×

মুক্তচিন্তা

বঙ্গবন্ধু বাঙালি জাতিকে উপহার দিয়েছেন মহান স্বাধীনতা

Icon

অনলাইন ডেস্ক

প্রকাশ: ২৬ মার্চ ২০২৩, ১২:১৫ এএম

আজ ২৬ মার্চ। আমাদের স্বাধীনতা দিবস। আমাদের ৫২তম স্বাধীনতা দিবস। স্বাধীনতার মহান স্থপতি ও স্বপ্নদ্রষ্টা জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের জন্মের মাসও এই মার্চ। মার্চ মাসটি আমাদের নানা দিক থেকে নানাভাবে উজ্জীবিত করে। অগ্নিঝরা মার্চ এলে আমাদের মনে পড়ে ৭ মার্চের কথা, মনে পড়ে ৭ মার্চ প্রদত্ত জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ঐতিহাসিক এবং মহান সেই ভাষণটির কথা। বাংলাদেশের রাজনৈতিক ইতিহাসে যা স্বাধীনতার ঘোষণা হিসেবেই খ্যাতি অর্জন করেছে। ১৯৭১ সালের ৭ মার্চের বঙ্গবন্ধুর সেই ভাষণটি খ্যাতি অর্জন করেছে পৃথিবীর অন্যতম ভাষণসমূহের একটি উল্লেখযোগ্য ভাষণ হিসেবেও। এই মার্চেই আমাদের মনে পড়ে ২৫ মার্চ গভীর রাতে ‘অপারেশন সার্চ লাইট’ নামক অভিযানের মাধ্যমে পাকিস্তানি স্বৈরশাসক কর্তৃক এদেশের সাধারণ মানুষের ওপর নির্মম ও নির্বিচার গণহত্যা চালানোর কথা। নিরীহ ও নিরস্ত্র মানুষের ওপর এমন হত্যাযজ্ঞ পৃথিবীর ইতিহাসে বিরল। সেদিনের সেই হত্যাযজ্ঞ নিয়ে ‘নিউইয়র্ক টাইমসের’ সংবাদদাতা সিডনি শনবার্গ ঢাকায় অবস্থানের অভিজ্ঞতা জানিয়ে বিশ্ববাসীকে যে সংবাদ জানিয়েছিলেন তা ছিল এরূপ : ‘৭৫ মিলিয়ন মানুষের পূর্বপাকিস্তান প্রদেশে স্বায়ত্তশাসনের আন্দোলন ধ্বংস করার জন্য নিরস্ত্র সাধারণ নাগরিকদের বিরুদ্ধে পাকিস্তানি বাহিনী কামান ও ভারি মেশিনগান ব্যবহার করছে। [..] কোনো সতর্কীকরণ ছাড়াই বৃহস্পতিবার রাতে আক্রমণ শুরু হয়। পশ্চিম পাকিস্তানি সৈন্যরা, সেনাবাহিনীতে রয়েছে যাদের সংখ্যাধিক্য, প্রাদেশিক রাজধানী ঢাকার রাস্তায় নেমে আসে বিশ্ববিদ্যালয়সহ স্বাধীনতা আন্দোলনের বিভিন্ন শক্ত ঘাঁটি অবরোধের উদ্দেশ্যে। [..] বিদেশি সাংবাদিকরা সকলেই অবস্থান করছিলেন হোটেল ইন্টারকন্টিনেন্টালে। কি ঘটছে বোঝার জন্য বাইরে যেতে চাইলে ব্যাপকভাবে মোতায়েন সেনাপ্রহরীরা তাদের জোর করে ভেতরে ঠেলে দেয় এবং বলে ভবনের বাইরে পা বাড়ানোর চেষ্টা নিলে তাদের গুলি করা হবে।’ পাকিস্তানিরা শুধু বাঙালি নিধন করেই ক্ষান্ত ছিল না, তাদের অপকর্মের খবর বিশ্ববাসী যেন জানতে না পারে সে ব্যবস্থা পাকাপোক্ত করতেও নানা রকমের ফন্দিফিকির করেছে। স্বাধীনতার মাস এই মার্চেই আমাদের গভীরভাবে মনে পড়ে পাকিস্তানিরা ক্ষমতা হস্তান্তর না করে নানা টালবাহানায় বাঙালির মনের ভেতর জ্বালিয়ে দিয়েছিল দ্রোহের আগুন। তারা আগুন জ্বালিয়ে দিয়েছিল বাংলার শহর-বন্দর-নগর-গ্রাম-গঞ্জে। সমগ্র বাংলাদেশকে পাকিস্তানিরা এই মার্চ মাসেই একটি অগ্নিকুণ্ডে পরিণত করে তুলেছিল। কিন্তু বাংলার সমগ্র জনপদ ও জনমনে আগুন জ্বালিয়েই তারা ক্ষান্ত হয়নি। মনে পড়ে, সেদিন ২৫ মার্চের গভীর রাতেই বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবকে পাকিস্তানি জান্তা শাসক বন্দি করে পশ্চিম পাকিস্তানে নিয়ে যাওয়ার কথাও। পাকিস্তানের অন্ধকার কারাগারে বঙ্গবন্ধুর অনিশ্চিত জীবনের কথা ভেবে ভেবে সমগ্র বাঙালি জাতি সেসময় কেমন দিশেহারা হয়ে পড়েছিল তাও মনে পড়ে আমাদের। এই মার্চেই আমাদের বিশেষ করে মনে পড়ে পাকিস্তানি জান্তা বাহিনীর হাতে বন্দি হওয়ার ঘটনা অগ্রিম আঁচ করে বঙ্গবন্ধু কর্তৃক রচিত স্বাধীনতার চূড়ান্ত ঘোষণাপত্রটির কথাও। ২৫ মার্চ রাত সাড়ে ১২টার দিকে অর্থাৎ ২৬ মার্চের প্রথম প্রহরে বঙ্গবন্ধু পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর হাতে গ্রেপ্তার হওয়ার ঠিক অল্প কিছু মুহূর্ত আগে ওয়্যারলেস মাধ্যমে চট্টগ্রামের জহুর আহমেদ চৌধুরীর কাছে স্বাধীনতার ঘোষণা বার্তাটি প্রেরণ করেন। আমাদের মনে পড়ে ঐতিহাসিক সেই ঘোষণাটি নিয়ে পরবর্তীকালে জন্ম নেয়া নানা বিভ্রান্তির কথাও। মনে পড়ে বঙ্গবন্ধু মুজিব সেখানে জাতির উদ্দেশে উদাত্ত আহ্বান জানিয়েছিলেন এই বলে যে, “পাকিস্তান সেনাবাহিনী অতর্কিতভাবে পিলখানা ইপিআর ঘাঁটি, রাজারবাগ পুলিশ লাইন আক্রমণ করেছে এবং শহরের রাস্তায় রাস্তায় যুদ্ধ চলছে। আমি বিশ্বের জাতিসমূহের কাছে সাহায্যের আবেদন করছি। আমাদের মুক্তিযোদ্ধারা বীরত্বের সঙ্গে মাতৃভূমি মুক্ত করার জন্য শত্রæদের সঙ্গে যুদ্ধ করছে। [..] সর্বশক্তিমান আল্লাহ্র নামে আপনাদের কাছে আমার আবেদন ও আদেশ- দেশকে স্বাধীন করার জন্য শেষ রক্তবিন্দু থাকা পর্যন্ত যুদ্ধ চালিয়ে যান। আপনাদের পাশে এসে যুদ্ধ করার জন্য পুলিশ, ইপিআর, বেঙ্গল রেজিমেন্ট ও আনসারদের সাহায্য চান। কোনো আপস নাই, জয় আমাদের হবেই। পবিত্র মাতৃভূমি থেকে শেষ শত্রæকে বিতারিত করুন। সব আওয়ামী লিগ নেতাকর্মী এবং অন্য