×

জাতীয়

প্রয়োজন ‘গণহত্যা’র স্বীকৃতি আদায়

Icon

কাগজ প্রতিবেদক

প্রকাশ: ২৫ মার্চ ২০২৩, ১২:০০ এএম

প্রয়োজন ‘গণহত্যা’র স্বীকৃতি আদায়

একাত্তরের গণহত্যা। ফাইল ছবি

‘তুমি আসবে ব’লে, হে স্বাধীনতা/ শহরের বুকে জলপাই রঙের ট্যাঙ্ক এলো/ দানবের মত চিৎকার করতে করতে/ ছাত্রাবাস বস্তি উজাড় হলো/ রিকয়েললেস রাইফেল/ আর মেশিনগান খই ফোটালো যত্রতত্র/ ছাই হলো গ্রামের পর গ্রাম/ বিধ্বস্ত পাড়ায় প্রভুর বাস্তুভিটার/ ভগ্নস্তূপে দাঁড়িয়ে একটানা আর্তনাদ করলো একটা কুকুর/ তুমি আসবে ব’লে, হে স্বাধীনতা/ অবুঝ শিশু হামাগুড়ি দিলো পিতামাতার লাশের উপর।’ ‘অপারেশন সার্চ লাইট’ এর নামে পাকিস্তানি জলপাই রংয়ের দানবদের একরাতে অর্ধ লাখ গণহত্যার সেই ভয়াল কালরাত আজ।

বাঙালি জাতির ইতিহাসে এক নৃশংস, ভয়ংকর ও বিভীষিকাময় কালরাত্রি। স্বাধীনতা দিবস, বিজয় দিবস এবং একুশে ফেব্রুয়ারির মতোই ১৯৭১ সালের ২৫ মার্চ পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর ঘটানো হত্যাকাণ্ডের দিনটি জাতীয়ভাবে ‘গণহত্যা দিবস’ হিসেবে স্বীকৃতি পেয়েছে। ২০১৭ সালের ১১ মার্চ জাতীয় সংসদে সর্বসম্মতিক্রমে এ প্রস্তাব পাস হয়। মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রণালয়ের প্রেস বিজ্ঞপ্তিতে জানানো হয়েছে, রাত ১০টা ৩০ থেকে ১০টা ৩১ মিনিট পর্যন্ত সারাদেশে প্রতীকী ‘ব্ল্যাক আউট’ পালন করা হবে। তবে কেপিআই এবং জরুরি স্থাপনাসমূহ এ কর্মসূচির আওতামুক্ত থাকবে।

কী ঘটেছিল সর্বনাশা সেই রাতে : বিকাল ৫টা বেজে ৪৪। ঠিক এক মিনিট পরেই ঢাকার প্রেসিডেন্ট ভবন থেকে জেনারেল ইয়াহিয়া সোজা এয়ারপোর্ট চলে গেলেন। এর আগেই বঙ্গবন্ধু-ইয়াহিয়া সিরিজ বৈঠক ব্যর্থ হয়। শান্তিপূর্ণ সমাধানের পথ এড়িয়ে প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া বাঙালি হত্যার নীলনকশা বাস্তবায়নের নির্দেশ দিয়ে পাকিস্তানি প্রেসিডেন্ট বিমানে করে করাচি পালালেন। রাত নামার সঙ্গে সঙ্গেই ক্যান্টনমেন্ট থেকে জিপ, ট্রাক বোঝাই দিয়ে সৈন্য, ট্যাঙ্কসহ অত্যাধুনিক সমরাস্ত্র নিয়ে সারা শহরে ছড়িয়ে পড়ে।

মধ্যরাতে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রবেশ করে মার্কিন ট্যাঙ্ক। সঙ্গে সেনাবোঝাই লরি। জগন্নাথ হল ও ইকবাল (জহুরুল হক) হলের প্রতিটি রুমে ঢুকে ঘুমন্ত ছাত্রদের গুলি করে হত্যা করে পাক জল্লাদরা। একে একে গুলি করে, বেয়োনেট দিয়ে খুঁচিয়ে হত্যা করে জগন্নাথ হলের ১০৩ জন হিন্দু ছাত্রকে। হলের কর্মচারীদের কোয়ার্টারে ঢুকে তাদের স্ত্রী-বাচ্চাসহ পুরো পরিবারকে একে একে নির্মমভাবে হত্যা করে। পাক জান্তাদের কালো থাবা থেকে রক্ষা পায়নি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকরাও। ড. গোবিন্দ চন্দ্র দেব, ড. জ্যোতির্ময় গুহঠাকুরতা, অধ্যাপক সন্তোষ ভট্টাচার্য. ড. মনিরুজ্জামানসহ বিভিন্ন বিভাগের ৯ জন শিক্ষককে নিষ্ঠুরভাবে হত্যা করা হয়।

