×

মুক্তচিন্তা

সড়ক পরিবহন : অনিয়মই নিয়ম যেখানে

Icon

অনলাইন ডেস্ক

প্রকাশ: ২৫ মার্চ ২০২৩, ১২:১৬ এএম

সড়ক পরিবহন : অনিয়মই নিয়ম যেখানে
সড়ক পরিবহন : অনিয়মই নিয়ম যেখানে

অনিয়ম, বিশৃঙ্খলা, আর অরাজকতা অনেক জায়গাতেই আছে; কিন্তু সড়ক পরিবহনে যতটা আছে অতটা তীব্র আকারে নেই বোধ করি কোথাও। এমন দিন খুঁজে পাওয়া দুষ্কর যেদিন সড়কের কোথাও না কোথাও দুর্ঘটনায় হতাহত কিংবা ক্ষয়ক্ষতির ঘটনা ঘটছে না। পত্রিকার পাতা খুললে হররোজ এসব খবর আমাদের চোখে পড়ে। দু-চারটিকে স্বাভাবিক বলে ধরে নেয়া গেলেও বাকিগুলোকে স্বাভাবিক মনে করার কোনো উপায় নেই। ১৯ মার্চ পদ্মা সেতুর এক্সপ্রেসওয়েতে যে দুর্ঘটনাটি ঘটল তার প্রেক্ষাপট পর্যালোচনা করলেই অনুমান করে নেয়া যায় কেমন অনিয়ম ও বিশৃঙ্খল অবস্থা বিরাজমান সড়ক পরিবহনের গোটা খাতে। রেলওয়েকে টেনে তোলার কিছুটা প্রয়াস আছে, নৌপথ নিয়েও চেষ্টা আছে যৎকিঞ্চিত, কিন্তু সড়ক পরিবহনে শৃঙ্খলা আনার ক্ষেত্রে অগ্রগতি সামান্যও আছে বলে বোধ হয় না। দায়িত্বপ্রাপ্ত সরকারি সংস্থা বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন কর্তৃপক্ষ [বিআরটিএ] দায়িত্ব পালনে নিস্পৃহ, মালিকশ্রেণি বেপরোয়া, শ্রমিকরা পরিস্থিতির শিকার; কখনো বা মালিকদের স্বার্থ রক্ষায় বাধ্য। মন্ত্রণালয়ও নিয়ন্ত্রণ আরোপে অসমর্থ। এমন অবস্থা চলতে থাকলে সড়ক মৃত্যু ফাঁদে পরিণত হতে সময় লাগবে না। দুর্ঘটনার দিন ইমাদ পরিবহনের একটি বাস সকাল সাড়ে ৭টার দিকে খুলনা থেকে রওনা হয়ে ঢাকা আসার পথে এক্সপ্রেসওয়ের শিবচরের কুতুবপুর এলাকায় নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে খাদে পড়ে যায়। তাতে বাসের চালক ও তার সহকারীসহ ১৯ জনের মৃত্যু হয়। বাকিরা আহত হয়েছেন। এক্সপ্রেসওয়েরও ক্ষতি হয়েছে। অভিযোগ উঠেছে চালক এ সময় ঘুমিয়ে পড়েছিলেন। দীর্ঘ সময় বাস চালাতে গিয়ে চালকরা ক্লান্ত হয়ে যাতে ঘুমিয়ে না পড়েন সে জন্য সড়ক পরিবহন