দেশপ্রেমিক প্রিয় লোকদের কাছে এ সংবাদ পৌঁছে দিন। আল্লাহ আপনাদের মঙ্গল করুন। জয় বাংলা।” আমরা জানি, বঙ্গবন্ধুর এই ঘোষণা-বার্তা ইপিআরের ওয়্যারলেসের মাধ্যমে বাংলাদেশের প্রায় প্রতিটি জেলার প্রতিটি থানায় পৌঁছে যায়। অনেকেই আবার এই বার্তা সাইক্লোস্টাইল করে সাধারণের মধ্যেও বিতরণ করেন। বিদেশের পত্রপত্রিকা ও গণমাধ্যমে বঙ্গবন্ধুর স্বাধীনতার এই ঘোষণা পাকিস্তান থেকে পূর্বাঞ্চল তথা বাংলাদেশের বিচ্ছিন্ন হওয়ার এই অভিযাত্রাকে কেউ কেউ আবার ‘গৃহযুদ্ধ’ হিসেবেও প্রচার করে। চট্টগ্রাম বেতার কেন্দ্র থেকে আওয়ামী লীগ নেতা আবদুল হাননান বন্ধুর স্বাধীনতার ঘোষণার বাণী প্রচার করেন। পরে চট্টগ্রামে অবস্থিত অষ্টম ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের মেজর জিয়াউর রহমান ২৭ মার্চ কালুরঘাট ট্রান্সমিটার থেকে বঙ্গবন্ধুর পক্ষে স্বাধীনতার ঘোষণাপত্রটি পাঠ করেন। একই ঘোষণা ২৯ মার্চ পুনঃপ্রচার করা করা হয়। কিন্তু আমরা এও জানি যে, ইতিহাসের অন্ধ-কানাগলিতে প্রকৃত সত্যকে লুকিয়ে অথবা সত্যকে আড়ালের অপচেষ্টায় মেজর জিয়াউর রহমানকেই স্বাধীনতার ঘোষক বলে প্রচার ও প্রতিষ্ঠিত করার নীল-নকশা বাঙালির জীবনকে আচ্ছন্ন করে তুলেছিল। বঙ্গবন্ধু কর্তৃক রচিত স্বাধীনতার ঘোষণাপত্র পাঠ করার কৃতিত্ব আরোপ করতে গিয়ে একটি গোষ্ঠী মেজর জিয়াউর রহমানকেই ইতিহাসের ‘নায়ক’ বানিয়ে ফেলে। অথচ হাজার বছরের শ্রেষ্ঠ বাঙালি, বাঙালির স্বাধীনতার ও অর্থনৈতিক মুক্তির স্বপ্নদ্রষ্টা বঙ্গবন্ধু মুজিবকে করে ফেলা হয় খলনায়ক। যে শেখ মুজিবুর রহমানের জন্ম না হলে হাজার বছরের পরাধীন জাতির ভাগ্যে মুক্তির স্বাদ, স্বাধীনতার স্বাদ গ্রহণ সম্ভবই হতো না কোনোকালে। আজীবনের তিল তিল সাধনার মাধ্যমে বাঙালি জাতিকে স্বপ্ন দেখিয়ে কাক্সিক্ষত মুক্তির লক্ষ্যে, স্বাধীনতা অর্জনের লক্ষ্যে বঙ্গবন্ধুই যেন হাত ধরে ধরে নিয়ে অগ্রসর হয়েছেন। বাঙালি জাতিকে উপহার দিয়েছেন মহান স্বাধীনতা। বঙ্গবন্ধুর নাম স্মরণ করেই বাঙালি সব ক্রান্তিকাল অতিক্রম করবে। এই ভরসায় আমাদের উচ্চারণ স্বাধীনতার এই দিনে মুজিব তোমায় পড়ে মনে। ইতিহাস আমাদের অনেক কিছু মনে করিয়ে দিলেও ইতিহাসের শিক্ষাগ্রহণ আমাদের কমই ঘটে। তাই মাঝেমধ্যে আমরা রাজনৈতিক ভ্রষ্টাচার দেখে স্তম্ভিত হই। স্তম্ভিত হই ইতিহাসের মীমাংসিত বিষয় নিয়ে