×

সারাদেশ

চট্টগ্রামে বরাবরের মতই উপেক্ষিত মাস্টারদা সূর্যসেন

Icon

কাগজ প্রতিবেদক

প্রকাশ: ২২ মার্চ ২০২৩, ০৮:০৮ পিএম

চট্টগ্রামে বরাবরের মতই উপেক্ষিত মাস্টারদা সূর্যসেন

ছবি: চট্টগ্রামের রহমতগঞ্জে জে এম সেন হল প্রাঙ্গণে মাস্টারদা সূর্যসেনের আবক্ষ ভাস্কর্য। ছবি: চট্টগ্রাম অফিস

যে মানুষটির জন্ম না হলে চট্টগ্রামে বৃটিশ শোষকদের বিরুদ্ধে আন্দোলন হতো। যে বিপ্লবীর জন্ম না হলে চট্টগ্রামে বৃটিশদের শৃঙ্খল থেকে মুক্তির জন্য এত বিপ্লবীর সৃষ্টি হতো না। যে বিপ্লবী মহানায়কের জন্ম না হলে বীরকন্যা প্রীতিলতার মত বীর কন্যারা দেশমাতৃকার জন্য অসীম সাহসে হাসতে হাসতে প্রাণ দিতেন না। যে সূর্যসেন এর জন্ম না হলে চট্টগ্রামে বৃটিশদের অস্ত্রাগার থেকে আগ্নেয়াস্ত্র-গোলাবারুদ কেড়ে নিয়ে সেই অস্ত্র ব্রিটিশ সৈন্যদের বিরুদ্ধে ব্যবহার করার সাহস পেতেন না। যে বিপ্লবী মাস্টারদা সূর্যসেনের জন্ম না হলে ১৯৩০ এর এপ্রিলে চট্টগ্রাম যুববিদ্রোহ হতো না। জালালাবাদ পাহাড়ে ব্রিটিশ সৈন্যদের সঙ্গে চারদিনব্যাপী যুদ্ধও হতো না। তিনি প্রখর রৌদ্রের মতই সূর্যসেন।

বুধবার (২২ মার্চ) ছিল তার জন্মদিন। বলতে গেলে এই মহান বিপ্লবীর জন্মদিনটি প্রশাসনতো বটেই রাজনৈতিক দলগুলোও যেন ভুলে বসে আছে। অথবা ভাবছে- কি দরকার অযথা এমন একজনকে স্মরণ করার যদি সরকারি বা রাষ্ট্রীয় কোন বাধ্যবাধকতা না থাকে!

অথচ ছোট- বড় রাজনৈতিক সমাবেশে রাজনৈতিক নেতারা জোর গলায় ‘এই চট্টগ্রাম বিপ্লবী মাস্টারদা সূর্যসেনের চট্টগ্রাম, এই চট্টগ্রাম বীরকণ্যা প্রীতিলতার চট্টগ্রাম, এই চট্টগ্রাম কাজেম আলী মাস্টারের চট্টগ্রাম’- এমন নানারকম বিশেষণে ভূষিত করে তাদের রাজনৈতিক বক্তৃতাকে গরম করেন। কিন্তু যাদের নামে নেতারা জনগণের মন কাড়ার চেষ্টা করেন, রাজনৈতিক মাঠ গরম করেন সেসব বিপ্লবীদের স্মৃতিচিহ্ন সংরক্ষণ, তাদের স্মৃতিরক্ষায় বা তাদেরকে যাতে ভবিষ্যৎ প্রজন্ম চিনতে পারে, অতীত গৌরবগাঁথা সম্পর্কে জানতে পারে তার কোন উদ্যোগই নেয়া হয়নি সরকারি কোন প্রশাসন বা রাজনৈতিক নেতাদের পক্ষ থেকে।

চট্টগ্রাম সিটি কর্পোরেশনের মেয়র বীর মুক্তিযোদ্ধা মো. রেজাউল করিম চৌধুরী বিভিন্ন সভা- সমাবেশে প্রায়শ বলে বেড়ান- সিটি কর্পোরেশন চট্টগ্রামের ব্রিটিশ বিরোধী বিপ্লবী, বীর মুক্তিযোদ্ধাসহ চট্টল মনিষীদের জীবনী সংরক্ষণসহ তাদের ভাস্কর্য বা ম্যুরাল স্থাপন করবেন। কিন্তু তিনিও মেয়র পদে আসীন হয়েছেন বেশ কিছুদিন হলো, কিন্তু তার কোন প্রতিফলন দেখেনি চট্টগ্রামবাসী।

