×

মুক্তচিন্তা

‘আওয়ামী লীগ দেশের মানচিত্র খেয়ে ফেলছে’ : বিএনপি কি নতুন মানচিত্র উপহার দেবে?

Icon

অনলাইন ডেস্ক

প্রকাশ: ২১ মার্চ ২০২৩, ১২:১৬ এএম

‘আওয়ামী লীগ দেশের মানচিত্র খেয়ে ফেলছে’ : বিএনপি কি নতুন মানচিত্র উপহার দেবে?

গত ১৮ মার্চ বিএনপির নেতৃত্বাধীন সরকারবিরোধী জোটগুলো ঢাকাসহ ১২টি মহানগরে সরকারের দুর্নীতির বিরুদ্ধে সমাবেশ ও মিছিল করেছে। গত আগস্ট মাস থেকে শুরু হওয়া সরকারবিরোধী আন্দোলনের কর্মসূচি হিসেবে পদযাত্রা, সমাবেশ, মিছিল এখনো অব্যাহত আছে। আগামীতে আরো জোরে এসব কর্মসূচি সরকারের বিরুদ্ধে দেয়া হবে বলে বিএনপি এবং এর সঙ্গে যুক্ত থাকা কয়েকটি রাজনৈতিক দলের নেতারা স¤প্রতি দাবি করেছেন। দেশবাসী তাদের আন্দোলন হলে অবশ্যই দেখতে পাবে। তবে আন্দোলনের কর্মসূচিগুলোতে আগের মতো নেতাকর্মীদের যে খুব উপস্থিতি ঘটছে, তেমনটি আর দেখা যাচ্ছে না। কিন্তু নেতারা প্রতিটি কর্মসূচিতে অংশ নিয়ে যেসব বক্তব্য প্রদান করেন, সেগুলো কখনো রাজনৈতিক বিনোদনের বেশি কিছু উপহার হিসেবে পাওয়া যায় না। গত ১৮ মার্চের সমাবেশে বিএনপির মহাসচিবের কিছু বক্তব্য ইলেকট্রনিক মিডিয়ার কল্যাণে শ্রোতা দর্শকদের কানে লেগেছে। মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর ‘সুবক্তা’ এতে কোনো সন্দেহ নেই। তিনি দর্শক শ্রোতাদের আনন্দ দেয়ার জন্য কথা বলেন নাকি চিন্তার খোরাক হিসেবে দেন- সেই প্রশ্ন করাই যেতে পারে। তিনি খুব সুচতুর ভাষায় অনেক কথাই বলেন। সব শ্রোতারা যে বোকা নন, যুক্তিহীনও নন, তার কথায় গদগদ বিশ্বাস করেন তাও নন- সেই বিবেচনাটি তিনি হয়তো রাখতে চান না। তিনি যে রাজনীতি ও দল করেন। সে রাজনীতি ও দলের আদর্শ, অতীত ইতিহাস এবং নেতৃত্বের ঐতিহ্যের সর্বশেষ প্রবক্তা এখন তিনি। তিনি অনেকের কাছেই এখন বিএনপির দুঃসময়ের কাণ্ডারি। যেহেতু দলের চেয়ারপারসন অসুস্থ, বয়োবৃদ্ধ এবং বিচারিক আদালতে দণ্ডপ্রাপ্ত, তাই দলের হাল ধরার অবস্থানে তিনি নেই। দলের ভারপ্রাপ্ত চেয়ারপারসন তারেক রহমান সুদূর লন্ডনে বসে ভার্চুয়ালি দল চালাচ্ছেন। তাই দলের মূল নেতৃত্বের অনুপস্থিতিতে মির্জা ফখরুলই এখন দল এবং আন্দোলন ঘোছাতে মাঠে সক্রিয় আছেন। এককালে উগ্রবাম ছাত্ররাজনীতি করেছেন বলে অনেকেই বলে থাকেন। পরবর্তী সময়ে কলেজে শিক্ষকতা করেছেন। ফলে রাজনীতির বিদ্যাবুদ্ধি তার রয়েছে এতে কোনো সন্দেহ নেই। কিন্তু বিদ্যাবুদ্ধি তো অনেকেরই থাকে, সেটির প্রয়োগ কে কোন পাত্রে কীভাবে করছেন, সেটি মৌলিক প্রশ্ন। রাজনীতিতেও তাই। মির্জা ফখরুল বিএনপির দুঃসময়ের কাণ্ডারি হওয়ায় এখন অনেকেই তাকে দল থেকে ভবিষ্যৎ প্রধানমন্ত্রী হিসেবে মনোনীত করারও প্রস্তাব করছেন। সেই প্রস্তাব বিএনপি রাখবে কি রাখবে না সেটি তাদের