×

মুক্তচিন্তা

রাবিতে শিক্ষার্থী-ব্যবসায়ী সংঘর্ষ প্রসঙ্গে

Icon

অনলাইন ডেস্ক

প্রকাশ: ২২ মার্চ ২০২৩, ১২:২৬ এএম

রাবিতে শিক্ষার্থী-ব্যবসায়ী সংঘর্ষ প্রসঙ্গে

গত ১১ মার্চ রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের সঙ্গে বিনোদপুর বাজারের ব্যবসায়ীদের ব্যাপক সংঘর্ষ হয়। সংঘর্ষে বিনোদপুর ও ক্যাম্পাসসহ তৎসংলগ্ন এলাকা পরিণত হয় যুদ্ধক্ষেত্রে। এ ধরনের সৃষ্ট পরিস্থিতি অনাকাক্সিক্ষত এবং অনভিপ্রেত। তুচ্ছ একটি ঘটনাকে কেন্দ্র করে সৃষ্টি হয় এ ধরনের অরাজক পরিস্থিতির। বিভিন্ন গণমাধ্যম সূত্রে জানা যায়, বগুড়া থেকে একজন ছাত্র বাসে করে ক্যাম্পাসে ফিরছিল, বাসে কন্ডাক্টরের সঙ্গে ছাত্রটি ভাড়া নিয়ে হয় কথা কাটাকাটি। ছাত্রটি বিনোদপুর এসে নেমে কন্ডাক্টরকে মারধর করলে এই বাস পরিবহনের কাউন্টার মাস্টার পরিস্থিতি শান্ত করার জন্য হস্তক্ষেপ করে। এই হস্তক্ষেপটি হয়ে যায় আগুনে ঘি ঢালা। শুরু হয় ছাত্র-ব্যবসায়ীদের মধ্যে ধাওয়া-পাল্টাধাওয়া। কিছুক্ষণের মধ্যেই এলাকাটি রণক্ষেত্রে পরিণত হয়ে ওঠে। শুরু হয় দোকানপাটে অগ্নিসংযোগসহ নানা ধরনের অরাজক কর্মকাণ্ড। এ ধরনের পরিস্থিতি ইতোপূর্বে ঘটেনি। তাই প্রশ্ন জাগে কেন ব্যবসায়ী ও শিক্ষার্থীরা এতটা অসহিষ্ণু হয়ে উঠেছিল। শুধু তদন্ত নয়, তার এই দুটি ভিন্ন ধারার দুই গোষ্ঠীর সংঘর্ষের মূল কারণ অনুসন্ধান করা প্রয়োজন। ব্যবসায়ীদের বিচারের দাবিতে ক্যাম্পাস হয়ে উঠে উত্তাল। শিক্ষার্থীরা বিশ্ববিদ্যালয় রেলস্টেশনের রেলপথে আগুন জ্বালিয়ে রেল চলাচলও বন্ধ করেছিল। ভাবতে অবাক লাগে এটা কোনো ইস্যু নয়, দেশের স্বনামধন্য একটি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা এ সামান্য একটি বিষয় নিয়ে এত বড় তুলকালাম কাণ্ড ঘটিয়ে ফেলল। রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের ভেতরকার বহু সমস্যা আছে যেগুলোকে শিক্ষার্থীরা ইস্যু করে আন্দোলন করতে পারছে না, অথচ একজন শিক্ষার্থীর সামান্য বাস ভাড়া নিয়ে আন্দোলন করে সারাদেশকে করে ফেলেছিল চিন্তিত। করোনাকালে ভিসি বিশ্ববিদ্যালয়ের অনেক গাছ নির্বিচারে কেটে ফেলেছিলেন তা নিয়ে কোনো শিক্ষার্থী কোনো কথা বলেনি। অথচ সামান্য বাস ভাড়ার বিষয়টি জাতীয় ইস্যুতে পরিণত করার একটি প্রচেষ্টা চলে। এতে প্রমাণ হয় যে, দেশের শিক্ষা ব্যবস্থার চলমান পদ্ধতিই শিক্ষার্থীদের একটি সংকীর্ণ সীমাবদ্ধ আবরণে ঢেকে ফেলেছে। রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় স্থাপন হয়েছে ১৯৫৩ সালে। বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের সঙ্গে এলাকার মানুষের সম্পর্কটা খুবই নিবিড়। রাজশাহী বাংলাদেশের অন্যতম শিক্ষানগরী। এখানে রয়েছে অসংখ্য শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান। তাই