বর্তমান মেয়রের আগেই নির্বাচিত মেয়র ছিলেন নগর আওয়ামী লীগের বর্তমান সাধারণ সম্পাদক আ জ ম নাছির উদ্দীন। সবচেয়ে মজার বিষয় হলো সাবেক মেয়র নাছির উদ্দীনের সঙ্গে যখন চট্টগ্রামে দায়িত্বরত ভারতীয় সহকারী হাই কমিশনার দেখা সাক্ষাৎ বা কোন মিটিং হতো তখনই তিনি বলতেন, এইতো খুব শীঘ্রই সিটি কর্পোরেশনের উদ্যোগে ব্রিটিশ বিরোধী বিপ্লবীদের স্মৃতি রক্ষায় কাজ শুরু হবে।

সর্বশেষ তিনি মেয়র থাকাকালে চট্টগ্রামে ভারতের দায়িত্বরত একজন সহকারী হাইকমিশনারের সঙ্গে মেয়রের অফিসকক্ষে আলাপকালে তিনি বলেছিলেন, চট্টগ্রামের লালদীঘি চত্বরকে মাস্টারদা সূর্যসেন চত্বর এবং সেখানে এই বিপ্পবীর একটি সুউচ্চ ভাস্কর্য নির্মাণ করা হবে সিটি কর্পোরেশনের উদ্যোগে।

ভাবখানা এমন যে- মাস্টারদা সূর্যসেন ও ব্রিটিশ বিরোধী বিপ্লবীরা ভারতীয় নাগরিক, দয়া করে তাদেরকে বাংলাদেশে সম্মান দেয়া হচ্ছে।

শুধুমাত্র চট্টগ্রামের নেতৃবৃন্দ বা প্রশাসনের কর্তা ব্যক্তিদের দৈন্যতা নয়। এ দৈন্যতা স্পষ্টভাবে ধরা পড়েছিল ২০১৮ সালের মধ্য জানুয়ারিতে ভারতের সাবেক রাষ্ট্রপতি প্রণব মুখার্জি চট্টগ্রাম সফর করেছিলেন তখন। তার আগমণকে ঘিরে চট্টগ্রাম নগরী, রাউজানে মাস্টারদা সূর্যসেনের বাস্তুভিটা, চট্টগ্রামের পটিয়ায় বীরকন্যা প্রীতিলতার বাড়ি, নগরীর পাহাড়তলীতে বৃটিশ আমলে তৎকালীন ‘ইউরোপীয়ান ক্লাব’ (যা আবার রেলওয়ের কাজেই ব্যবহৃত হচ্ছে) এসব স্থাপনার আমুল সংস্কার ও পরিবর্তন করা হয়েছিল।

তখন প্রশাসেনর কর্তা ব্যক্তি ও রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দের তোড়জোড় দেখে মনে হয়েছিল- ব্রিটিশ বিরোধী বিপ্লব ও চট্টগ্রাম যুব বিদ্রোহের মহানায়ক মাস্টারদা সূর্যসেনসহ তার সহযোদ্বা বিপ্লবীদের স্মৃতিরক্ষায় এবার সত্যি বুঝি কিছু হচ্ছে বা হতে যাচ্ছে। কিন্তু তা যে শুধুমাত্র প্রণব মুখার্জির সফরের সময় তাকে দেখানোর জন্য তা বোঝা যাচ্ছে পরবর্তী সময়ে।

প্রসঙ্গত, তখন চট্টগ্রাম সিটি কর্পোরেশনের মেয়র ছিলেন আ জ ম নাছির উদ্দীন। আশ্চর্য এবং দুঃখজনক হলেও সত্য যে, যে চট্টগ্রামকে ‘বিপ্লবতীর্থ’ নামে আখ্যা দেয়া হয় সেই বন্দরনগরী চট্টগ্রাম নগরীতে চট্টগ্রাম যুব বিদ্রোহের মহানায়ক মাস্টারদা সূর্যসেনের নামে কোন স্থাপনা নেই, কোন সড়কের নামকরণ করতে পারেনি সিটি কর্পোরেশন, কোন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের নামকরণ হয়নি। শুধু কি তাই?

