×

আন্তর্জাতিক

নিজের সংকট থেকে দৃষ্টি সরাতে বিশ্বকে আতঙ্কে রাখছেন পুতিন?

Icon

কাগজ প্রতিবেদক

প্রকাশ: ২৬ মার্চ ২০২৩, ০৮:২৮ পিএম

নিজের সংকট থেকে দৃষ্টি সরাতে বিশ্বকে আতঙ্কে রাখছেন পুতিন?

রুশ প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিন। ফাইল ছবি

নিজের সংকট থেকে দৃষ্টি সরাতে বিশ্বকে আতঙ্কে রাখছেন পুতিন?

পশ্চিমা বিশেষজ্ঞদের অভিমত, ইউক্রেন যুদ্ধ নিয়ে নিজের সংকট থেকে দৃষ্টি সরাতে বিশ্বকে আতঙ্কে রাখছেন রুশ প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিন। এরই মধ্যে বেলারুশে কৌশলগত পারমাণবিক অস্ত্র মোতায়েনের পরিকল্পনা ঘোষণা করেছেন তিনি। পুতিন বলেছেন, ইতোমধ্যে কৌশলগত পারমাণবিক অস্ত্র বহনে সক্ষম ১০টি যুদ্ধবিমান রয়েছে রাশিয়ার। রাশিয়ার একটি টেলিভিশন চ্যানেলকে গতকাল শনিবার এক সাক্ষাৎকারে ওই ঘোষণা দেন তিনি। পুতিনের এ ঘোষণা মোটেও ভালোভাবে নেয়নি ইউক্রেন। দেশটির কর্মকর্তারা বলছেন, পুতিনের এই সিদ্ধান্তের মধ্য দিয়ে বেলারুশকে ‘পারমাণবিক জিম্মি’ বানিয়েছে মস্কো। এ নিয়ে এমনকি যুক্তরাষ্ট্র ও তার মিত্রবাহিনী ন্যাটোসহ ইউরোপীয় দেশগুলো উদ্বেগের মধ্যে রয়েছে। তবে যুক্তরাষ্ট্রের ভাষ্য, বিষয়টি নিয়ে তারা উদ্বিগ্ন নয়। খবর বিবিসি,  রয়টার্স, সিএনএন ও গার্ডিয়ানের।

পুতিন বলেন, চলতি বছরের জুলাইয়ে কৌশলগত পারমাণবিক অস্ত্র বেলারুশে মোতায়েন করা হবে। তবে তিনি সুনির্দিষ্ট তারিখ ঘোষণা করেননি। এ সময় পশ্চিমারা সব রেডলাইন অতিক্রম করেছে মন্তব্য করেন তিনি। মস্কোতে সাংবাদিক পাভেল জারুবিনের প্রশ্নের জবাবে পুতিন বলেন, আমরা ক্রিমিয়ার জনগণকে রক্ষা করতে বাধ্য হয়েছিলাম। এইভাবে বা অন্যভাবে আমরা ডনবাসকে সমর্থন করেছি।

পশ্চিমা বিশ্লেষকেরা বলছেন, এর মধ্য দিয়ে চলমান যুদ্ধে ইউক্রেনকে সহায়তাকারী ন্যাটোভুক্ত দেশগুলোকে হুঁশিয়ার করলেন পুতিন। একই সঙ্গে যুদ্ধ ঘিরে পশ্চিমাদের সঙ্গে মস্কোর দ্বন্দ্বের আগুনও বাড়ালেন তিনি।

পশ্চিমা বিশেজ্ঞদের মত, পুতিন এখন অনেক সংকটের মধ্যে রয়েছেন। রুশ বাহিনী আকাশ থেকে ইউক্রেনের শহরগুলিতে বোমাবর্ষণ করছে, কিন্তু বছর পার হলেও স্থলযুদ্ধে তারা এখনও খুব একটা সুবিধা করতে পারছে না।

অন্যদিকে, পুতিন ইউক্রেনে সামরিক হামলা শুরুর কয়েক সপ্তাহ আগে চীন ও রাশিয়া ২০২২ সালের শুরুর দিকে একটি নো লিমিট অংশীদারিত্ব চুক্তি সই করে। সেই থেকে বেইজিং ইউক্রেন বিষয়ে পুতিনের সিদ্ধান্তের সমালোচনা করা থেকে বিরত আছে। এটা এতোদিন পুতিনের জন্য অবশ্য বেশ স্বস্তির বিষয় ছিল। কিন্তু পশ্চিমা বিশেজ্ঞরা মনে করছেন, সম্প্রতি চীনের সাথে বেশ কয়েকটি নতুন বাণিজ্য চুক্তি হলেও, চীনা নেতা শি জিনপিংয়ের সাথে শীর্ষ বৈঠক শেষে বেশি কিছু পাননি পুতিন। বিশ্বের সামনে একটা বিষয় বেশ পরিস্কার, রাশিয়া এখন বড়জোড় চীনের জুনিয়র অংশীদার হয়ে উঠছে। পশ্চিমারাই আসলে প্রধান অংশীদার শি জিনপিংয়ের চীনের কাছে। এটাও পুতিনের জন্য একটা বড় ভাবমূর্তি সংকট।

