×

মুক্তচিন্তা

এক্সক্লুসিভের মোকাবিলায় ইনক্লুসিভ রাজনীতি

Icon

অনলাইন ডেস্ক

প্রকাশ: ২১ মার্চ ২০২৩, ১২:১৫ এএম

এক্সক্লুসিভের মোকাবিলায় ইনক্লুসিভ রাজনীতি

বলিষ্ঠ আইডিয়া বা মতাদর্শের ওপর ভর করে সময়ে সময়ে বিভিন্ন ভাষা, ধর্মবিশ্বাস, আর্থিকভাবে বিভক্ত নানা শ্রেণি এবং এগিয়ে যাওয়া আর পিছিয়ে পড়া জনগোষ্ঠীকে ঐক্যবদ্ধ করে গড়ে উঠেছিল ঐক্যবদ্ধ দৃষ্টান্ত। জায়গা করে নিয়েছিল বৃহত্তর মোর্চার। এ বিষয়ে আমাদের সামনে প্রথম এবং সর্বশ্রেষ্ঠ দৃষ্টান্তটির নাম ভারতের জাতীয় কংগ্রেস, যা তৈরি হয়েছিল ১৮৮৫ সালে। স্বাধীনতা লাভের কোনো চিন্তা-ভাবনা তখনো ছিল না। সরকারের শিক্ষিত ভারতবাসীদের সুযোগ সৃষ্টির একটি প্ল্যাটফর্ম ছিল এটি। ইংরেজদের সঙ্গে আলোচনার সুযোগ পাওয়ার প্ল্যাটফর্ম ছিল এটি। এর অনেক পরে বাংলাদেশের জন্য আসে মুক্তিযুদ্ধের প্ল্যাটফর্ম। বঙ্গবন্ধুর আহ্বানে বাংলার স্বাধীনতা লাভের জন্য এক হয়ে দাঁড়িয়েছিল এ দেশের হিন্দু, মুসলিম, খ্রিস্টান, বৌদ্ধ, পুরুষ, মহিলা, গরিব, ধনবান, কৃষক, শ্রমিকসহ সব শ্রেণির বাঙালি। হাতে হাত মিলিয়েছিল একসঙ্গে। এসব যুগান্তকারী ঘটনা প্রায়ই ঘটে না, কখনো কখনো ঘটে যায়। তাই সেদিনের কংগ্রেস কিংবা বঙ্গবন্ধুর হাত ধরে এগিয়ে চলা আওয়ামী লীগ ঠিক একই জায়গা ধরে রাখতে পারেনি পরবর্তী সময়ে। কিন্তু তারপরও এ দুটি দল যথাক্রমে ভারত এবং বাংলাদেশের স্বাধীনতার মূলমন্ত্র হিসেবে কাজ করেছে; নিজ নিজ রাজনৈতিক দলে রক্ষণশীল ও প্রগতিশীল উভয়পক্ষকেই শামিল করেছে। বামপন্থির দিকেও খানিকটা ঝুঁকেছে, ধর্মনিরক্ষেতা ও সমাজতন্ত্র গ্রহণ করেছে, সমর্থন করেছে বাজার অর্থনীতিকে, সাদরে বরণ করেছে কল্যাণরাষ্ট্রের ধারণাকে। কিন্তু তাদের চ্যালেঞ্জ করে আজকের ভারতে প্রতিষ্ঠা পেয়েছে বিজেপির মতো চরম হিন্দু জাতীয়তাবাদী এবং দক্ষিণপন্থি রাজনৈতিক দল। আর বাংলাদেশে প্রতিষ্ঠা পেয়েছে মুসলিম জাতীয়তাবাদী এবং ধর্মীয়বলয়ের দক্ষিণপন্থি রাজনৈতিক দল বিএনপি। এদের রাজনৈতিক ফায়দা এক জায়গাতেই- সমাজের বিভাজনকে উসকে দেয়া। মুসলমানকে হিন্দুর বিরুদ্ধে, হিন্দুকে মুসলমানের বিরুদ্ধে যতখানি সম্ভব বিভক্ত করে রাখা। ভারতের বিজেপি এবং বাংলাদেশের বিএনপি তাই মানুষকে এক্সক্লুসিভ রাজনীতির স্বাদ জুগিয়েছে। ভারতের বিজেপির পাশে যেমন ছিল হিন্দুরাষ্ট্রের আদর্শে বিশ্বাসী আরএসএস; তেমনি বাংলাদেশে বিএনপির পাশে ছিল ধর্মীয় রাষ্ট্র তৈরির স্বপ্ন লালন করা জামায়াতে ইসলামী। এদের লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য এক এবং স্থির। তাই তারা এক্সক্লুসিভ রাজনীতির বাইরে যেতে চায় না। বৃহত্তর ধর্মীয় সংখ্যাগুরু জনগোষ্ঠীর সমর্থনই