দলীয় ব্যাপার। কিন্তু মির্জা ফখরুল এখন যেসব কথা বলছেন, সেগুলো শুনে ‘ভবিষ্যৎ প্রধানমন্ত্রীর’ যে ধারণা পাওয়া যাচ্ছে তাতে কেউ কেউ পুলকিত হতে পারেন। কেউ কেউ দ্বিধাগ্রস্ত হতে পারেন। এটি অবশ্য যার যার বুঝ মতো নিশ্চয়ই হবে। তার অনেক কথা নিয়েই ভাবতে বসলে বিএনপির নেতৃত্ব সম্পর্কে একটি ধারণা রাজনৈতিকভাবে পাওয়া যায়। ১৮ মার্চের বক্তৃতায় তিনি বলেছেন, ‘আওয়ামী লীগ দেশের সব খেয়ে ফেলেছে, এখন বাংলাদেশের মানচিত্রটাও খেয়ে ফেলতে বসেছে।’ দল হিসেবে আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীদের অনেক সমালোচনা করার রয়েছে। অনেক ক্ষেত্রেই তারা সফল হতে পারেনি। অনেক নেতাকর্মী দুর্নীতির সঙ্গে জড়িত আছেন, পত্রপত্রিকায় এ নিয়ে বিস্তর অভিযোগও আছে। কিন্তু আওয়ামী লীগের এই ১৪ বছরের শাসনামলে দেশের অর্থনীতি, কৃষি ও গ্রামীণ সমাজ, যোগাযোগব্যবস্থা, বিদ্যুৎ, নানা ধরনের মেগাপ্রকল্প ইত্যাদিতে যেসব অগ্রগতি সাধিত হয়েছে সেগুলোর কল্পনা বিএনপি নেতারা কখনো করেনি, তাই বিশ্বাসও করতে চাচ্ছে না। দুর্নীতি শুধু একা আওয়ামী লীগই করছে তা নয়। বিএনপির শীর্ষ নেতারা তাদের শাসনামলে দুর্নীতি করেননি এমন কোনো সাধুবাদ কেউ বিএনপির পক্ষে দেয়নি। শুধু দলীয় রাজনীতিবিদদের কথাই বলব কেন, দুর্নীতি এই সমাজের রন্ধ্রে রন্ধ্রে বহুকাল আগে থেকেই প্রবেশ করে আসছে। এখন লুম্পেন পুঁজিবাদের মুক্তবাজার অর্থনীতির কল্যাণে যে বিশাল মধ্যবিত্ত, উচ্চবিত্তের সৃষ্টি হয়েছে এমনকি যে নি¤œবিত্তেরও সমাজমানস রয়েছে তাতেও দুর্নীতির সুযোগ হাতছাড়া করার বাস্তবতা খুব ক্ষীণ- এমনটি অস্বীকার করার উপায় নেই। এমন কোনো পেশা এ দেশে রয়েছে কিনা, যেখানে দুর্নীতি পাওয়া যাবে না- সেই প্রশ্নের উত্তর পাওয়া খুবই দুরূহ ব্যাপার হবে। এদেশে রাজনীতিও এখন অনেকের উপার্জনের পেশা হয়ে দাঁড়িয়েছে। তা যদি না হবে, তাহলে তারা কি করে বাড়িগাড়ির মালিক হন, কোটি কোটি টাকা খরচ করে নির্বাচন করেন, দল করেন। একসময় অনেকেই ওকালতি, হোমিও ডাক্তারি, স্কুল মাস্টারি ইত্যাদি করে সংসার চালাতেন এবং বাকি সময়টা রাজনীতিতে দিতেন। এখন ছোট বড় যত দলই করেন না কেন, তাদের তো দেখি অর্থ-বিত্তের অভাব খুব একটা নেই। আমি বলবো না, সবাই দুর্নীতি করেন, তবে যারা ব্যবসাবাণিজ্য, শিল্প কলকারখানা করে যে বিপুল বিত্তের মালিক হচ্ছেন, তারা তা কি খুব সৎভাবে হচ্ছেন? বাংলাদেশে ব্যবসাবাণিজ্য, হাটবাজার, সুপারমার্কেট, ট্রেড লাইসেন্স, নানা ধরনের স্থাপনা ইত্যাদির ভেতরে এখন টাকার লেনদেন কীভাবে হয়, তা কি আমরা কিছুই জানি না? এক বছর আগে করোনার দোহাই, গত এক বছর ধরে ইউক্রেন যুদ্ধ এবং ডলার সংকটের অজুহাত দেখিয়ে বড়, ছোট, মাঝারি ব্যবসায়ী- মধ্যস্তত্বভোগীরা কীভাবে