এদিকে,  যুক্তরাষ্ট্র সম্প্রতি বলেছে, তারা আশঙ্কা করছে বেইজিং রাশিয়াকে অস্ত্র দিতে পারে। যদিও চীন এটি অস্বীকার করেছে। এ নিয়ে রবিবার (২৬ মার্চ) রাশিয়ার সরকারি টেলিভিশন চ্যানেলে এক ভাষণে পুতিন বলেন, আমরা চীনের সঙ্গে কোনো সামরিক জোট তৈরি করছি না। হ্যাঁ, সামরিক-প্রযুক্তিগত মিথস্ক্রিয়ার ক্ষেত্রে আমাদের সহযোগিতা রয়েছে।

তবে চীন ও রাশিয়া যাই বলুক, পশ্চিমা বিশেষজ্ঞরা বলছেন, বেইজিংয়ের সঙ্গে জ্বালানি ও অর্থের মতো ক্ষেত্রগুলোতে মস্কোর সম্পর্ক বৃদ্ধির অর্থ হলো রাশিয়া চীনের ওপর অত্যধিক নির্ভরশীল হয়ে উঠছে। রাশিয়া পুতিন সমালোচকরাও এমন কথাই বলছেন। তবে টেলিভিশনে দেয়া বক্তব্যে পুতিন অবশ্য বলেছেন, এ আসলে ঈর্ষান্বিত লোকদের মতামত।

তবে পুতিনও স্বীকার করেন, দশকের পর দশক ধরে চীনকে সোভিয়েত ইউনিয়ন ও রাশিয়ার বিরুদ্ধে অবস্থান নিতে দেখতে চেয়েছে অনেকেই।

তার ওপর আন্তর্জাতিক অপরাধ আদালতে রুশ প্রেসিডেন্টের বিরুদ্ধে মামলা এবং এর ফলে পুতিনের বিরুদ্ধে গ্রেপ্তারি পরোয়ানা জারি হওয়ার বিষয়টিও ফেলনা নয়। সব মিলিয়ে পুতিন এখন বেশ বেকায়দায় রয়েছেন। এ পরিস্থিতি থেকে চোখ সরাতেই পুতিন নতুন এই পদক্ষেপ নিতে চাচ্ছেন বলে বিশেজ্ঞদের ধারণা।

ইউক্রেনের প্রেসিডেন্ট ভলোদিমির জেলেনস্কির কার্যালয়ের উপদেষ্টা মিখাইলো পোদোল্যাক বলেন, বেলারুশে কৌশলগত পারমাণবিক অস্ত্র মোতায়েনের পরিকল্পনা ইউক্রেনের সাধারণ জনগণকে ভীত করে তুলছে। রবিবার সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম টুইটারে তিনি বলেন, ‘এর ফলে আমরা বহু ক্ষয়ক্ষতি ও জীবনহানির শঙ্কা প্রকাশ করছি।’

পশ্চিমা বিশেষজ্ঞদের ধারণা, পুতিনের ‘পারমাণবিক অস্ত্র’ শব্দচয়নের মধ্য দিয়ে সমগ্র বিশ্ববাসীর মনোযোগ এখন তার দিকেই নিবদ্ধ হয়েছে। কারণ, সাধারণ অর্থে পুতিন যা বলেন কিংবা সিদ্ধান্ত নেন, বিশ্ববাসী শ্যেনদৃষ্টিতে সেদিকে নজর রাখে। বেলারুশে পুতিন কৌশলগত পারমাণবিক অস্ত্র মোতায়েনের যে সিদ্ধান্ত নিয়েছেন, সেটি বিশ্বকে বেশ কয়েকবার শেষ করে দিতে পারে।

বলা হচ্ছে, কৌশলগত পারমাণবিক অস্ত্র ছোট হতে পারে, কিন্তু বেশ শক্তিশালী ও যুদ্ধক্ষেত্রে ব্যবহারোপযোগী। পারমাণবিক অস্ত্র মোতায়েনের এই সিদ্ধান্তের ফলে আগামী দিনগুলোতে ‍তৃতীয় বিশ্বযুদ্ধের ঝুঁকি বাড়িয়ে চলেছেন পুতিন।

বেলারুশে কৌশলগত পারমাণবিক অস্ত্র মোতায়েনের ঘোষণার সময় যুক্তরাষ্ট্রের উদাহরণ টেনেছেন পুতিন। বলেছেন, মার্কিন সরকারও ইউরোপের বিভিন্ন দেশে একই অস্ত্র মোতায়েন করে রেখেছে। তবে বেলারুশে রুশ পারমাণবিক অস্ত্র মোতায়েন করা হলেও এর নিয়ন্ত্রণ দেশটির হাতে দেওয়া হবে না।