যখন রাজনৈতিক দাবার চাল ভিন্নমাত্রায় প্রয়োগ হতে দেখি-শুনি। সম্প্রতি ৩০ লাখ শহীদ সংখ্যা নিয়ে পাকিস্তানি স্টাইলে বিতর্ক সৃষ্টি করছে বিএনপির শীর্ষ পর্যায়ের নেতৃবৃন্দ। এরা মহান মুক্তিযুদ্ধে জাতির জনকের ভূমিকাকে খাটো করে প্রচারের চেষ্টায় মত্ত শুধু কালুরঘাট বেতার কেন্দ্র থেকে বঙ্গবন্ধুর পক্ষে স্বাধীনতার ঘোষণা বার্তাটি পাঠ করার ‘পাঠক’ বা ‘ঘোষকের’ দায়িত্বখানি পালনের কারণে। যিনি আবাল্য রাজনীতিচর্চার মধ্য দিয়ে, জনসমর্থনের মধ্য দিয়ে একাধিকবার জনপ্রতিনিধি নির্বাচিত হয়ে এবং বিভিন্ন রাজনৈতিক কর্মসূচি ঘোষণা করার অপরাধে পাকিস্তানি শাসকের নিপীড়ন নির্যাতন ও কারাভোগের মধ্য দিয়ে জাতির বিশ্বাসযোগ্য ও ভরসাসম্পন্ন ব্যক্তিত্বে পরিণত তাকে মেজর জিয়ার সমান্তরালে দাঁড় করানোর অসুস্থ প্রতিযোগিতা দেখে খোদ ইতিহাস শাস্ত্রেরই যেন অন্ধ হয়ে যাবার উপক্রম ঘটে! জানি না, এসব ইতিহাসবিচ্যুত রাজনীতিক ব্যবসায়ীরা বাঙালির জীবনে আদৌ সুস্থ রাজনীতিচর্চার স্থান করতে পারবেন কিনা। মানুষকে বিভ্রান্ত করে ইতিহাসের অমোঘ ধারাবাহিকতাকে অস্বীকার করে কোনো রাজনীতি এদেশে প্রাতিষ্ঠানিক মর্যাদা পাক তা আমাদের কাম্য নয়। মহান স্বাধীনতার এই মাসে আমরা এরূপ প্রত্যাশা করি যে, বাংলাদেশে সেসব মানুষেরই রাজনৈতিক অধিকার থাকা উচিত যারা মহান মুক্তিযুদ্ধ ও স্বাধীনতাকে নিঃশর্তভাবে মেনে নেবে এবং মীমাংসিত বিষয় নিয়ে কোনো বিতর্ক সৃষ্টি করবে না। সবারই শর্তহীনভাবে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ, স্বাধীনতা সর্বোপরি জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবকে মনে রেখে, তার প্রতি শ্রদ্ধা রেখে রাজনীতির মাঠে থাকা উচিত। কারণ ২১ ফেব্রুয়ারি থেকে ২৬ মার্চ কিংবা ২৬ মার্চ থেকে ১৬ ডিসেম্বর সবসময় সব জাতীয় দিবস ও মাসে বঙ্গবন্ধুর নামটিই এই ভূগোল-বাংলার সমান্তরাল হয়ে ওঠে। আমরা বাংলাদেশটিকে যেমন ভুলতে পারি না তেমনি ভুলতে পারি না বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নাম ও তার অবিসংবাদী নেতৃত্বকে। আহমেদ আমিনুল ইসলাম : অধ্যাপক, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়। [email protected]

সাবস্ক্রাইব ও অনুসরণ করুন

সম্পাদক : শ্যামল দত্ত

প্রকাশক : সাবের হোসেন চৌধুরী

অনুসরণ করুন

BK Family App