কিশোরী বয়সেই বিয়ে হয়ে যায় সিদেখা বেগমের। বেকার মাদকাসক্ত স্বামীর অত্যাচারে সংসার টেকেনি। শরীরে মারের ক্ষত আর ৩ বছরের মেয়ে তাহমিনাকে নিয়ে আশ্রয় নেন হতদরিদ্র ভাইয়ের বাড়িতে। অন্যের বাড়িতে কাজ করে দুবেলার খাবার জোটাতেন। এভাবেই কেটেছে ১৭ বছর। মাঝখানে মেয়েকে বিয়ে দিলেও জামাইকে নিজ ঘরে বসিয়ে ভালো-মন্দের খোঁজ নেয়াটা ছিল দিবাস্বপ্নের মতোই। কিন্তু প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার আশ্রয়ণ প্রকল্পের ঘর পাল্টে দিয়েছে পুরো প্রেক্ষাপট। অভাব-অনটনের জীবনে সীমাহীন লড়াই-সংগ্রাম ছাড়া যার কিছুই জোটেনি, তার মুখেও ফুটেছে হাসি। হয়ে উঠছেন স্বাবলম্বী। তিল তিল করে টাকা জমিয়ে সাজিয়ে তুলছেন স্বপ্নের ঘর। যখন ইচ্ছা দাওয়াত দিচ্ছেন মেয়ে ও জামাইকে।
একসময় সরকারি খাস জমিতে ছাপড়া তুলে বসবাস করা শাহানারা বেগম ও শরিফ উদ্দিন দম্পতিও আশ্রয়ণের ঘর পেয়ে ঘুরে দাঁড়িয়েছেন। শরিফ অটোরিকশা চালান। আর শাহানারা ৬টা গরু, একটি ছাগল এবং বেশ কয়েকটি হাঁস-মুরগি পালন করেন। আগে যেখানে ঝড়-তুফানের দিন কোথায় থাকবেন, ৩ বেলা কীভাবে খাবেন, সন্তানদের পড়ালেখার খরচ কীভাবে চালাবেন- সেই চিন্তায় জীবন কাটত; তারাই এখন অভাব কাটিয়ে স্বপ্ন দেখছেন সন্তানদের মানুষের মতো মানুষ করার। শুধু সিদেখা বেগম আর শাহানারা নয়, আশ্রয়ণের ঘর পাওয়া সবগুলো পরিবারেরই জীবনের গল্প পাল্টে গেছে। অভাব ঘুচিয়ে নিজেদের ঘরকে পরিণত করেছেন সুখের বাতিঘরে। যেখানে নতুন নতুন স্বপ্ন জন্ম নিচ্ছে প্রতিনিয়ত। সেই সঙ্গে সমৃদ্ধির পথে এগিয়ে যাচ্ছে গৃহহীন, ভূমিহীন মানুষরা।
গতকাল মঙ্গলবার সিলেটের গোয়াইনঘাট উপজেলায় ফতেহপুর ইউনিয়নের আশ্রয়ণ প্রকল্পের ঘরগুলো ঘুরে এমন চিত্রই দেখা গেছে। এদিকে সারাদেশে আশ্রয়ণ প্রকল্পের আওতায় এক জায়গায় বেশ কয়েকটি ঘর নির্মাণ করে অনেকটা গুচ্ছগ্রামের মতো করা হলেও, বিন্নাকান্দির চিত্র একদমই ভিন্ন। সেখানে টিলার ঢালে ঢালে আলাদা করে ঘর নির্মাণ করে দেয়া হয়েছে। ফলে, দেখে বোঝার উপায় নেই এটি আশ্রয়ণের ঘর। সবজি চাষ, হাঁস-মুরগি পালন, গরু চড়ানোর জন্যও পর্যাপ্ত জায়গা পাচ্ছেন তারা।
গোয়াইনঘাট উপজেলার সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা বলছেন, বিন্নাকান্দি গ্রামের প্রতিটি ঘর আলাদা আলাদা জায়গায় করা হয়েছে। এতে করে ঘরগুলোর বাসিন্দারা নিজেদের স্বাবলম্বী করতে আরো বেশি সুযোগ পাচ্ছেন।