তাদের লক্ষ্য। ধর্মীয় সংখ্যালঘুর প্রতি অবহেলা প্রদর্শনই তাদের রাজনৈতিক কৌশল। ইনক্লুসিভ রাজনীতি তাদের শত্রæ। কিন্তু আমি, আমরা তো স্বাধীনভাবে জন্মগ্রহণ করেছি। আমরা জন্মেছি গণতন্ত্রের মধ্যে অথবা স্বৈরাচারের শাসনামলে অথবা এমন একটি দেশে যেখানে কোলাহল, বিবাদ বিদ্বেষ লেগেই রয়েছে। আর এগুলো এমন বিষয় যার ওপর আমার বা আমাদের কোনো হাত ছিল না। কিন্তু তার মাঝেও এ বিশ্বাসটুকু সবসময়ই ছিল যে, কিছু অবিচ্ছেদ্য বা হস্তান্তর অযোগ্য অধিকার নিয়েই আমরা জন্মেছি। শরীরের অধিকার, স্বাধীনভাবে চলাফেরার অধিকার, কথা বলা ও লেখার অধিকার, পছন্দের মানুষকে পছন্দ করি বলে প্রকাশ করার অধিকার। রাষ্ট্র নাগরিকের সম্মিলিত নামের পরিচয়। সেই রাষ্ট্রে নাগরিকদের দ্বারা গৃহীত সনদই হলো সংবিধান। সংবিধান নাগরিকের কথা যেমন বলে, তেমনি আবার কর্তব্যের কথাও বলে। সংবিধানের বাইরে রাষ্ট্র কোনো ক্ষমতা, কর্তব্য বা অধিকার জাহির করতে পারে না। তাই দেশের শেষ কথা সংবিধান অর্থাৎ জনগণ। রাষ্ট্র এবং নাগরিকের এ নিখুঁত সহাবস্থানের অবস্থায় কোনো ব্যত্যয় ঘটলে তা দেশের জন্য অমঙ্গল ডেকে নিয়ে আসে। তবে সংবিধানে যা লেখা আছে, তা যদি কখনো কখনো বিতর্কের সুযোগ করে দেয়, তার ব্যাখ্যার অধিকার ধারণ করে বিচার বিভাগ। বিচার বিভাগ সরকারের মুখাপেক্ষী হয়ে দাঁড়ালে দেশের সর্বনাশ হতে আর কিছু অবশিষ্ট থাকে না। তখন সবচেয়ে অসহায় হয়ে পড়ে দেশের জনগণ। যেসব অধিকার তার পাওয়ার কথা, তা আর খোলা থাকে না তার হাতে। তখন সংবিধান, জনগণ, রাষ্ট্র সবকিছু একাকার হয়ে মুখ থুবড়ে পড়ে। শুধু মাথা তুলে দাঁড়ায় তখন এক্সক্লুসিভ রাজনীতি- স্বৈরতন্ত্রের রাজনীতি। তিল তিল সাধনায় অর্জিত গণতন্ত্র তখন পুলিশি রাষ্ট্রের নিষ্পেশনে জর্জরিত হয়ে ওঠে। রাজনীতি নির্ভরশীল হয়ে পড়ে প্রতিহিংসাপরায়ণতার ধারার হাতে, রাজনৈতিক নেতা ও পুলিশের একে-অপরকে তেল দেয়ার সুদীর্ঘ জাল তৈরি হয়ে যায়। তাতে শামিল হয়ে যায় সরকারি কর্মকর্তারাও। তৈরি হয়ে যায় একটি নতুন ধরনের শাসনব্যবস্থা, যেখানে সবাই থাকলেও জনগণ শুধু অনুপস্থিত থাকে। আইনের শাসন হয়ে পড়ে উপহাসের বিষয়বস্তু। শুরু হয়ে যায় তখন রাষ্ট্রীয় সংস্থাগুলোর বিদ্বেষমূলক ও অসাধু কর্মকাণ্ড। এসবই এক্সক্লুসিভ রাজনীতির প্রাপ্তি। এক্সক্লুসিভ রাজনীতি উপহার দেয় এক্সক্লুসিভ ক্ষমতা। এ ক্ষমতা তখন আর ইনক্লুসিভ কোনো চিন্তাধারার মধ্যে থাকে না। রাজনৈতিক জোট বাধার কথা তো ভাবতেই পারে না। ক্ষমতা ভাগাভাগি দূরে থাক, ক্ষমতার ছিটেফোঁটাও কারো দিকে এগিয়ে দিতে তখন তাদের তাগিদ থাকে না। এমন একটি দুর্ভেদ্য এক্সক্লুসিভ ক্ষমতার রাজনীতিকে চ্যালেঞ্জ করার জন্যই ইনক্লুসিভ রাজনীতির