×

আন্তর্জাতিক

ইউক্রেন যুদ্ধবিরোধী ছবি আঁকায় বিচ্ছিন্ন হলো মেয়ে, রুশ বাবা গৃহবন্দি

Icon

কাগজ প্রতিবেদক

প্রকাশ: ২৫ মার্চ ২০২৩, ১০:৪১ এএম

ইউক্রেন যুদ্ধবিরোধী ছবি আঁকায় বিচ্ছিন্ন হলো মেয়ে, রুশ বাবা গৃহবন্দি

ছবি: সংগৃহীত

রাশিয়ার এক শহর ইয়েফ্রেমভের কেন্দ্রস্থলে যুদ্ধের ছবি দিয়ে ঢাকা একটি দেয়াল। অস্ত্রসহ মুখোশধারী একদল রুশ সৈন্যর বিশালাকার সব ছবি রয়েছে তাতে এবং লেখা রয়েছে ‘জেড’ আর ‘ভি’ দুটি অক্ষর – ইউক্রেনে রাশিয়ার তথাকথিত "বিশেষ সামরিক অভিযান"-এর প্রতীক এই দুটি অক্ষর। কিন্তু মস্কো থেকে ২০০ মাইল (৩২০ কি.মি.) দক্ষিণে এই শহরে আপনি ইউক্রেন যুদ্ধের আরেকটি চিত্র খুঁজে পাবেন। আর সেটি একেবারেই ভিন্ন।

শহরের কাউন্সিলর ওলগা পোডলস্কায়া তার মোবাইল ফোনে আমাকে একটি ছবি দেখালেন। এটি একটি শিশুর আঁকা ছবি। বাম দিকে একটি ইউক্রেনীয় পতাকা যেখানে লেখা রয়েছে "ইউক্রেনের গৌরব"; ছবির ডানদিকে রয়েছে রুশ তেরঙ্গা জাতীয় পতাকা। তাতে লেখা "যুদ্ধকে না বলছি!"। রাশিয়ার দিক থেকে ক্ষেপণাস্ত্র উড়ে যাওয়ার পথে অকুতোভয়ে দাঁড়িয়ে রয়েছেন একজন মা এবং তার সন্তান। খবর বিবিসির।

ছবিটি ২০২২ সালের এপ্রিল মাসে এঁকেছিল মাশা মসকালেভা। তার বয়স তখন ১২ বছর। তার বাবা অ্যালেক্সি মাশার একমাত্র অভিভাবক। তিনি পরামর্শের জন্য শহরের কাউন্সিলরের সাথে যোগাযোগ করেছিলেন। তিনি কাউন্সিলরকে জানিয়েছেন যে মাশার আঁকা ছবি দেখে স্কুল কর্তৃপক্ষ পুলিশে খবর দিয়েছিল। "পুলিশ অ্যালেক্সির সোশ্যাল মিডিয়া অ্যাকাউন্ট নিয়ে তদন্ত শুরু করে," ওলগা আমাকে বলছিলেন, "এবং তারা অ্যালেক্সিকে জানায় যে তিনি খুব খারাপ-ভাবে তার মেয়েকে বড় করছেন।“

এরপর অ্যালেক্সির বিরুদ্ধেই অভিযোগ গঠন করা হয়। সোশ্যাল মিডিয়ায় যুদ্ধবিরোধী পোস্ট দেয়ার জন্য এবং রুশ সশস্ত্র বাহিনীর অবমাননার জন্য অ্যালেক্সিকে ৩২,০০০ রুবল (প্রায় ৪১৫ মার্কিন ডলার) জরিমানা করা হয়। কয়েক সপ্তাহ আগে তার বিরুদ্ধে ফৌজদারি মামলা দায়ের করা হয়। আবারও অবমাননার অভিযোগের ভিত্তি ছিল তার যুদ্ধবিরোধী পোস্ট। এজন্য অ্যালেক্সিকে সম্ভাব্য কারাদণ্ডের মুখোমুখি হতে হচ্ছে।

অ্যালেক্সি এখন ইয়েফ্রেমভ-এ গৃহবন্দি রয়েছেন। তার মেয়ে মাশাকে আপাতত একটি শিশু-কেন্দ্রে পাঠানো হয়েছে। তার সাথে অ্যালেক্সিকে এমনকি টেলিফোনেও কথা বলতে দেয়া হয়নি। "পয়লা মার্চ থেকে মাশাকে কেউ দেখেনি,” ওলগা পোডলস্কায়া আমাকে বলছিলেন, "সে কেমন আছে তা জানার জন্য চেষ্টা করেও আমরা শিশু-কেন্দ্রটিতে ঢুকতে পারিনি।