পাল্টে যাওয়া জীবন সম্পর্কে বিন্নাকান্দি গ্রামের বাসিন্দা সিদেখা বেগম ভোরের কাগজকে জানান, ফতেহপুর এলাকায় কামাল নামে একজনের সঙ্গে তার বিয়ে হয়। স্বামী বেকার ও মাদকাসক্ত থাকায় প্রায়ই মারধার করত। মারধরে অতিষ্ঠ হয়ে একমাত্র মেয়ে তাহমিনাকে নিয়ে চলে আসেন হতদরিদ্র ভাইয়ের বাড়িতে। এরপর থেকে দুবেলা খাওয়ার জন্য পরের বাড়িতে কাজ শুরু করেন। কখনো কখনো না খেয়েও দিন কাটিয়েছেন। ৫ বছর আগে মেয়েকে বিয়ে দেন। মেয়ের জামাইকে কোনোদিন নিজের ঘরে বসতে দেবেন, সেটিও ভাবেননি কখনো। এক বছর আগে আশ্রয়ণ প্রকল্পের আওতায় ঘর পেয়ে এখন সবাইকে বলতে পারেন, এটা আমার নিজের ঘর। ঘরের চারপাশে সবজি চাষ শুরু করেছেন। লাগিয়েছেন বেশ কিছু সুপারি গাছও। সামর্থ্য বাড়লে গরু কিনবেন বলেও জানান। সেই সঙ্গে মেয়ে ও জামাই এলে নিজের ঘরে আপ্যায়ন করার স্বপ্নপূরণ হওয়ায় প্রধানমন্ত্রীকে ধন্যবাদ জানান সিদেখা বেগম।
শাহানারা বেগম ভোরের কাগজকে বলেন, স্বামী শরিফ উদ্দিন অটোরিকশা চালালেও আগে ঋণ পিছু ছাড়ত না। ঘর পাওয়ার পর এখন ৬টা গরুর মালিক হয়েছি। সঞ্চয় করাও শুরু করেছি। এখন একটাই ইচ্ছা ৩ ছেলেকে মানুষের মতো মানুষ করা।
একই এলাকায় আশ্রয়ণের ঘর পাওয়া স্বপ্না বেগম বলেন, আগে খাস জমিতে ছাপড়া তুলে থাকতাম। একটা নিজস্ব ঘর কতটা প্রয়োজন- সন্তান জন্ম দেয়ার সময় তা বুঝেছি। সিজার করানোর সময় দিনমজুর স্বামীর পক্ষে টাকা জোগাড় করা সম্ভব হচ্ছিল না। ঘর নেই, বেশি টাকা ধার দিলে পালিয়ে যেতে পারি- এই আশঙ্কায় কারো কাছে সহযোগিতা পাইনি। ঋণ নিতে চাইলাম, তাও দেয়নি। এখন ঘর হইছে, বৃষ্টির দিন পানিতে ভেজা লাগে না। ঝড়-তুফানেও ডর লাগে না। সবচেয়ে বড় কথা- শান্তিতে আছি।
নওয়াগাঁওয়ে উৎসবের আমেজ : আজ (বুধবার) গোয়াইনঘাটের নওয়াগাঁও আশ্রয়ণ প্রকল্পে উদ্বোধন করা হবে ১০০টি ঘর। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ভার্চুয়ালি যুক্ত হয়ে ঘরগুলো উদ্বোধন করবেন। এজন্য বানানো হয়েছে বিশাল প্যান্ডেল। লাগানো হয়েছে বিশাল বিশাল প্ল্যাকার্ড। যারা ঘর পাবেন, তারা নিজের ঘর দেখে খুশিতে আত্মহারা হয়ে পড়ছেন। অনেকে ইতোমধ্যে নিজের ঘরে উঠে গোছগাছ শুরু করে দিয়েছেন। অপেক্ষা করছেন আনুষ্ঠানিকভাবে ঘরের দলিল হাতে পাওয়ার।