রাশিয়া যদি শেষ পর্যন্ত বেলারুশে পারমাণবিক অস্ত্র মোতায়েন করে, তাহলে তা হবে গত শতকের নব্বইয়ের দশকের মাঝামাঝি সময়ের পর থেকে রাশিয়ার বাইরে দেশটির পারমাণবিক অস্ত্র মোতায়নের প্রথম ঘটনা। বিশেষজ্ঞদের অনেকেই বলছেন, এটি একটি গুরুত্বপূর্ণ ঘোষণা। কারণ, যুক্তরাষ্ট্রের মতো রাশিয়া দেশের বাইরে পারমাণবিক অস্ত্র মোতায়েন করেনি বলে এত দিন বড়াই করে এসেছে মস্কো।

২০২২ সালের ২৪ ফেব্রুয়ারি ইউক্রেনে যুদ্ধ শুরু করে রাশিয়া। রাশিয়াকে মোকাবেলার জন্য তখন থেকে ইউরোপ-আমেরিকা ইউক্রেনকে সহায়তা করতে থাকে। যুক্তরাষ্ট্র ও যুক্তরাজ্য প্রকাশ্যভাবে ইউক্রেনকে অস্ত্র দিয়ে আসছে। বিষয়টি রাশিয়ার মাথাব্যথার কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। আর সেই কারণে বেলারুশে পারমাণবিক অস্ত্র মোতায়েনের ঘোষণা দিয়েছেন তিনি। যুক্তরাষ্ট্র ও ইউরোপের ব্যাপারে পুতিন বলেন, এরই মধ্যে যুক্তরাজ্য ইউরেনিয়াম ভর্তি অ্যান্টি-ট্যাংক অ্যাম্যুনিশন পাঠানোর সিদ্ধান্ত নিয়েছে। এটা যুদ্ধের বিপজ্জনক মোড় নিতে পারে। যদিও যুক্তরাজ্য বিষয়টি অস্বীকার করেছে। তারা বলেছে, অ্যাম্যুনিশন শুধু সামরিক ক্ষেত্রে ব্যবহৃত হবে।

কূটনীতিকরা বলছেন, রুশ পারমাণবিক অস্ত্র বেলারুশে স্থায়ীভাবে মোতায়েন করা হতে পারে। কেননা পুতিনের হাতের নাগালেই রয়েছেন দেশটির প্রেসিডেন্ট লুকাশেঙ্কো।

বেলারুশের প্রেসিডেন্ট আলেকজান্ডার লুকাশেঙ্কো বহু আগে থেকে তাঁর দেশে পারমাণবিক অস্ত্র মোতায়েন করতে রাশিয়ার কাছে অনুরোধ জানিয়ে আসছিলেন বলে উল্লেখ করেছেন পুতিন। তবে রুশ প্রেসিডেন্টের এ দাবি নিয়ে তাৎক্ষণিকভাবে কোনো প্রতিক্রিয়া জানাননি লুকাশেঙ্কো।

বিশ্বে সবচেয়ে বেশি পারমাণবিক অস্ত্র হাতে রয়েছে রাশিয়ার। এরপরই রয়েছে যুক্তরাষ্ট্র। তবে পুতিনের শনিবারের ঘোষণা এবং ইউক্রেন যুদ্ধে রাশিয়ার সম্ভাব্য পারমাণবিক হামলা নিয়ে তাদের মাথাব্যথা নেই বলে জানিয়েছে ওয়াশিংটন।

যুক্তরাষ্ট্রের জাতীয় নিরাপত্তা কাউন্সিলের মুখপাত্র আদ্রিনে ওয়াটসন বলেন, ‘আমাদের এখনই পারমাণবিক অস্ত্র মোতায়েনের সময় আসেনি। রাশিয়ার হামলার প্রতিরক্ষায় ন্যাটো জোট সামষ্টিক ব্যবস্থা নেবে।

রাশিয়ার কৌশলগত পারমাণবিক অস্ত্রগুলিকে বেলারুশে স্থানান্তরিত করার ফলে শুধু ইউক্রেনের নয়, রুশ রাহিনীর থাবার নাগালে আসবে পোল্যান্ড, লিথুয়ানিয়া এবং লাটভিয়াসহ সমস্ত ন্যাটো মিত্ররা। ফলে  পুতিনের ঘোষণা গোটা ইউরোপে হুমকির মাত্রা বাড়ায়, এমন কিছু যা পুতিন চান।

পুতিনের ঘোষণার পর পারমাণবিক যুদ্ধ বেধে যাওয়ার সম্ভাবনা ‘এখনো অনেক কম’ বলে উল্লেখ করেছেন ওয়াশিংটনভিত্তিক গবেষণা প্রতিষ্ঠান স্টাডি অব ওয়্যারের (আইএসডব্লিউ) বিশ্লেষকেরা। আইএসডব্লিউ জানিয়েছে, তারা এখনো পুতিনকে ঝুঁকি নিতে অনিচ্ছুক একজন ব্যক্তি হিসেবে দেখছে। পারমাণবিক অস্ত্র ব্যবহারের একের পর এক হুমকি দিয়ে গেলেও, এ ধরনের হামলা চালানোর কোনো ইচ্ছাই তাঁর নেই।

সাবস্ক্রাইব ও অনুসরণ করুন

সম্পাদক : শ্যামল দত্ত

প্রকাশক : সাবের হোসেন চৌধুরী

অনুসরণ করুন

BK Family App