সেই রাতে রাজারবাগ পুলিশের সদর দপ্তরে পাকসেনাদের সাঁড়াশি অভিযানের মুখেও বাঙালি পুলিশ সদস্যরা আত্মসমর্পণের বদলে রাইফেল তাক করে প্রতিরোধ গড়ে তুলেছিল। কিন্তু শত্রুর ট্যাঙ্ক আর ভারি মেশিনগানের ক্রমাগত গুলির মুখে মুহূর্তেই গুঁড়িয়ে যায় সমস্ত ব্যারিকেড।

রক্তাক্ত ও বিভীষিকাময় ২৫ মার্চ কালরাত সম্পর্কে মার্কিন সাংবাদিক রবার্ট পেইন লিখেছেন, সে রাতে হাজার হাজার মানুষকে হত্যা করা হয়। ঢাকায় ঘটনার শুরুমাত্র হয়েছিল। পূর্ব পাকিস্তানজুড়ে সৈন্যরা বাড়িয়ে চলল মৃতের সংখ্যা। জ্বালাতে শুরু করল ঘরবাড়ি-দোকানপাট লুট আর ধ্বংস তাদের নেশায় পরিণত হলো যেন। রাস্তায় রাস্তায় পড়ে থাকা মৃতদেহগুলো কাক-শেয়ালের খাবারে পরিণত হলো। সমস্ত বাংলাদেশ হয়ে উঠল শকুনতাড়িত শ্মশান ভূমি।

অস্ট্রেলিয়ার ‘সিডনি মর্নিং হেরাল্ড’ পত্রিকার ভাষ্যমতে, শুধু ২৫ মার্চ রাতেই বাংলাদেশের প্রায় এক লাখ মানুষকে হত্যা করা হয়েছিল, যা গণহত্যার ইতিহাসে এক জঘন্যতম ভয়াবহ ঘটনা। পাইকারি এই গণহত্যার স্বীকৃতি খোদ পাকিস্তান সরকার প্রকাশিত দলিলেও রয়েছে। পূর্ব পাকিস্তানের সংকট সম্পর্কে যে শ্বেতপত্র পাকিস্তানি সরকার মুক্তিযুদ্ধকালে প্রকাশ করেছিল তাতে বলা হয়, ‘১৯৭১ সালের ১ মার্চ থেকে ২৫ মার্চ রাত পর্যন্ত এক লাখেরও বেশি মানুষের জীবননাশ হয়েছিল।’

বঙ্গবন্ধুর স্বাধীনতার ঘোষণা : রাত সোয়া একটার দিকে ট্যাঙ্ক, সাঁজোয়া গাড়ি ও এক লরি সৈন্য বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ধানমন্ডির ৩২ নম্বর বাড়ির দিকে এগিয়ে যায়। তারা গুলি ছুড়তে ছুড়তে বাড়ির ভেতরে প্রবেশ করে। রাত ১টা ২৫ মিনিটের দিকে এ বাড়ির টেলিফোনের লাইন কেটে দেয়া হয়। আর বাঙালির স্বাধীনতার স্বপ্নকে চিরতরে নিভিয়ে দেয়ার জন্য বঙ্গবন্ধুকে গ্রেপ্তার করে নিয়ে যায় পাকি হায়েনার দল। ২৫ মার্চ মধ্যরাতের পর অর্থাৎ ২৬ মার্চ প্রথম প্রহরে গ্রেপ্তার হওয়ার আগেই বঙ্গবন্ধু তৎকালীন ইপিআরের ওয়্যারলেসের মাধ্যমে আনুষ্ঠানিকভাবে স্বাধীনতার ও সশস্ত্র মুক্তিযুদ্ধের ঘোষণা দেন। ইপিআরের ওয়্যারলেসে বঙ্গবন্ধুর স্বাধীনতার ঘোষণা ছড়িয়ে পড়ে সারাদেশে।

