×

সারাদেশ

গাইবান্ধায় ১৩৭টি ইটভাটার মধ্যে ১২১টিই অবৈধ

Icon

কাগজ প্রতিবেদক

প্রকাশ: ২৬ মার্চ ২০২৩, ০৭:৩৩ পিএম

গাইবান্ধায় ১৩৭টি ইটভাটার মধ্যে ১২১টিই অবৈধ

ছবি: ভোরের কাগজ

গাইবান্ধায় ১৩৭টি ইটভাটার মধ্যে ১২১টিই অবৈধ
গাইবান্ধায় ১৩৭টি ইটভাটার মধ্যে ১২১টিই অবৈধ
গাইবান্ধায় ১৩৭টি ইটভাটার মধ্যে ১২১টিই অবৈধ
গাইবান্ধায় ১৩৭টি ইটভাটার মধ্যে ১২১টিই অবৈধ

গাইবান্ধা জেলায় চলতি বছর মোট ১৩৭টি ইটভাটায় ইট পোড়ানোর কাজ শুরু হয়, এর মধ্যে ১২১টিই অবৈধ। স্থানীয় প্রশাসনকে ম্যানেজ করে এসব অবৈধ ভাটার মধ্যে অন্তত ৩০টি বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের পাশে গড়ে তোলার অভিযোগ উঠেছে। এগুলো উচ্ছেদে কোনো ব্যবস্থা নেয়া হচ্ছে না। ফলে ইটভাটার বিষাক্ত ধোঁয়ায় পরিবেশ দূষিত হচ্ছে। বিশেষত ভাটার নির্গত ধোঁয়া শিশু-শিক্ষার্থীদের স্বাস্থ্যঝুঁকিতে ফেলছে। পাশাপাশি প্রশাসনের নাগের ডগায় আবাদি জমির ভূ-উপরিস্থ মাটির স্তর কেটে ইট তৈরি করায় জমির উর্বরতা কমছে। শুধু তাই নয়, ভাটার ধোঁয়ায় বিভিন্ন ফলমূল, শাক-সবজিসহ বিভিন্ন ফসলের মারাত্মক ক্ষতি হচ্ছে।

পরিবেশ আন্দোলন গাইবান্ধা জেলার আহ্বায়ক ওয়াজিউর রহমান রাফেল বলেন, শিক্ষা প্রতিষ্ঠানসহ জনবসতি এলাকায় ইট ভাটার কালো ধোঁয়া ও ইট পোড়ানোর গন্ধে শিশু শিক্ষার্থীসহ সাধারণ মানুষ অতিষ্ঠ। এগুলো উচ্ছেদে পরিবেশ অধিদপ্তর ও প্রশাসনের উল্লেখযোগ্য উদ্যোগ লক্ষ্য করা যাচ্ছে না। অবৈধ ভাটা উচ্ছেদে বাঁধা কোথায়, তা বোধগম্য নয়।

গাইবান্ধার জেলা প্রশাসক মো. অলিউর রহমান বলেন, অবৈধ ইটভাটা উচ্ছেদ অভিযান শুরু করা হয়েছে। ইতোমধ্যে ৫০টি বন্ধ করে দেয়া হয়েছে। কিছু ভাটা ভেঙে বা গুঁড়িয়ে দেয়া হয়েছে। এ ছাড়া ৬৪ লাখ টাকা জরিমানা ও দুইটি নিয়মিত মামলা করা হয়েছে। পর্যায়ক্রমে সকল অবৈধ ইটভাটা উচ্ছেদ করা হবে।

গাইবান্ধা জেলা প্রশাসক কার্যালয় সূত্রে জানা গেছে, গাইবান্ধায় প্রায় ১৭২টি ইটভাটা রয়েছে। এরমধ্যে এবছর ৩৫টি ইটভাটা চালু করা হয়নি। বর্তমানে চলমান ১৩৭টি ভাটার মধ্যে মাত্র ১৬টির পরিবেশ অধিদপ্তরের ছাড়পত্র অছে। এ ছাড়া গোটা জেলায় লাইসেন্স বিহীন ও পরিবেশ অধিদপ্তরের ছাড়পত্র ছাড়াই ১২১টি অবৈধভাবে ভাটা চলছে। তাও আবার বিভিন্ন শিক্ষা প্রতিষ্ঠান ও জনবসতিপূর্ণ এলাকায়।

