×

জাতীয়

বিশুদ্ধ পানি ছাড়াই চলছে স্বাস্থ্যসেবা

Icon

কাগজ প্রতিবেদক

প্রকাশ: ২২ মার্চ ২০২৩, ০৮:২৭ এএম

বিশুদ্ধ পানি ছাড়াই চলছে স্বাস্থ্যসেবা

ছবি: সংগৃহীত

উপকূলীয় হাসপাতালগুলোতে বিশুদ্ধ পানির সংকট

দেশের ২১ শতাংশ হাসপাতালে নেই বিশুদ্ধ পানির ব্যবস্থা

দেশের উপকূলীয় অঞ্চলে নিরাপদ ও সুপেয় পানির সমস্যা পুরনো। দিন দিন তা আরো প্রকট হচ্ছে। বিশেষ করে উপকূলীয় অঞ্চলের হাসপাতালগুলোতে এ সংকট আরো তীব্র। অবকাঠামো থাকলেও সেখানে নিরাপদ ও সুপেয় পানির ব্যবস্থা না থাকায় ভোগান্তি বাড়ছে রোগী ও রোগীর স্বজনদের। সেই সঙ্গে নিরাপদ পানির ব্যবস্থা না থাকায় হাসপাতালে ভর্তি রোগীদের সংক্রমণের ঝুঁকিও বাড়ছে।

সংশ্লিষ্টরা বলছেন, হাসপাতালে শুধু খাওয়ার জন্য নিরাপদ পানি প্রয়োজন- তেমনটা নয়। অস্ত্রোপচার, হাত ধোয়া, রোগীর ব্যবহৃত থালা বাসন, বিছানার চাদর ও পোশাক পরিষ্কারের ক্ষেত্রেও নিরাপদ পানি জরুরি। এসব কাজে ব্যবহৃত পানিতে ব্যাকটেরিয়া বা জীবাণু থাকলে রোগীর সংক্রমণের ঝুঁকি থাকে। অথচ উপকূলীয় অঞ্চলের অনেক হাসপাতালে হাসপাতাল পরিচালনার জন্য ন্যূনতম যে পরিমাণ পানি দরকার, সেটুকু পানির ব্যবস্থাও নেই।

২০২২ সালের শেষের দিকে প্রকাশিত বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা (ডব্লিউএইচও) ও ইউনিসেফের এক প্রতিবেদন অনুযায়ী, দেশের ২১ শতাংশ হাসপাতালে বিশুদ্ধ পানি সরবরাহের যথাযথ ব্যবস্থা নেই। সংস্থা দুটি বলছে, হাসপাতাল ও ক্লিনিকে সংক্রমণ প্রতিরোধ ও নিয়ন্ত্রণ করতে হলে বিশুদ্ধ পানির সরবরাহ বাড়াতে হবে। দেশের সরকারি ও বেসরকারি হাসপাতালগুলোর পানি, স্যানিটেশন, হাত ধোয়ার সুযোগসুবিধা ও বর্জ্য ব্যবস্থাপনার ওপর করা এই প্রতিবেদনে মৌলিক পানি সরবরাহ সেবার কিছু বৈশিষ্ট্য ঠিক করেছে জাতিসংঘের বিশেষায়িত এই দুই সংস্থা।

তারা বলছে, পানির মান হবে উন্নত, পানি থাকবে পর্যাপ্ত এবং প্রয়োজনের সময় পানির জন্য হাসপাতালের বাইরে যেতে হবে না। দেশে ৭৯ শতাংশ হাসপাতালে এ ব্যবস্থা থাকলেও প্রয়োজনের সময় পানি মেলে না ২১ শতাংশ হাসপাতালে। পানি প্রাপ্যতার দিক থেকে সরকারি হাসপাতালের চিত্রটা বেসরকারি হাসপাতালের চেয়ে খারাপ। ৮৮ শতাংশ বেসরকারি হাসপাতালে মৌলিক পানি সরবরাহ সেবার ব্যবস্থা আছে। সরকারি প্রতিষ্ঠানে তা ৭১ শতাংশ। অর্থাৎ ২৯ শতাংশ সরকারি হাসপাতাল পানির সংকটের মধ্যেই মানুষকে স্বাস্থ্যসেবা দিচ্ছে।

বাংলাদেশ কৃষি উন্নয়ন করপোরেশনের (বিএডিসি) তথ্যমতে, দেশের ৪১ জেলার ১৯২ উপজেলায় তীব্র পানিসংকট দেখা দিয়েছে। রাজধানীতে পানির স্তর ভূপৃষ্ঠ থেকে গড়ে ২১২ ফুট নিচে চলে গেছে। যে কারণে উপকূলীয় এলাকায় ভবিষ্যতে পানিতে সমুদ্রের লোনাপানি চলে আসার আশঙ্কা দেখা দিয়েছে। বেসরকারি সংস্থা ওয়াটার এইডের গবেষণা অনুযায়ী, বাংলাদেশের ২ কোটিরও বেশি মানুষ নিরপাদ পানি থেকে বঞ্চিত। এছাড়া সরকারি-বেসরকারি একাধিক সংস্থার গবেষণায় দেখা গেছে দেশের উপকূলীয় অঞ্চলসহ অনেক এলাকাতেই শুরু হয়েছে মরুকরণ প্রক্রিয়া। কারণ পানির স্তর অনেক নিচে নেমে গেছে।