প্রয়োজন ৯ মাসের ‘গণহত্যা’র স্বীকৃতি আদায় : গণহত্যার অর্ধশতক পেরিয়ে গেলেও আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি মেলেনি। বিচার হয়নি গণহত্যাকারী পাকিস্তানি হাইকমান্ডের। মুক্তিযুদ্ধের গবেষকদের মতে, বিজয়ের গৌরবে গৌরবান্বিত জাতির কাছে গণহত্যার বিষয়টি উপেক্ষিত থেকেছে বারবার। এ কারণে বহির্বিশ্বে গণহত্যার পৈশাচিক দৃশ্যটি অন্ধকারেই থেকে গেছে।

এদিকে জাতিসংঘ ঘোষিত গণহত্যাবিষয়ক একটি দিবস থাকায় অনিশ্চিত হয়ে পড়েছে এই স্বীকৃতি পাওয়া। গবেষকদের দাবি, শুধু ২৫ মার্চের গণহত্যার স্বীকৃতিই নয়; প্রয়োজন একাত্তরের ৯ মাসের নৃশংস গণহত্যার স্বীকৃতি। এক্ষেত্রে সরকার উদ্যোগী হলে আন্তর্জাতিকভাবে এই স্বীকৃতি আদায় সম্ভব। তবে সরকারের ধীরে চলো নীতির সমালোচনা করেছেন তারা। অবশ্য সরকারপক্ষ বলছে, দেরি হলেও গণহত্যার স্বীকৃতি আদায় সম্ভব। এজন্য আন্তর্জাতিক অঙ্গনে কাজ শুরু করেছে বাংলাদেশ। ইতোমধ্যে বেশ কিছু রাষ্ট্রের স্বীকৃতি পাওয়া গেছে। বাকি রাষ্ট্রের স্বীকৃতি আদায়ে কাজ চলছে।

যেভাবে সম্ভব স্বীকৃতি আদায় : জাতিসংঘের কনভেনশন অন দ্য প্রিভেনশন এন্ড পানিশমেন্ট অব দ্য ক্রাইম অব জেনোসাইডে গণহত্যার পাঁচটি বৈশিষ্ট্য হচ্ছে- কোনো গোষ্ঠীর মানুষকে হত্যা, তাদের শারীরিক ও মানসিকভাবে চরম ক্ষতিসাধন, জীবনমানের প্রতি আঘাত ও শারীরিক ক্ষতিসাধন, জন্মদান বাধাগ্রস্ত করা এবং শিশুদের অন্য গোষ্ঠীর হাতে তুলে দেয়া। এই পাঁচটি বৈশিষ্ট্যের একটি থাকলেই গণহত্যা হিসেবে চিহ্নিত হবে।

এই পাঁচটি বৈশিষ্ট্যের মধ্যে প্রথম চারটি বৈশিষ্ট্যই ২৫ মার্চের হত্যাযজ্ঞে রয়েছে। তাই এর আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি না পাওয়ার কোনো কারণ নেই। তবে জাতিসংঘ ঘোষিত গণহত্যাবিষয়ক দিবস থাকায় শুধু ২৫ মার্চের স্বীকৃতি পাওয়া প্রায় অসম্ভব। এক্ষেত্রে বাংলাদেশের ওপর পাকিস্তানি বাহিনীর পুরো ৯ মাসের অত্যাচারের স্বীকৃতি আনা সম্ভব। এজন্য প্রয়োজন বন্ধু রাষ্ট্রগুলোর স্বীকৃতি। মুক্তিযুদ্ধ বিষয়কমন্ত্রী আ ক ম মোজাম্মেল হক ভোরের কাগজকে বলেন, স্বীকৃতি আদায়ে সরকারের প্রচেষ্টা চলছে। গণহত্যা দিবসের স্বীকৃতি না হলেও গণহত্যার স্বীকৃতি আদায় করা সম্ভব। এজন্য প্রয়োজন জনমত। আমরা জনমত গঠনে কাজ করছি।

সাবস্ক্রাইব ও অনুসরণ করুন

সম্পাদক : শ্যামল দত্ত

প্রকাশক : সাবের হোসেন চৌধুরী

অনুসরণ করুন

BK Family App