আইনে তাদের যথাযথ বিশ্রামের কথা বলা আছে। দুর্ঘটনায় পতিত বাসের চালক জাহিদ হাসানের বিশ্রাম করার অবকাশ ছিল না। ৪৮ ঘণ্টার ভেতর ৩০ ঘণ্টা বাস চালিয়ে ক্লান্ত ছিলেন তিনি। গণমাধ্যমের খবর অনুযায়ী ইমাদ পরিবহনের বাসগুলো খুলনা, পিরোজপুর ও সাতক্ষীরা থেকে রাজধানী ঢাকায় যাতায়াত করে। পরিবহন কোম্পানিটির চালকদের বাস চালাতে হয় অনেকটা বিরতিহীনভাবে। চালক জাহিদ হাসানও তা করতে গিয়ে এমন দুর্ঘটনা ঘটান। চালকের পুত্র সাংবাদিকদের জানিয়েছেন, তার বাবা সপ্তাহে মাত্র একদিন বাসায় আসার সুযোগ পান। গাড়ি চালিয়ে তিনি সবসময় ক্লান্ত থাকেন। শুধু ইমাদ পরিবহন নয়, বাংলাদেশের অধিকাংশ পরিবহনের বোধ করি একই দশা। বিশ্রামের কথা আইনে বলা থাকলেও বাস্তবে নেই। ফলে চালকদের মেজাজ থাকে রুক্ষ, যে কোনো সময় যা দুর্ঘটনার কারণ হতে পারে, হচ্ছেও। আলোচ্য দুর্ঘটনা তার প্রমাণ। সরকার এক্সপ্রেসওয়েতে গাড়ি চালানোর নিয়ম করেছে ঘণ্টায় ৮০ কিলোমিটার গতিতে। কিন্তু চালকরা সেই পথে গাড়ি চালান ১০০-১২০ কিলোমিটার গতিতে। মৃত্যুবরণকারী চালকও নিয়ম ভঙ্গ করে অতিরিক্ত গতিতে গাড়ি চালাচ্ছিলেন বলে ভুক্তভোগীরা জানিয়েছেন। ইমাদ পরিবহনের এই বাসটি গেল নভেম্বরে গোপালগঞ্জে দুর্ঘটনা ঘটিয়েছিল। সে ঘটনায় ৩ জন মারা যান। শাস্তিস্বরূপ বিআরটিএর চলাচল স্থগিত করে। তাছাড়া বাসের ফিটনেস সনদেরও মেয়াদ পেরিয়ে গিয়েছিল। এতসব অনিয়মের ভেতর গাড়িটি দিব্যি দূরপাল্লায় যাতায়াত করছিল। খোঁজ করলে এমন অনিয়মের হদিস হয়তো মিলবে ভূরি ভূরি। বড় ধরনের দুর্ঘটনা ঘটানোর কারণে ইমাদ পরিবহনেরটি সামনে এলো, আমরা জানতে পারছি। বোঝা যায় আইনের খড়গ আসলে খড়গ নয়, মালিকপক্ষ থোড়াই কেয়ার করে যতসব বিধিনিষেধ। অপরাধ করে পার পাওয়ার সুযোগ থাকায় পুনঃপুন ঘটছে অপরাধের ঘটনা। লাইসেন্স ছাড়া গাড়ি চালানো যায়, বিআরটিএ যত গাড়ির নিবন্ধন দেয় লাইসেন্সধারী চালক আছে তার চাইতে কম- এমন পরিস্থিতি কি আছে অন্য কোনো দেশে?