সুন্দরগঞ্জ উপজেলার গাইবান্ধা-ধর্মপুর-সুন্দরগঞ্জ সড়কের পশ্চিম পাশে এমআরবি ইটভাটা। সড়কের পূর্বপাশে ধর্মপুর ১নং সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়। সরেজমিনে দেখা গেছে, ভাটার একদিকে বিদ্যালয়, তিনদিকে আবাদি জমি ও বসতবাড়ি। ভাটায় ইট তৈরি ও পোড়ানো চলছে। চিমনিতে প্রচুর ধোঁয়া উড়ছে। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক বিদ্যালয়ের এক শিক্ষক বলেন, ভাটার কালো ধোঁয়া, বালুর কারণে আমরা নিজেরা সর্দি-কাশিসহ নানা রোগে আক্রান্ত হচ্ছি। পাশাপাশি শিশুদের বেশি ক্ষতি হচ্ছে। লেখাপড়ার পরিবেশ ব্যাহত হচ্ছে।

ভাটা সংলগ্ন ধর্মপুর গ্রামের জমিরুল ইসলাম বলেন, ভাটার কারণে আমরা বাড়ির গাছের ফল ধরছে না। ঘরের ভিতরে বিছানা আসবাবপত্র নষ্ট হচ্ছে। একই কথা বলেন মেহেরুল ইসলাম। তাদের দাবি ইটভাটায় আবাদি জমির উপরের মাটি ব্যবহার করে ইট তৈরি করায় জমির উর্বরতাও কমে যাচ্ছে। ফলে ওইসব জমিতে ভালো ফসল উৎপাদন হচ্ছে না।

নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক ধর্মপুর ইউনিয়নের একজন কলেজ শিক্ষক অভিযোগ করেন, স্থানীয় ভাটা মালিকরা জনগণের কথা শোনে না। তারা পরিবেশ অধিদপ্তর ও প্রশাসনকে ম্যানেজ করে ভাটা চালাচ্ছেন। তাই প্রশাসনকে অভিযোগ দিয়েও কোনো লাভ হয় না।

ভাটা মালিক মাহবুবর রহমান বলেন, পরিবেশ অধিদপ্তর ছাড়পত্র দেয়না। তবে প্রতিবছর সরকারকে ভ্যাট-ট্যাক্স দিয়ে ভাটা চালাচ্ছি।

গাইবান্ধা-বামনডাঙ্গা-রংপুর আঞ্চলিক মহাসড়ক সংলগ্ন কিশামত সর্বানন্দ সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়। বিদ্যালয়টি সুন্দরগঞ্জ উপজেলার সর্বানন্দ ইউনিয়নের অন্তর্গত। বিদ্যালয় ঘেঁষে কেএনএম নামে একটি ভাটা রয়েছে। ভাটায় ইট পোড়ানো চলছে। ভাটা থেকে কালো ধোঁয়া বের হচ্ছে। শ্রমিকদের কেউ ইট তৈরি করছেন, কেউ কাঁচা ইট পোড়ানোর স্থানে নিয়ে যাচ্ছেন। বিদ্যালয় মাঠ ঘেঁষে কাঁচা ইট রাখা হয়েছে। পাশে বিদ্যালয়ে শিক্ষার্থীদের পাঠদান চলছে।

শিশু-শিক্ষার্থীরা জানায়, ধুলাবালি উড়ে আসায় আমাদের শ্বাসকষ্ট হয়। ক্লাসেও থাকতে পারছি না। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক বিদ্যালয়ের এক শিক্ষক বলেন, পাঠদান চলাকালীন ট্রাক্টর চলাচলের সময় ধুলা-বালুর কারণে শ্রেণিকক্ষের বারান্দা, চেয়ার বেঞ্চ বালুতে ঢেকে যাচ্ছে। এমনকি ইট ও মাটি পরিবহনের কারণে বিদ্যালয়ে ঢোকার কাঁচা রাস্তা নষ্ট হয়েছে। প্রতিবাদ করলেই হুমকি দেয়া হয়। ভয়ে ভাটার লোকজনের সঙ্গে কথা বলতে পারছি না। সর্বানন্দ গ্রামের কৃষক ফজলার রহমান বলেন, ভাটার কারণে জমির ফসল, গাছপালা নষ্ট হচ্ছে। গতবার কালো ধোঁয়ার কারণে এলাকার উঠতি বোরো ফসলের মাঠ পুড়ে গেছে। একই গ্রামের আবু তালেব নামে অপর এক কৃষক একই কথা বলেন।