প্রয়োজন, জোটের রাজনীতি প্রয়োজন; ক্ষমতা ভাগাভাগির রাজনীতির প্রয়োজন। রাজনীতি ঠিক পাটিগণিত নয়। সেখানে সব সময় দুইয়ে দুইয়ে চার হয় না। বেশিও হয়, আবার শূন্যও হয়। নির্বাচনী জোট নয়, রাজনৈতিক জোট প্রয়োজন। এক্সক্লুসিভ রাজনীতি মানুষকে নিজেদের মতো ভাবাতে চায়। কী খাওয়া উচিত, কী উচিত নয়, কাকে ভালোবাসা উচিত, কাকে ঘৃণা করা দরকার- তাও তারা মগজে ঢুকিয়ে দিতে চায়। তাই তার বিরুদ্ধে ইনক্লুসিভ রাজনীতির নীতিগত জোট প্রয়োজন, শুধু নির্বাচনের জোট নয়। রাজনীতি তো এমনই- দুটি ভিন্ন মতাবলম্বী দল নিজেদের নীতি ও আদর্শ প্রচার করে। দুপক্ষেরই প্রধান লক্ষ্য থাকে সাধারণ মানুষকে নিজেদের দলে টানা। কখনো কর্মী হিসেবে, কখনো সমর্থক হিসেবে, কখনো-বা নিছক ভোটার হিসেবে। এটাই রাজনীতির স্বাভাবিক রীতি। কিন্তু আজকাল অনেক ক্ষেত্রেই রাজনীতি আর সেই চেনা রীতির পথে হাঁটে না, তার থেকেও সহজ পথ খুঁজে নেয়। সামগ্রিকভাবে নীতি, আদর্শ, প্রভাব বিস্তারের প্রবল প্রচেষ্টায় মানুষের মধ্যে আরো বেশি জনপ্রিয় হওয়ার মরিয়া প্রয়াসের যে স্বাভাবিক রীতি ছিল রাজনীতির, তা আজ পথ হারিয়ে বসে আছে। আজ আর তারা সেভাবে ভাবেন না যে, মানুষ তাদের দর্শন, অবস্থান, চিন্তা-ভাবনা গ্রহণ করবে। তেমন গণতান্ত্রিক পথে অগ্রসর হওয়ার তাগিদটাই নেই তাদের কাছে। এই এক্সক্লুসিভ রাজনীতির যুগে যতই কোয়ালিশনের মাধ্যমে ইনক্লুসিভ রাজনীতির পথ দেখাবে, ততই জনগণের জন্য মঙ্গল। সে কাজে যত বেশি রাজনৈতিক দল এগিয়ে আসবে, ততই লাভ হবে দেশ ও দেশের জনগণের। রাষ্ট্রের ভিত্তিমূলে আঘাত হানার ইচ্ছাকৃত এবং দৃঢ় প্রয়াসের বিরুদ্ধে জেগে উঠুক সম্মিলিত রাজনীতিবোধ। চুপিসারে জনগণকে প্রান্তে এনে ছিন্নভিন্ন করে তাদের স্বাধীনতা ও অবিচ্ছেদ্য অধিকার থেকে বঞ্চিত করার অপচেষ্টা চলছে। সেই বঞ্চনার বিরুদ্ধে সম্মিলিত হোক চেতনার রাজনীতিবোধ। এ দাবি আজকের দিনের সবচেয়ে বড় রাজনৈতিক দাবি। জোট-রাজনীতি নিয়ে পরীক্ষা-নীরিক্ষা চলছে সেই সত্তরের দশক থেকেই। ন্যূনতম অভিন্ন কর্মসূচিই জোটের ক্ষেত্রে রাজনৈতিক রসায়ন। বহুদলীয় গণতন্ত্রের নানা মতবাদে বিশ্বাসী বিভিন্ন রাজনৈতিক দল প্রধানত ভিন্ন ভিন্ন জনগোষ্ঠীর স্বার্থ রক্ষা করে। এদের এক ছাতার তলে আসাটা কোনো সহজ ব্যাপার নয়। তারপরও বৃহত্তর স্বার্থে তা কখনো কখনো সার্থক হয়। এ রকম জোটের উপকারিতা অনেক। কোনো রাজনৈতিক দলকে কোনো নির্বাচনে যতজন ভোট দেয়, তার মধ্যে নিবেদিতপ্রাণ ভোটার কিন্তু ছোট একটা অংশ। বাকি বিরাট সংখ্যক ভোটারের সমর্থন অনেকটাই ঝুরঝুরে, বালির বাঁধের মতো। এরা ভাসমান বা ফ্লোটিং ভোটার। রাজনৈতিক ছোট একটা দমকা হাওয়াও তাদের সমর্থনকে উড়িয়ে নিয়ে যেতে পারে