"রুশ কর্তৃপক্ষ চায় তারা যেটা বলবে সবাইকে মেনে নিতে হবে। কারও নিজস্ব কোন মতামত থাকতে পারবে না। আপনি যদি মনে করেন কারও সাথে একমত হবেন না, তাহলে উচিত হবে তাদের সোশ্যাল মিডিয়া পোস্ট না পড়া। কিন্তু তার জন্য সেই ব্যক্তিকে গৃহবন্দি করা বা তার সন্তানকে শিশু-কেন্দ্রে পাঠানো একেবারেই অনুচিত।"

আমরা ইয়েফ্রেমভের একটি অ্যাপার্টমেন্ট ব্লকের বাইরে দাঁড়িয়ে আছি। ওপরে জানালাটি একসময় খুলে যায় এবং একজন লোক জানালা দিয়ে বাইরে তাকান। ইনিই হলেন অ্যালেক্সি। তার সাথে আমাদের কোনরকম যোগাযোগ করার অনুমতি নেই। গৃহবন্দিত্বের শর্ত অনুযায়ী, অ্যালেক্সি শুধুমাত্র তার আইনজীবী, তদন্তকারী কর্মকর্তা এবং কারা বিভাগের সাথে যোগাযোগ করতে পারবেন। আইনজীবী ভ্লাদিমির বিলিয়ানকো সবেমাত্র এসে হাজির হয়েছেন। সাথে এনেছেন কিছু খাবার এবং পানীয়, যা স্থানীয় অধিকার কর্মীরা অ্যালেক্সির জন্য কিনে দিয়েছেন।

"মেয়ে তার সাথে নেই, এটা তাকে বেশ দুশ্চিন্তায় ফেলেছে," অ্যালেক্সি মসকালেভার সাথে দেখা করার পর ভ্লাদিমির আমাকে বলছিলেন। "ফ্ল্যাটের সবকিছুই তাকে তার মেয়ের কথাই মনে করিয়ে দিচ্ছে। তার সাথে কী ঘটতে পারে তা নিয়ে সে চিন্তিত।" আমি আইনজীবীকে জিজ্ঞাসা করি, কর্তৃপক্ষ মাশাকে কেন তুলে নিয়ে গেছে বলে তিনি মনে করেন। "বাবার প্রতি তাদের যদি সত্যিকারের প্রশ্ন থাকতো, তাহলে তাদের উচিত ছিল তার কাছ থেকে বিবৃতি নেয়া। মাশার কাছ থেকেও বিবৃতি নেয়া বা তার সাথে কথা বলা উচিত ছিল," জানালেন ভ্লাদিমির।

"কিন্তু এর কিছুই করা হয়নি। তারা শুধু তাকে [শিশু-কেন্দ্রে] পাঠানোর সিদ্ধান্ত নিয়েছে। আমার মতে, অ্যালেক্সির বিরুদ্ধে যে ধরনের প্রশাসনিক ও ফৌজদারি অভিযোগ আনা হয়েছে, তা না হলে এমনটা ঘটত না। সমাজসেবা বিভাগ এই পরিবারটিকে নিয়ে মোহগ্রস্ত বলেই আমার মনে হয়। আমি মনে করি এসব ঘটছে সম্পূর্ণভাবে রাজনৈতিক কারণে। মেয়েটির ঐ ছবি আঁকার পর থেকেই পরিবারটির ঝামেলা শুরু হয়।"

রাস্তায় বেরিয়ে আমি অ্যালেক্সির প্রতিবেশীদের জিজ্ঞাসা করি, এই পরিস্থিতি সম্পর্কে তারা কী ভাবছেন। "সে একটি ভালো মেয়ে, এবং তার বাবার সাথে আমার কোনদিন কোনও সমস্যা হয়নি," বলছিলেন পেনশনভোগী অ্যাঞ্জেলিনা ইভানোভনা। "কিন্তু এনিয়ে কথা বলতে আমি ভয় পাচ্ছি। ভয়ের মধ্যে আছি। "সম্ভবত আমরা [অ্যালেক্সির] সমর্থনে স্বাক্ষর সংগ্রহ করতে পারি," একজন অল্পবয়সী মহিলা পরামর্শ দিলেন। কিন্তু কী ঘটছে তা নিয়ে যখন তার মতামত জানতে চাওয়া হয়, তখন তিনি উত্তর দেন: "দু:খিত, সেটা আমি আপনাকে বলতে পারবো না।"

আমি জিজ্ঞাসা করি, মুখ খোলার সম্ভাব্য পরিণতি সম্পর্কে তিনি কি ভীত?