তবে ভাটা মালিকদের একজন মোকলেছ মিয়া দাবি করেন, আমাদের ইটভাটা বিদ্যালয়টি প্রতিষ্ঠার আগে ২০০৭ সালে স্থাপন করা হয়। ভাটায় অনেক টাকা লগ্নি করা হয়েছে। এখন কিভাবে সরাবো। পরিবেশের ছাড়পত্র না থাকলেও অন্যান্য কাগজপত্র আছে।

কিশামত সর্বানন্দ থেকে আধা কিলোমিটার দূরে একই গ্রামে গড়ে উঠেছে মহিউল ইসলামের এফকেএম ইটভাটা। ভাটা থেকে প্রায় ৩০০ গজ দূরে খাজেমুল ইসলামিয়া দাখিল মাদ্রাসা ও আলহাজ্ব ইমান উদ্দিন জামিউল হাফিজিয়া মাদ্রাসা। ভাটার কারণে পাঠদান ব্যাহত এবং পরিবেশ দূষিত হচ্ছে বলে জানালেন মাদ্রাসা দুটির শিক্ষক-শিক্ষার্থীরা। তবে ভাটার মালিক মহিউল ইসলাম মুঠোফোনে বলেন, পরিবেশ অধিদপ্তরের অনুমতি নেই। তবে অনুমতি নেওয়ার জন্য আবেদন জানিয়েছি।

একইভাবে সাদুল্লাপুর উপজেলার ইদিলপুর ইউনিয়নের সাদুল্লাপুর-ঠুটিয়াপাকুর সড়কের পশ্চিম পাশে এসআরবি ইটভাটা। পূর্বপাশে কুঞ্জমহিপুর দক্ষিণপাড়া সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়।

এসব বিষয়ে রংপুরস্থ পরিবেশ অধিদপ্তরের পরিচালক সৈয়দ ফরহাদ হোসেন মুঠোফোনে বলেন, গত একমাসে গাইবান্ধায় জরিমানাসহ বেশ কিছু অবৈধ ইটভাটা গুঁড়িয়ে দেয়া হয়েছে। এরমধ্যে আমার নেতৃত্বে পাঁচটি এবং জেলা প্রশাসন পাঁচটি ভাটা ভেঙ্গে দেয়। অবৈধ ইটভাটা উচ্ছেদ অভিযান অব্যাহত রয়েছে।

গাইবান্ধা জেলা ভাটা মালিক সমিতির সাধারণ সম্পাদক ফুল মিয়া বলেন, অবৈধ ভাটার কারণে বৈধ ভাটা মালিকরা ব্যবসায়িকভাবে ক্ষতিগ্রস্থ হচ্ছেন। তারা অবৈধভাবে ইট পুড়িয়ে কম দামে বিক্রি করছেন। আমরাও তাদের বৈধভাবে ইট পোড়ানোর পরামর্শ দিচ্ছি। তিনি আক্ষেপ করে বলেন, অবৈধ ভাটা মালিকদের সাধারণ সম্পাদক পরিচয় দিতেও লজ্জা লাগে। এগুলো উচ্ছেদ করা দরকার।

জেলা আইনজীবী সমিতির সাবেক সাধারণ সম্পাদক অ্যাডভোকেট সিরাজুল ইসলাম বাবু বলেন, ইট প্রস্তুত ও ভাটা স্থাপন (নিয়ন্ত্রণ) আইন ২০১৩ এর ৪ ধারা অনুযায়ী ইটভাটা স্থাপনের জন্য জেলা প্রশাসকের কাছ থেকে লাইসেন্স গ্রহণ বাধ্যতামূলক। লাইসেন্সের জন্য পরিবেশ অধিদপ্তরের ছাড়পত্র বাধ্যতামূলক। সেই বিধান লঙ্ঘনের দায়ে দুই বছর কারাদণ্ড বা ২০ লাখ টাকা জরিমানা বা উভয় দণ্ড হতে পারে।

সাবস্ক্রাইব ও অনুসরণ করুন

সম্পাদক : শ্যামল দত্ত

প্রকাশক : সাবের হোসেন চৌধুরী

অনুসরণ করুন

BK Family App