যেখানে-সেখানে। ঐক্যের নাম করে চরিত্রগতভাবে পরস্পরবিরোধী কিছু দলের এই ঝুরঝুরে ভোটকে এক বাক্সে জড়ো করা এক দুঃসাহসিক প্রচেষ্টা, তাতে কোনো সন্দেহ নেই। তবে সেই দুঃসাহসিক কাজটি করে ফেলতে পারলে এক্সক্লুসিভ রাজনীতির ধারকদের বেশ খানিকটা ঝাঁকি দেয়া যায় বটে! আর তাতে সবচেয়ে বড় ধরনের উপকারটি হয় জনগণের- ভোটারের। রাজনৈতিক ইতিহাসে এ ঐক্যের ম্যাজিক কাজ করেছে সময় সময়। সময়বিশেষে এ ম্যাজিকের ক্ষেত্রটা প্রস্তুত হয়েই থাকে। এক্সক্লুসিভ রাজনীতির ধারকরাই এ ম্যাজিকের সলতেটা পাকিয়ে প্রস্তুত রাখে। প্রয়োজন পড়ে শুধু একটুখানি আগুনের ফুলকি। সম্মিলিত ঐক্য শুধু সলতেটাতে একটু আগুন জ্বালিয়ে দিতে পারলেই হলো। জনগণের একটা বড় অংশ প্রস্তুতই থাকে বিভাজনের রাজনীতির বিরোধী ভোট দিতে। দেশ আর জনগণ আগের মতো থাকলেও রাজনীতিটা একেবারেই নতুন আজকের দিনে। এখানে প্যাকেজটাই শেষ কথা। মানুষের জন্য কাজ কতটা হলো, জনগণ কী চাইছে, ভোটার কী চাইছে- দেখার সময় নেই। প্যাকেজে নেই এসব। সেসব পুরনো ফ্যাশন। এখন এসেছে নতুন নিয়ম- মোড়কটা চাই চকচকে। ভেতরটা ফাঁপা থাকুক না, মানুষ ওসব দেখতে পাচ্ছে না। একটু একটু করে মাদক সেবন করালে ধীরে ধীরে তার শরীর যেমন আচ্ছন্ন হয়ে পড়ে; মস্তিষ্ক কাজ করে না স্বাভাবিকভাবে; সবসময় থাকে একটা ঘোরের মধ্যে- জনগণেরও হয়েছে সে রকম অবস্থা। অন্তত নেতারা তেমনটাই মনে করেন। ক্ষমতার রাজনীতির অভেদ্য মায়াজালে আটকে রাখার চেষ্টা সবাইকে। প্রচারেই ব্যস্ত তাদের বিশাল কর্মীবাহিনী। একটি ইউনিট সোশ্যাল মিডিয়া সংক্রান্ত। সমাজের শ্রেণি ধরে ধরে দলপন্থি প্রচার চালিয়ে যাওয়াই তাদের কাজ। পাশাপাশি চলছে বিভেদ সৃষ্টির মহোৎসব। আর একটি ইউনিট কাজ করছে পরিসংখ্যান নিয়ে। দলের সব ব্যর্থতা অদ্ভুত মুন্সিয়ানায় বদলে দেয়া হচ্ছে সাফল্যে। শুধু তথ্যের ধাপ্পা দিয়ে যা ম্যানেজ করা যাচ্ছে না সেজন্য যুক্তি দাঁড় করাচ্ছে- এটুকু তো মানিয়ে নেয়াই যায়! তাই এ রাজনৈতিক দলটি ব্যস্ত, প্রচণ্ড ব্যস্ত। দেশবাসী বা ভোটারের জন্য নিরন্তর কাজ করার মতো সময় তাদের নেই। মানুষ কীভাবে চাল-ডাল কিনছে, মাসের শেষে কত হাতে নিয়ে বাড়ি ফিরছে- এসব ভাবতে তাদের বয়েই গেল! ইউনিটগুলোকে কঠোর নির্দেশ- নিজেদের কাজ করো। মন দিয়ে কাজ করো। প্যাকেজ বানাও। ক্ষমতার নয়া ব্যান্ডের প্রচার করো। লাগাতার করে যাও। এটাই তো আজকের এক্সক্লুসিভ রাজনীতির চিত্র, অপরিণতমনস্ক রাজনীতির দিশাহীনতা। এরই মোকাবিলা করতে হবে ইনক্লুসিভ রাজনীতি দিয়ে।

সুধীর সাহা : কলাম লেখক। [email protected]

সাবস্ক্রাইব ও অনুসরণ করুন

সম্পাদক : শ্যামল দত্ত

প্রকাশক : সাবের হোসেন চৌধুরী

অনুসরণ করুন

BK Family App