মানুষের পকেট খালি করছে, তাতো সবাই দেখছেন। এসব ব্যবসা-বাণিজ্য ইত্যাদির সঙ্গে যারা জড়িত, তারা কোনো না কোনো দল করেন বা সমর্থন করেন। অবৈধ উপায়ে প্রচুর অর্থ-বিত্তের মালিক তারা হয়ে আসছেন, এখন হচ্ছেনও। সুতরাং দুর্নীতি শুধু এককভাবে আওয়ামী লীগের ব্যবসায়ীরা করছেন, বিএনপি, জামায়াত ও অন্যান্য দলের নেতাকর্মী ও সমর্থক ব্যবসায়ীরা করছেন না- এমনটি দাবি করার মতো তেমন ভিত্তি আছে কি? সুতরাং দুর্নীতির বিরুদ্ধে সভা-সমাবেশে দাঁড়িয়ে যখন কেবল আওয়ামী লীগের দিকেই অভিযোগগুলো করা হয়, তখন নেতারা নিজের দলের নেতাকর্মীদের কি আড়াল করছেন না? ক্ষমতায় গেলে কি সম্মুখে থাকা নেতাকর্মীদের সবাই কেবল দেশ দরদি হয়ে দেশ সেবা করবে? অতীত অভিজ্ঞতা তো তা বলে না, দলের চরিত্রও তো তা বলে না। অথচ প্রকৃত রাজনীতিবিদ কোনো সার্বজনীন সমস্যাকে কখনো অস্বীকার করে অন্যের ঘাড়ে তুলে দেন না। বঙ্গবন্ধুর কথাই ধরুন। বঙ্গবন্ধু দুর্নীতির বিরুদ্ধে কথা বলতে গিয়ে অন্য কোনো রাজনৈতিক দলের নাম উচ্চারণ করেছেন বলে শুনিনি। তিনি জাতীয় এই সমস্যাটি সামাজিকভাবে তৈরি হওয়া এবং উত্তরাধিকারসূত্রে পাওয়ার কথা বলার সঙ্গে সঙ্গে এর বিরুদ্ধে তার অবস্থানের কথা যেমন স্পষ্ট করতেন, সংগ্রাম অভিযানেরও বেশকিছু উদ্যোগ তিনি নিয়েছিলেন। বর্তমান প্রধানমন্ত্রী বঙ্গবন্ধুকন্যা শেখ হাসিনা টানা ১৪ বছর ক্ষমতায় আছেন। কিন্তু তার বিরুদ্ধে দুর্নীতির কোনো অভিযোগ এখনো কেউ তথ্যপ্রমাণসহ তুলে ধরতে পারেননি। দলের নেতাকর্মীদের দুর্নীতি সম্পর্কে তিনি অবহিত এবং মাঝেমধ্যে অভিযানও পরিচালনা করে থাকেন। আমরা হয়তো তার কাছ থেকে আরো বেশি দৃঢ় অবস্থান আশা করি। কিন্তু জটিল এই সমস্যাটি একজন বা কতিপয়ের ওপর নির্ভর করবে না। কিন্তু দুর্নীতির বিরুদ্ধে সমাজ, রাষ্ট্র, রাজনীতি, শিক্ষা, সংস্কৃতি, প্রশাসন ও বিভিন্ন শ্রেণিপেশার ভেতরে আইন ও সচেতনতার সম্মিলন না ঘটাতে পারলে কোনোদিনই এর উৎপাটন কিংবা এর থেকে উত্তরণ সম্ভব হবে না। এখন দুর্নীতি নিয়ে যেসব পাল্টাপাল্টি অভিযোগ চলে তাতে ‘নিজেকে সাধু, অন্যকে চোর’ সাজানোর ভয়ংকর অপচেষ্টাই কেবল দেখা যাচ্ছে। মির্জা ফখরুল সাহেব দুর্নীতির বিরুদ্ধে কথা বলতে গিয়ে আওয়ামী লীগকে দেশের মানচিত্র খেয়ে ফেলার যে অভিযোগ করেছেন তার অর্থ কি বোঝাচ্ছে তিনিই ভালো বলতে পারবেন। বাংলাদেশের মানচিত্র দুর্নীতি করে একটি দল খেয়ে ফেলছে আর সবাই কি চেয়ে চেয়ে দেখছে সেটিই তো প্রশ্ন। আওয়ামী লীগের আমলে দুর্নীতি প্রত্যাশিত মানে কমেনি, কোথাও কোথাও বেড়েছে- এমনটি কেউ অস্বীকার করবে না। কিন্তু মানচিত্র খেয়ে ফেলার মতো দুর্নীতি হলে এ দেশে ১৬ কোটি মানুষ গত ১৪ বছর কোনো মঙ্গা কেন দেখছে না, পেটপুরে ভাত খাচ্ছে কীভাবে, কাপড় পরছে