তার জবাব:"হ্যাঁ, অবশ্যই।"

অ্যালেক্সি মসকালেভের অ্যাপার্টমেন্ট ব্লক থেকে স্থানীয় স্কুলটি সামান্য হাঁটাপথের মধ্যে। এখানেই মাশা পড়াশোনা করছিল। তার বাবা বলছেন, মাশার যুদ্ধবিরোধী ছবি দেখে স্কুল কর্তৃপক্ষই পুলিশকে ফোন করেছিল। এনিয়ে মন্তব্যের জন্য আমাদের লিখিত অনুরোধে স্কুল কর্তৃপক্ষ এখনও সাড়া দেয়নি। আমরা যখন স্কুলে ঢোকার চেষ্টা করি তখন আমাদের বলা হয় যে আমাদের ঢোকার অনুমতি নেই। আমারা টেলিফোন করলেও কোন উত্তর পাওয়া যায়নি।

তবে আমি স্কুলের ওয়েবসাইটটি ঘেঁটে দেখেছি। শহরের কেন্দ্রস্থলে দেশপ্রেমের প্রতীক যে দেয়ালটি দেখেছিলাম এই ওয়েবসাইট তার কথাই মনে করিয়ে দেয়। স্কুলের হোমপেজে “হিরোস অফ দ্য স্পেশাল মিলিটারি অপারেশন” - ইউক্রেনে যুদ্ধ করা রুশ সৈন্যদের দুই ডজন ছবি রয়েছে। কিছু দেশাত্মবোধক স্লোগানও রয়েছে: "বিজয়ের লক্ষ্যে সবকিছু বিসর্জন দিতে হবে! আসুন যুদ্ধের ময়দানে আমরা আমাদের সৈন্যদের সমর্থন করি!"

ইউক্রেন থেকে ফিরে আসা কিছু সৈন্য গত অক্টোবর মাসে এই স্কুলটি পরিদর্শন করেছিল। সেদিনের একটি বক্তৃতায় স্কুলের পরিচালক লারিসা ট্রোফিমোভা ঘোষণা করেছিলেন: "আমাদের বিশ্বাস রয়েছে আমাদের নিজেদের এবং আমাদের মাতৃভূমির ওপর, যারা কখনই কোন ভুল করতে পারে না।" শহরের অন্য প্রান্তে মসকালেভ পরিবারের সমর্থক এবং সাংবাদিকরা স্থানীয় আদালতে জড়ো হচ্ছেন। অভিভাবক হিসেবে অ্যালেক্সির পিতামাতার অধিকার সীমিত করার জন্য ইয়েফ্রেমভ জুভেনাইল অ্যাফেয়ার্স কমিশন আনুষ্ঠানিকভাবে আইনি পদক্ষেপ নিতে যাচ্ছে।

বিচারকের সাথে এটি একটি প্রাথমিক শুনানি। আইনজীবী ভ্লাদিমির বিলিয়েনকো জানালেন, অ্যালেক্সি ব্যক্তিগতভাবে এই শুনানিতে উপস্থিত থাকতে চেয়েছিলেন। কিন্তু গৃহবন্দি থাকার কারণে তাকে আদালতে আসার অনুমতি দেয়া হয়নি, যদিও এখানে শুনানির মূল বিষয় হচ্ছে বাবা হিসেবে তার সন্তানের সাথে দেখা করার অধিকার। আদালতের করিডোরে একজন মানবাধিকার কর্মী একটি পোস্টার মেলে ধরলেন। এতে লেখা রয়েছে: "মাশাকে তার বাবার কাছে ফিরিয়ে দাও!" একজন পুলিশ কর্মকর্তা তাকে পোস্টারটি সরিয়ে নিতে বললেন।

অ্যালেক্সি মসকালেভ এবং তার মেয়ে মাশার বিষয়ে মন্তব্য করার জন্য আমাদের অনুরোধে জুভেনাইল অ্যাফেয়ার্স কমিশন এখনও কোন সাড়া দেয়নি। অ্যালেক্সির একজন সমর্থক নাতালিয়া ফিলাটোভা বিশ্বাস করেন, মসকালেভ পরিবারের এই ঘটনা রাশিয়া-জুড়ে ভিন্নমতের ওপর সরকারি ক্র্যাকডাউনের প্রতিফলন মাত্র। "আমাদের সংবিধান বাক-স্বাধীনতা, বিবেকের স্বাধীনতা, নাগরিকদের মতামত প্রকাশের সম্পূর্ণ স্বাধীনতার গ্যারান্টি দেয়," নাতালিয়া আমাকে বলছিলেন, "কিন্তু এসব কাজ করা থেকে এখন আমাদের নিষিদ্ধ করা হয়েছে।"

সাবস্ক্রাইব ও অনুসরণ করুন

সম্পাদক : শ্যামল দত্ত

প্রকাশক : সাবের হোসেন চৌধুরী

অনুসরণ করুন

BK Family App