দুই. দীর্ঘ ৬ বছর আলোচনায় থাকার পর ২০২১ সালের ডিসেম্বর মাসে ঢাকায় ‘বাস রুট রেশনাইলেজশন’ বা বাস রুট ফ্র্যাঞ্চাইজি পরিকল্পনার অধীন চালু হয় বাস-পরিষেবা ‘ঢাকা নগর পরিবহন’। কেরানীগঞ্জের ঘাটারচর থেকে কাঁচপুর পর্যন্ত রুটে চলাচল দ্বারা এই কার্যক্রমের সূচনা ঘটে। পরে ২০২২ সালের অক্টোবর মাসে ঘাটারচর থেকে ডেমরা স্টাফ কোয়ার্টার ও ঘাটারচর- কদমতলী রুটে এই পরিষেবা বিস্তৃত হয়েছে। যতদূর জানি, ঢাকায় গণপরিবহন মালিকের সংখ্যা ২ হাজারের অধিক। তাদের বাসগুলোকে পর্যায়ক্রমে ৫-৬টি কোম্পানির অধীন এনে গণপরিবহনের বিশৃঙ্খলা দূর করা এর উদ্দেশ্য। বিশেষজ্ঞরা এই পরিকল্পনার সঙ্গে সহমত পোষণ করে আসছেন। এর বাস্তবায়ন শুরু হলে ভোগান্তির শেষ সীমায় পৌঁছানো মানুষের মনে কিছুটা আশার সঞ্চার হয়। সে আশা ফিকে হয়ে আসছে। বাস রুট রেশনাইলেজেশনের কার্যক্রম শুরু হয়েছে বেশি দিন নয়, মাত্রই বছর পূর্ণ হলো। এরই মধ্যে নানা অনিয়মের চিত্র ফুটে উঠতে শুরু করেছে। ঘাটারচর-কাঁচপুর রুটে চলাচলরত ‘নগর পরিবহন’-এর বাস নিয়ে আমার ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতা সুখকর নয়। স্টপেজগুলোতে টিকেট বিক্রি নিয়ে ঢিলেঢালা ভাব আছে। আশাহতের দিক হলো চালকরা যত্রতত্র বাস থামিয়ে বিনা টিকেটের যাত্রী ওঠানামা করান। টিকেটের অর্থ নিজেরা হাতিয়ে নেন। এই অনিয়ম দিন দিন বৃদ্ধি পাচ্ছে। এখানে নজরদারি মোটেও নেই, প্রতিকারের কোনো লক্ষণ দেখি না। এমন অবস্থা চলতে থাকলে অচিরেই কোম্পানি [নগর পরিবহন] ক্ষতির মুখে পড়বে এবং একটি আশাব্যঞ্জক উদ্যোগ মাঠে মারা যাবে। ভুললে চলবে না, ঢাকার বাস মালিকরা ‘নগর পরিবহন’-এ তাদের বাস অন্তর্ভুক্ত করতে আগ্রহী নন। অচলপ্রায় বাস দিয়েই তারা ব্যবসা চালিয়ে যেতে চান। স্বভাবতই এই গোষ্ঠীটি কলাকৌশল প্রয়োগ করে ফ্র্যাঞ্চাইজির কার্যক্রম পণ্ড করার মতলবে থাকবেন। সিটি করপোরেশন ও বিআরটিএ যৌথভাবে এই বাস রুট রেশনালাইজেশন পরিকল্পনার সঙ্গে যুক্ত, তাদেরই দেখভাল করার কথা ‘নগর পরিবহনের’ বাসগুলো নিয়মমাফিক চলছে কি না। দেখভাল যে ঠিকমতো হচ্ছে না তা আর বলার অপেক্ষা রাখে না। তারা মনে হয় জেগে ঘুমাচ্ছেন। যদি তেমনটিই হয় তাহলে আর নতুন নতুন রুট ফ্র্যাঞ্চাইজির ঘোষণা দিয়ে লাভ কী? ঘোষণা দেয়ায় পিছিয়ে থাকেননি বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন মালিক সমিতির সাধারণ সম্পাদকও। তার ঘোষণা থেকে জানা গেল ঢাকায় ই-টিকেটিং প্রথার সূচনা ঘটছে, পর্যায়ক্রমে তা সারা দেশে কার্যকর হবে। মিরপুর, মোহাম্মদপুরের কয়েকটি রুটে ই-টিকেট চালুও হলো। মিরপুরের খবর জানি না, তবে মোহাম্মদপুরে যা হলো তাকে মস্করা বলাই ভালো। এ রুটের কয়েকটি বাস যেমন মালঞ্চ, মিডওয়ে ইত্যাদির কর্মীরা প্রথম কয়েক দিন টিকেটের মেশিন গলায় ঝুলিয়ে রাখত, কিন্তু টিকেট পারতপক্ষে দিতে চাইত না, নানা অজুহাত দেখাত। যাত্রীরা কয়েক দিন তর্কবিতর্ক করার পর ক্ষান্ত দিলে মেশিনটাও এরপর আর থাকল না। বাসের কর্মচারীদের সঙ্গে যাত্রীদের ভাড়া নিয়ে যে বিবাদ লেগে থাকত ই-টিকেটের সিদ্ধান্ত বাস্তবায়িত হলে তা দূর হওয়ার সম্ভাবনা থাকত, তার আলামতও দেখা যাচ্ছিল। বাস্তবতা হলো সড়ক পরিবহন খাতে আইনকানুন, নিয়মশৃঙ্খলা- কোনো কিছুই টিকছে না। পুরোই নৈরাজ্যের কবলে সমগ্র সেক্টর। ঢাকায় যেমন ঢাকার বাইরের অবস্থাও তদ্রুপ। বিভাগীয় ও জেলা সদর থেকে শুরু করে উপজেলা-পৌরসভা পর্যন্ত একইরকম পরিস্থিতি। বাস-রিকশা-অটো-সিএনজি এমন হরেক যানবাহনে সয়লাব সড়ক সর্বত্র। কোথাও কোনো শৃঙ্খলা নেই। মানুষ যে হেঁটে একটু স্বাচ্ছন্দ্যে চলাচল করবে, নিরাপদে অতিক্রম করবে রাস্তা সে সুযোগও সংকুচিত হয়ে আসছে। ঢাকার যানবাহনের চেহারাসুরত দেখলে কি মনে হয় এটি কোনো উন্নয়নশীল দেশের রাজধানী? অনিয়ম নিয়ম যেখানে সেখানে মানুষ কী করে আশার আলো দেখবে?

মজিবর রহমান : কলাম লেখক। [email protected]

সাবস্ক্রাইব ও অনুসরণ করুন

সম্পাদক : শ্যামল দত্ত

প্রকাশক : সাবের হোসেন চৌধুরী

অনুসরণ করুন

BK Family App