নগরীর অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ কোন মোড়ে মহান এই বিপ্লবীর কোন ভাস্কর্য পর্যন্ত স্থাপন করা হয়নি আজ পর্যন্ত। চট্টগ্রাম কারাগারের যে ফাঁসি মঞ্চে সূর্যসেন ও তার অন্যতম সহযোদ্ধা তারকেশ্বর দস্তিদারকে ফাঁসি দেয়া হয়েছিল সেখানেও সাধারণ জনগণ ফুলেল কোন শ্রদ্ধা জানাতে যেতে পারে না। যে জালালাবাদ পাহাড়ে বৃটিশ সৈন্যদের সঙ্গে অসীম সাহসে বীর তরুনেরা যুদ্ধ করে (১৯৩০ সালের এপ্রিলের ১৮ থেকে ২২ এপ্রিল পর্যন্ত) চট্টগ্রামকে চরদিনের জন্য স্বাধীন রেখেছিলেন সেটিও কেউ দেখতে পারে না সংরক্ষিত (সেনানিবাস) এলাকা হওয়াতে।

বারবার বিভিন্ন সমাবেশ সেমিনার থেকে বৃটিশ বিরোধী বিপ্লবীতের স্মৃতিরক্ষাসহ নতুন প্রজন্মের কাছে জানানোর জন্য পাঠ্যপুস্তকে জীবনী ও বীরগাঁথা সংরক্ষণের দাবি জানানো হলেও তা সেই দাবিতেই রয়ে গেছে। শুধুমাত্র চট্টগ্রাম নগরীর রহমতগঞ্জের জে এম সেন হল প্রাঙ্গণে মাষ্টারদা সূর্যসেনর একটি আবক্ষ ভাস্কর্য রয়েছে যেটিও কোন সরকারি উদ্যোগে হয়নি। হয়েছে সম্পূর্ণ বেসরকারি উদ্যোগে।

বৃটিশ বিরোধী বিপ্লবের মহানায়ক মাষ্টারদা সূর্যসেনের জন্মবার্ষিকীতে বুধবার (২২ মার্চ) রাউজানের নোয়াপাড়ায় তার বাস্তুভিটায় স্থাপিত আবক্ষ ভাস্কর্যে ফুল দিয়ে শ্রদ্ধা জানিয়েছেন রেলপথ সংক্রান্ত সংক্রান্ত সংসদীয় স্থায়ী কমিটির সভাপতি ফজলে করিম চৌধুরীসহ স্থানীয় কয়েকটি সংগঠনের নেতারা।

এছাড়া চট্টগ্রামের ইতিহাস-ঐতিহ্য, সাহিত্য ও সংস্কৃতি নিয়ে গবেষণাধর্মী সামাজিক সংগঠন ‘চৈতগ্রাম’ এর পক্ষ থেকে কালুরঘাট দ্বিতীয় সেতুর নাম ‘মাস্টার দা সূর্যসেন’ এর নামে নামকরণের দাবি জানানো হয়েছে। এতো গেলো রাজনৈতিক দল, সিটি কর্পোরেশন, সরকারি বা রাষ্ট্রীয় অনীহার বিষয়।

বৃটিশ বিরোধী বিপ্লবীদের স্মৃতি সংরক্ষণের দাবিতে চট্টগ্রামে কয়েকটি সংগঠন রয়েছে। সে সব সংগঠনেরও কোন তৎপরতা চোখে পড়েনি মাষ্টারদার জন্মবার্ষিকী পালনের জন্য।

কে ছিলেন মাস্টরদা সূর্যসেন!