এখানের কিছু ব্যবসা-বাণিজ্য গড়ে উঠেছে শিক্ষার্থীদের কেন্দ্র করে। এখানকার আর্থসামাজিক প্রেক্ষাপটের বিবেচনায় শিক্ষার্থী ও ব্যবসায়ীদের সম্পর্কটা সাপে নেউলে হওয়ার কথা না। বিনোদপুরে এমন হওয়ার পেছনে অনেক কারণ। বিশ্ববিদ্যালয়ের আশপাশের ছোট ছোট দোকানদার শিক্ষার্থীদের দেখলে ভয় পায়। কারণ ক্যাম্পাস এবং তৎসংলগ্ন এলাকায় ছোট ছোট ব্যবসায়ীর কাছ থেকে কিছু শিক্ষার্থী জোরপূর্বক বাকি নিয়ে যায়, টাকা চাইতে গেলে বাকি পরিশোধ তো দূরের কথা উল্টো গালমন্দ করে। শোনা গেছে, একজন ক্ষুদ্র ব্যবসায়ী ক্যাম্পাসে একটি খাবার দোকান দিয়েছিলেন, বাকির অঙ্ক এমন পর্যায়ে এসে দাঁড়ায় যে তিনি বাধ্য হয়ে দোকান বন্ধ করে দেন। কিছুদিন আগে বিশ্ববিদ্যালয়ের মেইন গেটের কাছে রাস্তার দক্ষিণ পাশে একটি দোকানে চা খাওয়ার জন্য বসি, দোকানিকে চায়ের অর্ডার দেই, দোকানি চা বানানোর প্রস্তুতি নেয়। এমন সময় তিন তরুণ এসে দোকানিকে বলে, মামা চা দেন। দোকানি বিনয়ের সঙ্গে বলে মামা পাতি নেই। আমি একটু বিস্মিত হয়ে যাই। কারণটা হলো আমাকে চা দেবে বলে বসিয়ে রাখল আর এই তিন তরুণকে বলছে পাতি নেই। কিন্তু আমি কোনো কথা বলি না বিষয়টি শুধু দেখতে থাকি। তারপর তরুণরা দোকানিকে চাপ দিলে দোকানি বলে মামা পাতি আনতে গেছে দেরি হবে অনেক। একটু রাগ করেই দোকানির কথা শুনে তরুণরা চলে যায়, তারা যেতে যেতে বলে কিসের দোকান দিয়েছ যে পাতি থাকে না। ওরা চলে যাওয়ার পর দোকানি আমাকে চা দেয়। ওদের কেন দিল না জানতে চাইলে দোকানি বলে, ‘দেখুন আমাদের কয় টাকার ব্যবসা, প্রতিদিন এরা এসে ২০-২৫ কাপ চা বাকিতে খেয়ে যায়, এদের কাছে অনেক টাকা বাকি, টাকা তো দেয়ই না চাইতে গেলে গালমন্দ করে। আরো জানায়, এদের গালমন্দের ভাষা শুনলে ভূতও পালাবে। আজকালের লেখাপড়া কোনো লেখাপড়া হলো।’ দোকানির কথাটা শুনে একটু অবাক হলাম। দেশের সর্বোচ্চ বিদ্যাপীঠে শিক্ষা অনুশীলনকারীদের সম্পর্কে একজন সাধারণ মানুষের এমন নেতিবাচক মন্তব্য। রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে বর্তমানে যে ছাত্ররাজনীতি অনুশীলন করা হয় তাকে ছাত্ররাজনীতির সংজ্ঞার ফ্রেমে আবদ্ধ করা যায় না। স্নাতক প্রথম বর্ষে ভর্তি হওয়া দুজন শিক্ষার্থীর কথোপকথন শুনেছিলাম, তারা পরস্পরের বন্ধু। তা ছিল এমন, দুজনই সিদ্ধান্ত নিয়েছে তারা একটি ছাত্র সংগঠনে যোগ দেবে, তাই একজন আরেকজনকে বলছে প্রথম এক বছর শুধু অবজারভেশন করব, তারপরের বছর কিছু মারামারি-দাঙ্গা করতে হবে তৃতীয় বর্ষে উঠলে কোনো একটি পদ নিয়ে নেব, চতুর্থ বছর ভালোভাবে রাজনীতি করব তারপর বেরুলেই তো চাকরি। শিক্ষার্থীরা কি দেশের সর্বোচ্চ বিদ্যাপীঠে জ্ঞানার্জনের জন্য আসে? না সার্টিফিকেটধারী হতে আসে, এটা দেখার বিষয়। যে কোনো প্রকারে নেতা হওয়া এবং নেতা হওয়ার বদৌলতে