আশ্রয়ণের ঘর পেতে যাওয়া নুরুন নেহার ভোরের কাগজকে বলেন, ৫ ছেলে আমার। ভেবেছিলাম ওরাই আয় করে বাড়ি বানাবে। আমাদের কষ্ট থাকবে না। ছোট ছেলে মানসিক সমস্যায় আক্রান্ত। অন্য ছেলেরা বিয়ে করে আমাদের ফেলে চলে গেছে। বৃদ্ধ স্বামী মো. ইলিয়াস মিয়ার দিনমজুরির টাকায় চলে অভাবের সংসার। এর মধ্যে নিজেদের একটা ঠিকানা হতে যাচ্ছে। তাই নতুন ঘর দেখতে এলাম। সারাজীবনের স্বপ্ন আগামীকাল (আজ) পূরণ হতে যাচ্ছে। মনে আর কোনো কষ্ট নাই। এখন শান্তিতে মরতে পারব।
ঘর পেতে যাওয়া পাথরশ্রমিক জাহাঙ্গীর আলম বলেন, আমার বাবা মৃত বশির মিয়াও ভূমিহীন ছিল। জন্মের পরে ব্রিজের নিচে ছাপড়া ঘরে বড় হয়েছি। কখনো ভাবিনি নিজের পাকা ঘর হবে। এটাই একমাত্র স্বপ্ন ছিল। যেটা প্রধানমন্ত্রী পূরণ করেছেন। এখন একটাই লক্ষ্য ৩ ছেলেমেয়েকে পড়ালেখা শেখানো।
গোয়াইনঘাট উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) তাহমিলুর রহমান ভোরের কাগজকে বলেন, নওয়াগাঁও আশ্রয়ণ প্রকল্পের পরিকল্পনা হাতে নেয়া হয় ২ বছর আগে। নির্জন হাওড় এলাকায় নতুন সভ্যতা গড়ে তোলার মতোই ৫ একর ৩৬ শতাংশ জায়গার ওপর প্রকল্পটি বাস্তবায়ন করা হয়েছে। এজন্য প্রথমে ৩০ লাখ টাকার মাটি কেটে জায়গা ভরাট করা হয়। এরপর ২ একর জায়গায় নির্মাণ করা হয়েছে ১০০টি ঘর। বাকি জায়গা কৃষিকাজের জন্য রাখা হয়েছে। ওই জায়গায় ইতোমধ্যে এক হাজার ফলজ ও ঔষধি গাছ লাগানো হয়েছে। পানি ব্যবস্থাপনায় খরচ হয়েছে ২০ লাখ টাকা। প্রতিটি ঘরে সুপেয় পানির লাইন দেয়া হয়েছে। যা আর কোনো আশ্রয়ণ প্রকল্পে নেই। পাশাপাশি জায়গা ভরাটের জন্য মাটি কেটে এক কিলোমিটার খাল সৃষ্টি করা হয়েছে। এই খালের পানি ৩ হাজার হেক্টর কৃষিজমিতে ব্যবহৃত হচ্ছে। এই খালে মাছও চাষ করা হবে। যার লভ্যাংশ সমিতির মাধ্যমে আশ্রয়ণের ঘর পাওয়া মানুষদের মধ্যেই বন্টন করা হবে।
তাহমিলুর রহমান আরো বলেন, গোয়াইনঘাটে মোট ১,১০১টি ঘর নির্মাণ করা হবে। আগামীকাল (আজ) ১৭০টি ঘর প্রধানমন্ত্রী হস্তান্তর করবেন। যার মধ্যে ১০০টি নওয়াগাঁও আশ্রয়ণ প্রকল্পের। এখন ১২৪টি ঘরের নির্মাণকাজ চলছে। বাকি ঘরগুলো আগেই হস্তান্তর করা হয়েছে। সিলেটের সর্বশেষ ভয়াবহ বন্যায় নিঃস্ব হওয়া ২৩টি পরিবারকে এখানে ঘর দেয়া হচ্ছে।
ইউএনও আরো বলেন, প্রধানমন্ত্রীর উপহারের ঘর পেয়ে মানুষ খুশিতে আত্মহারা। সবাই আমাদের দেখলেই দৌড়ে এসে প্রধানমন্ত্রীকে ধন্যবাদ জানাচ্ছেন। এমন মহতী উদ্যোগের সঙ্গে থাকতে পারাটা আমাদের কর্মজীবনেও অনেক বড় পাওয়া।
মন্তব্য করুন
খবরের বিষয়বস্তুর সঙ্গে মিল আছে এবং আপত্তিজনক নয়- এমন মন্তব্যই প্রদর্শিত হবে। মন্তব্যগুলো পাঠকের নিজস্ব মতামত, ভোরের কাগজ লাইভ এর দায়ভার নেবে না।