সূর্য সেন, যিনি ‘মাস্টারদা’ নামে সমধিক পরিচিত। ভারত উপমহাদেশে ব্রিটিশবিরোধী স্বাধীনতা আন্দোলনের অন্যতম নেতা হিসেবে পরিচিত ব্যক্তিত্ব।

এই বাঙালি বিপ্লবী তৎকালীন ব্রিটিশবিরোধী সশস্ত্র আন্দোলনে সক্রিয়ভাবে অংশ নেন এবং নিজ জীবন বলিদান করেন। মাস্টারদা সূর্য সেন ছিলেন বিপ্লবী ‘যুগান্তর’ দলের চট্টগ্রাম শাখার প্রধান এবং ১৯৩০ সালের চট্টগ্রাম অস্ত্রাগার লুণ্ঠনের প্রধান সংগঠক।

সূর্য সেন ১৯১৮ সালে বিপ্লবী যুগান্তর দলকে পুনরুজ্জীবিত করেন। আত্মরক্ষার কৌশল হিসেবে তিনি ‘ন্যাশনাল স্কুল’-এ শিক্ষক হিসেবে যোগ দেন। শিক্ষকতা করার কারণে তিনি পরিচিত মহলে ‘মাস্টারদা’ আখ্যা পান। ক্রমেই তার দল চট্টগ্রামে সক্রিয় হয়ে ওঠে।

১৯২৯ সালে চট্টগ্রামে জেলা কংগ্রেসের সম্মেলনে সভাপতি হিসেবে উপস্থিত ছিলেন সুভাষচন্দ্র বসু। এতে সূর্য সেন সম্পাদক পদে নির্বাচিত হন। একই বছর ১৩ সেপ্টেম্বর লাহোর জেলে একটানা ৬৩ দিন অনশন করে বিপ্লবী যতীন্দ্রনাথ মারা যান। এর প্রতিক্রিয়ায় সারা বাংলায় প্রচণ্ড বিক্ষোভ দেখা দেয়। বিক্ষোভ মিছিল ও সভায় নেতা সূর্য সেন বিপ্লবের পরবর্তী কার্যক্রমের পরিকল্পনা সদস্যদের সামনে তুলে ধরেন।

১৯৩০ সালের ১৮ এপ্রিলের সশস্ত্র বিদ্রোহ ছিল সূর্য সেনের নেতৃত্বে বিপ্লবীদের দীর্ঘ সময়ের প্রস্তুতি ও সুষ্ঠু পরিকল্পনার ফসল। জালালাবাদ পাহাড়র যুদ্ধের একপর্যায়ে আত্মগোপন করেন তার অন্য সতীর্থদের নিয়ে। পরবর্তীকালে গৈরালা গ্রামে আত্মগোপন করে থাকার সময় গ্রামবাসী একজন সূর্য সেনের লুকিয়ে থাকার তথ্য পুলিশকে জানিয়ে দেয়। ১৯৩৩ সালের ২ ফেব্রুয়ারির প্রথম প্রহরে একদল গোর্খা সৈন্য গোপন স্থানটি ঘিরে ফেলে। সৈন্যবেষ্টনী ভেঙে বেরিয়ে যাওয়ার সময় সূর্য সেন ধরা পড়েন।

‘যুগান্তর’ দলের চট্টগ্রাম শাখার নতুন সভাপতি তারকেশ্বর দস্তিদার সূর্য সেনকে চট্টগ্রাম জেল থেকে ছিনিয়ে আনার প্রস্তুতি নেন। কিন্তু পরিকল্পনাটি ব্যর্থ হয়। তারকেশ্বরের সঙ্গে আরও কয়েকজন গ্রেপ্তার হন। ১৯৩৩ সালে সূর্য সেন, তারকেশ্বর দস্তিদার এবং কল্পনা দত্তের বিশেষ আদালতে বিচার হয়। ১৪ আগস্ট সূর্য সেন ও তারেকেশ্বর দস্তিদারের ফাঁসির রায় ও কল্পনা দত্তের যাবজ্জীবন কারাদণ্ড হয়।

১৯৩৪ সালের ১২ জানুয়ারি চট্টগ্রাম কারাগারে সূর্য সেন ও তারেকেশ্বর দস্তিদারের ফাঁসি কার্যকর করা হয়।

সূর্য সেন ১৮৯৪ সালের আজকের দিনে (২২ মার্চ) চট্টগ্রামের রাউজান থানার নোয়াপাড়া গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন।

সাবস্ক্রাইব ও অনুসরণ করুন

সম্পাদক : শ্যামল দত্ত

প্রকাশক : সাবের হোসেন চৌধুরী

অনুসরণ করুন

BK Family App