এদিকে উপকূলীয় এলাকার হাসপাতালগুলোতে সুপেয় পানি নিশ্চিতের কাজটি কার- এ নিয়েও রয়েছে অস্পষ্টতা। কেউ বলছেন, স্বাস্থ্য বিভাগের অধীনস্থ প্রতিষ্ঠানের সব দায়িত্ব স্বাস্থ্য বিভাগের। স্বাস্থ্য বিভাগ বলছে, এটি স্থানীয় সরকার বিভাগের কাজ। কেউ বলছেন, স্বাস্থ্য প্রকৌশল অধিদপ্তরের কাজ। আর স্বাস্থ্য প্রকৌশল অধিদপ্তর বলছে, হাসপাতালে নিরাপদ পানি সরবরাহের জন্য তাদের কোনো আলাদা ব্যবস্থা নেই।

উপকূলীয় অঞ্চলের কয়েকটি হাসপাতালের কর্মকর্তাদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, প্রতিটি হাসপাতাল চত্বরে একটি করে পুকুর রয়েছে। সুপেয় পানির সরবরাহ নিশ্চিত করতে ফিল্টারের ব্যবস্থা করা হলেও লবণের মাত্রা বেশি থাকায় কয়েক মাস পরই ফিল্টার নষ্ট হয়ে যায়। গভীর নলকূপ স্থাপন করে মিলছে না সমাধান। বৃষ্টির পানি সংরক্ষিত রেখে তা পরিশুদ্ধ করে (রেইন ওয়াটার হারভেস্টিং) সুপেয় পানির চাহিদা মেটানো হচ্ছে। এছাড়া সরকারি ও বেসরকারি কয়েকটি সংস্থার উদ্যোগে কিছু প্রকল্পের মাধ্যমেও চেষ্টা চলছে সুপেয় পানির চাহিদা মেটানোর।

বাগেরহাট শরণখোলা স্বাস্থ্য ও পরিবার পরিকল্পনা কর্মকর্তা ডা. প্রিয় গোপাল বিশ্বাস জানান, হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ নিজস্ব ব্যবস্থাপনায় রোগীদের সুপেয় পানির ব্যবস্থা করছে। তিনি ভোরের কাগজকে বলেন, হাসপাতাল চত্বরে থাকা পুকুরের পানি মটরের সাহায্যে সরবরাহ করা হয়। সেই পানি বিভিন্ন কাজে ব্যবহৃত হয়। সুপেয় পানির জন্য রয়েছে ফিল্টার। কিন্তু পানিতে লবণের মাত্রা এত বেশি যে দুয়েক মাসের মধ্যেই ফিল্টার নষ্ট হয়ে যায়। পরবর্তীতে বৃষ্টির পানি সংরক্ষণে ফিল্টারের ব্যবস্থা করা হয়েছে। তবে আশার কথা হলো, হাসপাতালে বিশুদ্ধ পানি সরবরাহে জাপানের একটি প্রকল্প চলমান রয়েছে। আগামী এক মাসের মধ্যে এই প্রকল্পের কাজ শেষ হবে। এই প্রকল্প চালু হলে সুপেয় পানির ব্যবস্থা অনেকটাই নিশ্চিত হবে।

সুপেয় পানির পর্যাপ্ত ব্যবস্থা নেই বাগেরহাটের রামপাল উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সেও। প্রতিষ্ঠানের কর্মকর্তা ডা. সুকান্ত কুমার পাল ভোরের কাগজকে বলেন, এই এলাকায় লবণাক্ততার পরিমাণ অনেক বেশি। হাসপাতাল এলাকায় ৭শ থেকে সাড়ে ৭শ ফুট গভীর যে নলকূপ ছিল, তাতে আয়রন ও লবণাক্ততার পরিমাণ অনেক বেশি ছিল। এখন সেই সমস্যা কিছুটা কমেছে। হাসপাতালের নতুন ভবনের সঙ্গে ‘সাবমার্সিবল পাম্প’ করা হয়েছে। সরকারিভাবে স্বাস্থ্য প্রকৌশল অধিদপ্তরের অধীনে এই পাম্পটি এক হাজার ফুটেরও বেশি গভীর। এই পাম্পের পানি আগের তুলনায় অনেক ভালো। যা হাসপাতালে সরবরাহ করা হচ্ছে।