কিছু পাওয়াটা হলো ’৯০-এর পরবর্তী ছাত্ররাজনীতি। বাংলাদেশের ভাষা আন্দোলন থেকে শুরু করে মহান মুক্তিযুদ্ধ এবং স্বৈরাচার এরশাদবিরোধী আন্দোলন- প্রতিটি আন্দোলনের সূত্রপাত করে এদেশের ছাত্রসমাজ। অথচ আজকে দিনে দেশের পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা দেশ-জাতি নিয়ে কিছু ভাবে না। তারা ব্যস্ত নিজেদের ক্যারিয়ার নিয়ে। বর্তমান শিক্ষাব্যবস্থা বা বর্তমান শিক্ষা পদ্ধতির ভালোমন্দ কোনো দিকই শিক্ষার্থীদের আলোড়িত করে না। মৌলবাদী রাজনীতি প্রতিরোধের সূতিকাগার ছিল পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর ক্যাম্পাস অথচ এই রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্যাম্পাসই হয়ে উঠেছিল মৌলবাদের চারণভূমিতে। স্বাধীনতাবিরোধী আদর্শের ছাত্র সংগঠন করলেই চাকরি পাওয়া গছে। ’৯১-৯৬ এবং ২০০১-২০০৮ সাল পর্যন্ত রাজশাহী বিশ্বদ্যিালয়ে শিক্ষক, কর্মকর্তা ও কর্মচারী নিয়োগ দেয়া হয়েছে মৌলবাদী মতাদর্শের শিক্ষার্থীদের। তাছাড়া অদ্যাবধি পর্যন্ত রাজনীতির সাইনবোর্ড না হলে বিশ্ববিদ্যালয়ের কোনো পদেই চাকরি পাওয়া যায় না। সারা পৃথিবীতে মৌলবাদ এবং প্রগতিশীল রাজনীতি পরস্পর বিবদমান দুটি স্রোতধারা। এই দুই ধারায় বিভক্ত রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্যাম্পাস। তাদের বিবাদে ঘোলা হচ্ছে পানি আর সুযোগসন্ধানী একটি গোষ্ঠী নিজেদের ক্ষমতা টিকিয়ে রাখতে করছে ছাত্রদের ব্যবহার। এটা এখন সব সংগঠনের নামে নেতাদের কাজ। ছাত্ররা নীতি-নৈতিকতাকে তোয়াক্কা না করে মোহাবিষ্ট হয়ে ভবিষ্যতের একটি কাজের আশায় ছাত্র সংগঠনে লিখাচ্ছে নিজেদের নাম। তাই দেখা যায়, যে যখন ক্ষমতায় তখন একমাত্র এই সংগঠনটির রাজনৈতিক কার্যক্রম অনুশীলন হয় ক্যাম্পাসে। তবে এটাকে রাজনীতির অনুশীলন বললে ভুল হবে, এটা হয় অনেকটা তোয়াজ করার মতো কাজ। ক্ষমতাসীন রাজনৈতিক ছাত্র সংগঠনটির আদর্শও চর্চা হয় না। শোনা যায়, দেশের পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের ভিসি হওয়ার জন্য শিক্ষকরা ক্ষমতাসীন ছাত্র সংগঠনের নেতাদের পেছনে ছুটেন। দেশের পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্যাম্পাসে মুক্তরাজনীতি চর্চা নেই। স্থবির হয়ে পড়েছে রাজনীতি অনুশীলন। ক্যাম্পাসগুলোতে অভাব দেখা দিয়েছে নীতি-নৈতিকতা মূল্যবোধের রাজনীতির আদর্শের। দেশের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোর অসুস্থ রাজনীতি চর্চা বন্ধ করতে হবে। রাজনীতির প্ল্যাটফর্ম বিবেচনায় না নিয়ে মেধার ভিত্তিতে করতে হবে শিক্ষক, কর্মকর্তা-কর্মচারী নিয়োগ।

শাহ মো. জিয়াউদ্দিন : কলাম লেখক। [email protected]

সাবস্ক্রাইব ও অনুসরণ করুন

সম্পাদক : শ্যামল দত্ত

প্রকাশক : সাবের হোসেন চৌধুরী

অনুসরণ করুন

BK Family App