৎকারসহ আমার বইয়ে স্পষ্ট উল্লেখিত (তাজউদ্দীন আহমদ : নেতা ও পিতা ১৪৭-১৪৮, ২৭৪-২৯১, ৩০১-৩১০ পৃষ্ঠা)। তিনি আরো বলেন, ‘বঙ্গবন্ধু যে স্বাধীনতার বার্তা পাঠিয়েছিলেন, তার একমাত্র (জীবিত) সাক্ষী, বঙ্গবন্ধুর পারসোনাল এইড হাজি গোলাম মোরশেদ, যিনি ২৫ মার্চ রাতে বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে ৩২ নম্বর রোডের বাসভবন থেকে গ্রেপ্তার হন।’ তার ও প্রকৌশলী শহীদ নূরুল হক, যিনি বঙ্গবন্ধুর নির্দেশে খুলনা থেকে ট্রান্সমিটার এনেছিলেন ঘোষণা দেয়ার জন্য, তার স্ত্রীর সাক্ষাৎকার আমার বইয়ে ঐতিহাসিক তথ্য হিসেবে উল্লেখিত হয়েছে। বইয়ে আরও উল্লেখিত যে বঙ্গবন্ধুর পক্ষ থেকে ২৬ মার্চ দুপুরে এবং সেই সন্ধ্যায় চট্টগ্রাম আওয়ামী লীগের নেতা আবদুল হান্নান স্বাধীনতার ঘোষণা দেন (১৪৭ পৃষ্ঠা) এবং ২৭ মার্চ স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রের অন্যতম প্রতিষ্ঠাতা বেলাল মোহাম্মদের অনুরোধে বঙ্গবন্ধুর পক্ষ থেকে পরবর্তী ঘোষণা দেন তৎকালীন মেজর জিয়াউর রহমান (৭১ ও ১৪৭ পৃষ্ঠা)। আরো উল্লেখযোগ্য ব্যাপার, যা বইয়ে ব্যারিস্টার আমীর-উল-ইসলামের সাক্ষাৎকারে উদ্বৃত হয়েছে, তা হলো... অবিসংবাদিত নেতা বঙ্গবন্ধু ১৯৭১ সালের ২৬ মার্চ স্বাধীনতা ঘোষণা করেছেন। অতএব, ওই দিন থেকে স্বাধীনতার ঘোষণা কার্যকর হবে।’ (২৭১ পৃষ্ঠা)।

তাহলে সিদ্ধান্ত দাঁড়ায় বঙ্গবন্ধু স্বাধীনতার ঘোষণা দিয়েছিলেন এবং তা প্রতিষ্ঠিত সত্য। এই সত্যটি সরাসরি ক’জন বুদ্ধিজীবী প্রকাশ করেছেন? তারা কীসের অপেক্ষায় আছেন- আরো কিছু পদপদবি, স্বীকৃতি, মাসোহারা নাকি অন্য কিছু? দেশে এক শ্রেণির মানুষকে আওয়ামী বুদ্ধিজীবী বলে চিহ্নিত করা হয়। তাদের অবস্থান হয়তো আছে তবে তারা যে কোনো প্রকার আত্ম-তরকী ব্যতিরেকেই সত্যের নির্মোহ প্রকাশ ঘটিয়ে থাকেন।

লেখক: বীর মুক্তিযোদ্ধা, শিক্ষাবিদ ও বুদ্ধিজীবী। ওয়ার্ল্ড ইউনিভার্সিটি অব বাংলাদেশের উপাচার্য।

সাবস্ক্রাইব ও অনুসরণ করুন

সম্পাদক : শ্যামল দত্ত

প্রকাশক : সাবের হোসেন চৌধুরী

অনুসরণ করুন

BK Family App