বৃষ্টির পানি শোধনের জন্য পাইকগাছা উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে রয়েছে ভিন্ন পদ্ধতি। হাসপাতালের একটি রুমে রয়েছে একটি ওয়াটার এটিএম। দুই টাকার একটি মুজিব কয়েন দিলেই মেলে দুই লিটার পানি। ২০১৮ সালের ২৫ নভেম্বর প্রকল্পটি চালু হয়। এতে হাসপাতালের রোগীদের সুপেয় পানি নিশ্চিত হয়েছে। হাসপাতালের স্বাস্থ্য ও পরিবার পরিকল্পনা কর্মকর্তা ডা. নীতিশ গোলকার ভোরের কাগজকে বলেন, আগে হাসপাতালে নিরাপদ সুপেয় পানির কোনো ব্যবস্থা ছিল না। টিউবওয়েলের পানি ছিল লোনা ও আর্সেনিকযুক্ত। বেশ কয়েক বছর আগে সুপেয় পানির জন্য পৌরসভা থেকে হাসপাতালে একটি পানির লাইন আনা হয়। সেই পানির বিলের জন্য স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের কাছে আবেদন করা হলে এই খাতে অর্থ দেয়ার সুযোগ নেই বলে জানানো হয়েছিল। টাকা না পেয়ে ওই পানির লাইনটা বিচ্ছিন্ন করা হয়। বিকল্প ব্যবস্থার জন্য রেইন ওয়াটার হারভেস্টিং পদ্ধতি চালু হয়। আর অন্যান্য কাজের জন্য পুকুরের পানি ব্যবহার করা হয়। কয়েকটি বেসরকারি সংস্থা ও স্থানীয়দের উদ্যোগে হাসপাতালে আসা রোগীদের সুপেয় পানির সংকট কমেছে।

হাসপাতালে সুপেয় পানির সরবরাহ প্রসঙ্গে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের ভারপ্রাপ্ত পরিচালক (ক্লিনিক ও হাসপাতালসমূহ) ডা. শেখ দাউদ আদনান ভোরের কাগজকে বলেন, হাসপাতালের পানি এবং বর্জ্য ব্যবস্থাপনার কাজ স্থানীয় সরকার বিভাগের। ওয়াসার মাধ্যমে অথবা পৌরসভা ও ইউনিয়ন পরিষদের মাধ্যমে এই কাজগুলো করে থাকে। উপকূলীয় এলাকায়ও পানির চাহিদা স্থানীয় সরকারই পূরণ করে। সুপেয় পানি নিশ্চিতে স্বাস্থ্য বিভাগের কোনো কার্যক্রম নেই। কাজটি স্থানীয় সরকারের দায়িত্বে পড়ে।

জনস্বাস্থ্য প্রকৌশল অধিদপ্তর সূত্রে জানা যায়, বঙ্গোপসাগরের সঙ্গে উপকূলীয় অঞ্চলের নদনদীর সংযোগ থাকায় সাগরের নোনাপানি সরাসরি ওই নদনদীতে পৌঁছে যায়। ফলে নোনাজলের আগ্রাসন বেশি। শুষ্ক মৌসুমে নদীতে নোনাপানির মাত্রা বেড়ে যায়। পুকুরগুলোতেও থাকে নোনাপানি। বেশ কিছু এলাকার টিউবওয়েলে রয়েছে আর্সেনিক ও আয়রনের প্রবণতা।

হাসপাতালে বিশুদ্ধ সুপেয় পানি সরবরাহের জন্য আলাদা কোনো প্রকল্প বাগেরহাটে নেই বলে জানান জনস্বাস্থ্য প্রকৌশল অধিদপ্তর বাগেরহাটের নির্বাহী প্রকৌশলী জয়ন্ত মল্লিক। তিনি ভোরের কাগজকে বলেন, হাসপাতালকেন্দ্রিক আলাদা কোনো প্রকল্প আমাদের এখানে নেই। যদি কোনো হাসপাতালে সুপেয় পানির সংকট হয় তাহলে স্থানীয় সরকার বিভাগ কিংবা স্থানীয় সংসদ সদস্যের কাছে আবেদন করা হয়। তাদের দেয়া তালিকা ধরে সেখানে পানির ব্যবস্থা করা হয়। জেলা পরিষদের একটা প্রকল্প ছিল সেই প্রকল্পের মাধ্যমে ১৪৭টি পুকুর খনন করে পানির ব্যবস্থার উদ্যোগ নেয়া হয়। এর মধ্যে ১৩০টির মতো সুপেয় পানির জন্য পন্ড স্যান্ড ফিল্টার (পিএসএফ) স্থাপন করা হয়েছে। এছাড়া রেইন ওয়াটার হারভেস্টিংয়ের মাধ্যমেও সুপেয় পানির ব্যবস্থা করা হয়।

এ প্রসঙ্গে জনস্বাস্থ্য প্রকৌশল অধিদপ্তরের খুলনা সার্কেলের তত্ত্বাবধায়ক প্রকৌশলী বাহার উদ্দিন ভোরের কাগজকে বলেন, উপকূলীয় এলাকায় সুপেয় পানির সমস্যা দীর্ঘদিনের। রেইন ওয়াটার হারভেস্টিংই এখানে মূল ভরসা। নতুন একটি প্রকল্প এসেছে। এ প্রকল্পের মাধ্যমেও সুপেয় পানির সমস্যার সমাধান করা যাবে।

সাবস্ক্রাইব ও অনুসরণ করুন

সম্পাদক : শ্যামল দত্ত

প্রকাশক : সাবের হোসেন চৌধুরী

অনুসরণ করুন

BK Family App