কীভাবে, আশ্রয়হীনরা আশ্রয় পাচ্ছে কীভাবে, দারিদ্র্যবিমোচন কর্মসূচিতে বছরে বাজেটের সাড়ে ১৬ শতাংশ ব্যয় করছে কীভাবে, গ্রামীণ অর্থনীতি গত ১৪ বছরে আমূল পালটে গেছে কীভাবে, হতদরিদ্র, বিধবা এবং বয়স্করা সরকারি অনুদান পাচ্ছে কোন কোষাগার থেকে, পদ্মা সেতু, মেট্রোরেল, শত শত ব্রিজ, কালভার্ট হয়েছে কীভাবে, কর্ণফুলী টানেল, রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্র, ২৪ হাজার মেগাওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদনের সক্ষমতাসহ বড় বড় মেগাপ্রকল্প হচ্ছে কীভাবে, নতুন একটি সমুদ্রবন্দর হয়েছে কীভাবে, ডিপ সি সমুদ্রবন্দর হচ্ছে কীভাবে, দেশের আনাচে-কানাচে রাস্তাঘাট হলো কীভাবে, মাথাপিছু আয় প্রায় ৫ গুণ বাড়ল কীভাবে, আন্তর্জাতিকভাবে বাংলাদেশ সবার দৃষ্টি কেড়ে নিল কীভাবে, বাংলাদেশের পোশাক শিল্পসহ অন্যান্য শিল্প খাত এত স্বল্প সময়ের মধ্যে ঘুরে দাঁড়াল কীভাবে- এসব হাজারো প্রশ্নের উত্তর কি দেশের অর্থনীতি ফোকলা করে ফেললে বা মানচিত্র খেয়ে ফেললে দেয়া যেত? বাংলাদেশ করোনার সংকট মোকাবিলা করেছে, বিনা পয়সায় টিকা দিয়েছে, দেশে চিকিৎসা ব্যবস্থায় বিপুল সংখ্যক চিকিৎসক, নার্স, চিকিৎসা বিশ্ববিদ্যালয়, চিকিৎসা মহাবিদ্যালয়, গ্রামীণ কমিউনিটি ক্লিনিকসহ নানা ধরনের প্রতিষ্ঠান গড়ে তোলা হলো কীভাবে, এত নতুন বিশ্ববিদ্যালয়, স্কুল-কলেজ এবং নতুন শিক্ষাব্যবস্থার আয়োজন হচ্ছে কীভাবে? নিশ্চয়ই সরকারের অর্থনৈতিক পরিকল্পনা এবং মিশনারি ভিশনারি নেতৃত্ব ছিল। সে কারণেই দুর্যোগ, দুর্নীতি, অপচয়, অব্যবস্থাপনার পরও বাংলাদেশ গত ১৪ বছরে অর্থনৈতিকভাবে যে বিরাট অগ্রগতি সাধন করেছে তার একটি বড় অর্জন দৃশ্যমান হচ্ছে। যদি দুর্নীতি, অপচয় ইত্যাদিকে অনেকটাই রোধ করা যেত, তাহলে উন্নতির চিত্রটা আরো বেশি দেখা যেত। কিন্তু মির্জা ফখরুল সাহেব যেভাবে আওয়ামী লীগের শাসনামলে বাংলাদেশের মানচিত্র খেয়ে ফেলার ভয়ংকর অভিযোগ তুলছেন, তাতে প্রশ্ন জাগে মানচিত্রহীন এই জাতির জন্য তিনি এবং তার দল কোথায় আবাসভূমি তৈরি করবেন? সেই প্রশ্নের কি কোনো গ্রহণযোগ্য উত্তর তিনি দিতে পারবেন, নাকি এসব মুখরোচক রাজনৈতিক বুলি তিনি আওড়িয়েই যাবেন? ইতিহাসের পাতায় বিএনপির শাসনামল আর রাজনৈতিক দর্শনের পৃষ্ঠায় সাম্প্রদায়িক এবং ডানপন্থার রাজনীতির ঐতিহাসিক অবস্থানের পাঠটি তিনি ভালো করে পড়লে হয়তো বুঝতে পারবেন পাকিস্তানের কেবলই পশ্চাৎপসারণের ইতিহাস এর এটি একটি সহজপাঠ তার জন্য হতে পারে।

মমতাজউদ্দীন পাটোয়ারী : অধ্যাপক (অবসরপ্রাপ্ত), ইতিহাসবিদ ও কলাম লেখক। [email protected]

সাবস্ক্রাইব ও অনুসরণ করুন

সম্পাদক : শ্যামল দত্ত

প্রকাশক : সাবের হোসেন চৌধুরী

অনুসরণ করুন

BK Family App